গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১২

৪১তম সংখ্যা ১৭ই ডিসেম্বর ২০১২ ৫টি গল্প মৌ দাশগুপ্তা, ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়, সূর্য ভট্টাচার্য, অনুপ দত্ত ও সংহতি মজুমদার

বন্ধুত্ব

মৌ দাশগুপ্তা

রুমি আমার একদম ছোটবেলার বন্ধু। আমরা থাকতাম শ্রীভূমি কমপ্লেক্স নামের বহুতল আবাসের চারতলার দক্ষিণমুখী ফ্ল্যাটটায়। ওদের পরিবার আমাদের বাড়ির ঠিক উপর তলার ভাড়টে হয়েছিলো আজ থেকে প্রায় বছর আঠারো আগে। আমি তখন বোধহয় সবে ক্লাস ওয়ান। ঠিকমত মনেও নেই। সত্যি বলতে কি, ঐ সময়ের অনেক ঘটনাই মায়ের মুখে শুনেশুনেই আমার স্মৃতিতে ছাপা রয়েছে বলেই আমার ধারণা।

         তখন রুমির বয়স আমার মতই হবে, ঐ পাঁচ কি ছয়। ওর ছোট্ট ভাইটা তখন ওর মায়ের কোলে। আমরা এবং আমাদের মায়েরাও সমবয়সী থাকায় দুই পরিবারে ভাব জমতে দেরী হয়নি। আমরা দুই বোন ওদের দুই ভাইবোনের সাথে খেলাধুলা করেই বড় হয়েছি। ছোটবেলা রুমির পাকা পাকা কথা শুনে সবার কান ঝালাপালা হত। তুলনায় স্বভাবে বিচ্ছু আর মারকুটে টাইপের হলেও আমি কিন্তু মুখচোরা ছিলাম। তবু আমাদের বন্ধুত্বে কোন খামতি ছিলনা। কি দিনই না গেছে! যখন রুমি ছাড়া সুমির একটা দিনও কাটতে চাইত না। জোড়া মানিকের মত থাকতাম আমরা সবসময়। স্কুল জীবন থেকে শুরু করে গোটা কলেজের সময়টা আমরা একসাথে কাটিয়েছি। একজনের জন্য আরেকজন ছিল প্রাণান্ত। আর আজ চোখের দেখাটাও হয়না ঠিকমত। জীবনের একেকটা অধ্যায়ে জীবনটা কাটতে থাকে বিনি সুতোয় গাঁথা মালার মত একটা সরলরৈখিক ছন্দে। একটু  বেশিরকম সরলরৈখিক বলেই হয়ত ভাবতাম আমাদের ভাবটা চিরকালই বুঝি একরকম থাকবে। যেমন বিখ্যাত দার্শনিক থেলিস বলেছিলেন ‘জগতের সমস্ত কিছুই সৃষ্টি হয়েছে জল থেকে’! অথচ জীবনটা জলবৎ তরলং তো নয় সব তো ঠিকমতই চলছিল। আমাদের জীবনে প্রেমের বার্তা নিয়ে কোনো পুরুষ আসলেও আমি কখনো সেই ডাকে সাড়া দিইনি। অবশ্য সাড়া দেবার কথাও নয়।

         আমার বাবার স্বপ্ন ছিল আমি অনেক দূর অবধি পড়াশোনা করবো। লম্বা লেজের মত ডিগ্রী থাকবে আমার নামের পাশে। বাবার অকালমৃত্যু আমার মনে একটা জেদ ঢুকিয়ে দিয়েছিল যে আমায় অনেক অনেক দূর অবধি পড়াশোনা করতেই হবে। এভাবেই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজ জীবনে প্রবেশ করলাম। আমি পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী এবং পরপর  পরীক্ষাতে রেজাল্ট ভালো করাতে সবাই ভাবত পড়াশোনাতেই সুমির মন। কিন্তু রুমি ছিল স্বভাবপ্রেমিক একদম আমার উল্টো। আমাদের সহজাত বন্ধুত্বের অন্যতম কারণই ছিল সম্পর্কের স্বচ্ছ্বতা আর স্বতঃস্ফূর্ততা। আমরা দুজন দুজনের কাছে কিছুই গোপন করতাম না কবে কোন ছেলেটা  দুকলি গান  গেয়েছে ওকে দেখে, কবে কে ওকে চোখ টিপেছে, কোন সিনেমার নয়িকার হাসি একদম ওর মত, কোন ফুচকাওয়লা বেস্ট ফুচকা রাখে, কোন বিয়েবাড়িতে পাড়ার কে কি আদিখ্যেতা দেখিয়েছে, টিভিতে  বিজ্ঞাপিত কোন জিনিসটা গুনমানে সেরা, কোন মেয়ে ওকে হিংসা করে ওর নামে অন্যদের কাছে মিথ্যে  বলে চুকলি কাটে, এইরকম অপ্রাসঙ্গিক এবং পারস্পরিক সম্পর্কহীন কথা নিয়ে একটানা কলকলিয়ে যেত রুমি। আমি কিছু শুনতাম, জানতাম, বুঝতাম কিন্তু অধিকাংশই একান দিয়ে ঢুকিয়ে ওকান দিয়ে বার করে দিতাম। তাতে ওর খুব একটা অসুবিধা যে হত তা নয়। তবে হঠাৎ করে গলা নামিয়ে চোখ টিপে অদ্ভুত ভ্রূভঙ্গী করে কে কার হাত দিয়ে ওকে প্রেমপত্র পাঠিয়েছে বলা শুরু করলেই প্রমাদ গুনতাম। এই একটা ব্যাপারে রুমি আমায় বড় অসুবিধায় ফেলে দিত। সুন্দর মুখের সুন্দরী আমার বান্ধবীটি প্রেমরোগের রুগী  ছিল। ছেলেদের কাছ থেকে মিষ্টি কথা শুনতে, স্তাবকতা পেতে বড় ভালবাসতো। যে  কারণে স্কুলের অনেক মেয়েই রাগ বা হিংসা করে ওকে এড়িয়ে চলতো। বলতো ও নাকি ছেলেদের নাচিয়ে বেড়ায়। মিথ্যে বলবো না, আমাদের অনেক ক্লাসমেটের বয়ফ্রেন্ডকেই
দেখেছি কিছুদিন পর নিজের বান্ধবীর বদলে রুমির প্রতি বেশী আকর্ষিত হয়ে
পড়ত। রুমি কদিন খুব মাতামাতি করত, তারপরেই নতুন বন্ধু জুটিয়ে আগের জনকে অনায়াসে টা টা বাই বাই করে দিত। আমার বন্ধু হলেও জানতাম অনেকেই আড়ালে ওকে ব্যঙ্গ করে ‘ছেলেধরা’ বলে ডাকতো। এইসব কারণে রুমির এই গায়ে পড়া প্রেমরোগী স্বভাবটা আমার পছন্দ না হলেও, রুমি মোটেও গ্রাহ্য করতো না।

          রুমি খুব ভালোবাসতো লম্বা লম্বা প্রেমপত্র পেতে। সেগুলো বারবার পড়ত, জমিয়ে রাখতো পরম মমতায়। মন খারাপে, অসুস্থতায়, একা থাকলে, এমনকি গরমের লম্বা ছুটিতেও আমি বাদে ওরাই ছিল ওর সত্যিকারের সঙ্গী। কিন্তু নিজে লিখতে পারতো না। এই একটা কাজ ওর হয়ে আমিই করে দিতাম। বইপড়া বিদ্যে উজাড় করে, কবিতার টুকরো জুড়ে,  হিন্দী গানের কলি সাজিয়ে বেশ পাঁচমিশেলী টক ঝাল মিষ্টি গোছের লাভলেটার লিখতে মন্দ লাগতো না আমার। বরঞ্চ লেখার সময় পাড়ার হিরো সপ্তর্ষিদার মুখটাই বারবার মনে পড়ত। রুমি সে লাভলেটারটা
যাকেই দিক না কেন, আদতে সেটা থাকত সপ্তর্ষিদাকে লেখা আমার নামহীন
নিরুচ্চরিত প্রেমপত্র। আর এই একটা গোপন কথাটা আমি প্রাণে ধরে রুমিকেও বলে উঠতে পারি নি। ভালো মেয়ে হবার গাঁটগচ্চা আর কি!

