গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ৩১ জুলাই, ২০১২

৩০তম সংখ্যা - তিনটি গল্প > মৌ দাশগুপ্তা, অর্ঘ্য রায়চৌধুরী ও রেজওয়ান তানিম


এক ফোঁটা বৃষ্টি

মৌ দা শ গু প্তা
জকের দিনটা খুব সুন্দর, মেঘ ছাওয়া আকাশটা যেন প্রকৃতি রাণীর ছবি আঁকার ক্যানভাস। খেয়ালী মেয়ে মেঘের ওপর নানা রঙের তুলির টানে কত রঙের আলপনাই না ফুটিয়ে তুলছে সারা আকাশ জুড়ে। মেঘেরাও নানানরকম রং পাল্টে চলেছে!  কখনো ধুলো ধুলো রং, তো কখনো কালচে-সাদা, আবার কখনো মাটি মাটি রংয়ের ওপর একটু করে নীলের ছাপ,আবার কখনো গাঢ় কালচে ছাইরঙ্গা হ'য়ে, ধীরগতিতে আমার জানালার সীমিত একফালি ফ্রেমের এপাশ থেকে ওপাশে ভেসে চলেছে আপন মনে,না জানে কোন সে এক অজানার উদ্দেশ্যে, তাকিয়ে থাকতে থাকতে আপনা আপনিই মন জুড়ে ভেসে এল মন খারাপের বাদল, সে জলভরা কালচে স্মৃতির চাপচাপ দলা পাকানো মেঘমালা উদাস আমার মনটাকে ছেয়ে ফেলতে না ফেলতেই বাইরের সত্যিকারের আকাশটা কেমন মেঘলা হয়ে এলো; ধীরে ধীরে আকাশের রং গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে হতে এক সময়ে .......।

এতটা একটানা লিখে পেনটা বন্ধ করতেই হোল, বৃষ্টির ছাঁট ঢুকছে ঘরে। জানলাটা বন্ধ না করলেই না, এদিকে ভাইঝির বাংলা রচনাটিও শেষ না করলেই না। বেজার মুখে উঠতে যাবো, তার আগেই দেখি কে যেন ঝটপট জানালাদুটোর পাল্লা টেনে বন্ধ করে টিউবলাইটটা জ্বালিয়ে দিল। কে কাজটা করলো সেটা দেখতে পেয়ে আমার মুখেও বুঝিবা হাসির টিউব লাইটই জ্বলে উঠল
- ওমা টাপুর যে, কখন এলি ?
- এই তো এলাম গো দিদি, এসেই সিধে তোমার ঘরে, ভাগ্যিস এলাম, যা তালকানা লোক বাপু তুমি, আমি না এলে ভিজে একসা হতে যে, লেখাপড়া নিয়ে বসলে কি আর কোনদিকে খেয়াল থাকে তোমার ? এত বড়টি হলে, তাও স্বভাবটি গেল না!

            বকতে বকতে, বলতে বলতে,  মেয়ে চেয়ারটি বিছানার পশে টেনে নিয়ে এসে গ্যাঁট হয়ে বসলেন , আমারও অনেকদিন পর পাকাবুড়ীর বকুনি খেতে মন্দ লাগছিল না, বাড়ীতে এখন বকুনি দেবার কেউ নেই যে, ওটা তো এখন আমার কাজ। বসেই আড়চোখে লেখার কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন..
- এত  কম আলোয় লিখছো যে বড়? চশমার কাঁচটা ওই কাঁচের গেলাশের তলার মত না হলে পোষাচ্ছে না বুঝি? তা কি এত মন দিয়ে লেখা হচ্ছে শুনি?
হাসি চেপে গম্ভীর মুখে বললাম- 
- প্রেমপত্র!
- পেমপত্তর? আর তুমি ? হু, সে মুরোদ  তোমার থাকলে তো বত্তে যেতাম গো, বাড়ীর এতগুলো সুন্দর সুন্দর বৌদিদের ভীড়ে একটা জামাইবাবু তো পেতাম ! 
- আরে তোর জন্য সে চেষ্টাই তো করছি, একটা জামাইবাবু বিহনে তোর কত যে দুঃখ, বুঝতে কি আর বাকি আছে কারো ?
- তোমার না সবটাতেই ঠাট্টা, বলোনা এত মন দিয়ে একলা ঘরে অন্ধকারে কি লিখছো?টাপুরের আবার ফলার সাথে বিশেষ সদ্ভাব নেই। নাটক নভেল আমি লিখিনা, তবে হ্যা, আমার দুএকটি গল্প ছাপার হরফে আত্মপ্রকাশ করেছে বটে, টাপুরের আপাত আক্রমটি সে দিকে ই দেখে তাড়াতাড়ি বললাম,
- উফ টাপুর, বকতে পারিস বটে বাপু তুই, রাই-এর স্কুলে কি এক বাংলা রচনা লিখতে দিয়েছে, তাই      লিখছিলাম।
- তাতো বটেই, তোমার তো সারাজীবন হোমটাস্ক মেজদা করে দিল,এখন মেজদার মেয়েরটা তুমি না করে দিলে চলে?
নাঃ, মেয়েটা দেখি আজ একটা অনর্থ না করে ছাড়বে না। মেজবৌদি শুনতে পেলে আজ এবাড়ীতেই নতুন করে মহাভারতের পালা শুরু হয়ে যাবে। অতএব অন্যকথায় যাওয়াই ভালো।
- আজকাল তো তোকে দেখতেই পাই না টাপুর, কোথায় থাকিস  রে?
- কি কথার ছিরি গো দিদি, রোজ আসছি, বড় দিদাকে রামায় মহাভারত পড়ে দিয়ে যাচ্ছি, মন্দিরে পেন্নাম ঠোকাতে নিয়ে যাচ্ছি,তা তুমি চোখে চশমা এঁটে তিনতলার চিলেকোঠায় একটেরে হয়ে বই মুখে বসে থাকলে আর দেখবে কোথা থেকে?
- তা আজ বড় মনে করে এলি যে?
- ওই দেখো, ভালো কথা ভুলে যাচ্ছিলাম, আজ শ্রাব সংক্কান্তি যে, টুপুর….
নামটা কানে আসতে আমার প্রসাদ সুদ্ধ  হাতটাও যেমন মুখের কাছে এসে থেমে গেল, তেমনি মুখরা টাপুরটাও কথা থামিয়ে ওড়নার কোনে চোখটা মুছে নিলো।
টাপুর আর টুপুরএকটুকরো স্মৃতিমাখা আবছা ছায়া,..ছেঁড়া ফ্রকপড়া দুটো ছোট্ট মেয়ে, এই তো সেদিনের কথা......

         ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে বাসন মাজতে ,ঘর মুছতে আসত বুড়ি মাসী। মাঝ বয়সী , পরনে মিলের আধময়লা ছাপা শাড়ি , খুব শক্তপোক্ত চেহারা , গায়ের রঙ খুব কালো ছিল, রোদে পোড়া কালো রঙ , মুখে অজস্র আঁকিবুকি, মাথার চুল পুরো কালো , তবু যে কেন সবাই বুড়ি মাসী বলতো কে জানে, খালি আমার ঠাকুমা ডাকতেন সুনির মা’ , কিন্তু সুনিটি যে কে তা আমরা জানতাম না, সুনি বলে কাউকে দেখিও নি কোনদিন। অনেক পুরোনো লোক, শুনেছি আমার স্বর্গতা  বড়ঠাকুমার আমলে এ বাড়ীতে কাজে লেগেছিল। বড়ঠাকুমাকে দাদাদের মনে থাকলেও আমার একটুও মনে পড়ে না, খালি আমার নিজের ঠাকুমার মুখে ওনার গল্পই শুনেছি।

বুড়ী মাসীর নিজের বলে কেউ যে ছিল তাই-ই জানতাম না,সেই কোন সাতসক্কালে এসে কাজে লাগতো আর ফিরত সেই সূয্যি ডোবার পর, কামাই টামাই, জ্বর জ্বালাও কোনদিন হয়েছে বলে শুনিনি।তা সেই বুড়িমাসী বলা নেই কওয়া নেই টানা চারদিন কামাই করার পর এক টুপটাপ বৃষ্টিভেজা সক্কাল বেলায় দুটো ছোট ছোট বাচ্চা মেয়ে নিয়ে এসে হাজির।ছেঁড়া ফ্রকপড়া দুটো ছোট্ট মেয়ে, চুলে চিরুনী নেই,নাক বইছে, রাজ্যের ধুলোভরা পায়ে রংচটা প্লাস্টিকের চটি।আমার আবার ছোটবেলা থেকেই সব ব্যাপারে  ভারী কৌতুহল, অতএব দাদাদের কানে সঠিক খবরটি পৌঁছে দেবার বাসনায় মা জেঠিমার চোখ পাকানো উপেক্ষা করে সটান হাজির ঠাকুমার দরবারে, একদম কোল ঘেঁষে।বড়দের কথাবার্তায় বুঝলাম এ দুটি নাকি মাসীর নাতনী, মেয়ের ঘরের মেয়ে,পরপর তিন মেয়ের পর আবার যমজ বোন, শ্বশুরঘরে মেয়েকে অনেক কথা শুনতে হয় বলে মাসী গিয়ে নিয়ে এসেছে। আমার তো শুনে আনন্দে লাফানোর উপক্রম, বাচ্চাদুটো তাহলে মাসীর সাথে দিনভর এখানেই থাকবে, বাড়ীর ছোট বলে দাদারা সবসময় আমার ওপর কর্তৃত্ব ফলায়,এবার আমিও ছড়ি ঘোরানোর লোক পেলাম বলে !
- ও মাসী, কি নাম গো ওদের?
- ওদের নাম? ঘেন্না আর ফেলনা।
- ওমা এ আবার নাম হল নাকি? আমি হেসে গড়িয়ে পড়লেও বড়রা কেউ হাসলো না।
ঠাকুমা তাড়তাড়ি বললো, - না সুনির মা, এ বাড়ীতে ও নাম চলবে না,টাপুর টুপুর বৃষ্টিভেজা দিনে মেয়েদুটোকে আনলে যখন, এ বাড়ীতে সবাই এখন থেকে ওদের ওই টাপুর টুপুর নামেই ডাকবেখন। ও বড় বৌমা বাচ্চাদুটোকে কিছু খেতে দাও দেখি, আর ছোটবৌমা, দেখোতো মিঠির ছোটবেলার ভালো জামা টামা,খেলনা-পাতি দু একটা আছে নাকি!

সেই থেকে টাপুর টুপুর দুবোন আমার জ্যান্ত পুতুলের মত নিজস্ব সম্পত্তি হয়ে গেল। আমার কাছে বকা খেত, অ আ ক খ , এ বি সি ডি , এক দুই শিখতো, ছোটখাটো ফাইফরমাশ খাটতো, বুড়ি বাসন্তী, আইশ-বাইশ খেলত, না কথা শুনলে চড় চাপড় দিতেও থামতাম না, বদলে আমার চকলেট টফি কেক খাবারের ভাগ পেত, ছবি আঁকার খাতা,রং পেন্সিল  পেত,দাদাদের চুল ধরে টানা,গাট্টা খাওয়া থেকেও বাঁচতো।

এ ভাবেই চললো বেশ কিছুদিন,প্রায় বছর দুয়েক, তখন ওরা স্কুলেও যেতে শুরু করেছে, হঠাৎ একদিন ওদের বাবা এসে প্রায় জোর করেই নিয়ে গেল ওদের, কোথায় কাদের বাড়ীতে নাকি ঘরের কাজ করবে, দুটো পয়সা রোজগার করে বাপের অভাবের সংসারের সুরাহা করবে ! বুড়িমাসীর থেকে খবর পেয়ে মনটা খুব খারাপ হলেও ধীরে ধীরে পুরানো রুটিনেই আবার অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। মাঝে মধ্যে টাপুর টুপুরকে মনে পড়ত অবশ্যই, কিন্তু টানটা অতটা ছিল না, বুড়ীমাসিও খবর পেত না, যতদিন না টুপুর মরে গিয়ে নিজে খবর হয়ে উঠলো আর কাঁদতে কাঁদতে স্বয়ং টাপুর-ই সে খবর নিয়ে হাজির হোল আমাদের বাড়ী। টুপুর নাকি জ্বর হয়ে মরে গেছে, কিন্তু টাপুর জানতো কথাটা সত্যি না, এক পড়াতেই দুই আলাদা বাড়ীতে দু বোনে কাজ করত, তাই টাপুর জানতো কাজের বাড়ীতে কথায় কথায় সামান্য ভুল ত্রুটিতে কি মারটাই না খেত টুপুর,এমনকি মরার পরেও ওর গলার, গায়ের , কালশিটে পড়া দাগগুলো অন্যকাহিনীই বলছিল।

