গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ২৯ জুলাই, ২০১৩

৫৬তম সংখ্যা ।।৩০শে জুলাই ২০১৩

এই সংখ্যায় ৫টি গল্প । লিখেছেন - শর্মিষ্ঠা ঘোষ, অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী, সুবীর সরকার, সীমা ব্যানার্জী রায় ও ইন্দ্রাণী সরকার ।

                    পত্রিকা পড়ুন সূচীপত্রে ক্লিক করে

শর্মিষ্ঠা ঘোষ

পুনর্জন্ম
                শতদ্রু গিয়ার বদলাল । এতক্ষণ খালি চড়াই এসেছে , হেয়ারপিন টার্নিংটার পর রাস্তা খানিক সমান । দমচেপে বসেছিল হিয়া । অলটিচুডের হেরাফেরিতে ওর কানে তালা লেগেগ্যাছে । পেছনে অখণ্ড নীরবতা , বুড়ো বুড়ি প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে যথারীতি নেই কারণে ঝগড়া করেছে । আপাতত মুখে কুলুপ । একদিক দিয়ে অবশ্য ভালই হয়েছে । গাড়িতে উঠেই বুড়ো এমন বকবকাচ্ছিল যে এরকম রাস্তায় কন্সেনট্রেট করা মুশকিল । গল্প বলতে বুড়োর ঝুলিতে সাকুল্যে খান দশেক । সেই গল্প সারাজীবনে কয়েককোটি বার শুনেছে হোলফ্যামিলি । অবশ্য প্রতিবার কথনে গল্পে খানিক মেদ জমে বুড়োর । যারা আগে শুনেছে , তারা মুখটিপে হাসে । কেউ কিন্তু ধরিয়ে দেয় না জনসমক্ষে । বোঝে বুড়োর জীবনে এখন এটুকুই রোমাঞ্চ , সেই আনন্দটুকু কেড়ে নিয়ে কি লাভ !
                সামনেই হাঁটছে কয়েকটি স্কুলপড়ুয়া । নিনির বয়সীই হবে বা । কি কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ছে একে অন্যের গায়ে । হাঁটুর ওপর স্কার্ট ভি নেক ডিপ কালারের পুলোভার , পায়ে জুতোমোজা , ফোলাফোলা টম্যাটোর মত গাল , সক্কলের পিঠে স্কুলব্যাগ , কিন্তু কি অদ্ভুত, সকলেরই বই হাতে ধরা । ওরা কি শেষ পিরিয়ডে বইখাতা না ঢুকিয়েই দৌড় মেরেছে  নাকি, ভাবছিল দিয়া । কিন্তু খানিক এগিয়ে ভুল ভাঙল । আরেকদল পোড়োকে দেখে বুঝল , এটাই এখন ইন থিং । সত্যি , সময়টা বড় দ্রুত ছেড়ে যাচ্ছে হিয়াদের , আঙ্গুল তুলে মস্করা করে বলছে , ‘ এক্কেবারে বুড়ো হয়েগ্যাছ হে !মেয়েও আজকাল প্রায় ই বলে , ‘  তুমি কিচ্ছু বোঝ না, মা ! ‘