আমার পরিবারের কেউই ছেলেদের সাথে হৃদয়ঘটিত ব্যাপার নিয়ে আমাকে সন্দেহের চোখে দেখত না । আমাকে নিয়ে তারা নিশ্চিন্তই ছিল। কিন্তু রুমিকে নিয়ে ওর মা মালা মাসী, এমনকি আমার মায়েরও দুশ্চিন্তার শেষ ছিলো না। এর মধ্যেই বলা নেই, কওয়া নেই, অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পর হঠাৎ করেই রুমি বিয়ে করে ফেললো। আর করবি তো কর, বিয়েটা করলো সেই সপ্তর্ষিদাকেই। আশ্চর্য্য এই যে,যে রুমি আমায় ওর সারাদিনমানের কাহিনী না বললে ঘুমাতে পরতো না, সে এত বড় কথাটা আমার কাছে কেন যে গোপন রাখল ভগবান জানেন!

সপ্তর্ষিদাদের বাড়ি থেকে বিয়েটা স্বভাবতই মেনে নিল না। বরং পরে শুনেছি ছেলের পাত্রী হিসাবে সপ্তর্ষিদাদের বাড়ি থেকে নাকি আমার কথাই ভেবে রাখা হয়েছিল। বিয়ের পরই ওরা পাড়ি জমাল সপ্তর্ষিদার নতুন কর্মক্ষেত্র মুম্বাইয়ে। বিয়ে করে হটাৎই রুমির  এইভাবে পর হয়ে যাওয়া, বা সপ্তর্ষিদার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যাওয়াটা যেন আমার পৃথিবীটাকে টলিয়ে দিলো। যদিও আমার নিশ্চুপ বিমর্ষতাকে লোকে বান্ধবীর বিচ্ছেদে আমার একা হয়ে যাওয়ার দুঃখের কারণ হিসাবেই ধরে নিল। অথচ ব্যাপারটা মোটেও মামুলি ছিল না আমার কাছে শুধু আমিই জানতাম আমার অনুভূতির পারদ কতখানি গভীর। আমার রক্তাক্ত হৃদয়ের গোপন রক্তপাত শুধু আমার ভেতরেই গোপন রইলো। ওদের বিয়ের পর আমি অনেকবেশী চুপচাপ হয়ে গেলাম, আগের চেয়েও আরো বেশী।

রুমিদের অনুপস্থিতিতে আমার মনোযোগ চলে গেলো আরো বেশী পড়াশোনার দিকে। বিয়ের পরে রুমিটা আশ্চর্য্যজনক ভাবে নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল না কোন ফোন, না কোন চিঠি। ওকে চিনি বলেই বুঝতাম কাজটা ওর পক্ষে কতটা অস্বাভাবিক। আর সত্যি বলতে কি আমিও রুমির সাথে ইচ্ছে করেই যোগাযোগ করিনি। হয়তো সপ্তর্ষিদার সাথে ওর বিয়ে হয়ে যাওয়াটা মন থেকে মানতে পারিনি বলেই আমার মাঝে তৈরি হয়েছিল তীব্র এক ধরণের বিদ্বেষ, সেই সাথে অনীহাও, কিন্তু এটাও জানতাম যে, আমার এই অবুঝ অস্থিরতা, অকারণ মনখারাপের অনুভূতিগুলো কখনোই ওদের সুখী বিবাহিত জীবনকে ছুঁতে পারবে না। আর এই ভেবে এক অসহায় অভিমানে একা একাই চোখের জল ফেলতাম। আপন মনে ভাবতাম, রুমিও বুঝি কষ্টেই আছে আমাকে ছাড়া। ওরা খুব ভালো থাকুক তা চাইলেও, একই সঙ্গে হিংসুটের মত ভাবতাম ওরাও, বিশেষত রুমিও এমন করে কষ্টে থাকুক আমার মত। এরপর আমি মাষ্টার্স ডিগ্রী করার সময়, হস্টেলে চলে যাই।

ফাইনাল পরীক্ষার পর ফিরে এসে শুনি রুমি এসেছে। ও নাকি অসুস্থ। প্রায় আড়াই বছর দেখা হয়নি তাও ভেতর থেকে একটুও গরজ পাচ্ছিলাম না ওর সাথে দেখা করার। তবু না চাইতেও সিঁড়ির মুখে ওর সাথে দেখা হয়ে গেল। জোর করে ও ধরে নিয়ে গেলো ওদের বাড়ি। সেই ভারী পর্দা টানা, হাল্কা এক্রাইলিক পেন্ট লাগানো ঘর, ভারী কাঠের আসবাব। সারা ঘরে অনেকবার দেখা সেই ঝকঝকে বাহারী রঙ্গিন কুশন কভার, টেবিলক্লথ, বিছানার চাদর, দেওয়ালে ঝোলানো দামী পেইন্টিং। একসময় এই ঘরেই কত সকাল দুপুর বিকেল সন্ধ্যা কাটিয়েছি দুজনে। সেই ঘর, সেই পরিচিত পরিবেশ, কিন্তু অনেকদিন পরেও শুধু  ওর উপস্থিতিই আমাকে বেশ অস্বস্তি দিচ্ছিল। ভাবছিলাম না আসলেই হতো। ওর বিউটি পার্লার ফেরত মাথা থেকে পা অবধি প্রসাধনের মোড়কে ঢাকা আপাতসুন্দর চেহারায় অসুখী ছাপ একেবারে স্পষ্ট। দেখে খারাপ লাগলেও ঐ খারাপ লাগাকে পাত্তা দিলাম না। 

 আমার পাল্টে যাওয়া মনোভাব যে বুঝতে পারছেনা সে ওর হাবেভাবেই বোঝা যাচ্ছিল। নিজের মনেই কথা বলে যাচ্ছিল একটানা। ওর নাকি সপ্তর্ষিদাকে বিয়ে
করাটাই জীবনের সবচেয়ে ভুল কাজ হয়েছে, ওর নাকি খালি ঘর সাজানো পুতুলের
মত ঘর সাজানোর সুন্দর বউ চায়। ভালবাসাবাসি জিনিসটাই নাকি ওর আসে না।
নিজে অফিস ট্যুরের নাম করে ফষ্টিনষ্টি করে আসে আর রুমিকে ঘরে বন্ধ করে
রাখে কারও সাথে মিশতে,এমনকি, কথা বলতে অবধি দেয় না। আর এই সব নিয়ে কিছু বলতে গেলেই বলে রুমি নাকি অসুস্থ, সন্দেহবাতিক, রুমির মানসিক
চিকিৎসার দরকার। ওর কাঁপাকাঁপা অভিমানী কণ্ঠস্বর, হঠাৎ হঠাৎ জলভরা আষাঢ়ে
মেঘ হয়ে যাওয়া চোখ দেখেও আমার একটুও সহানুভূতি আসছিল না, উল্টে
ন্যাকামি মনে হচ্ছিল সব কিছু বলতে বলতেই কাঁদুনি ভুলে সাপের মত
হিসহিসিয়ে উঠলো রুমি। ম্যানিকিওর করা লাল নেলপলিশ লাগানো আঙ্গুল আমার
দিকে বাড়িয়ে বললো,

