গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৯ মে, ২০১২

তিনটি গল্প - লিখেছেন মিত্রপক্ষ সাই, পৃথা রায়চৌধুরী ও অর্ধেন্দু শেখর গোস্বামী



শুভ নববর্ষ

মিত্রপক্ষ সাই

আলাদা করে এই দিনটি নিয়ে কোন উচ্ছ্বাস আমার নেই। তবে হ্যা শুভকামনা তো করা যেতেই পারে, তাই আবারও শুভেচ্ছা সহ সবাইকে আমার শুভ নববর্ষের অনেক অনেক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানালাম। জানি অনেকেই চোখ ট্যাঁরা করে তাকাচ্ছেন আমার দিকে! ভাবছেন এই হলো ইন্টেলেকচ্যুয়েল আতেলদের সমস্যা। কারনে অকারনে সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়ে। কি তাই তো !

আসলে পাশের বাড়ি থেকে কচি পাঁঠার মাংসের গন্ধ ভেসে আসছে। আমার নিমন্ত্রণ নেই। তাই একটু সেন্টু সেন্টু গন্ধ! উমন'টাও আমার পাশে বসে আছে মাটিতে। ও বেশ অস্বস্তিতে রয়েছে। মনটা ভালো নেই, এবার চালের গুড়োর নাড়ু হয়নি। মাহাজন চাল দেয়নি। বলেছি বিকেলে মেলায় নিয়ে যাবো। তাই সেই লোভে মাংসের গন্ধ কে আপাতত পাত্তা দিচ্ছে না। ওর বাবা বেড়িয়েছে শেষ বাজারে পাঁঠার, খাসির ভুঁড়ি গুলি কিনে আনতে। কচি বাশের ভেতর ঢুকিয়ে ভর্তা হবে পাঁঠার নাড়ীভুঁড়ির। আমি ওকে না করেছি আজ খাবি না তুই।
কালই ওর বাবা কে দারুণ ধমকে গেছে চৌধুরী। সারা বছর চৌধুরীর মাঠে খেটেও তার তিন হাজার টাকার ঋণ শোধ হয়নি। শেষে বলে গেছে আজ এসে টাকা না পেলে পোষা শুয়োরটা নিয়ে যাবে। রুপবতীকে বলে গেছে বাংলা মাল এক নম্বরটা গরম গরম তৈরী রাখতে। ডান ঘার নেড়েছে রুপবতী। তখনই কোলের'টা মুখ দিতে গেল বুকে। বুকের কাপড় আলগা হতেই চৌধুরী আরও একশ টাকা পুষিয়ে নিল। বলে গেছে আসার সময় একটা লাল বেলাউজ নিয়ে আসবে ভেতরের টা আনবে নাকি সেটাও জিজ্ঞেস করতে ভুলে নি চৌধুরী

দিবাকর গত ক'বছর বাড়ী ফিরতে পারেনি। ছুটি পায়নি। বিদ্যুৎকে প্যারিসের কোন মায়া আর ধরে রাখতে পারছে না। আজ সকালেও বলছিল মায়ের কথা। নন্দিনী রান্না করছে ইলিশ সেদ্ধ। আর ভাবছে ইস একবার যদি রাজা এসে খেতে চাইত! মনামী শুনেছি বেশ ব্যাস্ত আজকাল। পিছন ফিরে তাকানোর সময় নেই।ইন্দ্রটা আজও রাতের কবিতা লিখে চলেছে। নায়মা'র মনটা সক্কাল থেকেই খারাপ। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। আর রোখা যাবেনা বিয়েটা আসছে বছর। রাজীবের রঙের দোকানে প্রচুর বাকি হয়ে গেছে। একটা ছবিও বিক্রী হয়নি। রঙ ফুরিয়েছে সব। রাকিব আজও অপেক্ষা করবে তার প্রিয়তমার জন্য দুপুর রোদ্দুরেই লাল টি শার্ট পরে

ব্রেকিং নিউজের জন্য আজও ছুটি পায়নি গৌতম মায়ের শাড়ী দুটো জমেছে। একটা পুজোর আর একটা পয়লা বৈশাখের দেয়া হবে কিনা কোনদিন কে জানে ! রিয়া জানেনা কোনদিন আর কাউকে ভালবাসতে পারবে কিনা!

তানিয়া আজও ভাবে বোনটা কেন চলে গেল দুদিনের জ্বরে! এতো অভিমান! অর্পিতা আজও শেষের কবিতা পরে, প্রতিদিন সক্কাল বেলায় ভাবে এই বুঝি এলো অমিত...। আমি জানিনা এরপরেও কিভাবে ভালো থাকার চেষ্টা করবো মিষ্টি মিষ্টি হাসি মুখ করে! ইতিহাসের খীলান গুলি দেখে মনে পরে গেলো, কোনদিনই মানুষ ভালো থাকতে পারেনি এই দিনগুলিতে। ইতিহাস বলে, রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য মোঘল সম্রাট আকবরের যুগে প্রবর্তন হয়েছিল বাংলা সালের। বর্ষশুরুর সে দিনটিই এখন বাঙালির প্রাণের উৎসব বাদশাহ আকবরের নবরত্ন সভার আমির ফতেহ উল সিরাজি বাদশাহি খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য ফসলি সালের শুরু করেছিলেন হিজরি চান্দ্রবর্ষকে সৌরবর্ষের মতো মিলিয়ে নিয়ে। তিনিই হিজরিকে বাংলা সালের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করেছিলেন ও পয়লা বৈশাখ থেকে বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু করেছিলেন। আর বৈশাখ নামটি নেওয়া হয়েছিলো নক্ষত্র বিশাখার নাম থেকে পয়লা বৈশাখে নাকি আকবর মিলিত হতেন প্রজাদের সঙ্গে চারদিকে বিতরণ হতো মিষ্টি সঙ্গে চলতো খাজনা আদায় এরপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলে বর্ষবরণ উৎসব চলে আসে জমিদার বাড়ির আঙিনায় খাজনা আদায়ের মতো একটি রসহীন বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় গান বাজনা, মেলা আর হালখাতার অনুষ্ঠান আজও খাজনা আদায় করতে আসবে চৌধুরী ফুলবতীর বাড়ি তবে ফুলবতী আপাতত সব ভুলে ব্যাস্ত সকাল থেকে কালী গরুর দুধ ওগলাতে বিশাল লোহার কড়াইয়ে কাঠের চুলোয়। এতে নাকি সংসারের শ্রীবৃদ্ধি হয়। উমনটা কখন যে পালাল আমার পাশ থেকে চুপটি করে! ও পালালেই একটা দুর্ঘটনা ঘটে নিশ্চিত।
যাই এবার আমিও, নন্দিনীর কোন খোঁজ পাই কিনা দেখি একবার আমার পাহাড়ে !