ঐ বাড়ীর লোকেরা টাপুর টুপুরের বাবাকে হাতে পয়সা গুঁজে দিয়ে থানা পুলিশ এড়িয়েছিল, টুপুর মরায় এই বিরাট পৃথিবীর কারো কোন ক্ষতি হয়েছিল বলে মনে হয় না, তবে টাপুরের ছোট্ট জীবনটায় অনেক বদল এসেছিল। ও  টুপুরের মত ভাগ্যের হাতে মার খেতে খেতে মরে যেতে রাজী ছিল না , তাই ঠিক করেছিল ও  আর লোকের বাড়ী কাজ করবে না,পড়বে, পড়াশুনো করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে।তাই কাজের বাড়ী ছেড়ে বাবার কাছে ফেরত গেছিল,  সেখানে বেদম মার খেয়ে দিদিমার কাছে পালিয়ে এসেছিল, মেয়ের সংসারে আরো অশান্তির ভয়ে বুড়ীমাসীও তখন ওকে নিজের কাছে রাখতে সাহস না পেয়ে নিয়ে এসেছিল আমাদের বাড়ী। বাবা জেঠার আপত্তি থাকলেও ঠাকুমা আর পিসি-ঠাকুমার জোরে আমাদের বাড়ীতেই ওর থাকার ব্যাবস্থা হয়েছিল। রান্নার কাজ করত যে বুড়ী বিন্দিপিসি, তার থাকার ঘরেই আরেকটা তক্তাপোষ পেতে দেওয়া হয়েছিল। আবার স্কুল যাওয়া শুরু করেছিল টাপুর। সময়ের সাথে ভুলেই গেছিলাম যে টাপুর আমাদের কেউ হয়না।

এর পর অনেক বছর পার হয়ে গেছে, সেদিনের অনেক চরিত্রই আর আমাদের মাঝে নেই। ঠাকুমা, জেঠিমা,জেঠামশাই,বাবা,বুড়ীমাসী,বিন্দিপিসি,কতজন! আমিও তো প্রৌঢ়ত্বের দোরগোড়ায়, তবু টাপুর আছে। ওর বাবা মারা যাবার পরে মা আর বিধবা মেজবোনকে নিজের কাছে নিয়ে এসে সংসার পেতেছে আমাদের বাড়ী থেকে বেশ খানিকটা দূরে, নতুনপাড়ায়। টাপুরের রেলের লোয়ার ডিভিশন ক্লার্কের চাকরীটাই এখন ওদের তিনজনের ভরসা

- কি গো দিদি, হাতে পেসাদটা নিয়ে কি এত আকাশ পাতাল ভাবছো গো ? ওই এককুচি পেয়ারা আর একটা বাতাসা খেতে লোকে কত সময় যে নষ্ট করতে পরে সেটা তোমায় দেখে শেখা উচিত। কিন্তু আমার বাপু তোমার মত সময় নষ্ট করলে তো আর চলবে না,বাড়ী সুদ্ধ সবাইকে পেস্সাদ খাইয়ে বাড়ী গিয়ে  এই সন্ধেবেলাতেই আবার মাকে দাঁত তোলাতে নিয়ে যেতে হবে , দিন ধরে বুড়ী যা ভোগাচ্ছে না।
স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি , আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে টাপুরের মুখের লুকানো কষ্ট,ক্ষোভ, অন্তর গ্রাস করে থাকা প্রিয়জন হারানোর সন্তাপ। প্রতিদিনের মতোই ফেরত আসছে দৈনন্দিন বারোমাস্যর কাহিনী,  পার্থিব যত পাওয়া না পাওয়ার খতিয়ান, মুছে যাচ্ছে ওর স্বপ্ন  দেখা চোখ থেকে অতীত বঞ্চনার অশ্রু স্রোতএই পরিবর্তন ই তো জীবন।  


·         
o                                   পকেটমার 
    অ র্ঘ্য রা য় চৌ ধু রী

         
গিয়েছিলাম বেলেঘাটা। বন্ধুর মেয়ের জন্মদিনে একাই, অফিস ফেরত। চর্ব্য- চোষ্য-লেহ্য-পেয়র পর স্বভাবতই বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেরি হ’ল। বেলেঘাটা থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা শিয়ালদা এসে দেখি, দশটা তেত্রিশের শান্তিপুর ছাড়ব ছাড়ব করছে। এক দৌড়ে ট্রেনে উঠলাম। শীতকাল, তাই জানলার ধার বাঁচিয়ে গুছিয়ে বসলাম। ছোট কামরা, টিমটিমে হলুদ বালব জ্বলছে প্যাসেঞ্জার মাত্র তিনজন আমার মাঝখানের প্যাসেজ পেরিয়ে ওপাশে এক নিরীহ চেহারার ভদ্রলোক, তার সঙ্গী আর তাদের সামনে জানলার বিপরীত দিকে কালো চাদরে মুখ ঢাকা সবুজ চেক চেক লুঙ্গী পড়া একটা লোক আমি যাব ব্যারাকপুর, টিটাগরের পড়েই, বেশী দূর না, তাই তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবার একটা চান্স আছে। ট্রেন ছাড়ল, হুইশেল দিয়ে দুলকি চালে এগিয়ে চললো জানলার দিকে তাকিয়ে আছি, দূরে বসার জন্যে প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না, শুধু আলোগুলো সরে সরে যাচ্ছে। ঘটাং ঘটাং শব্দ করে পেরিয়ে গেল শিয়ালদার  ব্রীজ, এইবার স্পীড নিল। দরজা খোলা থাকায় কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। গুটিসুটি মেরে বসলাম। নিরীহ চেহারার ভদ্রলোকটি ঘুমাচ্ছেন, পাশে একটি বড় পার্সেল রাখা, হাত দিয়ে ধরে রেখেছেন। পার্সেলের ওপাশে বসে তার সঙ্গী।