- এই তুই, তোর জন্য আমার সংসারটা ভেসে গেল বেশ ভালো মেয়ে সেজে লোকের সামনে সুনাম কুড়াতি আর তলায় তলায় ঐ লোকটার সঙ্গে প্রেম করে বেড়াতিস আমাকে জানতে অবধি দিস নি, না ? ভেবেছিলি ডুবে ডুবে জল খেলে শিবের বাবাও টের পাবে না। কিন্তু আমিও রিমিতা অধিকারী। আমার কাছ থেকে লুকাতে পারলি ? তোর আছেটা কি? ঐ কাগুজে ডিগ্রী ছাড়া ? রূপ, রঙ, টাকাপয়সা ? পারিস আমার মত কথা বলতে, গান গাইতে, লোকের সাথে ভাব জমাতে ? স্টাইল বুঝিস ? ড্রেসকোড জানিস ? পারিস আমার মত করে মোগলাই, থাই, চাইনীজ আইটেম রাঁধতে ? পারিস ছবির মত করে ঘর গোছাতে ? সেজেগুজে লোকের মন ভোলাতে পারিস ? তবে আমার ঘরের লোকটা তোর জন্য পাগল কেন ? কেন আমার নাম দিয়ে তোর লেখা সেই চিঠিগুলো আমায় ছুঁতে দেয় না ? কেন নিজের কাছে  লুকিয়ে রাখে ? কেন কথায় কথায় তোর সাথে আমার তুলনা করে ? বল কেন ? কি দেখেছে ও তোর মধ্যে, যা আমার মধ্যে নেই ? তোর দিক থেকে ওর নজর সরাতে আমার সব কিছু তো ওকে উজাড় করে দিয়েছিলাম, তাও শরীরটা পেলেও মনটা পেলাম না কেন ? এখান থেকে পালিয়েও তোর ডাইনী নজর এড়াতে পারলাম না কেন ? ও আমায় কোনদিনই ভলোবাসেনি ভালোবেসেছে তোর লেখা চিঠিগুলোকে, তোকে, তোর বাচনভঙ্গী, মিষ্টি মিষ্টি মন ভোলানো কথা আর সেই মিথ্যেকথার মারপ্যাঁচকে। তুই না একটা ডাইনী, বুঝলি, ডাইনী ! কি যাদু জানিস তুই ? আমার বর, বাবা, মা, ভাই, কেউ আমার কথা কানে নেয় না, ভাবে আমি একটা পাগল, কেন তুই আমার এই সর্বনাশটা করলি ? কেন কেন?

ওর অসুস্থ হিসহিসে কণ্ঠ আমার কানে তোলপাড় তুলতে থাকে অবিরত, ও কি করে জানবে এতদিন ধরে আমার বুকের ভেতর তোলপাড় তোলা অহর্নিশি অন্তর্দহনের কথা ? আমার একটুও মায়া-দয়া হচ্ছিলো না রুমির ওপর। বরং শুনতে শুনতে এক অব্যক্ত আনন্দে শিউরে উঠছিল আমার মন কেমন প্রতিশোধ পূরণের তৃপ্তিতে আমার ভেতরটা ভরে উঠছিল। আসলে আমরা কেউ কি জানি একেকটি মানুষ বুকের মাঝে কি বয়ে নিয়ে বেড়ায় ? সত্যি কি জানি আমার মন কি চায়, কেন চায় ? কোন বিষণ্ণতায় ভরা গজলের মাঝে যে শুধু হাহাকারই থাকে না, পেয়েও না পাওয়ার অতৃপ্তিই শুধু থাকে না, তারও ওপরে থাকে মন ভোলানো সুরের ঠিকানা, সে খবর আর কজন রাখে ?


এক টুকরো জীবন

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

এই অঞ্চলটা শহরের পুরোন এলাকা। দু-পাশে ছোট ছোট দোকান, তেমন কিছু বড় বড় আহামরি দোকানপাটও নেই। একদিকে চলে গেছে সবজি বাজারের রাস্তা আর অন্যদিকে, শহরের আরও একটি পথ পুরোন পাড়ার দিকে। বড় বড় দোকান, বাজার এসব পড়ে আরও কিছুটা এগিয়ে। সে সব হল চোখ ধাঁধানো গয়নার দোকান, শাড়ী, জুতো, ফার্নিচারের দোকান। বড় বড় ঘর, তার চকচকে মেঝে, দোকানের দেয়ালে সব কাঁচ লাগানো। আলো পড়লে ঠিকরে ওঠে চারিদিক ওদিকটায় গেলে মনখারাপ হয়ে যায় মন্মথের। কত দিন ধরে তার সাধ অম্নি একটা দোকান দেবার...কিন্তু ওইটুকুই, সাধ্য কোথায় ?

ঘন মেঘ করেছে, কালো হয়ে এসেছে চারিদিক। দুএক ফোঁটা যেন গালেও পড়লো বলে মনে হল। ছাতাটা খুলবে নাকি ! ভাবতে ভাবতেই মন্মথ এসে পড়ল মণিরামের দোকানে। মণিরাম তার মহাজন, আজ কদিনি ধরেই তাগাদা মারছে তাকে। তাগাদা সে মারতেই পারে। পুজোর আগে টাকাপয়সা এমনিতেই পাওনা মণিরামের। সামান্য টুকিটাকি জিনিসের ব্যাবসা মন্মথের, মণিরাম তার যোগানদার। কিন্তু আর সে টানতে পারছে না। কোথা থেকে কি যে হবে ভেবে কুলকিনারা পায় না মন্মথ। মণিরামের কাছে কি একটু ছাড়ান চাইবে--ভাবনাটা মাথায় নিয়েই মণিরামের দোকানে ঢুকে পড়ল মন্মথ।

কাজ মিটিয়ে দোকান থেকে বেরোতেই দেরী হয়ে গেল। আকাশ আরো কালো হয়ে এসেছে। ওপরের দিকে মুখ তুলে চেয়ে দেখল মন্মথ। বেশি দেরী করলে বাস পেতে অসুবিধে হবে। মনটা কিন্তু একটু খারাপ হয়েই ছিল। আজ সুযোগ বুঝে মণিরাম লেকচার দিলো অনেক “তুমি বুড়ো লেকচার দিচ্ছ আমায়, পয়সার বেলা কি ছাড়ান দিলে”-- মনে মনে একটা গালাগাল দিল মন্মথ।