প্রতিচ্ছবি


পৃথা রায়চৌধুরী

রান্নাঘরে ট্রেতে শরবতের গ্লাস সাজাতে সাজাতে জয়ী মুখ টিপে নিজের মনেই একটু হেসে নিল। সুমিত্রা দেবীর কথা তার কানে ভেসে আসছিল। পাশের বাড়ির রিতু পিসি আর মিত্রা কাকিমার কাছে জয়ীর নামে প্রশংসার ফুলঝুরি আজ তাঁর মুখে। জয়ীর মতো বৌমা নাকি লাখে - দু লাখে একটা মেলে অথচ ভাবতে অবাক লাগে, আজ থেকে প্রায় বছর পাঁচেক আগে এই জয়ীকেই তাঁর মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়েছিল একমাত্র ছেলে নীলের স্ত্রী হিসেবে

শরবত নিয়ে ড্রয়িং-রুমে ঢুকে সে দেখল তার রাশভারি শাশুড়ি ফলাও করে তার গুণকীর্তন করছেন। বাকি দুজনও বেশ মনোযোগ সহকারেই তাঁর কথা শুনছেন ; সমর্থনও করে চলেছেন। জয়ী জানে, এসব মেকি নয়। ওকে দেখেই তিনজন হৈহৈ করে উঠলেন, "আয়, আয়, বোস এখানে।" বসলো ও কিছুক্ষণ , তারপর কাজের অছিলায় উঠে এলো নিজের ঘরে আসলে মুখের সামনে এত প্রশংসা শুনে একটু লজ্জাই পাচ্ছিল বিশেষ কিছুই না, মিত্রা কাকিমার মেয়ে সোমালি কিছুদিন যাবতবেড়াতে এসেছে ছেলেকে নিয়ে। ছেলেটা যেমন মিষ্টি, তেমনই দুরন্ত; পাঁচ বছর বয়েস। আজ দুপুরে চারটে সিঁড়ির ওপর থেকে লাফ মেরেছে তার দেখা কোনও একটাপ্রিয় কার্টুন চরিত্রের মতো। ফলে যা হবার তাই হয়েছে, মাথা ফেটে রক্তারক্তি কান্ড। সবাই যখন চীৎকার করে কান্নাকাটি করছে, সে তখন সময় নষ্ট না করে, গ্যারাজ থেকে গাড়িটা বার করে এনেছে। নিমেষে সোমালি আর গুবলুকে নিয়ে রুবি জেনারাল হসপিটাল পৌঁছে গেছে। সেখানে নিজস্ব প্রভাব খাটিয়ে কিছুক্ষনের মধ্যেই গুবলুকে চিকিৎসাও করানো হয়ে যাবার পর আবার বাড়ি।
            
মিত্রা কাকিমা একাই থাকেন, কাকু গত বছর মারা গেছেন। তাই এসব কিছু করার আর কেউ সে সময় উপস্থিত ছিলনা। জয়ী এক নামকরা সংবাদপত্রের সাংবাদিক। নীলের সাথে পরিচয় সেই সুবাদেই। নীলও সেখানেই সাংবাদিকতা করত। ক্রমে সেই পরিচয় গড়াল ছাদনাতলায়। সুমিত্রা দেবি এই জিন্স-টপ পরা সাংবাদিক বৌমাকে পছন্দ করেননি। তাঁর মতে, বাড়ির বউরা এরকম হলে মানায় না। একেকবার সে ভেবেছে চাকরি ছাড়ার কথা, কিন্তু নীল সমানে ওর পাশে দাঁড়িয়েছে, ওকে উৎসাহ দিয়ে গেছে, আর মাকেও বোঝানর চেষ্টা করে গেছে; বুঝিয়েছে, তার এই পোশাকটাই তার পরিচয় নয়। এভাবেই চলছিল। তারপর হঠাৎ একদিন কি যেন হয়ে গেল। মাত্র বত্রিশ বছর বয়েসে, আঠাশ বছরের জয়ী কে ছেড়ে, ম্যাসিভ স্ট্রোকে সে চলে গেল সেই থেকে জয়ী একাধারে জয়ী ও নীল যদিও এসবের জন্য তাকে নিজের গলার কাছে উঠে আসা দলাপাকানো ব্যথাটা বারেবারে গিলে ফেলতে হয়েছে

আজ সুমিত্রা দেবী তার শাশুড়ি নন, তার মা এখন তিনি ওকে আঁকড়ে বেঁচে আছেন ঋজু, তাঁর নাতি, নীল-জয়ীর তিন বছরের ছেলে সারাক্ষণ তাঁর আঁচলের সাথে লেপটে থাকে

আর মা, আবার তাঁর সেই নীলকে মানুষ করে তুলছেন। "জয়ী, খাবি আয় মা...", মার ডাক ভেসে আসে। সুমিত্রা দেবি রাতের খাবার সাজিয়ে ডাক দেন রোজ এইভাবে; খুব ভালো লাগে তখন। নীলের ছবিটাকে হাতে নিয়ে আজও বলে গেল সে,"আমি পেরেছি, ......"

