গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ২৭ মে, ২০১৫

বর্ষ ৪ সংখ্যা ১৩।। ২৮শে মে ২০১৫

এই সংখ্যায় ১০টি গল্প । লিখেছেন – সুবীর সরকার, বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়, ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়, সুবীর কুমার রায়, আবু রাশেদ পলাশ, শ্রাবণী বসু, দেবাশিস কোণার,  ত্রিভুবনজিৎ মুখার্জী, সীমা ব্যানার্জী রায়, ও শাঁওলি দে ।
            
          পড়ুন সূচিপত্রে ক্লিক করে

সু বী র স র কা র

টু নু মু নু এ ক্কা

 

তো,এক বিকেলডোবার ক্ষণে টুনুমুনু এক্কার সাথে দেওয়ান বর্মনের দেখা হয়ে গেল।দেওয়ানের কপালে ঘাম,ঘাড়ের গামছায় মুখ মুছে সে যখন ধানহাটি থেকে বেরিয়ে আসছে তখনই দেখা পেল টুনুমুনু এক্কার।কালো পেশল শরীরে ঢেউ তুলে তুলে ধামসা মাদলের তালে শরীর দুলিয়ে টুনুমুনু তখন প্রবেশ করতে যাচ্ছে মোরগলড়াইপর্বে।হাড়িয়াহাট পর্বে।দেওয়ান বর্মণ কি টুনুমুনু এক্কাকে গ্রহণ করবে?না কি তিন নদী পাঁচ ফরেষ্ট ঘেরা তার জোতজমির ভিতর,দিক ও দিগরের ভিতর ছড়িয়ে দেবে!দেওয়ানের প্রবীণ চোখের কুঞ্চনে সাময়িক দ্বিধা তৈরী হতে থাকলেও দেওয়ান কিন্তু টুনুমুনুর দিকে মুখভরতি হাসি নিয়ে পানের পিক নিয়ে হাজির হয়।টুনুমুনু তখন দেওয়ানের দিকে হাততালি ছুড়ে দেয়।বর্ণাঢ্য উৎসবের দিকে টেনে আনতে থাকে দেওয়ানকে।চারপাশের নদীগুলি ফরেষ্টগুলি হাতিমাহুতের গানগুলি মনকেমনের দিনগুলি থেকে প্রবল একাকীত্ব আর বিষাদ যেন চুঁইয়ে নামতে থাকে।জোতজমির খালবিলের বাড়িটাড়ির গানবাজনার হাসিতামাসার এক পরিপক্কতায় কেমনতর এক দিনদুনিয়াই বুঝি সংশয়তাড়িত করে ফেলতে থাকে সমগ্র পরিপার্শটুকুন আর মহিষের গাড়ির সমবেতে ঘুমকাতুরে এক অসহায়তায় দ্বন্দদ্বিধা নিয়ে দেওয়ান দাঁড়িয়ে থাকেন আর একসময় জাঁকজমকের সঙ্গে ফিরতে থাকেন আবহমানের জোতজমির দিকে।পূর্বস্মৃতির তোয়াক্কা না করেই, যেভাবে মাদলধামসায় মেতে ওঠে টুনুমুনু এক্কা।