দুএকটা দোকান এগোতে না এগোতেই হুড়মুড় করে বৃষ্টি এসে পড়ল বড় বড় ফোঁটায়। ব্যাগ সামলে, ছাতা খোলার আগেই খানিকটা ভিজে গেল মন্মথ। এদিক ওদিক তাকিয়ে ছোট একচিলতে একটা দোকানে নিজেকে বাঁচাতে ঢুকে পড়ল সে। একের বেশি দুজন দাঁড়ানো যায় না, কিন্তু দোকানটা বেশ সাজানো। ঘাড়-মুখ মুছে দোকানটা দেখতে লাগল সে। সাদা আর কমলা রঙের চৌখুপী করা দেয়াল, গাঢ কমলা রঙ্গের সানমাইকা দেওয়া কাউন্টার। একটি অল্পবয়সী বছর বারো/তেরোর ছেলে কাউন্টারে বসে বসে কাগজে লাল ডটপেন দিয়ে ছবি আঁকছে হিজিবিজি আর মাঝে মাঝে হাতে ধরা একটা রোদ চশমার কাঁচে লাল পেনটা দিয়ে দাগ দিচ্ছে। আরো একটু ভিতরে এসে পকেট থেকে রুমাল বের করে হাতমুখ মুছল মন্মথ। মুখ তুলে তাকাল ছেলেটি,
- কি নেবেন কাকু  
‘কি আছে তোমার দোকানে’ -- এদিক ওদিক দেখতে দেখতে বলল মন্মথ বেশ লাগছে তার দোকানটা। বড় ঝলমলে না হোক, এরকমও যদি একটা দোকান থাকত তার! 
‘সায়া, ব্লাউজ, বাচ্চাদের জামা, শাড়ীর ফলস, আরো কত কি আছে, কি নেবেন আপনি’- কাউন্টারের ওপর ঝুঁকে লাল পেন ঠুকতে ঠুকতে বলে ছেলেটি
‘আচ্ছা দেখি, রুমাল আছে তোমার কাছে’ - হাতের নোংরা, ভেজা রুমালটা পকেটে পুরে নিজেকে সামলে নিয়ে বললে মন্মথ। 
‘দাঁড়ান, গোডাউন থেকে নিয়ে আসি’ - বলেই কাউন্টার ডিঙ্গিয়ে লাফ দেয় ছেলেটি  
‘সে আবার কতদুরে, দেরী হবে না তো’ ? - বাইরে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে মন্মথ ততক্ষণে দোকানের বাইরে চলে গেছে ছেলেটি

এবার ভালো করে দোকানের ভেতরে আগ্রহ ভরে দেখতে লাগল সে দেয়ালের গায়ে কাঁচ আঁটা শো-কেস। তার ভেতরে নানারকম ডিজাইনের বাচ্চাদের জামাকাপড় একদিকে মেয়েদের কিছু একরঙা ব্লাউজ থেকে হালফ্যাশানের জরিওয়ালা ব্লাউজ আটকানো আছে। সামনের দিকে তাকের ওপর ভর্তি করা আছে সায়া, ব্লাউজ, বাচ্চাদের আরো কিছু জামাকাপড়। পাশের ছোট ছোট তাকে আরো কিছু টুকিটাকি জমা করা হটাৎ চোখে পড়ে ক্যাশ বাক্সের দিকে খোলা, না বন্ধ ! আচ্ছা ছেলে তো, তাকে একা বসিয়ে রেখে চলে গেল দোকানের বাইরে ! ভাবতে ভাবতেই  আবার লাফিয়ে কাউন্টার ডিঙ্গিয়ে এল ছেলেটি, হাতের মুঠোয় দুটো রুমালের প্যাকেট
‘এই নিন কাকু, দেখুনবলে সে প্যাকেটের গিঁট খোলে। 
‘এত দেরী করলি, দুটো রুমালের প্যাকেট খুঁজতে এত দেরী! কোথায় তোদের গো-ডাউন’ - বলে উঠল মন্মথ   মুখ নীচু করে রুমালের গিঁট খুলতে খুলতে উত্তর দিল ছেলেটি ‘কাছেই, নীচের দিকে ছিল, খুঁজে পেতে দেরী হল...-দেখে নিনি কাকু, অন্য দোকান থেকে সস্তায় পাবেন এখানে’ - ছেলেটির কথায় কান না দিয়ে বাইরে বৃষ্টি দেখল মন্মথ বাইরে তখনও অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। 
- ‘এই, তুই এমনি বাইরের লোককে দোকানে বসিয়ে রেখে চলে যাস কেন রে, যদি কেউ কিছু নিয়ে যায়’ ? --কখন যে বাচ্চা ছেলেটিকে নিজের অজ্ঞাতসারে সে তুই বলেছে মন্মথ জানে না।
‘কি হবে, সামনে তো কত লোক আছে, তুমি চুরি করবে নাকি, তুমি তো ভাল লোক’ -- হাসে ছেলেটি সেও নেমে আসে অন্তরঙ্গতায়।‘কি করে জানলি আমি ভালো লোক ? ক্যাশবাক্স খুলে রাখিস কেন’ এবার হাসে ছেলেটি, খিলখিল করে হাসল সে...মন্মথ তাকিয়ে দেখছিল ছেলেটিকে।
‘এটা তো তালা দেওয়া’...
-চাবি কিন্তু ঝোলানো আছে -- হাত দিয়ে দেখায় মন্মথ।
‘ধ্যাত, ওটা তো অন্য চাবি, ওখানে ঝুলিয়ে রেখেছি’ - ভুরু নাচিয়ে বলে ছেলেটি। মনে মনে ছেলেটির বুদ্ধির তারিফ করে মন্মথ
‘কি নাম তোর’ -- একটা রুমাল দেখতে দেখতে শুধোয় ছেলেটিকে।
‘বাবলু...না সুমিত’
‘সুমিত কি ? তোদের পদবী কি’ – মন্মথ প্রশ্ন করে আবার।
‘ঘর... 
‘ঘর ! ঘর নামে কোন পদবী আছে নাকি, জানা ছিল না তো’! ‘
‘কোন ক্লাসে পড়িস’ ? এবারে একগাল হাসি ছেলেটির...
‘পড়িই ...না’
‘তুই পড়াশোনা করিস না, এইটুকু বাচ্চা ছেলে, পড়িস না কি রে, তোর বাবা-মা বকে না ?
‘না, বকে না আমার পড়তে ভালই লাগে না’...
‘তুই পড়াশোনা করিস না, স্কুলে যাস না’!...বিস্মিত হয় মন্মথ।
‘না, নাইন পর্যন্ত পড়ে ছেড়ে দিয়েছি’
‘নাইন পর্যন্ত পড়েছিস’...এবার ভাল করে লক্ষ্য করে ছেলেটিকে ওইটুকু ছেলে, বলে কিনা নাইনি অব্দি পড়েছে !
‘এই, কত বয়স তোর’ ? হা হা করে হাসে ছেলেটি
‘কত বলতো ?...আমার বয়স ষোল।
‘সে কি রে! আমি ভেবেছি বার...ছেলেটির সঙ্গে যেন খেলায় মেতেছে মন্মথ। রুমাল দেখার চেয়ে ছেলেটিকেই তার বেশি ভাল লাগছিল। 
‘পড়লি না কেন’- আবার জিজ্ঞেস করল সে। এবার ছেলেটি একটু গম্ভীর হয়ে বলল... ‘কি করব, আমার যে পড়তে ভালই লাগতো না, তাহলে পড়ব কেন’?
‘পড়তে ভাল লাগত না, তাহলে কি ভাল লাগত ?
‘দোকান করতে...কত লোক, রোজ রোজ নতুন মাল, কত রকমের জিনিস, কত রকমের লোক আসে দোকানে, আমার এইসব ভাল লাগত...আমার না দোকান করতে খুব ভাল লাগে, তাই তো পড়তে ভাল লাগত না’....একটু ছটপট করে শরীর দোলায় সে।
‘বিক্রি করতে পারিস, কি রকম বিক্রি হয় তোর দোকানে? আর কে কে আছে তোর, বাবা, দাদা ...নেই?
‘আর কেউ না, এই দোকানটা আমার, আমি একা চালাই একটা ছেলে আছে, এখন খেতে গেছে বাবা আর দাদা অন্য একটা দোকান আছে, সেটা চালায়। সেটা ষ্টেশনারী দোকান’
‘তুই নিজে নিজে দোকানটা করেছিস ?
‘না, আগে অন্য একটা দোকান ছিল, বাবা চালাতে পারেনি, দু-বছর দোকানটা বন্ধ ছিল ছমাস হল এই দোকানটা আমি খুলেছি, এটা এখন আমার দোকান’- ছেলেটার চোখেমুখে যেন গর্বের আভাস !
‘দোকান বন্ধ হলে তোদের অসুবিধে হয়নি’ ? যেন সব কিছু জেনে নিতে চায় মন্মথ একটু অস্বস্তি হল, কিন্তু বলে ফেলল।
‘কেন হবে না ? জান... তখন মাথায় করে লোকের দোকানে দোকানে মাল দিয়েছি, তাও পড়াশোনা করতে ভাল লাগত না’  
‘তোর তাহলে কি কঠিন লাগত, অঙ্ক না ইংরাজী ?
‘আমার ঘরের মধ্যে বসে থাকতেই ভাল লাগত না, দুর...বাইরের কিছু দেখা যায় না’...অস্থির হল এবার ছেলেটি
‘তুমি নেবে না, রুমাল ?
‘দে, ওই সাদা রুমালটা দে’, বলে মন্মথ।
‘দাও, এগারো টাকা বাইরের বাজারে এগুলো একুশ টাকা
‘ভাগ, আমাকে কি বোকা পেয়েছিস ? এই, তোরা সামনের বাচ্চাদের এই জামাগুলো কত করে বিক্রি করিস রে... হাত দেখিয়ে শো-কেসে ঝোলানো হলুদ আর নীলের ডোরাকাটা জামা একটা দেখিয়ে বলল মন্মথ
‘একশ কুড়ি’...
‘আর কিনিস কত দিয়ে...ইচ্ছে না হলে না বলিস’...
‘মহাজনরা দেয় ষাট টাকায়, বেচি একশ কুড়িতে...
‘তুই তো দারুণ ব্যাবসাদার, ষাটটাকার জিনস বেচিস ডবল দামে’ ! হাসে ছেলেটি, যেন সেও মজা পেয়েছে।
‘লেখা থাকে আরো বেশি আমি দিই ষাট টাকায়, কাস্টমার খুশি হয় বাকিটা ছেড়ে দিলে’ - হা হা করে হাসে ছেলেটি।
‘ভাল লাগে এইসব করতে’ ?
‘হ্যাঁ’ - লম্বা করে ঘাড় নাড়ে বাবলু, না সুমিত নামের ছেলেটি কৌতুক অনুভব করে মন্মথ একটু কিছু খাওয়াতে পারলে বেশ হত ছেলেটিকে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলে... ‘চা খাবি’ ?
‘না, আমি এখন খাবো না, ভাত খেয়ে এসেছি, আমার এখন অনেক কাজ আছে, তুমি খাও’
‘তবে থাক...বলে মন্মথ