সেইসব কথা
অর্দ্ধেন্দু শেখর গোস্বামী

আগুন ও জলের ভয়াবহ রুদ্র রূপ দর্শন ছাড়া শৈশবে ভয় পাওয়ার তেমন ঘটনা স্মৃতি হাতড়ে পাওয়া যাচ্ছে না বাচ্চাদের ভূতের ভয়টাই বেশি করে পাওয়ার কথা। কিন্তু শৈশবে তেনাদের সাথে আমার যেটুকু চেনাশোনা ছিল তাতে তেনাদের খুব ভয়ংকর বলে মনে হয়নি কখনও। আমাদের গাঁয়ের দশ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে কোথাও বিজলিবাতি ছিল না। সন্ধেবেলায় হ্যারি- কেন বা লণ্ঠনের টিমটিমে আলো ব্যতীত অন্য কোন আলোরও চল ছিল না।  সারা গাঁ খুঁজলে হয়তো দুএকটা অচল তিন-ব্যাটারির লম্বা এভারেডি টর্চ মিলত। মাঝে মাঝে ডাকাতদের ভয়ে গ্রামপাহারা দেওয়ার হুজুগ উঠত। তখন থানা থেকে বোধ হয় ওইরকম টর্চ ছাড়াও লাঠি-ফাটির বরাদ্দ হত। কিছুদিনের মধ্যেই টর্চের ব্যাটারি ফুরিয়ে যেত, পাহারা-পার্টিও অচিরে অদৃশ্য। আশেপাশের কোথায়ও ডাকাতির খবর না পাওয়া পর্যন্ত নতুন করে আর পাহারাদল গড়ার উদ্যোগ দেখা যেত না। সন্ধের পর তাই বেশীরভাগ সময়ই অন্ধকার ছিল আমাদের সঙ্গী। চলাফেরা করার সময় আমরা অন্তত আলো আর অন্ধকারের মধ্যে বিশেষ ফারাক বুঝতাম না।
ভূতের ভয় মনে চেপে বসতে না পারার সেটা একটা কারণ হতে পারে অন্য কারণটা  অবশ্যই আমার মা মা খুব সুন্দর করে গল্প বলতে পারতেন। বহু মজার মজার গল্প ছাড়াও ভূতের গল্পেও তাঁর ভাঁড়ার পরিপূর্ণ ছিল

আমার পাঠশালা যাওয়া শুরু হওয়ার  আগে পর্যন্ত যে সব সন্ধ্যায় মা সকাল সকাল হেঁসেল থেকে ছুটি পেতেন,আমাকে  নিয়ে শুয়েই তাঁকে 'কাইনি' শুরু করতে হত। তাঁর সন্তানদের মধ্যে আমিই ছিলাম কনিষ্ঠতম। সুতরাং যথেষ্ট বড় হয়েও তাঁর পীযূষভাণ্ডে আমার অধিকার কায়েম ছিল। সেই শুষ্ক ভাণ্ডে আমার অত্যাচার থেকে অব্যাহতি পেতে হলে 'কাইনি'বলে যাওয়া আবশ্যিক ছিল আমি ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত। তাঁর ভূতের গল্পের মধ্য দিয়েই আমার তেনাদের সঙ্গে পরিচয় হয়। তবে সেই পরিচয়ে ভীতির পরিবর্তে মজারই উদ্রেক হল। মায়ের সমস্ত ভূতই ভূভারতের একটি জায়গাতেই বসবাস করত। সেটি তাঁর বাপের  বাড়ি আর মামাশ্বশুর বাড়ির মধ্যিখানে শিলাবতী নদীর বালির চরে। তাঁর অধিকাংশ
ভূতের গল্পের নায়ক ছিলেন আমার বাবার এক মামা অর্থাৎ তাঁর মামাশ্বশুর।

আমার ঠাকুমা,আমরা বলতাম - দিদিগোঁসাই,ছিলেন ছোটোখাটো এক জমিদারের মেয়ে সেই জমিদারকে সবাই বলত 'ভেলাইডিহার রাজা'তো সেই রাজারই এক ছেলে, নাম সম্ভবত হরনাথ সিংহ বাবু (মা বলতেন,'আরসিং'-কেননা গুরুজনের নাম অনুচ্চার্য)গভীর রাত্রে প্রতিদিন কে জানে কোথা থেকে নদীর চর পেরিয়ে বাড়ি  ফিরতেন। আর চরের মধ্যিখানে তাঁকে ভূতের দল ঘিরে ফেলত। তারা গোল হয়ে তাঁকে  ঘিরে নাচ শুরু করত - খুচ-চু-নাচন, খুচ-চুনা-চন,-খুচ্চু-নাচন... মা সুর করে করে তাদের নাচের বোল বলতেন অনেকক্ষণ ধরে। গল্পের ওই জায়গাটাই আমার সবচেয়ে ভাল লাগত। এমনও হয়েছে কোন কোনদিন ওই সুরেলা বোল শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়েছি। আরসিং এর মাথায় থাকত পাগড়ি আর হাতে লোহা বাঁধানো বাঁশের লাঠি। তিনি বনবন করে সুদর্শন চক্রের চেয়েও বেশী বেগে লাঠিটি ক্রমান্বয়ে মাথার উপর,ডানপাশে,শূন্যে লাফ দিয়ে উঠে পায়ের তলায়,তারপর বাঁ পাশ হয়ে আবার মাথার উপর এমনই ঘোরাতেন যে তার ফাঁক দিয়ে ছুঁচটিও গলতে পারত না যে দুএকটা সাহসী ভুত ছুঁচের আকার ধরে গলবার চেষ্টা করত তারা লাঠির ঘায়ে বহু দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ত। ক্রমে ক্রমে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে আরসিং একটি হুঙ্কার ছেড়ে ধীরে ধীরে নদী পার হয়ে ঘরে ফিরতেন আর দূর থেকে ভূতের দল খোনা গলায় চিৎকার করে বলত,- যাঁ যাঁ,আঁজ খুঁব বেঁচে গেঁলি,এঁকদিন না এঁকদিন তোঁর ঘাঁড় মটকাঁবই   কাজেই আরসিং এর লড়াই জারি থাকত। আর সে জিতবে বলে জেনেও আমি পরের দিনের যুদ্ধের জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করতাম। তবে কি,আরসিং নামটি শুনলেই যেমন একটা শিংশুদ্ধু বীরের ছবি মনে ভেসে উঠত(সিং যে কোন নামের অংশ হতে পারে সেটা সেদিন ভাবনার অগম্য ছিল),ভুতেদের তেমন ভয়ঙ্কর কিছু মনে হোত না।ভূতের ভয়টাও সেজন্যে বুঝি শৈশবে তেমন দানা বাঁধেনি। একা ঘরের মধ্যে কখনো  সখনো গা ছমছম করলেও তার পিছনে আর যাই থাক ভুতের আশঙ্কা ছিল না। ঘরের বাইরে বেরোলেই ছমছমানি কেটে যেত। সেই শৈশব থেকেই বদ্ধ ঘরের চাইতে অবারিত বাহির আমার অধিক আপন মনে হত। সে প্রসঙ্গ এখন থাক,ভূতেদের ব্যাপারটা আগে শেষ করা যাক। যেহেতু জানতাম ভূতেদের স্থায়ী ঠিকানা ভেলাইডিহার নদীর চর, সুতরাং অন্য কোথাও তাদের সাক্ষাতের আশঙ্কা নেই।

