পাখি’দি
কলেজে সবে
নতুন বছরের ক্লাস শুরু হয়েছে। আমরা ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্ররা বেশ ভয়ে থাকি সব সময়।
ছয় সাতজন একসাথে দল বেঁধে চলি। সিনিয়রদের কাছ থেকে পারত দূরে থাকি। র্যাগিঙ্গের
ভয়ে। প্রথম তিন মাস এভাবেই নাকি র্যাগিং চলে ফি বছর। তার উপর ভিন দেশ থেকে আসা
আমরা ক’জন তরুন। ঠিক এই সময়টাতে শিবুদার সাথে
আমাদের পরিচয় ফোন করতে গিয়ে।
আমাদের অবসর সময়টা কাটতো শিবুদার
সাথে আড্ডা দিয়েই। আমাদের হোস্টেলে আসতো প্রতিদিন বিকেলে। শিবুদা ছাড়া যে আড্ডা
ঠিকমত জমতো না তা বেশ কয়বারই টের পেয়েছি। রহস্যময় শিবুদাকে নিয়ে আমাদের জানার ছিল
ব্যাপক আগ্রহ। বিশেষ করে তার কাজ কম্ম নিয়ে আমাদের উৎসাহের কমতি ছিল না। শিবুদার
সাথে যখন প্রথম পরিচয় হয় তখন আমাদের কারোরই মোবাইল ছিল না। আমরা যে হোস্টেলে
থাকতাম সেখানে একটা ল্যান্ড ফোন ছিল কিন্তু আইএসডি কল করা যেত না। ফলে পাশের
টেলিফোনের দোকানই একমাত্র ভরসা। দোকানটা চালাতো শিবুদা। একপাশে শিবুদা পাঁচ ছটা
ফোন আগলে আর অন্যপাশে সুন্দরী পাখিদির আয়ত্তে ছিল কসমেটিকস সামগ্রী। শিবুদা আর
পাখিদির মাঝে কথাবার্তা খুব একটা হতে দেখিনি। দু’জন যার যার
কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। এই নিয়েও আমাদের মাঝে একটা অন্যরকম উৎসুকতা ছিল। আসলে
শিবুদার চেয়ে পাখিদিই আমাদের বেশি টানতো। শিবুদা যেদিন আসতো না দোকানে সেদিন
পাখিদি বসতো টেলিফোন বুথে। দুটোই কি চমৎকারভাবে চালাতো পাখিদি! মাঝে মাঝে আমি
পাখিদির সাথে গল্প করতে দোকানে যেতাম। কথায় কথায় অনেক কিছুই জেনেছি। আমার আজকের
গল্প পাখিদিকে ঘিরেই।
পঁয়ত্রিশোর্ধ্ব শিবুদা কেন যে আজো বিয়ে’থা করেনি এ এক মূর্তমান রহস্য আমাদের কাছে। নাকের নিচে
মোটা গোঁফের কারনে চেহেরায় একটা জাঁদরেল পুরুষালি ভাব ছিল। শিবুদার বাড়িটা ছিল
হোস্টেল থেকে পায়ে হেঁটে কুড়ি মিনিটের পথ। আমাদের কোন দরকার পড়লেই চলে যেতাম তার
বাড়িতে। মস্ত বড় একটা এলসেশিয়ান ছিল তার। বাসায় ছাড়া থাকলে কারো সাহস নেই সামনে
যাওয়ার। প্রথম প্রথম আমাদের দেখলেই তেড়ে আসতো। অনেকবার দেখেছে আমাদেরকে তাই বোধয়
শেষের দিকে আর তেমন উৎপাত করতো না। শিবুদা লেখাপড়া করেনি খুব একটা, আমরা অনেকবার চেষ্টা করেছি জানার কিন্তু পারিনি। তবে
শিবুদা সারা এলাকায় বেশ পরিচিত ছিল একটা কারনে। ডোমের কাজ করে শিবুদা। তাকে এক
নামে চিনে সবাই। এই কাজের জন্য রাত দুপুরে শিবুদার স্মরনাপন্ন হতে হয় অনেককেই।