এইটুকু একটা ছেলে , কি দৃঢভাবে বেছে নিয়েছে তা্র পেশা, উপভোগ করছে তার জীবনের আনন্দ পারবে, ঠিক পারবে একদিন বড় হতে মন্মথ পারেনি পছন্দমত জীবন তার হল কই ! আবার বাইরে তাকায় সে। ব্যাগ খুলে টাকা দেয় ছেলেটির হাতে। হাত পেতে টাকা নেয় ছেলেটি। ক্যাশ বাক্স খোলে অন্য একটি চাবি দিয়ে যা সে লুকিয়ে রেখেছিল ছোট্ট একটি গণেশের মুর্তির তলায়
‘আমি কিন্তু তোর চাবির জায়গা দেখে নিলাম’ - রসিকতা করে বলে ছেলেটিকে। -‘নাও না, আজ যা বৃষ্টি, সকাল থেকে বিক্রিই হয়নি, মোটে তিনশ টাকা আছে, দেখবে? হাসতে হাসতে মাথা নাড়ে মন্মথ  

‘আবার একদিন এসে গল্প করব তোর সঙ্গে, আজ যাই। তুই খুব ভাল ছেলে রে’ বেরিয়ে আসে মন্মথ ধরে এসেছে বৃষ্টিটা রোদ উঠেছে চারিদিক আবার ঝলমলে হয়ে উঠেছে আগের মত। একহাতে ছাতা ও আর একহাতে ব্যাগ সামলে বৃষ্টিস্নাত কালো চকচকে পিচরাস্তায় পা রাখে মন্মথ মুখ ফিরিয়ে হাসিমুখ করল দোকানের দিকে তাকিয়ে। মিষ্টি মুখখানিতে একমুখ হাসি নিয়ে হাত নাড়ে বাবলু, না সুমিত, সুমিত ঘর।

চৌমাথার মোড়ে এসে দাঁড়াল একবার মন্মথ। ...বেশ লাগছে তার, মনটা হালকা হয়ে গেছে, মণিরামের দোকানের সেই গুমোট কেটে গেছে। মুখে মৃদু হাসি নিয়ে এগিয়ে চলে সেশহরের ব্যস্ত কোলাহলে নিজেকে সঁপে দেয় মন্মথ।

দৃষ্টিভাগ


অল্পকাল আগে পর্যন্ত নন্দিনীর পৃথিবীটা ছিল অন্ধকার। একটা জমাট বাঁধা কালো অবয়ব, যাকে সে স্পর্শ করতে পারতো না, শুধু শব্দ দিয়ে অনুভব করত। যে তার আলোকিত দুনিয়াটাকে গ্রাস করে নিয়েছিল। স্মলপক্সে বারো বছরের নন্দিনী দৃষ্টি হারিয়েছিল।

জন্ম থেকেই যারা দৃষ্টিহীন, তাদের কষ্ট একরকম। কিন্তু যারা এই পৃথিবীর আলো দেখেছে, তাদের চোখে যখন অন্ধকার নেমে আসে, সে অন্ধকার আরও নির্মম। নন্দিনী তার জগতের রং ও রূপ দেখেছে। যৌবনের ঊষালগ্নে যখন এক অজানা অনুভূতি তার নবোদ্ভিন্ন শরীর ও মনে দোলা লাগিয়েছে, তখনই নেমে আসে সন্ধ্যা। রঙ্গমঞ্চ আলোকিত হবার আগেই যবনিকা পতন। নন্দিনী কেন উন্মাদ হয়ে যায় নি, তা বিধাতাই জানেন।

তারপর আরও দশ বছর কেটেছে। তার জীবনে কৌশিক এসেছে। কৌশিক শিক্ষিত ও সংবেদনশীল। নন্দিনী তাকে দেখে নি। কিন্তু কৌশিকের কথায় সে এক অবলম্বন খুঁজে পেয়েছে। নিশ্ছিদ্র আঁধারে একটা প্রদীপের শিখার মতো। আলোর নিয়মানুসারে তা কোনকিছুতে প্রতিফলিত না হলে সে বস্তু দেখা যায় না। নন্দিনীও কিছু দেখতে পায় নি, কিন্তু আগ্রাসী অন্ধকারে একটি প্রদীপের শিখাও কিছু কম নয়। নন্দিনীকে নিয়ে একসাথে পথ চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কৌশিক। নন্দিনীর অসম্পূর্ণতাকে মেনে নিয়েই সে তাকে গ্রহন করেছে। তার অন্ধত্বে সে ব্যথা পেয়েছে, কিন্তু হাল ছাড়ে নি। ক্রমাগত সে নন্দিনীকে সাহস জুগিয়েছে, সাহচর্য দিয়েছে।

একদিন কৌশিক এসে বলল, নন্দিনী দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবে। কোন একজন রাজী হয়েছে, নন্দিনীকে তার একটি চক্ষু দান করতে। কৌশিক বিশেষজ্ঞের সাথে সব আলোচনা করে জেনেছে, অপারেশন সম্ভব। নন্দিনী সব শুনেও হতাশ গলায় বলে, ‘অন্ধকে মিথ্যে আশা দিও না কৌশিকদা, পাপ হবে কিন্তু’ কৌশিক চুপ করে থাকে।