বাবার মুখে অবশ্যি একবার আমাদের গ্রামের মাঠেই ঘোড়া-ভূত দেখার কথা শুনেছিলাম। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শী যখন নিজেই শেষ করতেন এইভাবে যে - ভোরবেলার ঝাপসা আলোয় ছুটন্ত ঘোড়া বোধ হলেও সেটা সম্ভবত দৃষ্টিবিভ্রমই ছিল - তখন তাঁর সংশয়ী সুর কোনভাবেই ভূতের উপস্থিতির পক্ষে জোরালো সাক্ষ্য দিত না। তবে অনেকটা বড় হয়ে,যখন আমি বারো, ক্লাস সিক্স-এ পড়ি,সন্ধেবেলায় খোলা ছাদে ভুতের ঢেলা খেয়েছিলাম। গ্রীষ্মকাল,বড়ো  জোর নটা হবে। সে আমলে অজ গাঁয়ের লোকেরা সন্ধে হতে না হতেই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ত। আমাদের বিশাল একান্নবর্তী পরিবার।পাশাপাশি দুটি দোতলা বাড়ি,একটি টিনের  ছাউনি মেটে,অন্যটি ইঁট সুরকির গাঁথনি পাকা। পাকা বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে উঠেই দোতলার খোলা ছাদ,ছাদ সংলগ্ন পর পর দুটি ঘর। প্রথম ঘরটির সামনে খোলা ছাদে মাদুর পেতে বসে হ্যারিকেনের আলোয় আমি পাটিগনিতের অঙ্ক করছি। ঘরটির ভেতর বাবা ঘুমিয়ে।

সারা গ্রাম নিস্তব্ধ। ধীরে বইছে দখিনা হাওয়া। নতুন প্রশ্নমালার একটার পর একটা অঙ্ক
আমার মিলে যাচ্ছে,আমি তাতে এমনই নিমগ্ন যে বাহ্যজ্ঞান প্রায় লুপ্ত। হঠাৎ ঠক করে একটা শব্দ!চমকে মুখ তুলে দেখি একটা ছোট ইঁটের টুকরো গড়াতে গড়াতে আমার খাতার উপর এসে থেমে গেল। ধক করে লাফিয়ে উঠেই হৃৎপিণ্ডটা সজোরে ছুটতে শুর করল। আমিও একলাফে ঘরের ভিতরে বাবার পাশে বিছানায় মুখ গুঁজলাম। কতক্ষণ পরে খেয়াল নেই - একটু ধাতস্থ হয়ে বাবাকে ডেকে তুললাম। বললাম,-কিসে ঢিল ছুঁড়ল - ছাদে--! বাবা উঠলেন, বললেন,- চলো তো দেখি... 

ছাদে বেরিয়ে আমার কথা বন্ধ হয়ে গেল--কোথাও কোন সাড়া-শব্দ নেই,মাদুরের  উপর হ্যারিকেন জ্বলছে,আমার বই খাতাও খোলা পড়ে-খাতার উপর থেকে শুধু ঢিলটাই উধাও!  বাবা কী ভেবেছিলেন জানি না। হয়ত ভেবে থাকবেন আমার মনের ভুল। কিন্তু আমি সেদিন সেই রহস্যের কোন কিনারা খুঁজে পাইনি। এখন পরিণত বয়সে এসে,ছোটদের দৃষ্টিকোণ  থেকে বড়দের জগতের আধচেনা,অস্পষ্ট ঘটনাবলী স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে সেই রহস্যের একটা ব্যাখ্যা পেয়েছিলাম। সেটা উপযুক্ত জায়গায় বলা যাবে ।



মঙ্গলবার, ২২ মে, ২০১২

তিনটি গল্প - মৌ দাশগুপ্তা , অনুপম দাশ শর্মা ও নীলম ত্রিবেদী




    অনুতাপ

মৌ দা শ গু প্তা 
 
 অবসরপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সরকারী অফিসার বেণুগোপালবাবুর বাড়ীর অদূরে ট্যাক্সিষ্ট্যান্ডটাতেই বুড়ী ভিখারিনীটার বাস। যেতে আসতেই চোখে পড়ে,আর চোখাচোখি হলেই হাতের দোমড়ানো নোংরা টিনটা বাড়িয়ে তোবড়ানো ফোকলা মুখে বুড়ীটা বিকৃত উচ্চারণে একটা কথাই বলে, _ “এট্টা ট্যাহা দে না বাবু, মুড়িটুক খাইশহর কলকাতার বুকে এই রকম অভিজাত পাড়াতেও ভিখারি ? বেণুগোপালবাবু বড় অস্বস্তি বোধ করেন। শেষমেষ একদিন বিরক্তি চাপতে না পেরে আবাসনের সেক্রেটারী শ্রীনিবাসনকে বলেই ফেললেন, “আরে মশাই, ওই ভিখারীটাকে তাড়ান তো ! আর সহ্য হয়না” শ্রীনিবাসন আমতা আমতা করে জবাব দিল, - “না মানে, এত বয়স্ক, ওর তো ভালো করে হাঁটাচলার ক্ষমতাই নেই, থাকুক না,কারো কোন ক্ষতি তো আর করছে না।“ - “মানে ? ক্ষতি করছে না মানে ? তার মানে আপনি ওকে তাড়াবেন না, তাই তো ? ঠিক আছে আমিও দেখছি।রগের চোটে আর কথার পিঠে কথা খুঁজে পান না বেণুগোপালবাবু। সটান মুখ ঘুরিয়ে অকুস্থল থেকে সম্মানজনক পশ্চাদপসরন করেন, মুখের গজগজানিটা অবশ্য চলতেই থাকে।
           