নির্মাণ বিনির্মাণ নিয়ে একা একা বসে থাকা।রাজার হাতির পিছে পিছে দেওয়ানের ঘোড়া যুক্ত হয় আর বিস্তৃত কালখণ্ডে স্মৃতিকাতর হতে থাকা।দেওয়ান বর্মনের জোতজমি পত্তন করেছিল মেঘা বর্মণ।হাটের ভিতর মাঠের ভিতর রাতদিন খেলে বেড়াতো বাঘ।বাঘের নখ বাঘের লেজ অতিসন্ত্রস্ত জনপদগুলিতে কেবল হাওয়া ছড়িয়ে দিত।হাওয়ায় ভেসে আসা গান মাঘকুয়াশায় দলা দলা একাকীত্ব নিয়ে বিষাদ নিয়ে পুর্নজন্মের কথকথার বৃত্তে সীমায়িত হতে গিয়েও হোঁচট খায় আর দশ কুড়ি পঞ্চাশ গঞ্জগাঁ জুড়ে রবিশস্যের লকলকে সম্ভার।রাস্তায় রাস্তায় গান বাজে।বাজনায় বাজনায় নৃত্যে নৃত্যে আশ্চর্যতম দুলুনির ভরকেন্দ্রে গিয়ে ঝাকড়া সব গাছপালায় অতিজীবিত হতে থাকা অনুখণ্ডগুলি দিয়ে ধরাছোঁয়ার এক জীবন ক্রমে টেনে নিয়ে চলে আর তখন দেওয়ান বল টুনুমুনু বল ধানহাটির ইঁদুর বল সব কিছুই যেন বৃত্তায়নে আটকে পড়া মজা ও ম্যাজিক।ধামসামাদল না থামলেও বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি নামে।উঠোনের নিকানো অংশে কীর্তনসুর প্রতিষ্ঠিত হলেও কোথাও কোন স্বীকৃতি জোটে না।কেবল নদীর ওপর সাঁকো আর ওপারের ছায়াছন্নতায় বুদ হয়ে যাওয়া বিষন্ন সব মানুষেরা হাড়হিম এক নির্জনতাই ফিরিয়ে আনতে আনতে গান গাইতে গাইতে কিভাবে অন্যমনষ্ক ও আত্মগত হয়ে উঠতে থাকে!
হাজার হাতির মিছিল তখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।চিলাপাতা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা বাইসনের পাল ফের জঙ্গলেই।নদী পেরিয়ে চলে যাওয়া ধাইধাই বিটে।এমত দোলাচলে বাঁধা না দিয়েও আদিঅন্ত মেঘের ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে  কিভাবে দূরাগত গন্তব্য নির্ধারিত হতে থাকলে সোনাভাবী হাসির বান ডেকে আনে।কাঠের বাড়ির সিজিলমিছিল দেখে বুক ভরা শ্বাসে নতুনভাবে বেঁচে থাকতে চাওয়া।বৃক্ষনদীআকাশপুকুররহালগেরস্থির ভরভরন্তির ভেতর জীবনের পর জীবনের প্রবাহিত হতে থাকা।মহল্লায় মহল্লায় মাদলধামসা জেগে উঠলে টুনুমুনু শনিচরী ফাগুলাল চুনিয়া মালতিরা গাথাকিংবদন্তির লহর তলে।করম পূজার মাঠ জুরে অন্ধকার নামে।জোনাই জ্বলে।মোরগলড়াই শেষে ফিরতে থাকে চিলবানুস ওরাও।চিল্বানুসের পীঠে চিতার থাবার দুরন্ত আচড়।অতি পুরাতন পৃথিবীর বাঘে-মানুষের লড়াইয়ের গল্প স্বপ্নতাঁত বুনতে থাকলে চিলবানুস কখন কিভাবে যেন ‘বাঘুয়া’ হয়ে ওঠে।অতিকথার পৃথিবীতে এইসব চলতেই থাকে।দেড়শো ঘোড়া তিরিশ হাতির দেওয়ান ধনী টুনুমুনু এক্কাকে চিনতে পারবার প্রয়াসটুকুন জারি রাখেন আর সব পেরিয়ে জীবনযাপনের অর্ন্তগতে অবধারিতভাবেই টুনুমুনু, তার বাড়িটাড়ি গানকিসসা হর্ষবিষাদ ও হাটগঞ্জ সমেত।















বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

অসমাপ্ত সংলাপ

মেঘের দুপুরে নিজের ছায়াকে সনাক্ত করা যতটা কঠিন তার চেয়েও জটিল অনীকদাকে চেনা ।কখন যে কি করে বসে তা আন্দাজ করা মুশকিল । শুধু মুশকিল নয় বিশ্বাস করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে অনেক সময় । প্রথম পরিচয় কখন কিভাবে হয়েছিল মনে নেই তবে প্রতিদিনই তাকে রহস্যময় মনে হত । মানুষটাকে কি আমি আজও চিনি ? নিজেই তো জানিনা । চেনা অঙ্কের মত মনে হলেও শেষ লাইনে এসে থমকে গেছে উত্তর । ধরতে গিয়েও চ্যাং মাছের মত পিছলে গেছে বারবার । এখন যে মানুষটি আমার সামনে দাঁড়িয়ে সে কি সত্যিই অনীকদা ? নিজেকেই প্রশ্ন করি ।জিজ্ঞাসার বৃত্তে ঘুরে যায় স্নায়ু । বহিরঙ্গে অনীকদার কোন ছাপ নেই । লাল টুপি যা তার অবয়বের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে কবেই, আজ নেই । দাড়ি গোঁফ সুন্দর ভাবে কামানো । অথচ অনীকদা মানেই এলোমেলো বিন্যাস বর্জিত ফিদেল কাস্ত্রো দাড়ি । ছন্নছাড়া আধ ময়লা হাফ সার্ট । উদভ্রান্তের মত এক দীর্ঘশ্বাস । আজ সেসব কিছুই নেই । বেশ স্মার্ট , রিলাক্সড ও সুন্দর লাগছে তাকে । ডাকলাম কি ব্যাপার অনীকদা , তোমাকে বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে , ফ্রেশ । তুমি তো এমন ছিলেনা । প্রেমে পড়লে না কি ? - খেপেছিস ? - দেখে তো তাই মনে হচ্ছে । কি ব্যাপার দাদা ? - পরে শুনিস। সে অনেক গল্প ।কেমন আছিস ? - ভাল নেই । - -কেন ? কি হল ? - অনেকদিন তোমাকে দেখিনি প্রান ভরে। - তাই ? ফুসফুস ভরা এক অলৌকিক হাসি হাসল অনীকদা - এবার রোজ দেখা হবে । প্রাণ ভরে যতখুশি দেখিস । ডেলি দেখলে ভাল লাগবেনা, আকর্ষণ কমে যাবে বৈচিত্র্য মুগ্ধতাও । - বাড়তেও তো পারে ।
- চান্স নেই। গালাগালি ছাড়া আমার আর কোনো পুরস্কার নেই। আসি রে, অনেক কাজ । পরে কথা বলব । - হ্যাঁ , দাদা । তোমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে । - অফিস ? সে তো চারদিন হল ছেড়ে দিয়েছি । তোরা জানিস না ? অনীকদা ফিরে তাকাল আমার দিকে । - ফালতু ইয়ার্কি করছ কেন বস । ঠিক এভাবেই বেরিয়ে এল কথাগুলো । - অন গড বলছি । তবু বিশ্বাস হয়না । এরকম কথা অনীকদা বহুবার বলেছে । বারবার শুনতে শুনতে কবেই তো গুরুত্ব কমে গেছে সেসব কথার । -বিশ্বাস কর দু নৌকায় পা দিয়ে চলতে গিয়ে অনেক ভুগেছি। না নাটক না চাকরি কিছুই তো সামলাতে পারিনি । চা না কফি এই দ্বন্দ্বেই তো কেটে গেল এতগুলো বছর । ভুল রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে কবেই তো হারিয়ে গেছে আসল রাস্তা । আমি অনীকদার দিকে তাকাই , তার চোখের লিপি পড়তে থাকি , এ কি কোনও নাটকের সংলাপ ? -শেষ পর্যন্ত আমি পেরেছি । অনেক দিন পর ... অনীকদা কে থামিয়ে দিই মাঝপথে । তুমি কি পাগল হয়ে গেছ দাদা ? -আজ নয় অনেকদিন আগেই । পাগল ছাড়া কেউ নাটক করেনা, কবিতা লেখেনা । জানে এতে পয়সা নেই , যশ ভালোবাসা , খ্যাতি নেই... শুধু গালি। তালি দেওয়ার কেউ নেই । আজ চলি । বলে ঝড়ের গতিতে চলে গেল অনীকদা । ব্যাপারটাকে আমি সত্যি মনে করিনি সেদিন । প্রলাপ নাট্য সংস্থার সাথে আমার যোগাযোগ অনেকদিনের । শিশুশিল্পী হিসেবে দু একবার অভিনয়ও করেছি ছোটবেলায় । প্রলাপ অনীকদার নিজের হাতে তৈরি । তার ঘর উঠোন । তার জীয়ন কাঠি । ততটা সংসারী নয় অনীকদা । বউ ছেলে মেয়ে সবই আছে অথচ সম্পর্কহীন নিরাসক্ত । একে একে সবাই ছেড়ে গেছে তাকে । ছাড়তে পারেনি তার মা । রোজগার পাতি মন্দ নয়। বেসরকারি চাকরি । চাকরি ভাল লাগেনা বলে মাঝে মাঝে without pay . নাটকের দল নিয়ে দূর দূরান্তে যেতে হয় , অফিস কামাই । নাটকের প্রস্তুতি ,অফিস কামাই । প্রচুর মাইনে কাটা যায় । চাকরিটা যাব যাব করেও যায়নি । এসব নিয়ে সংসারে নানা অশান্তি ।ঝুট ঝামেলা দাম্পত্য কলহ । সুমিতা বৌদি শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই অনীকদাকে ছেড়ে চলে যায় । ছেলে মেয়ে দুটো তখন ছোট । এসবকথাও নিঃসংকোচে অনীকদা বলেছে আমার কাছে সবার কি আর সংসার ভাল লাগে ? - এখনও সময় আছে , তুমি বৌদিকে বোঝাও । - বুঝিয়ে হয়ত আবার নিয়ে এলাম । কিন্তু আমার জীবন তো বদলাতে পারব না । - নিজেকে অন্তত একটু বদলাও , সামান্য । - পারবোনা , বিশ্বাস কর আমি পারবো না । এসব কথা বলার সময় তার গলার কম্পাঙ্ক আমি অনুভব করেছি । চোখে অশ্রুভাস কিম্বা মুখে দুর্ভাগ্যের কোন অভিব্যক্তি লক্ষ করিনি সেদিন । পরে অনেক পরে একদিন কথায় কথায় বলেছিল সুমিতাও ভুল বুঝল , দুজন মানুষের বাঁচার সংজ্ঞা যখন পুরোপুরি আলাদা হয়ে যায় তখন হাত ছেড়ে দেওয়াই উচিত । ...। এই প্রথম আমি অনীকদা কে মঞ্চের বাইরে কাঁদতে দেখেছিলাম । আরও অনেককথা ছিল হৃদয়স্পর্শী আত্মা নিংড়ানো । আজকের অনীকদাকে কিন্তু ততখানি সিরিয়াস মনে হল না আমার ।
২ ঐ দেখ স্বর্ণ মৃগ দূরে...। মায়ার ছলনে ভুলি
কি যেন হারায়ে খুঁজি আজ । কই সীতা ? আনন্দ উৎসব সুখ চুরি করে নিয়ে গেছ তুমি তো রাবণ ।