ডাক্তার তরফদার অসাধারন সার্জেন। নন্দিনীর একটা চোখে অপারেশন করলেন। সফল অপারেশন। নন্দিনীর ডান চোখের কালো পর্দাটা সরে গেছে। এখনও একটু ঝাপ্সা দেখছে বটে, কিন্তু সেই পৃথিবী সেই আলো নন্দিনী আবার দেখতে পাচ্ছে, যা দশ বছর আগে তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছিল। ডাক্তার তরফদার বলেছেন, খুব শিগগিরই তার দৃষ্টি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

কৌশিক মাসখানেক আসে নি, কোথাও গেছে বলে জানিয়েছে। আজ কৌশিক ফিরে আসছে। যার শুধু কণ্ঠস্বর শুনেছে, যাকে শুধু স্পর্শ দিয়ে চিনেছে নন্দিনী, আজ তাকে প্রথম দেখতে পাবে। আজ সে প্রথম দেখবে দেবতা কেমন দেখতে হয়। এক চোখের একমাত্রিক দর্শন। তাও তো দেখতে পাবে।

কৌশিক এলো। নন্দিনী দেখলো লম্বা একহারা একটা চেহারা, ঠোঁটের কোনে লেগে আছে একটা সুখের হাসি। তার চোখে কালো চশমা। যে চোখ দিয়ে নন্দিনী এতদিন জীবনকে অনুভব করছিল, সে চোখদুটো ঢাকা কালো কাচের আড়ালে। নন্দিনী বলল কৌশিককে চশমাটা খুলতে। ‘থাক না নন্দিনী’, কৌশিক বলল, ‘ডাক্তার তরফদার বলেছেন, আরও কিছুদিন চশমাটা ব্যবহার করতে। আমারও যে তোমার মত একটাই চোখ’
- ‘কি বলছ তুমি, তোমারও চোখে অপারেশন হয়েছে’ ! নন্দিনী আতংকে আকুল হয়ে বলে, ‘আমাকে আগে তো কখনো বলো নি’?
- ‘এতদিন বলবার প্রয়োজন হয়নি নন্দিনী...’,কৌশিক শান্তকণ্ঠে বলে, ‘আজ বলছি’

কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা, তারপর কৌশিকই আবার নীরবতা ভাঙ্গে, ‘তোমাকে দু'চোখ ভরে তো দেখা হয়ে গেছে নন্দিনী। এখন থেকে নাহয় এক চোখেই দেখবো।

সেই গানের মানুষটা

অনুপ দত্ত




         তার সাথে পরিচয়ের কথা ঠিক মনে নেই  I  ওর সঙ্গে গানের আসরে যেতাম ৷ মাথার ভেতরে আমার তখন গানের পাগল যেন উলঙ্গ হয়ে নাচে --গাইত সে খুব ভালো I  অবধারিত তার ডাক আসতো  সবার শেষে ৷  আমার লাভ হতো তার ষ্টেজে উঠার গে,মাঝে মাঝে তার সাথে কথা বলা আর অন্যের গান শোনা  I  আমরা দুজনে কথা বলা মানে  গল্প করতাম ৷ তবে গল্প বেশি হতো তার অন্য পরিচিত নামকরা লোকজনের বা তার অনুপ্রানিত সখী  অথবা  সখার এক অভাবনীয় গল্প গাঁথা নিয়ে ৷ বেশির ভাগ সময়ে সে প্রণব সরকার কথা বা মালবিকা খানের গান গাইবার কথা  বলত I   তাদের সঙ্গীত জীবনের সাধনার কথা -- প্রনবদার উদ্দাত্ত কন্ঠে  রবি ঠাকুরের গান বা লুপ্তপ্রায় বাংলা ভজন গাইবার কথা I  কখনো কখনো মালবিকার সুরেলা নজরুলের গান গাইবার কথা বলত I  প্রনবদা তো আর বেচে  নেই.. তবে  তার গান আজও আমার কানে লেগে আছে I  মালবিকার কথা জানিনা

         অনেকদিন...সেই বালুরঘাট ছাড়ার পর থেকে তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই I আমার পাগলপনা গানের  মন ভরে যেত যখন তার সঙ্গ পেতাম,  আর তার গান শুনতে পেতাম একেবারে খালি গলায় আহা ...অমন  উদ্দাত্ত গলা অনেকদিন আমি শুনিনি I  তার সাথে কথা বলে এক অদ্ভুত শূন্যতা   নজরে পড়ত I  সে এত কথা  বলত  আমাকে কিন্তু নিজের বিষয়ে বা নিজের ছেলেবেলার কথা কখনো বলত না I কখনো আমার ক্রমাগত অনুরোধে  --সে  চুপ হেঁসে  অন্য কথায় সুর বদলে দিত I কৌতুহল  হতো আমার I আবার তাকে জোরাজুরি করে দুঃখের ভাগী হতেও মন চাইত না I

        একবার শীত জাঁকিয়ে পড়ার আগে তার সাথে অনেক দূরে অনুষ্ঠান করেতে যাবার সুযোগ হলো। জায়গাটা শিলিগুড়ি I  তখনও বালুরঘাটে ট্রেন আসেনি I হবার কথা চলছিল, তা প্রায় ২৫/৩০ বছর ধরে I রাজনৈতিক মতবিরোধের এক নজির বলাযায় ।  আমাদের জায়গা থেকে শিলিগুড়ি প্রায় ৭/৮ ঘন্টার রাস্তা হবে বাসে   আমি তো  বেশ তৈরী ছিলাম  I এমন সুযোগ কি হাত ছাড়া করা যায়  I  সকালের বাস ,আমাদের পাশা পাশিপাশি  সিট  পড়েছিলো  I  সব ঠিকঠাক চলছিল  খুশির মেজাজে, স্বর্গ যেন একেবারে নিচে নেবে এসেছিল ....গর্বের ভেতরে  সবকিছু নিয়ে একেবারে হাতের মুঠোয় I 

          ঘটনাটা ঘটল একটু অন্য রকম , বাসের ভেতরে এক ১০/১২ বছরের   ছেলের সঙ্গে বাস কন্ডাকটারের অভাবনীয় ব্যবহারে তাকে আমি প্রথম দেখলাম বেশ উত্তেজিত  হতে I  টিকিট  কাটতে পারছিল না বলে কন্ডাক্টার  ছেলেটাকে বেশ জোরে  চড় থাপ্পর মারছিলছেলেটা বার বার বলছিল - “বাবু পয়সা নেই, পয়সা নেই বাবু, খেতে  পাই নি আজ দুদিন, শহরে যাচ্ছি কাজের আশায়...যদি কিছু করে খেতে পাই" দৃশ্যটা এমন কিছু নতুন নয়, এমন ঘটে হামেশাই  I   কিন্তু কেমন যেন অদ্ভুত ছিল I   অবাক হবার পালা আমার,যখন দেখলাম সে উঠে গিয়ে কন্ডাকটারের  কলার  চেপে ধরে দাঁতে দাঁত ঘষে বলছে “ওকে চড় থাপ্পর মারার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে ? আপনার ঘরে কি নিজের ছেলে পুলে নেই ? আপনি কি মানুষ, না কি ? কত ভাড়া হয়েছে আমায় বলুন, আর আমাদের সাথে ওর  একটা টিকিট কেটে দিন শিলিগুড়ি অবধি,  আমাদের সঙ্গে যাবে” I