সেদিনটা ছিল বাংলাবন্ধ। সকাল থেকেই অঝোরে বৃষ্টি। প্যাচপেচে দিনটা সকাল থেকেই কেমন যেন মুখ ভার করে রয়েছে । এদিকে ঘরে বেণুগোপালবাবু স্ত্রী সুশীলার ধূম জ্বর ।প্রথমে সদাব্যস্ত স্বামীকে কিছুই না জানিয়ে চুপচাপ ঘরের কাজ সেরে গেছেন, কাজই বা আর কি? মোটে তো দুটি লোক ঘরে। কিন্তু শেষ অবধি জ্বরটা আর চাপা থাকেনি, জ্বরের ঘোরে সুশীলা যখন বেহুঁশ, ঘড়িতে তখন মধ্যরাত।কাকেই বা আর তখন ডাকেন বেণুগোপালবাবু? এদিকে মোবাইলে পারিবারিক ডাক্তারবাবুকে ধরা যাচ্ছেনা, যা দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, টাওয়ার ই নেই মোবাইলে, ল্যান্ডলাইনটাও অচল।পাশের ঘরে তালা দেওয়া, সপরিবারে কোথাও গেছেন ওনারা, ওপরের কি্বা নীচের তলার ফ্ল্যাট থকে লোক ডাকবেন ? একে তো মধ্যরাত তায় যা আবহাওয়া, কেই বা আর শুনবে, কেই বা আর উঠবে ! বেণুগোপালবাবু লোকটিও বিশেষ মিশুকে নন, লোক ডাকাডাকিতে তাই বড় আপত্তি, তবে যতদূর সম্ভব মনে হচ্ছে কাছের ওই ট্যাক্সিষ্ট্যান্ডটাতে বোধহয় রাতেও ট্যাক্সি পাওয়া যায়, কোনভাবে সুশীলাকে যদি কোন নার্সিংহোমে নিয়ে

যাওয়া যায় তো চিকিৎসাটা অন্তত সময়মত করানো যাবে অত্যন্ত উদ্বগর সাথে সেদিকেই পা বাড়ান তিনি।অঝোর বৃষ্টি, মধ্যরাতের স্ট্রীটল্যাম্পের ঝাপসা আলোয় জলভরা রাস্তায় হাঁটতে গিয়েহঠাৎ পা টা একটা গর্তে ঢুকে যায়, বেণুগোপালবাবুও সপাটে রাস্তায়  আছড়ে পড়েন ব্যাস আর কিছু মনে নেই
          
জ্ঞান ফিরতে দেখেন, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন,পাশে উদ্বিগ্ন মুখে অপেক্ষা করছেন সুশীলা ওনাকে ক্লান্ত অসুস্থ লাগলেও ধাক্কাটা যে সামলে গেছেন সেটা বোঝাই যাচ্ছে। সুশীলার মুখ থেকেই শুনলেন যে, বৃষ্টিভেজা রাস্তায় বেণুগোপালবাবুকে উল্টে পড়ে যেতে দেখে ঐ বুড়ী ভিখারী ই সেদিন চেঁচামাচি করে আশেপাশের আধাঘুমন্ত ট্যাক্সিওয়ালা, চায়ের দোকান বন্ধ করে বেনচে ঘুমানো দোকানের বয়, আবাসনের পাহারাদার, সবাইকে জগিয়ে তুলে ধরাধরি করিয়ে কোনমতে ওনাকে ঘর অবধি নিয়ে আসে, ঘরের দরজা  খোলাই ছিল,  খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘরে ঢুকে সুশীলাকে ওই অবস্থায় দেখে মাথায় জলটল দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনে, এর মধ্যে ফ্ল্যাটবাড়ীর জনাকয়েক প্রতিবেশীকেও পাহারাদার ছেলেটি গিয়ে ডেকে আনে,তারাই ছোটাছুটি করে ডাক্তার, অ্যাম্বুলেন্স, হাসপাতাল সব ব্যাবস্থা করে ফেলে। অর্থাৎ ওই বুড়ী ভিখারীই সেদিন কোনমতে অবস্থা সামলে দেয় শুনতে  শুনতে নিজের আগের ব্যাবহারের কথ ভেবে লজ্জা পান বেণুগোপালবাবু, বুড়ীর ওর একটা মন কেমন করা সম্পর্কর টান টের পান, মনে মনে তখনই ঠিক করে ফেলেন বাড়ী গিয়েই বুড়ীটার জন্য কাজচালানো কোন বৃদ্ধাবাস জাতীয় স্থায়ী আস্তানার ব্যবস্থা করে দেবেন, ভাবতেই  মনে মনেই যেন খানিকটা প্রায়শ্চিত্ত করার শান্তি পান দুচোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে, মানসিক শান্তি না ওষুধের জন্য তা বলা অবশ্য কঠিন
          
দিন তিনেক পরে ভাঙ্গা পা নিয়ে হাই ব্লাড প্রেশার, কোলেষ্টরল আর ডায়াবেটিসের রুগী বেণুগোপালবাবু হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ীফেরার পথে দেখেন, বুড়ীর বসার জায়গাটা খালি সাথে ছিল দিল্লী থেকে জরুরী তলব পেয়ে ছুটে আসা মেজছেলে বসন্ত আর ওর কলেজের বন্ধু, নীচের ফ্ল্যাটের মিষ্টার কাঞ্জিলালের ছোটছেলে মোহন মোহনকেই প্রশ্ন করে জানতে পারলেন একদা দাপুটে সরকারী আমলা বেণুগোপালবাবুর অনুরোধ ফেলতে না পেরে আবাসনের সেক্রেটারী বুড়ীকে পুলিশের সাহায্য নিয়ে ওখান থেকে হটিয়ে দিয়েছে। দুচোখ জ্বালা করে জলে ভরে এলো সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে বিড়বিড় করে বললেন, “আমায় মাপ করে দিস মা, আমি তোকে চিনতে পারি নি