মাইল মাইল দীর্ঘ বনভূমি ...। - কি বকছ অনীকদা ? - প্রলাপ । রামের ডায়লগ বলছি । আমার নতুন নাটক । - ডায়লগ শুনতে আসিনি দাদা । - তবে - তুমি কি সত্যিই চাকরিটা ছেড়ে দিলে ? - কেন ? তোর বিশ্বাস হচ্ছেনা ? তবে দেখ বলে পকেট থেকে রেজিগনেশন লেটার বার করে আনে অনীকদা । এখনও অ্যাকসেপ্ট করেনি , দু এক দিনের মধ্যেই করবে । দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়ালই ভাল , তা ওরা ভাল করেই জানে। - আরও ভাবা উচিৎ ছিল তোমার - অসম্ভব । অনেক ভেবেছি , বারবার পিছিয়ে এসেছি । আর নয় । - খাবে কি ? তোমার তো জমানো টাকাও নেই । - চলে যাবে । যাদের চাকরি নেই তাদের যেভাবে চলে । আমি চুপ করে থাকি । বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি । কোথায় দাঁড়িয়ে আছি । - চিন্তা নেই । ৩/৪ টে সিরিয়াল আমার হাতে । যা পাব , আমি আর মা দুটো তো প্রানি ঠিক চলে যাবে । বুঝতে পারি ফালতু বকছে অনীকদা । কোথাও কিছু নেই । বিরক্ত হয়ে উঠি থামো তো , কি মনে কর তুমি জীবনটাকে ? নাটক ? থিয়েটার ? রঙ্গমঞ্চ ? - একদম তাই । জীবন তো এক প্রলম্বিত নাটক । তার বেশি কিছু নয় । অনীকদার হাতেপায়ে ধরতে বাকি রেখেছিলাম । শোনেনি আমার কথা । এরপর আর কোন যোগাযোগ ছিলনা । অভিমান হয়েছিল ভীষণ ।পরে সুমিতা বউদির সাথে একদিন দেখা হয়েছিল অশোক বস্ত্রালয়ে । সঙ্গে ঋদ্ধি ও ছিল , অনীকদার মেয়ে , এখন কলেজে পড়ে । সব খুলে বলেছিলাম । - তাহলেই ভাবো এইসব পাগল ছাগল নিয়ে সংসার করা কত জটিল । - কেমন আছ বৌদি ? - আছি একরকম । জীবনের চলার পথ অনেকসময় পা ও ঠিকমত খুঁজে নিতে পারেনা । আসি ভাই । মানুষটাকে দ্যাখো , খুব চিন্তা হয় ...। এরপর অনেক ধুলোবালি জমেছে স্নায়ুর পর্দায় । আমাকেও পেটের দায়ে চলে আসতে হয়েছে অনেক দূরে । ৩ অনীকদার মায়ের মৃত্যুর সময় ওর পাশে থাকতে পারিনি । অফিসের কাজে হায়দ্রাবাদে ব্যস্ত ছিলাম তখন । ফিরে এসে শুনি সরমামাসি আর নেই । আফসোস হয়েছিল খুব । অনীকদার চোখমুখ তখন পাগলের মত । অনর্গল বকে চলেছে অসংলগ্ন কথা । অর্থহীন প্রলাপ । দেখতেও ঠিক স্বাভাবিক লাগছে না । চোখে জল এল । মানুষের গতিপথে কত বাঁক । বিচিত্র রঙের খেলা ছবিঘরের দেওয়ালে । মাসীমার কথা স্মরনে এল । কত যন্ত্রনা আর কষ্ট নিয়ে বেঁচেছিল একটু সুখ দেখবে বলে । দেখতে পেল কি ? অনীকদার মুখোমুখি দাঁড়ালাম এবার । আমাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল অনীকদা । চোখের জলের ধারাস্নানে ভিজে যেতে লাগলাম আমরা দুজনে ।