       উল্টোডাঙ্গা ট্রেন ঢুকছে। ট্রেন থামলে হুড়মুড় করে উঠে পড়ল একটি ফ্যামিলি। দশাসই চেহারার এক ভদ্রলোক, ছোট করে কাটা চুল, পরিস্কার দাঁড়ি গোঁফ কামান, পরনে লাল কটকটে উইন্ড চিটার আর সবুজ প্যান্ট। হামবড়া ভাব। ভদ্রলোক উঠেই হাঁকডাক করে কামরাটাকে সরগরম করে তুললেন। দুই ছেলেকে ধমকে ধামকে জানলার ধার থেকে তুলে অন্য সিটে বসালেন। স্রীকে বসাচ্ছিলেন চাদর মুড়ি দেওয়া লোকটার প্রায় পাশেই, লোকটাকে দেখে ভুরু কুঁচকে অত্যন্ত বিরক্তি প্রকাশ করে প্যাসেজের ধারের সিটে বসালেন। নিজে বসলেন তার পাশে। তারপর হঠাৎ সামনের সিটের নিরীহ ভদ্রলোকটির দিকে চোখ পড়তেই "আরে নির্মলদা যে" বলে তার হাঁটুতে চাপড় দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন। নির্মলদা বললেন " আমি তো অনেক্ষণ আগেই আপনাকে দেখেছি"। ওনার মুখের কথা শেষ না করতে দিয়েই নবাগত প্যাসেঞ্জারটি বলে উঠলেন "আরে আমিও কি আপনাকে দেখিনি নাকি? আমিও তো দেখেছি, দেখেছেন তো কি অবস্থা? গেছিলাম শ্বশুর বাড়ি মৌলালিতে, এই সব লটবহর নিয়ে কি আর পারা যায়? অনেক করে বলছিল থেকে যেতে কিন্তু, এই বরুন দত্ত গুপ্ত থাকবে শ্বশুরবাড়ি? নৈব নৈব চ"। নির্মল বাবু একটু হাসলেন। ট্রেন ততক্ষণে বেশ স্পীড নিয়ে ফেলেছে। বরুন দত্ত গুপ্ত জিজ্ঞেস করলেন, "তারপর আসা হচ্ছে কোত্থেকে?" নির্মল বাবু বললেন "অফিস ফেরত গেছিলাম ছেলের বই কিনতে, বি এস সি পড়ছে তো? খরচ সামাল দিতে দিতেই অস্থির, আজকালকার বইগুলোর কি দাম?" বরুনবাবু বললেন " তা বললে কি চলবে? ছেলে কি আপনার মতো দশটা পাঁচটা অফিস আর ওভারটাইম করবে? তার ওপর বড়বাবুর ধাতানি? বলে হা হা হা হা করে হেসে উঠলেন। আমার বিরক্ত লাগছিল। শান্তির পরিবেশটা নষ্ট করে দিল। পাশের ভদ্রলোকটি এতহ্মন আলোচনায় যোগ দেন নি, বোধহয় মিতভাষী মানুষ, উনি বললেন " ঠিকই বলেছেন, আজকালকার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ভীষণ খরচ"। বরুনবাবু বললেন, "কিন্তু তা বললে হবে? এই তো আমার দুই ছেলে, বড়টা পড়ে সেভেনে আর ছোটটা ফাইভে, দুটো ছেলের জন্যেই প্রাইভেট টিউটার রেখে দিয়েছি, বাড়ি এসে পড়ায়। মাস গেলে সাতশো টাকা আর রোজ এককাপ করে চা বিস্কুট। বই যখন যা লাগবে সব কিনে দিই। দুজনের বই মিলিয়ে প্রায় দশ হাজার টাকার মতো কিনে দিয়েছি। দুটোই পড়াশোনায় ভালো। আমি তো দেখিই না।" বলে ঠোঁট বেঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন। নির্মল বাবু আর সঙ্গীর তো চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। বেলঘরিয়া এল। নির্মল বাবু সঙ্গীকে বললেন " আপনি তো খড়দায় নামবেন"। সঙ্গী ভদ্রলোক বললেন "দেরী আছে"।
এবার বরুন দত্ত গুপ্তের চোখ পড়ল সবুজ চেক লুঙ্গী, কালো চাদরের দিকে। চাপা গলায় বললেন, "এরা যে কেন এখানে ওঠে? ভেণ্ডার ক্লাস। যত সব চোর পকেটমার, আবার সিটে বসে যাওয়া চাই। সাবধানে যাবেন নির্মলদা, আমি অবশ্য পলতা অবধি আছি"। নির্মল বাবু বললেন, " আর বলবেন না, সেদিন অফিস যাওয়ার পথে দুশ টাকা ভর্তি মানিব্যাগটা পকেটমারি হয়ে গেল, অফিস টাইমের ভিড়। তারপর এই ভদ্রলোকের কাছ থেকে টাকা ধার করে বাড়ি ফিরলাম। ইনি আমার কলিগ।" বলে পাশের ভদ্রলোকটিকে দেখালেন। বরুন বাবুর মুখে আবার সেই তাচ্ছিল্যের হাসি, "আপনাদেরই হয়, কই আমি তো পঁচিশ বছর ধরে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করছি, আমার তো একদিনও হোল না, আসলে আপনারা বড্ড কেয়ারলেস থাকেন। যদি এক ব্যাটাকে ধরতে পারি দেখিয়ে দেব আড়ং ধোলাই কাকে বলে"। 

           ট্রেন সোদপুরে ঢুকছে। কালো চাদর মুড়ি দেওয়া লোকটা উঠে দাঁড়াল। বরুন বাবু স্পর্শ বাঁচিয়ে সরে বসলেন, ওনার স্ত্রীও নাকে রুমাল চাপা দিয়ে সরে এলেন। লোকটা দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ট্রেন থামলে কালো চাদর লোকটা ট্রেন থেকে নেমে যেতে যেতে বলল, "দাদা আপনার পকেটমার হবে কি করে? সারা জীবন দেখে এলাম পকেটে তো থাকে পঞ্চাশটা মাত্র টাকা, আবার বড় বড় কথা বলেন?" ট্রেন থেকে নেমে অন্ধকারে লোকটা মিলিয়ে গেল। বরুন দত্ত গুপ্ত সারা রাস্তা আর একটাও কথা বলেন নি।




দুটো খুন ও কিছু দুঃস্বপ্ন 
রে জ ও য়া ন তা নি ম

মি এখন যেখানে আছি তার থেকে ফুট পাঁচেক সামনে পড়ে আছে কিছুক্ষণ আগে খুন হওয়া একজন মানুষের লাশ। লাশটি একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষের । সমস্ত দেহ বিন্যাসের মধ্যে বিশাল ভুঁড়িটা দৃষ্টি আকর্ষণ করত সবার আগে। এখন অবশ্য সেটা নেতিয়ে পড়েছে। একটা প্রকাণ্ড আর ধারালো ছুরি এফোঁড় ওফোঁড় করে চিরে দিয়েছে লোকটার ভুড়িটাকে। রক্তে গড়াগড়ি! কী বিশ্রী অবস্থা! আমাকে চেয়ে চেয়ে দেখতে হচ্ছে । 

মানুষ কি করে খুন হয়, এই নিয়ে মনে বিশ্রী রকমের একটা কৌতূহল কাজ করত। প্রায় প্রতি সকালেই খবরের কাগজে চোখ বুলাতে বুলাতে আশফাককে বলতে শুনতাম- খুনের কথা, হত্যার কথা, ধর্ষণের পরে জবাই করে নির্মম ভাবে মেরে ফেলার কথা। আমি ওর গলায় শুনতে পেতাম হতাশার স্বর, মানুষ কি কোনদিন সভ্য হবে না? কত দিন ভেবেছি- খুন, ধর্ষণ এগুলো কী জিনিস, কেউ যদি বলে যেত, পেপারটা যদি পড়ে দেখতে পারতাম ! আমার সেই আকাঙ্খা আজ মিটে গেছে ভয়ঙ্করভাবে । একটা ভয়াল বিভীষিকা এসে যেন নগ্ন করে দিল অসভ্যতার কালো লোমশ বাহুটাকে । এক সাথে আজ দুটো খুনের দৃশ্য দেখতে হল ! প্রথমটি দেখার পরেই আমার সর্বাঙ্গে শুরু হয় ভীতিপ্রদ কাঁপন । আমি চাইছিলাম ছুটে বেরিয়ে যেতে । পালিয়ে যেতে এ ঘর ছেড়ে অনেক দূরে । কিন্তু পারিনি । 

দ্বিতীয় খুনটা ছিল আরো নির্মম, আমার জন্যে আরো বেশি কষ্টের। এই ঘরের কর্ত্রী, আশফাকের স্ত্রী সোমা খুন হল আজ রাত্রে। ওর লাশটা পড়ে আছে শুভ্র চাদরের বিছানাতে। অদ্ভুত রকমের এলোমেলো হয়ে আছে চাদরটা। চিড়ে গেছে বেশ কিছু জায়গায় । অবশ্য তা হবার কথাই ছিল। পাষন্ড খুনিটা যেভাবে খুবলে খেয়ে নিয়েছে সর্বস্ব, যেভাবে মৃত্যুর কোলে শুইয়ে দিয়েছে নিখুঁত নিপুনতায়; যেভাবে নিথর হয়ে পড়া দেহের ভিতরেও খুঁজে নিয়েছে নিজের আদিমতম সুখের ঠিকানা ; তাতে এই শাদা চাদরের ছেড়া কিংবা বিছানার আলুথালু অবস্থা কোন অর্থই বহন করে না। বরং এই জঘন্য রকমের নোংরা হয়ে থাকা বিছানা পত্র- এটা অনিবার্যই ছিল, ঘটনাক্রমের সাথে। এ গুলো কি ভাবছি আমি? একটু আগে আমার চোখের সামনে শেষ হয়ে গেল একটা রক্ত মাংসের মানুষ, আমায় যত্ন দিয়ে, ভালবাসা দিয়ে আপন করে নেয়া সোমা। আর আমি তার মৃত্যুকে ফেলে সাদা চাদরের ছোপ রক্ত আর চিড়ে ফালাফালা হবার বিষয়টা নিয়ে বকে যাচ্ছি ! আমার ভিতরটা কি বদলে গেছে হঠাৎ এই খুনোখুনি দেখে ? আমার চোখের মনিতে কি এখন অশ্লীল নিস্তব্ধতা, অন্তহীন গভীর প্রশান্তি? খুনিটার মতন তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করবার মানসিক ধীশক্তি আমিও কি অর্জন করেছি? এখন কি সোমা, মৃত একটা লাশ আর কিছু নয় আমার কাছে? আর দশটা সাধারণ মানুষের মত? কে জানে, কিছুই জানি না আমি । আমি, আমি আর ভাবতে পারছি না, আমার চোখ দুটো বুজে আসছে ভীষণ যাতনায়। আমি মুক্তি চাই- নীরব, অটল তুমি আমায় মুক্তি দাও!

দিন সাতেক আগে আশফাক আমাকে বের করে দিতে চেয়েছিল এই ঘর থেকে। আমায় বলেছিল অপয়া, একটা অভিশপ্ত জিনিস। আমাকে রাখতে চেয়েছিল বসার ঘরের এক কোনে। সোমা বাধা দিয়েছিল বলেই সেদিন আমাকে বের করা হয়নি। তুমি কি জানতে সোমা, তোমার জীবনের কালরাত্রি ঘনিয়ে আসছে একটু একটু করে। অন্ধকারের প্রেতাত্মা গ্রাস করে নেবে, কালো জগতে? জানতে বোধহয়, তাই রাখতে চেয়েছিলে প্রত্যক্ষদর্শী এই অসাড় আমাকে। হায়, আমার কথা তোমরা কি কোনদিন শুনতে পাবে মানব জাতি, আমার ঈশ্বর ?
সেদিন সকাল থেকেই আমার আনন্দ। ওর মুখে অনেক দিন পরে শুনি চেনা সেই গানটাপ্রতিদিন ধুলোর অনাবশ্যক আক্রমণ থেকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসতো সে। সেদিন এল অন্য রকম আনন্দ নিয়ে। তখনই বুঝেছিলাম আজকে আমার সুখের দিন। সত্যিই তাই হল। কিছুক্ষণ পরে ফেরত দেয়া হল আমার জীবনীশক্তির সর্বশেষ ও চতুর্থ অংশটুকু, যার অভাবে আমি ছিলাম অসাড়, মূঢ়। পৃথিবী টিকে আছে শব্দের খেলায়। শব্দহীন জীবন অনর্থক! সোমার বদান্যতা কথা বলার সুযোগ করে দিল আবারো । এর আগে একমাস, আমার কণ্ঠ রুদ্ধ করে রেখেছিল আশফাক ! বেচারা আশফাক, সামান্য আমাকে অপয়া ভেবেছিলে! কিন্তু কি অপয়া, কি অভিশাপের খপ্পরে পড়েছে তোমাদের সংসার, তুমি জানতেও পারনি। আমি সেদিন শেষ বারের মত গেয়ে উঠেছিলাম গানগুলি। গেয়ে উঠেছিলাম চিৎকার করে, প্রাণের সবটুকু শক্তি, সবটুকু আনন্দ নিয়ে। আমি গেয়েছিলাম মধ্যরাতে অর্থাৎ বারোটায় ! গেয়েই চলেছিলাম পরের ঘণ্টা দুটিতেও। এর পরেই শুরু হল সোমার দু:স্বপ্ন । ঘুমে অচেতন আশফাক, তার পাশে শয়নরতা সোমা। আশফাকের মত সেও ছিল ঘুমিয়ে। কিন্তু সে ঘুম ছিল না আনন্দের, ছিল না পরিতৃপ্তির। বরং মুখভঙ্গিতে ছিল স্পষ্ট ভয়ের রেখা। নিজের গলায় হাত দিয়ে বারবার অদৃশ্য কোন শ্বাপদের হাতকে সরিয়ে ফেলতে চাইছিল সে। চিৎকার করে বলতে চাইছিল, বাচাও বাচাও! কিন্তু দম বন্ধ করা অন্ধকারের মাঝে হিংস্র কালো হাতের থাবা, তাকে সেটা বলতে দিচ্ছিল না। ওদিকে মুখোশধারী মূর্তিটা বারবার বলছে-তুই মর, তুই মর। শ্বাস রোধ হয়ে আসছে সোমার। এভাবে ছটফট করতে করতেই হয়ত সেদিন মরেই যেত । আমি তখন রাত্রি তিনটায় চিৎকার করে উঠলাম তারস্বরে। তখন সোমার চাপা গোঙানি চলছিল অবিশ্বাস্য হিংস্রতার আক্রমণে। আশফাকের গভীর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে। আকুতির হাত তার পেটের উপর সশব্দে পতিত হয়। তন্দ্রাচ্ছন্নতা থেকে মুক্তি মেলে তার। চেয়ে দেখে নিজের থুতনির নিচে হাত দুটি দিয়ে কি যেন সরিয়ে দিতে চাইছে সে, অভিব্যক্তিতে ভয়ের ছাপ। কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে নিজের অজান্তে, ঘুমের মাঝেই । আশফাকের সজোর ধাক্কায় ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠে সোমা । তার কণ্ঠে শুনতে পাই ফুঁপিয়ে কান্না আর বিভীষিকাময় দু:স্বপ্নের বয়ান। কেউ একজন মেরে ফেলতে চাইছিল, তার জঠরাগ্রে বেড়ে উঠতে থাকা আগামীর স্বপ্নটাকে। বারবার বলেছে তার মৃত্যুর কথা, শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে যাবে কোন এক কালো হাত। সাথে অনাগত ভবিষ্যত, সোমার ছটি মাসের নিরন্তর সাধনার ফল তার বাবুটার জীবন প্রদীপ অমাবশ্যার অন্ধকারে ডুবে যাবার অশনি সঙ্কেত । রহস্যময় কালো মুখোশধারীটার শুধু একই কথা- তুই মর, তুই মর। প্রায় প্রতি রাতেই ওর ধস্তাধস্তি হত মূর্তিটার সাথে । প্রথম দিকে যখন মুখোশধারী গলা টিপে ধরতে যেত, তখন সে মুখোশ ধরে টান দিলেই পালিয়ে যেত। এ রকম হয়েছে অনেক দিন। কিন্তু আস্তে আস্তে আরো রূঢ় রুদ্র মূর্তি নিয়ে সামনে এল মুখোশধারী। প্রতি রাতের স্বপ্নেই ধস্তাধস্তির সময় বাড়ছিল। যদিও মুখোশ টেনেও খুলতে পারত না সে তবুও এই কাল্পনিক হাতাহাতির ফাকে প্রতিদিনই উন্মোচিত হয়ে আসছিল আড়ালে লুকিয়ে থাকা জান্তব কোন হাসি, পিশাচের পৈশাচিকতার নির্মম রূপ। সেদিন সোমা তার মুখোশ পুরোপুরি খুলে ফেলে। ভয়ার্ত কণ্ঠে আশফাকের কাছে বলে, সেই খুনি পশুটা আর কেউ নয় আব্দুল ।

আমার এখন ভীষণ হাসি পাচ্ছে । হা হা করে হাসতে ইচ্ছা করছে। মৃত লাশটির নিথর পাপড়ি গুলো মেলে চোখ খুলে দিয়ে বলতে ইচ্ছা করছে, মানুষ চেনো তুমি ? চেনো না। তুমি কিচ্ছু জানতেনা সোমা, কিচ্ছু না। চিৎকার করে বললাম, মনের সবটুকু ক্ষোভ নিয়ে, তুমি নির্বোধ । বোকা, একেবারেই অবলা নারী! মৃত্যু তোমার নিজের আয়োজন! আমার কান্না দমকে দমকে আসে, সোমাকে খুব ভালবাসতাম। তার হাসিতে হেসেছি, তার কান্নায় কেদেছি, এখন নিস্তব্ধ তার নিথর দেহের পানে চেয়ে। 
ভারী কাপড়ের পর্দার সুতোর ফাক থেকে ঘরে আসছে দু এক ফোটা আলো। এই আলো আসবার সময়টা দেখার জন্য কত রাত আমি জেগে থেকে পার করেছি! কত স্নিগ্ধ অনুভূতি আমাকে ঘিরে রেখেছে এই ক্ষণটুকুতে! কিন্তু আজ কোন স্নিগ্ধতা নেই, কোন মায়া নেই। কোন কোমলতা নেই আমার চারিদিকে শুধু কদর্যতা। কাদার মত থিকথিকে হয়ে আছে মেঝের রক্ত। অশ্লীল ভাবে বেরিয়ে আছে গেলে দেয়া ভুড়ি নাড়ির কিছু অংশ । সকাল হচ্ছে। আর একটু পরেই আসবে দু:সহ একটি দিন। কত কান্না কত দু:খ, কত মূল্যহীন শান্তনার বানী একে অপরকে দেবে, আর আমাকে তা শুনতে হবে? আমি সত্যিই জানি না কাল সকালে কে এসে প্রথম দেখবে সোমার লাশ? পুলিশ নাকি আশফাক, আমি জানি না, জানতেও চাই না ।