          পরের  সমস্ত সময় একেবারে চুপচাপ I  আর একটা কথাও হলো না বাস শিলিগুড়ি পৌছনো পর্যন্ত আমি বুঝতে পারছিলাম কোথাও একটা ছন্দ পতন তার মনে , কিন্তু কোথায় ?
         শিলিগুড়ি এসে গেলে, ছেলেটা বাস থেকে নেবে তার পায়ে  হাত দিয়ে প্রণাম করাতে সে তার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ, কোনো কথা তার মুখ থেকে বেরোলো না। এক গভীর দৃষ্টি দিয়ে ছেলেটার মাথায় হাত খালি বুলিয়ে দিলো  I  আমি এত গভীর দৃষ্টি তার চোখে দেখিনি কখনো আগে । সে দেখার   ভেতরে কি এক মায়া, এক আশ্বাস , আর কি এক প্রতিবাদের ছায়া  তার চোখে দেখতে  পেলাম ডাকবাংলোতে  ঠাই হয়েছিল আমাদের I  অনুষ্ঠান ছিল শিলিগুড়ি কলেজের ২৫ বছর পূর্তি রজত  জয়ন্তী  উত্সব পালনের I  যথা সময়ে আমরা কলেজ   অনুষ্ঠানে পৌছে গেলাম যথারীতি আবার সেই অপেক্ষা I  তার নাম বার বার ঘোষক বলে চলেছে ....উনি এস গেছেন আমাদের মাঝে , একটু ধৈর্য ধরুন,নবীনদের হয়ে গেলে উনি স্টেজে আসবেন...একটু সহযোগিতা করুন ইত্যাদি তখন প্রায় রাত দশটা হবে । অত নিয়ম কানুন ছিল না তখনযে রাত দশটা বাজলে মাইকে  বন্ধ  করে  দিতে হবে বা পুলিশের পারমিশন লাগবে I  তার ডাক আসার দেরি দেখে  সাহসে শুধাই  - ‘কি হোল তোমার আজ..কিসের অভাব  মনে হচ্ছে তোমার ? আমার কি কোনো অন্যায় হয়েছে ? এত চুপচাপ কেনো ? কথা বলছ না যে ! আমার দিকে তাকালো সে । সেই দীর্ঘ দীঘল  চোখের চাউনি দেখতে পেলাম I  যেমনটা দেখেছিলাম বাসের ভেতরে, তফাতটা শুধু এখন এক বিন্দু  জল চোখে  I    ভয়  হলো আমার - কোথাও কি আমি আবার আঘাত করলাম তাকে !  হঠাৎ সে আমার হাতটা  চেপে ধরল। দেখলাম তার চোখে  বেশ জল স্টেজের  আলোতে চিক চিক করেছে যেন  I  এবার বেশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি  I  ভেজা চোখ তুলে আমার দিকে চাইল সে – “মানুষ এত  নিষ্ঠুর হয় কেনরে ৷   কেন এই সমতার অভাব ? জানিস,বাসের সেই ছেলেটা আজ আমায় আমার ছোট বেলার কথা মনে  পড়িয়ে দিলো...এক সময় ওই রকমটা কেটেছে আমার I আমি অবাক চোখে শুনছি আর সে বলে চলেছে... “খাবার  ছিল না, পকেটে পয়সা  ছিল নাদোরে  দোরে ভিক্ষা করে বেরিয়েছি    কেউ  ছিল না আমার  বাবা মাকে হারিয়েছি  হিলি বর্ডারে , যখন বাংলাদেশের  সঙ্গে গুলি গোলা চলছিল । রাজনৈতিক  মতনৈক্য  দুই দেশের  ভেতরে আর মরলো কিছু নিরপরাধ লোকজন   বাবা মা গিয়েছিলেন সেখানে এক  কাকার বাড়িতে । আমাকে রেখে গিয়েছিলেন মাসিমার বাড়িতে ,খাদিমপুর  পাড়ায় I আর ফিরে আসেন নি তারা । এমনকি আমি তাদের আর চোখের দেখাও দেখতে  পাইনি  আমার বয়স তখন ঠিক ওই  ছেলেটার মত হবে I  তারপর সংগ্রাম আর সংগ্রাম । জীবনের অর্থ কিছু ছিল না আমার কাছে , রুপোলি পর্দার গল্পের মত ৷  কি করেছি আর কি করিনি আজ আমার আর মনে নেই  I  মনে  করতে চাইলে মনেও পড়ে না আর । মনে করতেও চাইনে এখন আমি শুধু  মনে পড়ে মনের ভেতরে - মনের আধারে  গান ছিল I সুরের মায়াজাল মনের ভেতরে কি এক অপার শান্তি বিরাজ করতো
         কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো সে দেখলাম চেহারাটা অনেকটা শান্ত হয়ে এসেছে - বোধহয়  কথাগুলো   বলতে পেরে  I  আবার আমার হাতটা টেনে নিল হাতে বলল  “স্থান কাল, না  বিচার না করে,  শুধু  সুরের সাধনা করেছি  আর মনে রেখেছি  এক অদ্ভুত  প্রতিবাদের জ্বালা  অন্যায়  বা অনাচারের বিরুদ্ধে I   দেখ ভাই , আমি তো আর তোমার মত লম্বা আর বলবান  নয়  যে দরকার পড়লে দুটো ঘা  লাগিয়ে দিলাম আর সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল  ; আমি মনকে জোর দিয়েছি, জুড়েছি  কথা আর সুরের মোড়কে” ।
         আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম তার কথা - এ কোন মানুষ ? কবে থেকে ঘুরছি তার সঙ্গে ,কোনো হদিস পাইনি তার মনেরদেখছিলাম কেমন করে গুটিয়ে থাকে মানুষ তার নিজের খোলের ভেতরে আবার যখন জল পায় কেমন নিজেই আবার বাইরে বেরিয়ে পড়ে ভাবছিলাম কি তোমার খেলা হে অন্তর্যামী । হঠাৎ এক শব্দে বাধা পড়লো আমার ভাবনায় “এই যে স্যার ..আসুন..দয়া করে”,  সেই ঘোষক এসে প্রায় তাকে টেনে তুলে নিয়ে যায় আরকি I গল্পটা ছেদ পড়ল বলে দুঃখ হলো
         সে ষ্টেজে  উঠলো , হাত তালিতে গম গম করে উঠলো সমস্ত আসর অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখলাম আজ । সে সাধারণত বসে এবং নিজে যন্ত্রের সঙ্গে গান গায়,আজ দেখলাম সে মাইকম্যানকে ডেকে কি যেন আদেশ দিলো I  স্টেজ ঠিক দু মিনিটের মধ্যে সাজিয়ে দিলো তারা । সে  মাইক হাতে  নিয়ে আজ প্রথম গাইল । আজ তার মুখে এক নতুন গান শুনলাম I   জানি কথা তার মনে  লেখা, আর সুর তো তার মনের ভেতরে কবে থেকে গুমরে গুমরে প্রকাশের অভাবে কাঁদছিল ........... আজ বাঁধ ভাঙ্গা জলের মত সে গাইলো........ 
ওরে মন..যা জেনে যা...
 কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয়
 প্রতিবাদে কর  প্রতিভূ  জয় I 
 ওরে মন..যা জেনে যা...
দিস না ছেড়ে নিজের আশা
বাঁধিস না ভয় মনে বাসা I  
ওরে মন..যা জেনে যা
দেখবি রে তোর জয়ের ধ্বজা
আকাশে উড়ে  দশ ভুজা I
ওরে মন..যা জেনে যা...
কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয়
প্রতিবাদে কর  প্রতিভূ  জয় I 
ওরে মন..যা জেনে যা...