                মেয়ের কথা মনে হতেই অন্যমনস্ক হয়ে যায় হিয়া । ভালোলাগে না একমাত্র মেয়েকে এতদূরে ফেলে রাখতে । বাড়িটা হা হা করে যেন গিলতে আসে । কিন্তু শতদ্রুর ঐ এক জেদ । মেয়েকে কনভেন্ট স্কুলে পড়াবে । নিজের বাংলা মিডিয়াম ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে ও বরাবরই কর্পোরেট মহলে কুঁকড়ে থেকেছে । বলে , ‘ জানো তো , ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে প্রথমেই জিজ্ঞেস করে কোন স্কুলে পড়েছ । যদি শোনে তথাকথিত নামী স্কুল , প্রথমেই একটা ইম্প্রেশন তৈরি হয়ে যায় । আমাদের সাথে পড়তো সুহাস , বেচারি দুর্দান্ত রেসাল্ট থাকা সত্বেও তেমন ভালো চাকরী পায় নি , স্রেফ ইন্টারভিউ তে ফ্লুয়েন্টলি ইংরেজি বলতে পারতো না বলে । ‘ হয়তো সেই হীনমন্যতা থেকেই মেয়ের ভবিষ্যৎ ভাবতে গিয়ে দিয়ার সেন্টিমেন্ট কে পাত্তা দিতে চায় নি । মাসে একবার আসে ওরা এই পাহাড়ি শহরে মেয়েকে দেখতে । সেই যাত্রায় এবার সঙ্গী হয়েছে মেয়ের ঠাকুমা ঠাকুর্দা ।

                গাড়িটা বেলা দশটার দিকে একটা ছোট্ট বাড়ি কাম রেস্তরাঁর সামনে দাঁড় করাল শতদ্রু । ‘কি তোমরা  সবাই চা টা খাবে তো ? আমার একটু রেস্ট দরকার । হাঁটু ব্যথা করছে ।‘ হিয়া পেছনে তাকাল । বাবা এক কথায় রাজী । চায়ের নেশা পেয়েছে । বাড়িতে থাকলে এসময় এককাপ লিকার চা খায় । সেই সকাল সাতটায় এককাপ করে লিকার চা আর দুটো ক্রিমক্রাকার খেয়ে রওনা দিয়েছে ওরা । অনেকক্ষণ ধরেই ছুঁচোতে ডন মারছে পেটে । মায়ের ঝুলিতে কাজু , ঝুরিভাজা , খুরমা ছিল , সেও তো কোনকালে শেষ । তাছাড়া একটা বিরতি বুড়ো বুড়ির ও দরকার । অনেকক্ষণ থম মেরে আছে । হাল্কা করা দরকার । 

                                      নামেই রেস্তোরাঁ । মোমো চাউমিন আর চা ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না । সেখানে মোমোর অর্ডার দিয়ে পাশের দোকান থেকে চিপস কিনে আনল হিয়া । বাবা চায়ের সাথে খাবে । মায়ের আবার জর্দা পানের বটুয়া বেরিয়ে গেল এই ফাঁকে । এই এক নেশা , শত বলেও ছাড়াতে পারেনি কেউ । চা খেয়েই বাবা আবার ফর্মে , গাড়িতে উঠেই শুরু করলো, ‘বুঝলি হিয়া , তখন আমি গ্যাংটকে পোস্টেড ... ।‘ মা চোখ পাকাল , ‘ এই আবার শুরু হোল । চুপকরে গাড়িটা ভালোভাবে চালাতে দাও বরং ‘। বাবা ক্ষুণ্ণস্বরে বলল , ‘ হু , আমি যেন আর গাড়ি চালাই নি কোনোদিন ! ‘,মা র ঠোঁট বেঁকে গেল, ‘সে আর আমি জানি না, তুমি কেমন কি চালাও! বেশি বারফাট্টাই মেরো না , দেব হাটে হাঁড়ি ভেঙে ‘। বাবা চুপ করে গেল গম্ভীর  মুখে ।