শিবুদা যে জীবিকার জন্য এ কাজটা করে তা কিন্তু না। কারন পদবী শুনলেই যে কেউ বুঝবে
এটা তার নেহায়েত নেশা। পদবীতে মুখোপাধ্যায়, পুরুদস্তুর
ব্রাহ্মণের ছেলে। সারা রাত মরা পুড়িয়ে প্রায়শ সকালে এসে হাজির হতো আমাদের
হোস্টেলে। স্বামী পরিত্যাক্তা বড় বোন তার ছোট দু’খানা পুচকে
ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকতো তাদের বাসায়। এলসেশিয়ান আর ভাগ্না-ভাগ্নিদের দাপাদাপিতে সজাগ
মানুষই টিকতে পারতো না, ঘুমানো তো
দুরের কথা। প্রতিদিন আটটা নাগাদ আমরা চলে যেতাম কলেজে। যাবার সময় দারোয়ান শ্যামলের
কাছে চাবি দিয়ে যেতাম। শিবুদা নিশ্চিন্তে ঘুমাতো দুপুর নাগাদ। কোনদিন আমরা ফিরে
এসে তাকে পেতাম আবার কোনদিন পেতাম না। বিকালে ঠিক এসে হাজির হত। কিভাবে মরা পুড়িয়েছে, হঠাৎ মরা মানুষ কিভাবে উঠে বসে যেত এই সব কাহিনী চলতো ঢের
রাত পর্যন্ত। শিবুদার মুখেই শোনা, একশটা মরা
পুরালে নাকি বিশেষ পুণ্যি হয়। তাই সে পুণ্যি লাভের আশায় একের পর এক মরা পুড়িয়ে
যাচ্ছে। শতখানা হতে আরও নটা বাকি।
যারা কল্যাণী শহরে গিয়েছেন তারা বুদ্ধপার্ক
জায়গাটা ভালো করেই
চেনেন। একটা বিশাল বটগাছ ঘিরে কিছু দোকানপাট, রমরমা
চারদিক। একপাশে বাসস্ট্যান্ড, সাথে
কয়েকটা গ্যারেজ। চারদিক থেকে এসে চারটি রাস্তা মিলেছে এক যায়গাতে। আর এই
বুদ্ধপার্ক থেকে যে রাস্তাটা কল্যাণী সেন্ট্রাল পার্কের দিকে গিয়েছে তার গোঁড়ার
শুরুতে বাঁদিকে দশ বারোটা পাকা দোকান পরপর। এ থেকে একটু এগিয়ে আমাদের সোনারতরী
হোস্টেল।
শ্যাম বর্ণের ছোটখাট গড়নের অসম্ভব মায়াময়ী
চেহারার পাখিদিকে দেখতাম গোলাপি রঙের একটা লেডিস সাইকেল চালিয়ে এসে প্রতিদিন আটটার
দিকে দোকান খুলতো। নিত্যদিন একই শাড়ি পড়ে আসতো দোকানে। অফ হোয়াইট কালারের লাল পাড়।
মাঝে মঝে অবশ্য ব্যতিক্রমও হতো। আর সেদিনই দেখতাম পাখিদি সাইকেল রেখে বুদ্ধপার্ক
থেকে কোলকাতাগামী বাসে উঠতো। ফিরতো সন্ধ্যে বেলায়। ঐ দিন শিবুদা সব কিছু সামাল
দিতো। এ নিয়ে অবশ্য কখনো পাখিদি বা শিবুদাকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি আমরা। আসল ঘটনা
জেনেছি অনেক পরে।
একদিন বেশ সকালে শিবুদা ঢুকলো আমাদের হোস্টেলে। আমরা তৈরি
হচ্ছি কলেজে যাবার জন্যে। কলেজ বাস হোস্টেলের সামনে দাঁড়ানো। ঢুকেই আমাকে বলল,
-মুন্না, তোর রুমের
চাবিটা দিয়ে যাস তো শ্যামলের কাছে? বাসা থেকে
ফ্রেশ হয়ে এসে ঘুমোব।
আরও বলল,
-অনেক আগে
পাখিকে নিয়ে একটা ঝামেলা বাঁধিয়েছিল ওর শ্বশুর বাড়ির লোকজন। আজ কয়েকজন মানুষ আসবে
