গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ৭ জানুয়ারী, ২০১৫

কেয়া মুখোপাধ্যায়


সহযাত্রী

ছোট বড় পাথর ছড়ানো এবড়োখেবড়ো পাহাড়ি পথটা বেয়ে তরতরিয়ে নেমে আসছিল অতীশ
অতীশমানে ডাক্তার অতীশ দীপঙ্কর চৌধুরী মাস কয়েক হল এই ছোট্ট পাহাড়ি টাউনের হসপিটালটায় এসেছে চাকরি নিয়েনামেই হসপিটাল, আদতে একটা গ্রামের হেলথ সেন্টারের থেকে খুব উচ্চমানের কিছু বলা যাবে না একেখানিকটা জেদের বশেই আসাডাক্তারি ডিগ্রী পাবার আগে এক, আর পরে এক- ভাল রেজাল্ট করে ডিগ্রী নিয়ে ডাক্তাররা কেউ শহর ছেড়ে যায় না, এটা যে ভুল, নিজেকে দিয়ে সেটা প্রমাণ করে দিতে চায় অতীশঅন্তত দুটো বছর এখানে কাজ করতে চায়একদিকে পাহাড়অন্যদিকে আঁকাবাঁকাউঁচু-নিচুখাড়া-ঢালু পথ চলে গেছে বহুদূর, কাছাকাছি বড় শহরটার দিকেপাহাড়ে পিঠ দিয়ে ছোট্ট টাউনটা পুরোনো-নতুনের ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করে তাকিয়ে আছে সামনের দিকেপাহাড়ি মানুষই বেশিসহজ সরল জীবন তাদেরকিছু কিছু শহুরে বিত্তবান মানুষও স্বাস্থ্যোদ্ধারের আশায় বাড়ি করেছেনমাঝে মাঝে এসে থাকেনএকটা দুটো হোটেলও আছেএকেবারেই সাধারণঅতীশের সামাজিক ক্লাসের সঙ্গে একেবারেই মেলে না পুরো ব্যাপারটা, কিন্তু ওই যে! তার জেদ! তাই দুটো বছর কাটাতেই হবে এখানে
দুপুরবেলা খুব একটা চাপ থাকে নাঅনেকসময় তাই অতীশ পাহাড়ে হাঁটতে যায়প্রথমে হাঁটা, তারপর স্পীড বাড়িয়ে জগিংনিজেকে ফিট রাখার জন্যেখাড়া এবড়োখেবড়ো পাহাড়ি পথ বেয়ে কিছুটা ওঠা আবার নেমে আসাএরকমই কয়েকবারআজও দ্বিতীয়বার নামছিল যখনদেখতে পেল সিংজী সেদিকেই আসছেতার কাছেই নাকিএকটু স্পীড বাড়াল অতীশপাথুরে জমিতে বয়ে চলা তিরতিরে জলের ধারাটা যেখানে বাঁদিকে ঘুরে গেছে, সেই মুখটায় এসে দেখা হয়ে গেল
জলদি চলিয়ে ডাগদার সাব, এক পেশেন্ট হ্যায়হাথমে চোট, বহতসি খুন নিকাল গয়া
যা বোঝা গেল, নার্স দিদিরা চান অতীশ একবার দেখুকহয়তো ওষুধপত্রও দিতে হবেনাহলে এসব ক্ষেত্রে প্রাথমিক ব্যাপারটা ওঁরাই সামলে নিতে পারেন
বয়স্ক মানুষ, বছর সত্তর বা কাছাকাছিধারাল ছুরিতে কেটে গেছে গভীর হয়ে
যা যা করতে হবে নার্সদের বলে দিয়ে নিজের ঘরে এসে অপেক্ষা করছিল অতীশএকটু কুন্ঠা নিয়ে ঢুকলেন ভদ্রলোক
দুটো ওষুধ লিখে দিলামএকটা এখানেই পেয়ে যাবেনখেয়ে নিনআর একটু অপেক্ষা করে যানসুগার আছে তো, ব্লিডিং বন্ধ হতে দেরি হচ্ছিলপুরোপুরি যে থেমেছে, বুঝে নেয়া দরকার
অসাবধানে এমন কেটে গেল
একটু ইতস্তত করেন ভদ্রলোক
বলছি কি, বেশ খানিকক্ষণ হল এসেছি  আর ইয়েমানেএখন তো আর রক্ত বেরোচ্ছে না এবার মনে হয় যেতে পারব
আপনি যেতে পারলেও আমি বলছি আর একটু থেকে যান
না মানে…”
ঘড়ির দিকে একবার তাকালেন ভদ্রলোকএকটু অস্থির ভাব মুখে চোখেঅতীশের চোখ এড়াল নাএই এক মুশকিলঅসুবিধেয় পড়লে ডাক্তারের কাছে আসবেকিন্তু একটু সামলে উঠলেই নিজেরাই সব ডিসাইড করতে থাকবেপ্রায়ই এটা দেখে দেখে এতদিনে গা-সওয়া হয়ে যাবার কথা অতীশেরতবু কথা না বলে পারে না
কী ব্যাপার বলুন তোআপনার ভালোর জন্যেই বলছি তোএত তাড়া কীসেরকাজ আছে অনেক?”
একটু হাসার চেষ্টা করলেন ভদ্রলোক
আমার আবার কী কাজরিটায়ার্ড মানুষ…”
তাহলেযানওরা ওষুধটা দিয়ে দেবেখেয়েআধঘন্টা বসে, তারপর যাবেন
আসলেআসলে আমার স্ত্রী অপেক্ষা করে থাকবেন…”
একা আছেন বাড়িতে?”
না না, কাজের মেয়ে আছে একটিসেজন্যে নয় প্রায় চারটে হয়ে এল তোএই বিকেলবেলার চা-টা আমরা একসঙ্গে খাইঅনেক বছরের অভ্যেস...
উফ! একদিন বিকেলে চা খেতে দেরি হলে বা একসঙ্গে খাওয়া না হলে কি পৃথিবী রসাতলে যাবে! অসন্তুষ্টিটা চাপতে পারল না অতীশ
আপনার দেরি হলে কি উনি খুব বিরক্ত হবেন? রেগে যাবেন?”
একটা দীর্ঘশ্বাস চাপার চেষ্টা করেন ভদ্রলোকএকটু থেমে থেমে বললেন,
নাহ! সেসব কিছুই হবে নাসেরকম কোন চান্সই নেইআসলে... তো জানেই না আমি কে...
তার... মানে?”
অ্যালঝাইমারচিনতে পারে না আমাকেঅনেকদিন
এরকম উত্তরের জন্যে তৈরি ছিল নাএকটু থমকে গেল অতীশতারপর প্রশ্নটা আচমকাই বেরিয়ে গেল মুখ থেকে
আপনার স্ত্রী জানেন না আপনি কে! তবু একটুও দেরি করা যাবে না একদিনও?”
অতীশের দিকে একবার তাকালেন ভদ্রলোকএক চিলতে ম্লান হাসি মুখেচেয়ারটা ছেড়ে উঠতে উঠতে বললেন,
ঠিকই জানে না আমি কেকিন্তু ডাক্তারবাবু, আমি তো জানি, আমার কে...।

হতবাক অতীশকে হাত তুলে নমস্কার করে আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেলেন