গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ১১ মার্চ, ২০১৫

মুরাদুল ইসলাম


কয়েকটি রঙিন স্যান্ডেল


সেদিন সন্ধ্যায় সৈয়দ শামসুর রহমানের মনে হল তিনি জীবনে ব্যর্থ হয়েছেন। তার ব্যর্থতার পরিমাণ দেখে তিনি নিজেই বিস্মিত হলেন। তার গলা শুকিয়ে গেল অতীতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ছন্নছাড়া কিছু চিন্তা করে। সৈয়দ শামসুর রহমান বিছানায় শুয়ে ছিলেন। তিনি উঠে বসলেন। বিছানার লাগোয়া আলনাতে অগোছালো কাপড় চোপড়ের মধ্য থেকে খয়েরী ময়লা পাঞ্জাবীটা নিয়ে পড়ে ফেললেন। তারপর হালকা নিঃশ্বাস ছেড়ে ডাক দিলেন, ময়না মিয়া, ময়না মিয়া!
কেউ কোন উত্তর দিল না।

সৈয়দ শামসুর রহমান আবার ডাকলেন। এবার গলার স্বর আরেকটু গম্ভীর এবং শব্দ আরেকটু জোরে। কিন্তু তবুও কেউ কোন জবাব দিল না। সৈয়দ শামসুর রহমান বিরক্ত হয়ে বিছানা থেকে নামলেন। পা মেঝেতে রেখে তিনি পায়ের স্যান্ডেল খোঁজলেন কিছুক্ষণ পা দিয়ে। সাধারণত এভাবে পেয়ে যান তিনি। তাই কখনো নিচে তাকিয়ে দেখার প্রয়োজন হয় না। এমন যদি হয় যে তিনি সাদা স্যান্ডেল পড়ে ঘুমিয়েছেন কিন্তু গভীর রাতে কেউ একজন এসে তার স্যান্ডেল বদলে সবুজ স্যান্ডেল রেখে গেল তাহলে হয়ত তিনি বুঝতে পারবেন না। তিনি সবুজ স্যান্ডেল পড়েই ঘুরবেন। তবে সাধারণত এরকম কখনো হবে না। কারণ চোর যদি গভীর রাতে ঘরে প্রবেশ করে তাহলে জুতা পরিবর্তন করে সৈয়দ শামসুর রহমানকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করবে না। চোরেরা জাগতিক বিষয়ে অধিক আগ্রহ অনুভব করে। সব ধরনের চোর। ছোট চোর, বড় চোর, মাঝারি চোর, শিক্ষিত চোর, অশিক্ষিত চোর, নীতিবান চোর, নীতিহীন চোর, মুখোশধারী চোর এবং মুখোশহীন গতানুগতিক চোর সবাই। কারোই সৈয়দ শামসুর রহমান জুতার রঙ পরিবর্তন ধরতে পারেন কি পারেন না, তা দেখার কোন আগ্রহ থাকার কথা না। তবে এর ব্যতিক্রমও হতে পারে। কারণ মানুষ কখন কি করে তা ঠিক বলা যায় না। হয়ত কোন এক চোর, নিতান্ত অনটনে জীবন যাপন তার। যেখানে বড় বড় মুখোশধারী চোরেরা দেশের সম্পদ চুরি করে শিক্ষামূলক সেমিনারে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ায় সেখানে সে এক নিতান্তই গতানুগতিক মুখোশহীন চোর। সেই চোর যদি কোন এক গভীর রাতে সাহস সঞ্চয় করে ঢোকে পড়ে সৈয়দ শামসুর রহমানের ঘরে, তারপর ডেস্কের যেখানে তার কবিতার খাতা থাকে তার ঠিক নিচের ড্রয়ার যখন খুলতে যাবে, ঠিক তখন যদি তার চোখ পড়ে সৈয়দ শামসুর রহমানের সাদা স্যান্ডের দিকে। এবং তারপর যদি তার চোখ যায় ঘুমন্ত সৈয়দ শামসুর রহমানের দিকে আর তার কোন এক অদ্ভুত কারণে যদি মনে এই লোকটি কি স্যান্ডেল পরিবর্তন করে রেখে গেলে পরদিন সকালে উঠে বুঝতে পারবে। যদি তার এরকম মনে হয়, হতে পারে, কারণ মানুষের ক্ষেত্রে কিছুই আগে থেকে বলা যায় না, তখন সে চোর সৈয়দ শামসুর রহমানের স্যান্ডেল পরিবর্তন করে রেখে যেতে পারে। তবে সে কোন রঙের স্যান্ডেল রেখে যাবে কিংবা সেই স্যান্ডেল সে কোথায় পাবে সে সম্পর্কে আসলে স্পষ্ট করে কিছুই বলা যাচ্ছে না। কারণ অনুমান নির্ভর কথাবার্তা অস্পষ্টতা নির্ভরও।
কিন্তু একথা ঠিক এরকম কিছু হলে বুঝা যেত সৈয়দ শামসুর রহমান স্যান্ডেলের রঙ পরিবর্তন বুঝতে পারবেন কি না।