                দূরথেকে ফুটে উঠছে হিলটাউনের পেন্সিল স্কেচ । মেঘ জমে আছে মাথায় । ঝিরঝিরে বৃষ্টি আদর করছে রাস্তা । খোলা জানালা দিয়ে হুটহাট মেঘ ঢুকে যাচ্ছে গাড়িতে । এত আরামেও চোখ বোজার উপায় নেই । খালি মনেহয় , কি যেন মিস হয়ে যাচ্ছে । তাছাড়া প্রতি টার্নিংএ একবার ডাইনে চেপে যাচ্ছে আরোহীরা , তো একবার বাঁয়ে । তাও ঝিমোচ্ছিল মা । বাবাও চোখ বুজে আছে । জাগা না ঘুমন্ত বোঝা দায় । হঠাৎ  একঝাঁক  ছাগল আর ভেড়া রাস্তা জুড়ে হেলেদুলে পেরনো শুরু করলো । ব্রেক কষল শতদ্রু । ‘ কি হোল , কি হোল ‘ বলে ধড়ফড় করে তন্দ্রা ভেঙে গেল বাবা মার । হলুদ গামবুট পরে বিশাল রঙচঙে ছাতা মাথায় পশুদের মালিক কিম্বা রাখাল প্রাণপনে হুইসিল বাজিয়ে ওদের লাইন করানোর চেষ্টা করছিলো । মিনিট ছয় সাত আটকে রইলো ওদের গাড়ি । 

পৌঁছেই চেনা সরদারজির হোটেলে গ্যারেজ করে দিল বাবা মাকে । ওরা প্রতিমাসে একবার করে আসে বলে মোটামুটি ফিক্সড রুমই পায় । ডাবলবেড ডিলাক্স । দুটো পাশাপাশি ঘর হলনা । মা বাবা একতলায় নিল । হাঁটু ব্যথা । সিঁড়ি ভাঙতে চায় না । বাবার ইচ্ছে ছিল দোতলায় যাবার । বেটার ভিউ পাবে । মা বেঁকে বসলো । হিয়ারা নিজেদের ঘরে গিয়ে রুম সার্ভিসে খাবার অর্ডার করে দিল । চাইনিজ ফ্রায়েড রাইস  আর চিলি চিকেন । বাবা মাটন পছন্দ করে , কিন্তু হিলে মুরগীটাই চলে বেশী । মা অন্যকিছু খেতে ভয় পায় । পাছে পর্ক বা বিফ খাইয়ে দ্যায় !

                ফ্রেশ হয়ে সেন্টার টেবিলটা আর রিক্লাইনার নিয়ে খাটের উল্টোদিকে সেট করে নিল হিয়া । শতদ্রু সিগারেট আর অ্যাশট্রে নিয়ে পাশে এসে বসলো । সেখান থেকে বিরাট কাঁচের দেয়ালজোড়া পর্দা সরালেই ধূমায়িত শৃঙ্গ । খেয়ে মা বাবা একটু গড়াবে । মেয়ের কাছে যেতে যেতে তিনটে বেজে যাবে । ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠছিল হিয়া । সময় আর কাটতে চাইছেনা যেন । উঠেগিয়ে নিজেদের বড় ট্রাভেল  ব্যাগ খুলে মেয়ের জন্য আনা দিম্মার হাতে বোনা সোয়েটার আর মাফলার বের করলো । বড় এক শিশি আচারও পাঠিয়েছে দিম্মা । হিয়া মাকে বারণ করে অনেক । এই বয়সে এত বোনাবুনির কি দরকার ? চোখটা যাবে শেষ হয়ে । তা বুড়ি কথা শুনলে তো ! বলে , ‘ যতদিন পারি , না করিস না । আর কি , সময় তো হয়ে এলো ‘। হিয়ার গলার কাছে অস্বস্তি হোল , কথাটা মনে করে । সমবয়সীদের পরপর মৃত্যু মাকে দার্শনিক করে দিয়েছে । এখন যেন খালি গুছিয়ে রেখে যাচ্ছে যতটা পারা যায় । হাত বোলাল মায়া ভরে । মায়ের স্নেহাশিষ লেগে আছে এতে ।

                ‘শোন, চলো না, আমরা বেড়িয়ে পরি, নিনি কে নিয়ে চলে আসি । মা বাবা বরং কাল সকালে যাবে ওর স্কুল দেখতে, এখন বিশ্রাম করছে করুক, আমরা ফিরে এসে একসাথে বেরবো ‘, হিয়ার গলায় ব্যাগ্রতা কান এড়াল না শতদ্রুর । রাজী হয়ে গেল । দুজনে পোর্টিকো থেকে গাড়ী বের করে রওনা দিল ।