এখানে। ওটার একটা দফা রফা হবে আজ। শ্যামলকে বলবি রোমটা একটু ঘুচিয়ে রাখতে।
আমি যথারীতি চাবিটা
শ্যামলকে দিয়ে কলেজে চলে গেলাম। সেদিন ভালো লাগছিলোনা বলে একটার দিকে চলে আসলাম। হোস্টেলের
সামনে এসে বাইরে থেকে পাখিদির গোলাপি সাইকেল আর শিবুদার বাইকটা দেখতে পেলাম
বারান্দায়। শ্যামলকে কোথাও চোখে পড়লো না। গেইটের কড়া নাড়তেই পাখিদি এসে লক খুলে
দিল। সদ্য স্নান করা পাখিদিকে দেখে আমি কিছুটা ভড়কে গেলাম। শিবুদার কথা জিজ্ঞেস
করতেই আমাকে বলল,
-শিবু তোর
রোমে ঘুমোচ্ছে। অন্য সবার কথা জিজ্ঞেস করতেই পাখিদি একটু অবাক হবার ভান করে পরক্ষণেই
মুচকি হেসে বলল,
-ওরা একটু আগে চলে গেছে। বলেই পখিদি সাইকেলটা বের করে আমাকে বলল,
-তোর শিবুদা
জাগলে বলিস আমি চলে গেছি।
আমি হ্যাঁ সুচক ঘাড় নাড়ালাম। পাখিদি যতক্ষণ না চোখের আড়াল হল, চেয়ে রইলাম। এমনিতেই পাখিদিকে দেখে চোখ সরতো না আমাদের।
আর আজ ভেজা চুলের পাখিদিকে সাক্ষাৎ যেন দেবী লাগছে।
ততদিনে আমরা দ্বিতীয় বর্ষে। কর্তৃপক্ষ
কলেজের পাশে বিশাল হোস্টেল করেছে দু’খানা।
ওখানে আমরা শিফট হব নেক্সট সপ্তাহে। দেখা করতে গেলাম পাখিদির সাথে। সেদিন শিবুদা
দোকানে আসে নি। পাখিদি একা বসে আছে। বিমর্ষ দেখাচ্ছে তাকে। আমাকে দেখে একটু হাসার
চেষ্টা করলো। সামনে বসে দু’একটা কথা
বলার পরই হঠাৎ আমার ডান হাতটা চেপে ধরে বলল,
-আজকে আমি তোকে একটা কথা বলব, ভাই। এখানে
কাউকে কোন দিন বলতে পারবিনা। তোর দেশে গিয়ে যাকে খুশি, যত খুশি বলিস। প্রমিজ কর।
আমি কথা দিলাম।
পাখিদি বলতে লাগলো,
-আমি খুব সাধারন ঘরের মেয়ে। আজ থেকে প্রায় আট বছর আগে শিবুর সাথে
পরিচয়। তখন এখানে কাজ নিয়েছি। একসাথে পাশাপাশি বসি। একটু আধটু কথা হয়। একসময়
অনেকটা মিশে যাই আমরা। এর বছর দুয়েক পর একদিন আমাকে সে তার ভালবাসার কথা জানায়।
ততদিনে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে অন্য যায়গাতে। শিবু বিয়েটা ভেঙে দিতে বলে। আমি রাজি
হইনি। আমি বেঁকে বসলে বাবার সন্মানে আঘাত লাগবে। তাছাড়া যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে
তার পরিবারের কাছে আমরা নানাভাবে ঋণী। তাই আমি শিবুকে ফিরিয়ে দেই। কিন্তু তার
ভালবাসাকে ফেরাতে পারিনি। মুছে ফেলতে পারি নি হৃদয় থেকে। বিয়ের পর আমি এখানকার
চাকরিটাও ছেড়ে দেই। কিছুদিন যেতে না যেতেই আমার বর শিবুর সাথে সম্পর্কের কথা জানতে
পারে। মানুষিক, শারীরিক টর্চার চালায় আমার উপর। ততদিনে