আশফাকের সঙ্গে সংসার শুরুর পর থেকে সোমা খুব আনন্দেই ছিল। অনাথ সে, স্বামীটিও পিতৃমাতৃহরনতাই দুজনার ঘরকন্না চলছিল ভালই। সমস্যা দেখা দেয় তার অন্ত:স্বত্তা হবার তিন চার মাস পর থেকে। আমি রাত দুটোর সময়ে কথা বলে উঠলেই সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। প্রতিদিন একই স্বপ্ন। ডাক্তারের চিকিৎসায় তেমন কোন ফল পাওয়া যায়নি। বারবার বদল হয়েছে ডাক্তার। কিন্তু দু:স্বপ্ন কমেনি, বরং বেড়েছে। প্রথম দিককার কথা, তখন স্বপ্ন দেখতো দু একটি করে। এর প্রাথমিক ফল হিসেবে সোমার প্রতিক্রিয়া হল বেশ দৃষ্টিগ্রাহ্য। নিজের জগতে গুটিয়ে গেল সে। অফিসে আশফাক যাবার পর থেকে প্রচন্ড একটা আতঙ্ক ঘিরে ধরত তাকেসন্ধার দিকে ঘরে ফেরার পরেই আবার সব কিছু ঠিক। সোমার এই আচরণ কেমন যেন একটা মায়াহরিণের শিকার হবার ভয়ে সর্বদা ভীত থাকার মত যে কিনা মায়ের আশ্রয়ে নিশ্চিন্ত। দিনকে দিন পরিস্থিতি হল আরো অস্থিতিশীল, জটিল। দিনের একাকীত্ব অদ্ভুত নেশার মত গ্রাস করল তাকে রাতের বেলাতেও। প্রথমে সপ্তাহ, পরে দু একদিন পরে পরেই দু:স্বপ্ন । 
আমার মনে পড়ে যায় সেই দিনগুলির কথা। ওদের নতুন সংসারে আমি নব সংযোজন তখন। আমি যেদিকে আছি তার ঠিক উল্টো দিকে সোমা দুটো তৈলচিত্র ঝোলায়। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি ছবিগুলো। আমি মনে মনে ভাবি কি করে আকে এই ছবিগুলো? এত জীবন্ত! আজ সেই ছবি আমার কাছে আর জীবন্ত মনে হচ্ছে না। আজ বিমূর্ত চিত্রকলার নতুন মানে খুজে পেয়েছি আমি। এই ছবিটি একজন মৃত্যু ভয়ে কাতর মানুষের বেচে থাকার শেষ আর্তি টুকুর বয়ান, নিথর হয়ে যাবার আগ মুহূর্তের গোঙানি! 
সোমার ভয় দূর করার জন্য সেই স্বপ্নদর্শণের পরে আশফাক অফিসে যায়নি দুদিন। এই দুদিনে তারা ঘুরে বেড়িয়েছে পুরোনো দিনের প্রেমিক জুটির মতন। পার্কের বেঞ্চিতে বসে হাতে হাত রেখে বসেছিল অনেকটা ক্ষণ। পুরোনো দিনের রোমান্সের স্বাদ দেবার জন্যেই লোকের অগোচরে আশফাক নিজের অধর স্থাপন করে বিষণ্ন সোমার উষ্ণতা হারানো ঠোটে। তাদের ক্ষণিক মিলনের সবুজ করুণ খেলায় কিছুক্ষণের মধ্যেই হারানো হাসি ফিরে আসে তার ঠোটে। ঘরে এসে এই কথা বলবার সময়ও সল্লজ ছিল সোমার মুখ । 
সেই ঠোটে এখন আর কোন আকর্ষণ নেই, থাকতে পারে না। মৃত নিথর সোমার লাল ঠোট দুটোতে বিষ ঢেলে দিয়ে অন্তিম সুখ নিয়েছে খুনিটা। মুখে কয়েকটা কামড়, আরো অসংখ্য আচড়ের দাগ। পারলে বোধহয় কাচা খেয়ে নিত। চাকু দিয়ে কেটে নিয়েছে তার সুপুষ্ট স্তন দুটো। কি বীভৎস! মানুষ এত নোংরা হয় আমার জানা ছিল না। আজ সত্যিই অনেক জানলাম, অনেক শিখলাম। তবে এত বেশি আমিতো শিখতে চাইনি! আমার ঈশ্বরের জাতি আমার সামনেই এমন পাপাচারে লিপ্ত হবে আমি কোন দিন ভাবিনি, ভাবতে পারিনি । 

মেঝের দিকে চোখ পড়ে আমার। হায় বোকা আব্দুল! পারলে না তুমি সোমার বিশ্বাস অর্জন করতে। দিন পনের আগে কেন ঢুকেছিলে শোবার ঘরে? আমাকে বাক্য দিতে, মুখে কথা বলার শক্তি, আমার চলনের চাবিকাঠিটা তুলে দিতে? সেদিনের সেই ভুলের মাশুল তুমি দিলে আজকের মৃত্যু দিয়ে। তুমি নিজে হারিয়েছ এ বাড়ির বাবুর্চির পদ, এই সরকারি কোয়ার্টারে ঢোকার প্রবেশাধিকার আর তরান্বিত করেছ নিজের মৃত্যুক্ষণ। কি ভীষণ দুর্ভাগ্য বয়ে নিয়ে এসেছিলে তুমি? হায় আব্দুল । 
সোমার রাগত ভঙ্গি এখনো মনে পড়েআব্দুলকে সে কখনোই পছন্দ করেনি। আব্দুলের রান্না আশফাকের পছন্দ বলেই কখনো কিছু বলেনি তাকে। অনাবশ্যক ছোক ছোক, খাজুরে আলাপ করতে আসা- এসবই তাকে অপ্রিয় ছিল তার। আর এই ঘটনার পরে আব্দুলকে বদলি করা হল পাশের বাড়িতে। আর আব্দুলের বিদায় বাগানের মালির জন্য হল শাপেবর। এমনিতেই সোমা তাকে পছন্দ করত কম কথা বলার স্বভাবের কারণে । প্রায় সকালেই ফুল দিয়ে যেত মালি বাহারউদ্দিন। সংসার ছিল না বাহারের। বিয়ে যাও করেছিল, বউ মরেছে অনেক আগেই। তবে এখন আমার সন্দেহ বউ কি সত্যিই মরেছিল? না কি সে মেরেছিল? কেউ জানে না। তবে নিরাসক্ত নির্বিকার ভাব ধরার অভিনয় করেছিল সে চমৎকার ভাবে। সে নিপুন অভিনয় দিয়ে জয় করে নিয়েছে সোমার মন ওর দিয়ে যাওয়া ফুল সাজাত বসার ঘর থেকে শুরু করে শোবার ঘরটুকু। স্নিগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে বাহার উদ্দিন বশ করেছিল তার মন, হিংস্রতার মরণ কামড় দেবার জন্যে। প্রথম প্রথম ফুল দিয়েই চলে যেত সে। দিনে দিনে অবস্থিতি বেড়ে গেল। ফুল দিতে এসে এ কথা, সে কথা তুলত সে। অবশ্য গত কিছু দিন থেকে সোমার শরীর মন খারাপ যাবার কারণে এতে ভাটা পড়েছিল। গত দুদিন সে কাজে যোগ দেয়নি। কাউকে কোন খবর না দিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। কোথায় ছিল কেউ তা জানে না । আজ ফিরে আসে সে, চরমতম আক্রোশ চরিতার্থ করতে । 