                একটু একটু করে ঠাণ্ডা বাড়ছে । মেঘ কাটে নি । বৃষ্টি নামবে মনেহচ্ছে খানিকক্ষণের মধ্যেই । হিয়ার তখন এসব খেয়াল নেই । ওর মন পড়ে আছে মেয়ের কাছে । খানিক এগোনোর পর মেঘটা যেন কালো চাদরে মুড়ে ফেললো চারদিক । ফগলাইট জ্বেলেও কিচ্ছু দ্যাখা যাচ্ছে না । শতদ্রু ভয় পেয়ে গেল । পারবে না আর এভাবে গাড়ি চালাতে , খুব পাকা ড্রাইভারও পারবে কিনা সন্দেহ । উল্টোদিক থেকে বেশ খানিকক্ষণ কোন গাড়ি আসে নি । বুঝতে পারছে না কি করা উচিৎ । হিয়ারও হুঁশ ফিরেছে ততক্ষণে । কয়েকবার আড়চোখে তাকিয়েছে শতদ্রুর দিকে । ওর কপালেও গভীর ভাঁজ । শতদ্রু খুব রাফ অ্যান্ড টাফ । সহজে ভয় পাবে না । সেই শতদ্রুর অবস্থা দেখে হিয়া কাঠ হয়ে গ্যাছে ভয়ে । শতদ্রুর থাইয়ের ওপর শক্ত হয়ে চেপে বসেছে ওর আঙুল । দেখতে দেখতেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল । পাহাড়ে বৃষ্টি ওরা প্রথম দেখছে না । কিন্তু এমন বৃষ্টি এই প্রথম । মনে হচ্ছে জগতসংসার ভেঙ্গে পড়েছে । গুমগুম শব্দ শোনা যাচ্ছে , কোথাও পাথর নামছে গড়িয়ে । ওদের মাথার ওপর নয়তো ? ঠিকঠাক কিচ্ছু ভাবার অবস্থায় নেই  শতদ্রু ।  মেয়েটা নিরাপদ আছে তো ? হা ভগবান ! মা বাবা যে কি করছে !  মোবাইলটার টাওয়ার চলে গ্যাছে । হিয়ার ঠোঁট কাঁপছে । ওর সামনে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না , শতদ্রু হিয়ার মাথাটা বুকে টেনে নিল । হু হু করে কেঁদে উঠলো হিয়া । শতদ্রু অভাগা , কাঁদতেও পারছে না । গাড়িটা একটা খেলনার মতো রাস্তার পাশে দাঁড় করানো । ভয় হচ্ছে , যে কোন মুহূর্তে ওপর থেকে ধ্বস নেমে আসবে । খুব কাছেই রাস্তা বসে গ্যাছে । বন্যার স্রোতের মত জল যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে । গাড়ির কাঁচ তোলা । ময়েসচার জমছে । দৃষ্টি ঘষা ঘষা । অস্পষ্ট লাগছে বাইরের তাণ্ডব । ‘ গুরুদেবকে ডাকো হিয়া ‘, শতদ্রু এটুকু উচ্চারণ করতে পারলো অনেক কষ্টে । ও কিছু দেখবে না , যা হয় হোক । চোখ বুজে ফেললো শতদ্রু । কতক্ষণ হোল কে  জানে ! মনে হচ্ছে আজই বুঝি পৃথিবীর শেষ । যদি মরেই যায় আজ ওরা দুজন এইভাবে রাস্তার ওপর , ওদের বডিও বোধহয় খুঁজে পাবে না কেউ কোনোদিন । মা বাবাকে বলেও আসা হয় নি । খুব চিন্তা করবে । ওদের যেন কোন ক্ষতি না হয় । মা বাবা যেন নিনিকে নিয়ে নিরাপদে থাকে ! নাস্তিক শতদ্রু হঠাৎ ফিল করলো , আস্তিকরা কত ভাগ্যবান , তারা নির্ভর করার মত , দোষারোপ করার মত একটা অবলম্বন তো পায় অন্তত !  
                হোটেলের ঘরে ঘুম থেকে উঠেই ভ্রু কুঁচকে গ্যাছে বাবার । মায়ের ঘুম তখনো ভাঙ্গেনি । মোবাইলটা একটা প্রস্তরযুগের ভোঁতা অস্ত্রের মত অচল হয়ে পড়েআছে । বাবা ওপরে গিয়ে দ্যাখে ছেলে বৌমার ঘরে তালা , রিসেপশান থেকে জানালো ওরা অনেকক্ষণ আগেই বেরিয়েছে , গাড়িটাও নেই । কপাল কুঁচকে গেলো বাবার । সর্দারজী নেই । একটা বাঙালী ছেলে ম্যানেজারি করছে । ও বল্ল , পাহাড়ে অসময়ের বৃষ্টি এটা । লক্ষণ ভালো না । ঘড়ির কাঁটা ছটা ছুঁতে চলেছে । কোন খবর নেই । নাতনির স্কুলের কি খবর কে জানে । হিয়ারা কি ওখানেই আটকে আছে ? কদিন আগেই উত্তরাখণ্ডের খবরে নড়ে গ্যাছে দেশ । মানুষের লোভে মানুষ মরছে । কেদারনাথ মন্দিরে থরে থরে পড়েছিল মৃতদেহ আর টাকার বান্ডিল । রামওয়ারা গ্রামটার কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় নি । পেপারে ছবি দিত । ডুলি শুদ্ধ ভেসে গ্যাছে তীর্থযাত্রী । পায়ে  নাইকের স্নিকার , গায়ে উডল্যান্ড জ্যাকেট , নিষ্প্রাণ দেহ , মুখ থুবড়ে পড়ে আছে পাথরের ওপর । খানিক আগেও যেখানে থরে থরে দোকানপাট গমগম করছিলো ক্রেতা বিক্রেতার ভিড়ে জাস্ট ভোজবাজির মতো উবে গ্যাছে । মাথা কাজ করছে না , সামনে চায়ের কাপ জুড়িয়ে জল । ঘরে যেতে সাহস হচ্ছে না , শতদ্রুর মাকে ফেস করার ক্ষমতা নেই , হাঁটুতে জোর নেই উঠে দাঁড়ানোর । নিশ্চল বসে আছে বাবা , মোমের আলোয় ভুতের মতো । কারেন্ট নেই বিকেল থেকেই । জেনারেটার খরচ করতে চাইছে না মালিক । এই দুর্যোগ কতক্ষণ থাকবে কে জানে ।     