যাইহোক, সৈয়দ শামসুর রহমান যখন পা দিয়ে কিছুক্ষণ খোঁজে স্যান্ডেল পেলেন না তখন তিনি নিচে তাকালেন। তার চোখে পড়ল সারি বেঁধে একদল পিঁপড়া যাচ্ছে। কিন্তু স্যান্ডেল নেই। তিনি খাটের তলায় মাথা ঢুকিয়ে এর নিচটাও দেখে নিলেন। স্যান্ডেল নেই।
তিনি খালি পায়ে মেঝেতে দাঁড়ালেন। তখন তার চোখে পড়ল ডেস্কের উপরে রাখা তার কবিতার খাতা। তিনি প্রায় সময়ই কবিতা লিখেন। অনেক অনেক অনেক কবিতা লিখেছেন। তিনি একজন ব্যর্থ কবি। এসব কবিতা তিনি কোথায় ছাঁপতে দেন না। লিখেই রেখে দেন। তার কবিতার বিষয়ের মধ্যে যে কত কিছু আছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। তিনি কবিতা লিখতে লিখতেই আসলে শেষ করে দিয়েছেন তার জীবন। নিজে এমনটাই মনে করেন। কিন্তু সমাজ তা মনে করে না। আসলে সমাজ জানেই না তিনি কবিতা লিখেন। অথবা জানলেও সমাজ কবিতাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয় না।
সমাজ সৈয়দ শামসুর রহমানকে মনে করে একজন অবসরপ্রাপ্ত বড় সরকারী চাকরিজীবি, যিনি তার চাকরিজীবনে ঘুষের মাধ্যমে অর্জন করেছেন অনেক টাকা। ধন সম্পদের প্রতি নেশাগ্রস্তের মত বাড়িয়েছেন তার সম্পদের পরিমাণ।

কিন্তু সৈয়দ শামসুর রহমান মনে করেন সমাজের এই ধারণা ভুল। তিনি কোনকালেই সরকারী চাকরিজীবি ছিলেন না। তিনি একজন প্রকৃত কবি হতে চেয়েছিলেন। কবি হতে গিয়ে ভুল করে মাঝে মাঝে হয়ে গেছেন অন্যকিছু। তবে ক্ষণিকের জন্য। মূলত তিনি একজন কবি। গাছের পাতা কীভাবে সূর্যের আলোকে অংশ অংশ করে ভাগ করে দিয়ে নিজস্ব অস্তিত্ব জানান দেয়, তা নিয়েই আজন্ম চিন্তা তার। সম্ভবত বাকী জন্মেও একইরকম চিন্তা তার সমস্তটা জুড়ে বিরাজ করবে।
তিনি ডেস্কের কাছে গিয়ে কবিতার খাতা খোলার সাথে সাথেই একজন লোক দরজায় মুখ বাড়িয়ে বলল, চাচাজি, ডেকেছেন?
সৈয়দ শামসুর রহমান বললেন, হ্যা। ডাকছিলাম। আমার স্যান্ডেল কই খুইজা দেখ।
লোকটা বলল, স্যান্ডেল তো বাইরে চাচাজি।
সৈয়দ শামসুর রহমান বললেন, বাইরে কেন? নিয়া আয়।

লোকটা দৌড়ে বাইরে গেল স্যান্ডেল আনতে। এক মিনিটের মধ্যে সে ফিরে আসল। হাতে টকটকে লাল এক জোড়া স্যান্ডেল। যেন লাল আলো বিকিরণ করছে।

সৈয়দ শামসুর রহমান জিজ্ঞেস করলেন, এইটা কি আমার স্যান্ডেল ? আমার স্যান্ডেল কি লাল?

লোকটা মাথা চুলকাতে লাগল। স্যান্ডেল লাল, কালো না সাদা তা সে লক্ষ্য করে নি। সৈয়দ শামসুর রহমান বিরক্ত মুখে বললেন,  বাইরে কি আর কোন স্যান্ডেল আছে?

লোকটা মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, জানি না চাচাজি। দেখি নাই।

সৈয়দ শামসুর রহমান ডেস্কের সামনের চেয়ারে বসা ছিলেন। তিনি উঠে বললেন, চল, বাইরে যাই। গিয়া খুইজা দেখি।

সৈয়দ শামসুর রহমান এবং তিনি যাকে ময়না মিয়া বলে ডেকেছিলেন সেই লোক, অর্থাৎ তারা দুজন তখন বাইরে বের হলেন। বাইরে প্রখর সূর্যালোক। সেই সূর্যতাপের নিচে সৈয়দ শামসুর রহমান এবং ময়না মিয়া স্যান্ডেল খুঁজতে লাগলেন।
অনেকক্ষণ খোঁজার পর তারা আরো দুটি স্যান্ডেল খোঁজে পেয়েছিলেন। সবুজ ও বেগুনি রঙের। সুতরাং, মোট স্যান্ডেল ছিল লাল, সবুজ ও বেগুনী রঙের।
তিনি তখনো ঘরে যান নি, তখন একটি লাল গাড়ি এসে তার ঘরের সামনে থামল। গাড়ি থেকে নেমে এল একটি লোক। তার চোখে কালো চশমা। সে সৈয়দ শামসুর রহমানের সামনে এসে জিজ্ঞেস করল, কবি সৈয়দ শামসুর রহমান কে?
সৈয়দ শামসুর রহমান বিস্মিত হলেন। কারণ এই প্রথম তাকে কেউ কবি সম্বোধন করল। তিনি জবাবে ভাঙা গলায় বললেন, আমি, আমি ই সৈয়দ শামসুর রহমান। কেন বলুন তো?

লোকটি হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিল হ্যান্ডশেকের জন্য এবং বলল, স্যার আমাদের একটি অনুষ্ঠানে আপনাকে প্রধান অতিথি করেছি। স্যার যেতেই হবে। স্যার আপনি না করতে পারবেন না।

সৈয়দ শামসুর রহমান লোকটির বাড়িয়ে দাওয়া হাতে নিজের হাত দিয়ে হ্যান্ডশেক করেছিলেন। লোকটার হাত ছিল জমে যাওয়া পানির মত ঠান্ডা।

সৈয়দ শামসুর রহমান বললেন, কিন্তু অনুষ্ঠানটা কীসের তা তো আগে জানতে হবে। সবকিছু জেনে বুঝে না গেলে পরে দেখা যাবে............

লোকটি তাকে প্রায় থামিয়ে দিয়ে বলল, স্যার আমি আপনার কথা বুঝতে পেরেছি। এরকম অনেক হয়। দেখা যায় ক্যাপিটালিস্ট কোন অনুষ্ঠানে ঘোর এস্টাবলিশমেন্ট বিরোধী কবিকে তারা না জানিয়ে প্রধান অতিথি হিসেবে নিয়ে এসেছে। কবি না জেনে চলে এসেছেন। এখন আর উঠে যেতে পারছেন না। মুখ গোমড়া করে বসে আছেন। যেন তার কুষ্ঠকাঠিন্য হয়েছে। এরকম অনেক পরিস্থিতি দেখেছি স্যার। তাই সব কিছু ঠিকঠাক করে নিয়ে এসেছি। আমাদের অনুষ্ঠান স্যার শুধুই কবিতা নিয়ে। আর কিছু না। বিশেষত আপনার সামগ্রিক কবিতাবলী নিয়ে আলোচনা করা হবে। আপনি বলবেন আমাদের। স্যার প্লিজ না করবেন না।

সৈয়দ শামসুর রহমান বললেন, কিন্তু আমি তো আমার কবিতা কখনো তেমন প্রকাশ করি নি। দুয়েকটা যা করেছি তাও ছদ্মনামে...

লোকটি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, স্যার, আপনার কবিতা আমরা পড়েছি। আপনি প্রকাশ যা করেছেন তা, এবং অপ্রকাশিত গুলোও। তাই তো আপনাকে প্রধান অতিথি করতে এসেছি।

সৈয়দ শামসুর রহমান কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় লোকটি বলল, স্যার আপনার হাতে তিন রঙের স্যান্ডেল কেন? লাল সবুজ বেগুনী। আপনি কি লালটা পড়বেন?

সৈয়দ শামসুর রহমান কি বলবেন ভেবে পেলেন না। তিনি তার পাশে দাঁড়ানো ময়না মিয়ার দিকে তাকালেন। ময়না মিয়া তাকাল লাল গাড়িটার দিকে।

লোকটি বলল, স্যার, আপনাকে নিয়ে যাওয়ার গাড়িও লাল, স্যান্ডেলও পড়ুন লাল।

ময়না মিয়াও তাতে সায় দিল। সৈয়দ শামসুর রহমান লাল স্যান্ডেল পড়ে ঝকঝকে রোদের দিনে লাল গাড়িতে উঠলেন। গাড়িটি তাকে নিয়ে রৌদ্র ভেদ করে চলে যেতে লাগল। সৈয়দ শামসুর রহমানের মাথায় ভেসে উঠছিল একটি কবিতা
তিনটা স্যান্ডেল
লাল নীল আর ধূষর
কিংবা
লাল সবুজ ও বেগুনী
তিনটা স্যান্ডেল
চিরতরে অমিমাংসিত রহস্যের মতো
লেগে থাকে হৃদয়ের কোনে
সৈয়দ শামসুর রহমান গাড়িতেই কিছু সময়ের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক আগ মুহুর্তে তার মনে হয়েছিল কয়টা বাজে। কিন্তু তার হাতে কোন ঘড়ি ছিল না এবং তার পাশে কেউ ছিল না। তিনি ড্রাইভারের সিটে বসা লোকটিকে জিজ্ঞেস করার মত শক্তি পেলেন না ক্লান্তির কারণে। তার চোখ ভারী হয়ে আসছিল।
লাল গাড়িটি তাকে নিয়ে আর ফিরে আসে নি।