সাইকেল                                                    

সংহতি মজুমদার

সাইকেলের চামড়ার সিটটায় দুবার থাবড় মেরে ভাল করে ঝেড়ে নিলেন মনীষবাবু। তারপর চেপে বসলেন তার উপর। ডিসপেনসারি যাবেন। পেশায় হোমিওপ্যাথ ডাক্তার। আজ বন্ধ্‌।কিন্তু তাকে তো যেতেই হবে।মানুষের অসুখ কি বন্ধ্‌ দেখে থেমে থাকে ? ওখানে লাল সবুজ সব মুখ্যমন্ত্রীই ফেল। তাঁর স্ত্রী তাঁকে যেতে বারন করেছিলেন- ‘আজকের দিনটা অন্তত বাদ দাও। এই বন্ধের দিনে রাস্তাঘাটের অবস্থা ভাল থাকবে না। পথে যদি’...ততক্ষণে মনীষবাবু তাঁর সাইকেলে চেপে পগার পার।

মাঝবয়সী লম্বা ছিপছিপে ফরসা   মনীষবাবুর সাইকেলটার লরঝরে অবস্থা। অনেকদিন পর বার করলেন। ডিসপেনসারিটা দূরে হওয়ায় তিনি বাসেই যাতায়াত করেন বাড়ি থেকে কর্মস্থলে যেতে তাঁকে দুটো নদী পেরোতে হয়। আজ বন্ধ্‌ হওয়ায় সাইকেলটাই সম্বল। পুরনো এই সাইকেলটা মনীষবাবুর অনেকদিনের সঙ্গী। অসময়ের বন্ধু। কলেজে পড়ার সময় তাঁর মানে সেই সময়ের তার প্রেমিকাকে এই সাইকেলে করেই নদীর ধারে নিয়ে গিয়েছিলেন সাইকেলটা তখন গাছের তলায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে তাঁদের প্রেমালাপ শুনেছিল। 
                                                     
ঝন্‌-ঝন্‌-ঝনাৎ! যাঃ! চেনটা পড়ে গেল। মনীষবাবু নেমে চেনটা তুলতে লাগলেন। হঠাৎ পাশ দিয়ে হুশ্‌-হুশ্‌  করে কয়েকটা মটরসাইকেল বেরিয়ে গেল। চোখ তুলে তাকাতেই দেখলেন প্রত্যেকটি গাড়িতে দুজন করে,মাথায় ফেটি বাঁধা,হাতে ঝান্ডা।কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়িগুলো চোখের আড়াল হয়ে গেল মেঠো পথের বাঁকে মনীষবাবু আবার সাইকেলে চড়ে বসলেন দুপাশে ধানক্ষেত।শরৎকাল বলে দুদিকের মাঠ কাশফুলে সাদা হয়ে আছে নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মত মেঘ মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। তিনি যখন পাশের গ্রামের কোন বাড়িতে রোগী দেখতে যান - এই পথ ধরেই যান। এই সাইকেল তাঁর কত যে চিকিৎসার সাক্ষী! দুচারটি মৃত্যুরও প্রত্যক্ষদর্শী এই সাইকেল। একবার রাত দুটোর সময় কলে পাশের গ্রামে গেছিলেন মনীষবাবু। একটা বাচ্চা ছেলের ডেঙ্গু হয়েছিল। শেষ অবস্থায় তাঁর ওষুধ কাজ করেনি ছেলেটি মারা গিয়েছিল। সাইকেলটা হয়তো সেদিন দুফোঁটা চোখের জল ফেলেছিল।

বেশ কিছুটা আসার পর তিনি একটা জটলা দেখতে পেলেন।আরে! সেই ছেলেগুলো না!এগিয়ে গিয়ে দেখলেন একজন চায়ের দকানদারের সাথে কথা কাটাকাটি চলছে। ছেলেগুলো বলছে ‘তোকে কাল বলেছিলাম না দোকান খুলবি না।       
-     দোকান না খুললে বাবু পেট চলবে কেমন করে ?
 - একদিনে কি মরে যেতিস নাকি ?
-আরে ওসব ওর ন্যাকামি
-ব্যাটা তলে তলে ওই পার্টির- দেখগে।                                                                            
-- এখুনি বন্ধ কর দোকান।
- তাহলে খাব কী বাবু?

 -‘আচ্ছা ত্যাঁদোরতো! কথায় কাজ হবে না বুঝলি। জোর করে ঝাপ ফেলে দে তো’ বলেই দোকানদারকে এক ধাক্কা মারল সে। খানিকটা এগিয়ে গিয়ে বেঞ্চের উপর পড়ল দোকানদার। তার মাথা ফেটে গেল। চোখের সামনে ঘটনাটা দেখে মনীষবাবু থাকতে পারলেন না। সাইকেলটা কোন মতে স্ট্যান্ড করে ছুটে গেলেন তার কাছে। বাক্স বের করে তুলো দিয়ে রক্ত মুছে ওষুধ লাগিয়ে দিতে গেলেন। পাশ থেকে মন্তব্য ভেসে এল ‘এ ব্যাটার এত দরদ কেনরে! নিজের ওষুধ বের করে আবার চিকিচ্ছে করছে! দে ব্যাটার সাইকেলটা ভেঙ্গে’   সত্যিই তারা যাবার আগে লাথি মেরে সাইকেলের স্ট্যান্ডটাকে ভেঙ্গে দিয়ে গেল। মনীষবাবু কিছু বললেন না। সাইকেলে চেপে ডিসপেনসারিতে পৌঁছলেন। গিয়ে দেখেন-অনেক পেশেন্ট অপেক্ষা করছে। সাইকেলটাকে একটা গাছের সাথে ঠেস দিয়ে রেখে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কাজ শুরু করে দিলেন। বেশ কয়েকটা ঘন্টা কোথা দিয়ে কেটে গেল টের পেলেন না

হঠাৎ ক্রিং! ক্রিং!   আরে! সাইকেলের আওয়াজ না! তাড়াতাড়ি মনীষবাবু বাইরে এসে দেখেন একটা ছেলে সাইকেলের উপর রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। পাঁজাকোলা করে কোনরকমে তাকে তিনই ডিসপেনসারিতে নিয়ে গেলেন। ছেলেটি একেবারে নেতিয়ে পড়েছে। খুব খারাপ অবস্থা। কিছুক্ষণ চিকিৎসার পর তাঁর নজরে পড়ল-এতো সেই ছেলেটা যে একটু আগে  তাঁর সাইকেলের স্ট্যান্ড ভেঙ্গে দিয়ে গেল। এতক্ষণে আস্তে আস্তে ছেলেটি চিকিৎসায় সাড়া দিয়ে চোখ মেলে তাকালো। ডাক্তারবাবুকে দেখতে পেয়েই সে হু-হু- করে কেঁদে ফেলল। বলল- ‘ডাক্তারবাবু, আমাকে মাপ করে দিন। যাদের খুশি করার জন্য আমি আপনার সাইকেল ভেঙ্গেছিলাম,তারাই আমার এই অবস্থা করে ফেলে দিয়ে গেছে...আমি আর হাঁটতে পারছিলাম না। তাই কোনরকমে আপনার সাইকেলের বেলটা বাজাই যাতে আপনি বাইরে আসেন।...সাইকেলটার কাছেও আমি  মাপ চাইছি-ডাক্তারবাবু’। 

শেষ কথাটা শুনে মনীষবাবুর মুখে হাসি ফুটে উঠল। তাঁর কাছে ক্ষমা চাওয়ার চাইতে সাইকেলটার কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য তিনি বেশি খুশি হলেন। চিক-চিক-করা চোখে তিনি তাঁর সাধের সাইকেলটার দিকে তাকালেন।