নিনিদের মিশনস্কুলটা একটা পাহাড়ের মাথায় চ্যাপ্তা থালার মত জমির ওপর । আসেপাশে উঁচু ভূমিরূপ নেই । ফলে ওপর থেকে বড়পাথর গড়িয়ে নামার ভয় নেই । তবে পাহাড় বড় খামখেয়ালী । কে বলতে পারে ধ্বস নেমে গোটা স্কুলবিল্ডিংটাই হুরমুরিয়ে নেমে আসবে না ! সিস্টার সিরিল সব বাচ্চাদের প্রেয়াররুমে জড় করেছেন । যিশুবাবার সামনে কাঁপাকাঁপা মোমের আলোয় ওরা দেখতে পাচ্ছে , হাঁটু মুড়ে বসে চোখ বুজে প্রার্থনা করছেন সিস্টার । গোটা হলে পিনড্রপ সাইলেন্স । সিস্টারের দুই গালে জলের ধারা । একদম বাচ্চারা এক কোণে জড়সড় হয়ে আছে । অন্য সিস্টাররা দু হাত দিয়ে ওদের বুকে আগলে রেখেছেন । যেমন করে পাখির ছানাদের ডানা মেলে আগলায় পাখির মা বাবা । ফোঁপাচ্ছে কেউ কেউ । হাতে ধরা সফট টয় বা খেলনা গাড়ি । নিনি পারছে না প্রার্থনায় মন দিতে । মা ফোন করেছিল সকালে । বলল , ‘ আসছি , সারপ্রাইজ আছে ‘। মা রা কোথায় এখন ? ওহ গড ! গলার কাছে পাথর চাপিয়ে দিয়েছে কেউ । খেয়াল করে নি কখন পাশে এসে বসেছে শিম্বা । ওদের কথা বন্ধ আজ দিন সাতেক । ফালতু ক্যাচাল করে শিম্বা ওকে সেদিন বকা খাইয়েছিল । একবারও স্যরি বলে নি । থাক , নিনিও দেখবে , কদিন পারে কথা না বলে থাকতে । হুহ , এই নাকি বেস্ট ফ্রেন্ডের নমুনা ! নেহাত মা বাবা নেই বলে শিম্বাকে এত বেশিবেশি পাত্তা দিত এতদিন । সেই শিম্বা নিনির গা ঘেঁষে বসে আছে । নিনির হাত অজান্তেই আঁকড়ে ধরল শিম্বার বরফ ঠাণ্ডা হাত । শিম্বা আরেক হাতে চাপ দিল ওর হাতে , চকচকে চোখে অনেক অভিব্যক্তি , যেন বলছে , ‘ এভ্রিথিং উইল বি ওকে ‘
                সর্দারজী ঝিমোতে ঝিমোতে সোফা থেকে প্রায় গড়িয়ে পড়ার মুখে বাবা ধরে ফেলল । সারারাত ঘুম হয় নি কারো । গোটা হোটেলের বোর্ডাররা রিসেপশানে এসে বসে আছে । উৎকণ্ঠায় , ভয়ে যে যার মাতৃভাষায়  সারারাত  আরাধ্যকে স্মরণ করে গ্যাছে । তবে তারা একদিক থেকে বাবার চেয়ে লাকি । তাদের ছেলে বউমা নাতনি এই ভাবে দুর্যোগের মধ্যে বাইরে পড়ে নেই । তারা সপরিবারে আছে এক ছাদের তলায় , একসাথে ভাগ করে নিচ্ছে উৎকণ্ঠার প্রহর । যা হবে , সকলের একসঙ্গে হবে । এককালের দুঁদে প্রশাসনিক অফিসার , সারাজীবন লোক চরিয়ে খাওয়া বাবা হঠাৎ বুঝতে পারলো হোটেলের ঐ বয়টার সাথে বাবার কোন তফাৎ নেই আদপেই । যতই ছড়ি থাকনা কেন হাতে , যতই লম্বা ল্যাজ থাক না কেন , এই মুহূর্তে কারুর কিস্যু করার নেই , বসে বসে দ্যাখা ছাড়া !