আমার পেটে নতুন অতিথি। নীরবে সব সহ্য করি। ছেলে হবার আগেই আমাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে
দেয়। এরপর থেকে আজ অবধি ঐ বেজন্মাটা আমার আর আমার সন্তানের কোন খোঁজ নেয় নি।
পাখিদির মাথায় সিঁদুর রহস্য এবার খোলাসা হয় আমার সামনে। আমি দেখতে পাই পাখিদির
চোখের কোনে জমে থাকা এক বিন্দু জল, আর তাতে
একরাশ ঘৃণা চিকচিক করছে ।
মন্ত্রমুগ্ধের মত কাহিনী শুনে গেলাম।
কিভাবে রিঅ্যাক্ট করবো ভেবে পাইনি তখন। একটু থেমে পরক্ষণে পাখিদি আবার বলতে শুরু
করে,
-আমি ফের এখানে চাকরি নেই এখানে। শিবু আমার দিকে আবারো হাত
বাড়ায়। ছেলে হয় আমার। শিবু সব সময় খোঁজ খবর নেয়। ছেলের জন্য খেলনা থেকে শুরু করে
জামা কাপড় সবকিছু কিনে দেয় সেই।
আমি জিজ্ঞেস করি, পাখিদি তোমার ছেলে কোথায় এখন?
-ও কোলকাতায় রামকৃষ্ণ মিশনে থেকে পড়াশুনা করছে। এবার ক্লাস টু’তে উঠেছে।
এবার আমার কাছে
এটাও স্পষ্ট হয়, মাঝে মাঝে পাখিদিকে কোলকাতার বাসে চড়তে
দেখি কেনো।
পাখিদি থামে না।
বলে যায় এক নাগাড়ে,
-জানিস ভাই, শিবু আমাকে
এতটা ভালোবাসে আগে বুঝিনি। ছেলের পড়ালেখার সব খরচ ওই দেয়। আমার কামাই দিয়ে নিজের
আর বাবা-মা’কে দেখাশুনা করি।
এবার আমি হেসে
বলি, এজন্যই বুঝি শিবুদা বিয়ে থা করেনি?
পাখিদি মুখ ঘুরিয়ে বলে,
-কি জানি? তোদের শিবুদাকেই জিজ্ঞেশ কর গিয়ে?
এক ঝলক হাসি দেখতে পাই পাখিদির সারামুখ
জুড়ে। আমি আর সেদিকে এগুলাম না। যদিও আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছিলো শিবুদার এই
নিঃস্বার্থপরতার পেছনে তার নিজস্ব তুষ্টির কথা। অন্যের সন্তানকে নিজের করে বড় করা, সেকি শুধু ভালোবাসা নাকি অন্য কিছু। আমার এই ভাবনার জট
ভেঙে দিল পাখিদিই।
-কি ভাবছিস ভাই? চুপ করে আছিস যে?
-না কিছু না। এমনিতেই, আমার উত্তর।
-আমার একটা গোপন কথা আছে। কাউকে বলিনি, শুধু তোকে
বলব আজ।
আমি বললাম, বল শুনি কি
কথা?
-প্রমিজ, কাউকে বলবি না। বললাম,
-প্রমিজ।
-সেদিন শিবু তোকে
যা যা বলেছিল সব মিথ্যে।
-মানে? সেদিন তোমার শ্বশুর
বাড়ির লোকদের করা মামলার সালিশ ছিলো না? ওখানে
তোমরা দু’জন ছাড়া আর কেউ ছিল না?
-বুদ্ধু কোথাকার। বলেই পাখিদি টেরা চোখে
তাকিয়ে এমন ভাব করলো, আমার নিজের
কাছেই নিজেকে চরম বোকা মনে হল।
বিদায় নিয়ে হেঁটে হেঁটে হোস্টেলে ফিরছি।
মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, ঠিকই তো।
সেদিন অন্য কেউ না থাকলেও হোস্টেলের সার্বক্ষণিক দারোয়ান শ্যামল তো থাকার কথা
ছিলো! বেটা শ্যামলা ছিলো কোথায়?