                        
সকাল আটটা। পাশের বাড়ির কেউ এখনো টের পায়নি খুনের কথা। অবশ্য পাবেই বা কি করে? এত দূরে দূরে কোয়ার্টার গুলো, রীতিমত বাংলো। তাই কখন পুলিশ আসবে, কখন এই দু:স্বপ্নের সমাপ্তি হবে, আমি জানি না। আশফাকের কথা ভেবে খুব কষ্ট হচ্ছে। বেচারা, তুমি তোমার সন্তানের, স্ত্রীর নিরাপত্তার কথা ভেবে রেখে গেলে তাকে, কিন্তু কি হল ? গতকাল আশফাক ঢাকা যায় অফিসের কাজে। কাল রাতে সোমার খুব ভাল ঘুম হয়েছিল নতুন ডাক্তারের চিকিৎসায়। তাই সকালে উঠে সে বলেছিলে আশফাকের সাথে সেও যেতে চায়। রাতের বেলা, এত বড় দোতলা বাড়িতে একা একা, তার জন্যে অস্বস্তির। কিন্তু অদ্ভুত শব্দের হাসি শোনা, দমবন্ধ ভাব কিংবা মৃত্যু সঙ্কেত সব তুচ্ছ করে দিল আশফাক। কিচ্ছু হবে নাএই চিরকালীন সান্তনার বানী দিয়ে গেল চলে। তার স্ত্রীকে সে চিরতরে হারাবে কি না, সে ভাবনা তার ছিল না। অবশ্য আমিও ভাবতে পারি নি এমন কিছু হবে। হায় দু:স্বপ্নের রাত !
রাত্রি এগারোটায় দুটো কড়া ঘুমের অষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ে। বোধ করি আব্দুল কিছু টের পেয়েছিল বাহারউদ্দিনের গতিবিধি। সে ছিল বাড়ির দরজার ধারে। বাধা দেয়ার শব্দ, আব্দুলের প্রতিরোধ টের পাচ্ছিলাম ভেতর থেকেই। কিন্তু সোমা ছিল গভীর তৃপ্তির শেষ জাগতিক ঘুমে। এমন করে ঘুমুতে দেখিনি অনেক দিন। কি আশ্চর্য, ক মিনিট পরেই যার ঘুম হবে সর্বশেষ, যখন আর জেগে উঠতে হবে না, তাকে এমন ঘুম মানায়? আমি কত চিৎকার করেছি কিন্তু সে শুনতে পায়নি। আমার জীবনচালিকা ছিল না, ছিল না কোন উপায়। আমি লাফিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে ছাড়েনি মহাকালের মত স্থানু হয়ে থাকা ধূসর দেয়ালটা। মূঢ় আমি কেদে গেছি অনবরত। কিন্তু আমার কোন ল্যাক্রিমাল গ্রন্থি নেই তাই দেখা যায়নি আমার চক্ষু জল। 

হঠাৎ দরজায় ভীষণ আঘাত, ভেঙে গেল শোবার ঘরের প্রবেশদ্বার । অসুরের মতন শক্তি বাহারের শরীরে, সেটা কখনোই জানতে পারিনি। অবশ্য জানবার কথাও নয়। এর আগে আমি দেখিনি কখনো তাকে। সোমার দিকে এগোবার আগেই আব্দুল আবার এসে ধরে ফেলে তাকে । আব্দুলের মুখে রক্ত, ঘুষিতে ঠোট ফাটা । বোধহয় সহকর্মী বলেই তাকে মারতে চায়নি প্রথমে । এ ঘরে প্রবেশের পরেই আব্দুলকে সে শুইয়ে ফেলে লাথির আঘাতে। অন্ডকোষ বরাবর প্রচন্ড লাথি, ককিয়ে ওঠে আব্দুল। এর পরেই ছুরি বের করে খুনিটা। এফোড় ওফোড় করে চিরে দেয় আব্দুলের বড় ভুড়িটাকে। আমি আর্তনাদ করে উঠি । আব্দুলের চিৎকারে ঘুম ভাঙে মৃত্যুর ডাক এসে যাওয়া সোমার । বিহ্বল সোমার কিছু বুঝে ওঠার আগেই কণ্ঠনালী চেপে ধরে অসভ্য, বর্বর লম্পটট । কয়েক মিনিটেই নেতিয়ে পরে এসে। এর পরে মৃতের চরিত্রহরণ আমায় হতবাক করে দেয় । আমি কি করে সেসব সহ্য করলাম আমি জানি না। আমি, সামান্য একটা দেয়াল ঘড়ি! বেজে চলতে হয় মহাকালের আজ্ঞা নিয়ে জীবনকালের সবটুকু ব্যাপী। কত স্মৃতি যোগ হয় জীবনে, কিন্তু এমন অপঘাত সহ্য করে যেতে হবে এমনটা ভাবিনি। চোখ দুটো এখনো বন্ধ করে রেখেছি। জানি না আর কতক্ষণ রাখতে হবে । যাবার আগে খুনিটা নির্মম রসিকতা করে গেল আমার সাথে। খাটের পাশের টেবিলে রাখা একটা পেন্সিল ব্যাটারী পেয়ে লাগিয়ে দিয়ে গেল। ইচ্ছে করেই করে গেল, কেননা লাগাবার পরে অসভ্য কণ্ঠের হাসি আর চোখে কৌতুকের ঝিলিক দেখতে পাই। রক্ত মাখা কালো হাতটা, আমার গায়ে লাগতেই ঘিন ঘিন করে উঠল দেহ। এখনো আমার পিছনে রক্ত, সোমা আর আব্দুলের। কি হবে মৃত্যুর পরে এখন আর গান গেয়ে! আমি গাইতে চাইনা এখন আর। কিন্তু নিয়তি আমাকে বাধ্য করে। আমি মুক্তি চাই নিয়তির কাছে। সকাল নটা। আমি চিৎকার দিলাম। আজকের দিনের শেষবারের মত। দরজায় খুটখাট শব্দ! কে এল আশফাক না পুলিশ? আমি তা নিয়ে ভাবিত নই। আমি শুধু ভাবছি, যেই আসুক এ লাশ সরিয়ে নেবে । আমি খুলতে পারবো আমার বন্ধ করা চোখ দুটো ...


·