তখন ফ্যাকাসে আলো ফুটতে শুরু করেছে । বৃষ্টি ধরেছে সবে । বাবা বেড়িয়ে এলো হোটেল থেকে । ‘দাঁড়ান বোসবাবু , আমিও যাবো আপনার সাথে ‘, বলে পাণ্ডেসাহেব এগিয়ে এলেন । পেছনপেছন আরও অনেকে । একরাত্তিরে কে যেন এক সুতোয় গেঁথে দিয়েছে গোটা ভারতবর্ষ । হোটেলথেকে কেউ কেউ চেয়ে এনেছে বেলচা , শাবল । কি কাজে লাগবে কে জানে । মাকে নাড়ানো যায় নি । সেই যে ধ্যানে বসে আছে তো আছেই । মায়ের পাশেও একটা মোবাইল রেখে এসেছে বাবা । ওটা এয়ারটেলের । কে জানে কোন নেটওয়ার্ক আগে প্রাণ ফিরে পাবে । নিনির স্কুলের রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে দলটা । প্রায় মাইলদুয়েক যেতে হবে খাড়াই । বাবার হাঁপ ধরছে কয়েকপা হাঁটলেই । মনেহচ্ছে কলজে ফেটে যাবে । হাঁ করে শ্বাস টানছিল । প্যাটেল বলল , ‘  ট্রাই টু কিপ ইওর মাউথ সাট , আঙ্কেল , আদারওয়াইস উ উইল গেট টায়ার্ড সুন ‘। ছেলেটা শতদ্রুর বয়সীই হবে হয়তো । বাবার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে উঠলো । ‘ বাবা ‘ ডাকটা আর কোনোদিন শুনতে পাবে তো ? একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল বাবা , সম্বিৎ ফিরল কার যেন সোল্লাশ চিৎকারে । এখানে মোবাইলের টাওয়ার দেখা যাচ্ছে বি এস এন এল এর । সবাই যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে লাগলো লোকাল পুলিশফাঁড়িতে । কেউ কেউ সাজেশান দিল প্রশাসনিক ভবনে ফোন করার । তবেই সঠিক তথ্য জানা যাবে । কি অবস্থা শহরের । পথঘাট কি কনডিশানে আছে । কোথায় কোথায় ধ্বস নামলো । ক্যাসুয়ালটি হলে তা কত । রেস্কিউ টিম কতদূরে । একেকজনের একেকরকম  জিজ্ঞাসা । দুএকজন শতদ্রুদের ফোন নাম্বার চেয়ে নিল । ট্রাই করবে । সর্দারজি ডিরেক্টরি ঘেঁটে নিনির স্কুলের ফোন নাম্বারটা নিয়ে এসেছিলেন । তিনি সেখানে ফোন করে জানালেন , নিরাপদেই আছে বাচ্চারা ।  তবে শতদ্রু কিম্বা হিয়া ওখানে নেই । পায়ের নীচে মনেহল ভুমিকম্প হচ্ছে বাবার । কেউ একজন ধরে ফেলল পড়ার আগেই। ফ্লাস্ক খুলে ব্রাণ্ডি বাড়িয়ে দিলেন নেন্নে সাহেব । মুখে চোখে জল দিলো কেউ একজন । রাস্তার ধারে পাঁজাকোলা করে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিল বাবাকে । তখনি বুক পকেটে বাবার মোবাইল বেজে উঠলো । ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন মোবাইলটা বের করে আনল বাবার পকেট থেকে । নীল টেলিফোনের সিম্বল ভেসে উঠেছে পর্দায় , ‘ হিয়া কলিং ... ‘    