বিষন্ন সকাল
অনুপম দাশ শর্মা
 
কোনদিন ভাবেনি সে পারবে।  হঠাৎই লোভ হল।  চ্যাটার্জি সাহেব ছুটিতে চেম্বারে শুধু কাবেরীর অবারিত দ্বার।  স্টেনোগ্রাফার। বলতে গেলে জোর করে বান্ধবী রীনা ফেসবুকে আ্যকাউন্ট খুলে দেয়।  রীনা অন্য অফিসে পোস্টেড ছোট্ট আ্যড্রেস ডায়েরীর শেষ পাতায় নোট, আই-ডি, পাসওয়ার্ড।  খুলে গিয়েছি অন্তর্জাল-এর রঙ্গীন জগত  অনিয়মিত ব্যবহারে এসেছে জনা পাঁচেক বন্ধু কিছু শুভেচ্ছামাখা ছবি। ইচ্ছে হল নাড়াচাড়া করার সুযোগ মেলায়  স্টেটাসে দেখা দিল ...."ছিলাম নিভৃতে একাকী
সুপ্ত ইচ্ছা পলকে শব্দের মৃদু ঝলকে হল আলোকের জোনাকি। "আশ্চর্য্য..! কম্পিউটারের ঔজ্জল্য নিমেষে হেরে গেল কাবেরীর মুখ প্রভার তড়িৎ চমকে।  পর পর কমেন্টস্ ভরে দিল উচ্ছাসমাখা ভালোলাগার প্রকাশে, বন্ধু-অবন্ধুর সাবাশে।  কাবেরী হাওয়ায় ভাসছে।  নিলাদ্রী মিত্ লিখেদিল....
উল্লাস ভরে বলি তোমায়
হাজার মাইল যাব পেরিয়ে
দেখি, কাবেরীকে আজ কে থামায়।"

কাবেরীর সামনে খুশীর পৃথিবী।  অবিশ্বাসের নিশ্বাস স্বচ্ছতা পেল বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা  পেনশনের টাকা ওষুধ গিলে নেয় অনেকটাই।  একমাত্র বো স্নাতক উত্তীর্না, চাকুরী প্রার্থী। সন্তানহীনতা আর অকাল বৈধব্য জীবনের রূপরস শুষে নিয়েছে কাবেরীর। অতএব, নিয়মিত বসা।  এবার কবিতার ছত্র অল্প অল্প করে দীর্ঘাবয়ব নীলাদ্রির মোবাইলে গেঁথে গেছে কাবেরীর ফোন নাম্বার।  প্রতিদিন বন্ধু আবেদনে সাড়া কাব্য চিন্তায় ভাগ বসায়।  দ্রুত পাঁচ থেকে পাঁচহাজার রবিবারের সারাদিন এখন আর ব্যস্ততায় বন্দী থাকেনা। ঘরোয়া কাজের ফাঁকে সঙ্গ দেয় ছোট্ট দূরভাষ। হঠাৎ জীবনপ্রবাহের এই মোচড় এতটা উচ্ছসিত করল, বহু অযত্নে ঘুমান সুরেলা কন্ঠ আবার জেগে ওঠে অসুখীর সংসারে।  ইতিমধ্যে ছোট্ ছিমছাম ল্যাপটপ শোভা পেয়েছে কাবেরীর বেডরুমে।  প্রতিদিনের সন্ধ্যা নতুন স্বাদে বর্ণময় হয় কাবেরীর কাব্য সান্নিধ্যে।  নীলাদ্রির সাথে ক্রমাগ চ্যাট কখন পার করে দেয় মধ্য রাতের বর্ডার, টের পায়না। নীলাদ্রি অবিবাহিত, চাকুরে, বছর তিনেক বড় কাবেরীর।  নীলাদ্রি জেনেছে কাবেরী হতাশা, বৈবাহিক জীবনের অপূর্নতা।  বন্ধুত্বের গভীর গুপ্তাকাশে অযাচিতস্বান্তনা পেয়ে কাবেরী কৃতজ্ঞ নীলাদ্রীর কাছে।  এক একটা রাত দু চোখেঅনিদ্রা লেপে দেয়। কাবেরীর মন সায়রে উত্তাল খুশীর লহর।  নতুন জগত ,অন্তরঙ্গতার সুনির্দিষ্ট কোন ইঙ্গিত ।  নীলাদ্রি যখন ফোন করে আবেগঘন কথা তুফান তোলে, যখন কবিতার পংক্তি ধরে ধরে ব্যখ্যার আড়ালে তীক্ষ্ন আবেদন জানায়.. এক ভবিষ্যতের আবছা রেখা স্পষ্টতর হয়েই চলে বোধের গভীরে।  কাবের অজান্তে কেঁপে কেঁপে ওঠে

অবশেষে কথা হল পাকা, মুখোমুখি হবার নীলাদ্রীর কাবেরীকে অনেক বছর বাদে পারলারে দেখে অবাক হল পাড়ার বন্ধু নয়না।  পেশাদা চোখ বুঝে নেয়, নিঃশব্দ হাসি স্বাগত জানায় । নীলাদ্রির সাথে প্রথম সাক্ষাত স্বরণীয় রাখতে কাবেরী লিখে রাখল কিছু ছত্র "ফাগের আকাশ ডাকছে তোমায় শুনতে তুমি চাও- হৃদয় জুড়ে তোমার আমি দেখতে কি গো পাও ?" রেখে দিল হাত ব্যগে। সংগোপনে, হৃদয়বৃত্তির আঙ্গনভূমে