সুবীর সরকার

আদিতমারির বাঘ


তারপর সেই ডোরাকাটা বাঘ হাতিনালার জঙ্গল পেরিয়ে ৭/৮ নদি টপকে এক মোরগডাকা ভোরের অমলিনতায় গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে একসময় উঠেই এল আদিতমারির লাল সুরকির রাস্তায় । খুবই নিঃশব্দে ঘটনাটি ঘটলো,ঘটে গেল । একসময় আলো ছড়ালো আদিতমারির আকাশে । ১৮ হাতির হরিকান্ত দেওনিয়ার ঘুম ভাঙলো । শীত এখন মধ্যপর্বে।হরিকান্ত দেওনিয়া হরিকান্ত জোতদার কাল অধিক রাত পর্যন্ত বাউরা বাজারের কুশাণয়াত্রার আসরে ইয়ারবক্সি পরিবৃত হয়ে বেশ রসেবসে গাননাচ পানাহার আমোদে বেশ রসস্থ হয়ে প্রায় ভোররাতে বাড়ি ফিরেছিল । ঘুমটাও হল না সেইমত । আজ সারাদিন ছেঁড়াখোঁড়া টুলুং ভুলুং নাওয়ের মতন কাটবে । এদিকে বিকেল পেরোলে যেতে হবে হাতিবান্ধা কাছারিতে খাজনা আদায়ে । দেওনিয়া ঘুম ভাঙলেও পালঙ্ক ছাড়লো না । পুর্নবার পাশ ফিরে আবারো টেনে নিল মোলায়েম কাঁথাখানি । তন্দ্রার ভিতর দেওনিয়ার আবছায়া চোখের সামনে লক্ষীরাণী পুটিরাণীর চিক্কণ মুখগুলি।


কত পুরনো সব দিনকালপর্ব পেরিয়ে হাটবাজার গানবাজনার বর্ণময়তায় নিমজ্জিত হতে হতে ভেসে বেড়ানো স্মৃতিটুকরোর কোলাজে মহামহিম পুরাকালের ধ্বনিময়তাই বুঝি ফিরে আসতে থাকে । গল্পহীন মানুষেরাই বুঁনে চলেন একটানা গল্পের ভুবনমায়া । তখন সময়টাই কালপর্বটুকুই মুল গায়ক । মুখ্য চরিত্র হয়ে দেশাচার লোকলোত্তরে আবেষ্টিত হতে থাকে।হরিকান্ত দেওনিয়ার আদিপুরুষ ধনিকান্ত দেওনিয়ার কাকিন্যার রাজার পাটহাতির অকালমরণদৃশ্যে শোকগ্রস্থ হওয়ার দৃশ্যমুহূর্ত ফ্রেমবন্দি হয়ে পড়লেও সময়পর্বকে অতিবৃহৎ এক আবহমানতাই এনে দেয় বুঝি।তখন দুরেকাছের সব জোতজমি বনজঙ্গল ঝাড়ঝোপ যেন হামলে পড়ে লাটসাহেবের মোটরগাড়ি লালজিরাজার হাতি খানবাহাদুরের জোড়া ফিটন ছোটরানীর পালকি বিলকান্দির বিল তিস্তাচরের কাশিয়ার ফুল । সময়ের ভিতর তবে কি উদাসীনতাই এনে দেয় সময়।এতকিছুর ফাঁকে আজার বেটির গান ভেসে যায় গদাধরের পারে পারে_ নাল শাড়ি নে রে ময়না /নাল শাড়ি নে/মোটরগাড়ি চড়বে ময়না/নাল শাড়ী নে...


নিন্দের আলিসে দেওনিয়ার শরীরে কম্পন জাগে নাকের ফুটো দিয়ে আদ্ভুত শব্দ বেরোয়।দেওনিয়ার অর্ধচেতনে তখন মনোরম সব দৃশ্যখণ্ড নুড়িভাসা জলে যেন ভেসে যাওয়া। কমলারানী ফুলুরানি হরিমতি সবাই গতজন্মের ওপার থেকে হাওয়ার ডানায় ভর দিয়ে নেমে আসে বর্তমানের মরপৃথিবীতে।পদমতির চরে জোতদখলের সেই রক্তারক্তি লড়াই । দেওনিয়ার হাত মাখামাখি খলিল পাইকারের লাশের টাটকা রক্তে । জোতজমি জোতজমির মত নিস্পন্দ পড়ে থাকে । দেওনিয়া হাতির হাউদায় বসে বড়খুটার বনাঞ্চলে পাখিশিকারে যায় ।


এইভাবে কালখণ্ডের খোঁদলে ইতিহাসবাহিত হতে হতে দেওনিয়া জাগতে না চাওয়ার প্রাবল্যেই বুঝি বা আরো আরো ঘুমের আলিসায় ডুবে যেতে থাকে।আদিতমারির লাল সুরকির রাস্তায় গর্বিত ভঙ্গিতে তখন হাঁটতে থাকে হাতীনালার জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা সেই ডোরাকাটা বাঘ।