সময়ের একটু আগেই পৌঁচেছে কাবেরী  হালকা গোলাপি শাড়ি আর ময়ূরপঙ্ক্খ রঙের স্লিভলেস  ব্লাউজে পিছিয়ে থাকা সময় হঠাৎই যেন হাজির মহা সমাদরে খানিকটা দৌড়ে রাস্তা পাড় হয়ে নীলাদ্রী সটান সামনে।  সাদা হাফ শার্ট আ আকাশি জিনস্, নিখুঁত কামান মসৃন গাল সুঠাম চেহারার ব্যক্তিত্বময়তা দেখে অভিভূত। নাস্তিক কাবেরী এই প্রথম পিছু ফেরে। ঈশ্বর প্রণামে আনত হয়। সামনেই সুরক্ষিত রেষ্টুরেন্ট।  পর্দাঘেরা ছোট্ট পরিসর।  ওরা বসল। ওয়েটা কাজ সারল। কাবেরীর হঠাৎই গুটিয়ে গেল, মনে মনে আওড়ান সংলাপ আটকে রইল গলায়। সহজ হবার আন্তরিক প্রয়াস টেনে নিল নীলাদ্রির চোখে চোখ রেখে।  নীলাদ্রি তাঁর ব্যগ থেকে বার করল এক গোছা ছাপানো কবিতার পাতা। সবটাই কাবেরীর লেখা। -জানো, সুযোগ পেলেই প্রত্যেকটা কবিতা আমি অন্তত একবার করে পড়ি রোজ
           
নীলাদ্রি মৃদু হাসে চিলতে হাসি এল কাবেরীর ঠোঁটেও। -তাই! থ্যাঙ্কস্। -অসাধারন লেখ তুমি। আলতো আঙ্গুল ছুঁলো। 'কাবেরী মনে হল সে যেন এই মুহূর্তে নির্জন দ্বীপে সবুজের মাঝে। পরিজন নেই কেউ। হারিয়ে গেছে দগদগে নিষ্ঠুর স্মৃতি  খুব আস্তে আস্তে কাবেরী নিজে ব্যাগ থেকে বের করতে লাগল লেখা চার লাইনের কবিতাটি।  ঠিক তখনি নীলাদ্রীর পকেটে বেজে উঠল মোবাইল।  -হ্যাঁ হ্যাঁ..চলে আসো। আছি এখানেই। ফোন রেখ কাবেরীর দিকে তাকাল।  -একদিন তোমার বাড়ি যাব। আলাপ হবে কাবেরীর আবার শুরু হল গুটানো ভেতর ভেতর

'আচমকা হুড়মুড় করে পর্দা সরিয়ে ভীড় করল তিনজন মহিলা।  - আরে, এই তো, আলাপ করে দিই..। কাবেরী একা বসে একদিকে  ওরা তিনজন নীলাদ্রিকে মাঝে রেখ একটা কবিতার বই নিয়ে মেতে গেল।   ওয়েটার সাজিয়ে দিল টেবিল - কাবেরী, নাও শুরু করো। আমরাও।  নীলাদ্রির উত্তাপহীনতা কাবেরীকে বিঁধলোচারজন তুমুল তর্কে মেতে গেল কাব্য সমালোচনায়।কাবেরীর কেমন যেন শীত অনুভব হল। দ্রুত উঠে দাঁড়াল।  - আমি উঠলাম নীলাদ্রি তর্ক থামাল। - আর একটু বসো না। বেরবো একসাথেই। আমার তাড়াতাড়ি ফেরা দরকার, কাজ আছে। ওক্কে। বাই।  নীলাদ্রি ফিরল, ফিরল তর্কও। কাবেরী হঠাৎ ভারি পা দুটো একটানে রাস্তায়। শরীরের কোথাও যেন ঝড় বয়ে গেছে। আনমনা আঁচল গায়ে জড়িয়ে নিল।  মনের কন্দরে বারংবার বিদ্যুতের চমকানি মাথার ভেতর হাতুড়ির ঘুষি।  কাবেরী ভাবল সে তাহলে এতটাই নির্বোধ?  না কি... বুঝে নেবার কৌলিন্যই ছিল ফাঁপা।  নীলাদ্রির এতদিনকার আবেগ সবটা তাঁর কাব্যপ্রিয়তা ? তাহলে সমর্পনের ইঙ্গিত! তা কি শুধুই আদিখ্যেতা! তিল তিল লালিত বুভুক্ষু স্বপ্নকে এত অনায়াসে হারিয়ে দিল কবিতার টান।কবিতা এতটা নির্মম হয়ে হাসছে আজ!

কোনমতে শরীর ঠেলে কাবেরী বাড়ি ফিরল।  সোজা টয়লেট। কোন চেঞ্জ না করে
শাওয়ার খুলে দিল।  অঝোরে ভিজছে আজ কাবেরী। অকাল বর্ষা ধুয়ে মুছে দিচ্ছ
কয়েক মাসের জমা আবেগ। শরীর বেয়ে মুক্তি পাচ্ছে কয়েক ঘন্টার ক্লেদ কষ্ট,
ধর্ষিত স্বপ্ন। আচমকা খানখান করে ফেটে পড়ল শব্দ কাবেরীর গলা থেকে। চীৎকার কান্নায় চাপা
পড়ে যাচ্ছে কাবেরীর জলপ্রপাত

বাড়ি ফেরার সময়
নীলম ত্রিবেদী

ক্যা বেটা গাড়ি নাহি মিল রাহা ? নাহি ভাই সাব। থোরা লিফট মিল যাতা তো......?
কাঁহা জাওগে ?
জামুরিয়া তরফ যানা থা ?
চল বৈঠ যা, আখালপুর তক ছোড় দেঙ্গে
থ্যাঙ্ক ইউ ট্রেকারটার পেছনের দিকের একটা সীটে বসে মুখ তুলে তাকাতেই দেখি ফিরোজ বসে আছে
চমকে জিজ্ঞেস করলামঃ আরে তু ? কাঁহা সে লৌট রাহা হ্যায় ?
আসানসোল গিয়েছিলাম আপনা বোলো ; কলকাত্তা থেকে আসছিস ?
হুম । রাতের ট্রেনটায় চাপলাম এখানে এসে দেখি কিছু নাই ট্রেকারটা তো তোর নাকি ?
থা , মানে বেচে দিলাম আখলপুরের একজনকে হটাৎ ?
তুই কি জানিস একটা রাতে কতকিছু ওলটপালট হয়ে যায় তুই তো পুরা এক সাল বাদ আসছিস আমার আব্বাকে তো তুই জানতিস, বেটা পাঁড় মাতাল আমার মাথাটা লজ্জায় ঝুকে গেল,কিন্তু ফিরোজ নির্বিকার।সে সারাদিনের জমা ক্লান্তির ভারে নুয়ে পড়া চোখের পাতা দুটোকে ওপর দিকে ঠেলে তোলার চেষ্টা করতে করতে বলে চলেঃ সারাদিন শালা জুয়া খেলে বেড়াতো আর বিকালের দিকে গিয়ে বসতো বিনয়ের দোকানে তুই তো জানিস ঐটা নাম কে ওয়াস্তে হোটেল আসলে একটা দেশি মদের দোকান। বোতল বোতল মদ গিলে রাত করে ঘরে ফিরে খালি চিল্লানি বউ পেটান মেয়েদের ধরে ধরে পেটান। একদিনের জন্য দেখি নি ট্রেকারে কতো ইনকাম হচ্ছে তার হিসাব নিকাশ করতে নৌ্সাদ কুত্তা যে ১০০-১৫০ টাকা মায়ের হাতে দিয়ে যেতো তাতে তো ঢং সে দিন গুজরান তো হত না উপর সে মারামারি- কাড়াকাড়ি শারাব পিয়েগা ? অউর পি জাহান্নুম মে তো জী ভর কে পিতা হোগা না ......!
বলেই ট্রেকার টার মেঝেতে ডান পা টা ঠুকে মুখে একটা হাত চাপা দিয়েই ফিরোজ চুপ হয়ে যায় বোধকরি ভালো করে দম নেওয়ার জন্যই
  
আমি চমকে উঠি গাড়ি টা ক্রমশ চেপে বসতে থাকে আমার চারপাশে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি একজন আধ উচ্চারনে গেয়ে চলেছে থোরি সি তো পী লী হ্যাঁয়.........”,সুরটাও তেমন সুবিধের নয়। অন্য সময় হলে এই গানটায় গুনগুনিয়ে ভুলটুকু ধরিয়ে দিতে পারতাম,কিন্তু না ! কি একটা অজানা বিতৃষ্ণায় মুখটা ঘুরিয়ে নিলাম মুখটা এদিকে ঘোরাতেই ফিরোজ বলে ওঠেঃ দিনরাতের কিচির কিচিরে পড়া কতটুকু হতো তুই বুঝতেই পারছিস দুটো বোনের শাদী তো হয়ে গেছিল, ছোটির বাকি আছে।ভেবেছিলাম এইচ.এস পাশ করে কোনও একটা কাজ করব ম্যাট্রিক পাশের যে ভ্যকান্সি গুলো বেরয় তার একটা বহুত কষ্টে ভরে ছিলাম
  
কলকাতায় পরীক্ষা ছিল। ফিরে এসে শুনি যেদিন থেকে গেছি সেদিন থেকে আব্বা ঘরে আসে নাই। পুরা একটা দিন কোথায় কাটিয়েছে কে জানে ? ব্যাগটা নামিয়ে রাতের বেলাতেই খুঁজতে বেরিয়ে যাই।বহুত খোঁজাখুঁজি করে দেখি শালা ধানক্ষেতের মাঝে বেহুঁশ পড়ে আছে কোনরকমে তুলে ঘরে নিয়ে আসি পরের দিন সকাল দশটায় সেই যে ব্যাথা শুরু হোল এক ঘণ্টার মধ্যে সব খতম কি!

আমার ভেতর থেকে শুধু একটিই শব্দ বের হয় ফিরোজ শান্ত স্বরে বলেঃ হ্যারে মরে গেলো। মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা এসে অধিকার করল আমাদের গাড়ি টাকে। কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করি গাড়িটাকে বেচলি কেন ? পয়তাল্লিশ হাজার টাকা শুধব কেমন করে চল্লিশ হাজারে বেচে দিলাম এখনও ৫০০০ বাকি। আমি চুপ করে থাকি। কিছু পরে বলি চাকরিটা পেলি ? ফিরোজ হেসে ওঠে।আর বলিস কেন,শালা যতদিনে জানতে পারলাম ততদিনে ইন্টারভ্যুর তারিখ পেরিয়ে গেছে। তাহলে এখন কি করছিস? কাজ করছি। কি কাজ? কাম খোঁজাটাও তো একটা কাজ,কি বলিস ?
          
একমুখ প্রশান্ত হাসি নিয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে জিজ্ঞাসু চোখ মেলে। আমি তাকাতে পারি না শুধায় তোর বোন তো এইবছর ম্যাট্রিক দেবে না ? পড়া ছেড়ে দিয়েছে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি তাহলে কি করছে এখন ? ফিরোজ নির্লিপ্ত ভাবে জবাব দেয় ঘরে ঘরে কামিনের কাজ করছে। আমি চুপ করে যাই। আর কোনও কথা হয় না। আখলপুরের আগেই সাতগ্রাম ইনক্লাইন বাবার কলিয়ারি আমাদের কোয়ার্টার। অনেকক্ষণ পড় ফিরোজ হটাৎই চৈতন্য পায় চেঁচিয়ে বলে ওঠেঃআরে রোকো, রোকো, দোস্ত কো উতরনা হায় গাড়ি  দাঁড়িয়ে যায় নামার সময় ফিরোজ বলে ওঠেঃ আজ কাম ঢুঁঢনে গয়া থা মিলা নেহি। কাল ফ্রি হ্যাঁয় গ্রাউন্ড মে আ জানা কাল তো রাহেগা না ? উৎসাহে কিছু একটা বলতে গিয়েও তীব্র মদের গন্ধে মুখটা সরিয়ে নি গাড়ি টা স্টার্ট নিয়ে চলে যায়
          
ঘরে ঢুকতেই দেখি হই-হই কাণ্ড কথায় কথায় মা বলেঃ কাজের বউটাকে ছাড়িয়ে দিয়েছি বড্ড কামাই করত আমার জিজ্ঞাসু মুখের দিকে তাকিয়ে মা জানায় এখন জুলী কাজ করছে