৪ কখনও কখনো খুব দাম্ভিক মনে হত তাকে । যখন বলত আমার ঐ সংলাপটা শুনেছিস তোদের শম্ভু মিত্র সাতজন্মেও পারত ওরকম ডায়লগ ছাড়তে ? রক্তকরবী , চাঁদ বনিকের পালা যদি আমার হাতে পড়ত কাকে অভিনয় বলে দেখিয়ে দিতাম । শম্ভু মিত্র একদম বোগাস । শুনে যেতাম সেসব কথা । লোকটা বলে কি আকাশের চাঁদ আর চাঁদু পরামানিকের তুলনা । অদ্ভুত মায়া হত । জানতাম বুকের ভেতর কোথাও তরল কষ্ট আছে । শুধু শিশির ভাদুড়ির প্রসঙ্গ এলে চুপ করে যেত। হাত দুটো মাথার উপর তুলে প্রনাম করে বলত গুরুদেব । যেমন শিক্ষিত মানুষ সেরকম ই প্রতিভাবান । নানা ধরনের নাটক শোনাত । বিদেশি নাটক নিয়েও অদ্ভুত সব কথা বলত , সব বুঝতাম না । - একটা নতুন নাটক নামাচ্ছি । একদম টাটকা । থিয়েট্রন কনসেপ্টে লেখা । সুন্দর এক্সপেরিমেন্ট বলে শুনিয়ে যেত পাতার পর পাতা । শ্রদ্ধায় প্রনত হয়ে উঠতাম । নির্ভার মমতায় গিলে খেতাম তার অভিব্যক্তি । যদিও সংলাপ তেমন গতিশীল নয় । আর্থিক অসঙ্গতি মঞ্চস্থ হতে দেয়নি সেই নাট্যরূপ । সরমামাসিমনির মৃত্যুর পর আরও অভাব নেমে এসেছিল ঘরে । অগোছালো ছন্নছাড়া ভাব । অনীকদাকে বলতাম ঘরের দিকে মন দাও । বউদিকে নিয়ে এসো , আর কেন অভিমান অট্টহাসিতে আকাশ কাপিয়ে হেসে উঠত অনীকদা দুদিনের এই মোহ একে তুমি ঘর বল । যে ঘরের স্বপ্ন দেখে এতদূর হেঁটেছি অক্লেশে ... আর বেশি দূরে নেই...। -তুমি কি সংলাপ বলছ দাদা ? -না তো । স্টেজের বাইরের আলোকিত সত্য । - তোমার আজকের জীবন এ তো শুধু নাটকের জন্য । সবকিছু ছেড়ে দিয়ে এভাবে বেঁচে থাকতে ভাল লাগে ? - পছন্দ না হলেও রোলটা খুব চ্যালেঞ্জিং । কাউকে কাউকে তো এ ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতেই হবে । ভারি হয়ে যেত বুকের বাতাস । জমাট বাঁধা কষ্টের পাহাড় ঠেলে বেরিয়ে আসত দীর্ঘশ্বাস । ৫ অনীকদাকে সম্বর্ধনা জানানোর আয়োজন করেছিলাম আমরা । তার সমস্ত জীবন তো নাটকের জন্য উৎসর্গীকৃত । ফুল মালা মানপত্র আর কিছু সাম্মানিক । সবাই ঝাপিয়ে পড়েছিল কাজটিকে সফল সুন্দর করার জন্য । অনীকদার জীবন ও কাজ নিয়ে একটা বইও করা হয়েছিল । মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল এই বার্তা । হাজার হাজার মানুষ এসে যুক্ত হয়েছিল আমাদের কাজে । কিন্তু যার জন্য এই আয়োজন তাকে আর খুঁজে পাইনি আমরা । মঞ্চ আর আলোর পৃথিবী থেকে সে তখন দূরে অনেকদূরে । তার পাণ্ডুলিপি গুছিয়ে রাখি । অগোছালো অর্ধসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করতে হবে এখন । পাতার পর পাতা উল্টে যাই । সাজাই । কিছু কাজ তো বাকি থাকেই মানুষের জীবনে । আবার কেউ আসবে মঞ্চে ঠিক তার ই মত ...।
স্টেজ অন্ধকার করে দিওনা কেউ আসছে ...।


ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

ফেরার


বাথরুমে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়াল রমেন। নিজের মুখটা আয়নায় দেখল। তারপর গালে হাত দিয়ে পরখ করল দাড়িটা কামাতে হবে, নাকি না হলেও চলবে। দুদিকে মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল নিজেকে। চোখ ছুঁচলো করে গোঁফটা দেখে নিল।  নাকের ফুটো দুই আঙ্গুলে করে ওপরে তুলে দেখল চুল গজিয়েছে কিনা। তারপর আরো একবার গালে হাত বুলিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে হাঁক দিল নীপাকে, ----ভাত দাও, আমার হয়ে গেছে।
নীপা এসে দ্যাখে চান নেই, দাঁড়ি কামানো নেই, উস্কো-খুস্কো একমাথা চুল আর চান না-করা চেহারা নিয়ে তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে রমেন।
--এ কি, এখনও তো চানই হয়নি তোমার! তোমার না বড্ডো তাড়াতাড়ি। আরে, আগে চানটা তো কর। আমার বেশী দেরি হবে না, তুমি চান করতে করতে হয়ে যাবেবলেই হাঁক দেয় রান্নাঘরে---বেলাদি..., দাদার কিন্তু হয়ে এসেছে...বলেই জোর করে গায়ে হাত দিয়ে ঠ্যালা দিল নীপাযাও...’!
--চান করব না, শীত করছে
ভুরু কোঁচকালো নীপা। গতকাল রাত্রেও যেন একই কথা  বলেছিল রমেনশীত করছে।  অথচ কাল রাত্রে বেশ গরম ছিল, দুটো পাখা একসঙ্গে চালিয়ে শুতে হয়েছিল। রমেন বলার পর একটা পাখা বন্ধ রেখেছিল নীপা। চাদর লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করেছিল রমেন কে। লাগবে না বলেছিল রমেন, কিন্তু ভোরবেলায় নীপার শাড়ির আঁচল টেনে গায়ে মুড়ি দিয়েছিল। না, নীপা এখনকার মেয়েদের মতো নাইটি-ফাইটি পরে বাড়িতে থাকে না, রাত্রিতেও শোয় না। এতদিন বাড়িতে শ্বশুর-শাশুড়িমা ছিলেন। তাঁদের সামনে ওসব পোষাকে নীপা খুব একটা স্বছন্দ বোধ করেনি কোনদিন, তাঁরাও না। মুখে যদিও  কিছু বলেননি। নীপার স্বাধীনতায় তাঁরা যে খুব হস্তক্ষেপ করতেন, তাও না। করলে এতদিন ধরে নীপা  অফিসে চাকরি করতে পারত না। নীপা-রমেনের দুই মেয়েকে তাঁরাই তো দেখেছেন ! আসলে নীপা নিজেই সেটা চায়নি।
শাড়ির আঁচলটা এমনভাবে জড়িয়ে গুটি-সুটি মেরে শুয়ে ছিল রমেন, যেন ভীষণ শীত করছে। রমেনের দিকে চিন্তিত মুখে চাইল নীপা। তারপর নিজের বাঁ হাত একবার রমেনের গলার কাছে রাখল, আর একবার নিজের গলায়। কিন্তু রমেনের গা ঠিক কতটা গরম বুঝতে পারল না। বলল--কি  জানি, বুঝতে পারছি না। ঠাকুরপোকে একবার ডাকব?’
রমেনের ভাই রণেন ডাক্তার, এবাড়িতেই থাকে, তিনতলায়। রমেনরা থাকে দোতলায়। নীপা বিয়ে হয়ে যখন এবাড়িতে এসেছিল, রণেন তখন স্কুলের শেষ ক্লাসের ছাত্র। আবদার করে বলেছিলতুমি কিন্তু আমার বৌঠান, আর আমায় ঠাকুরপো বলে ডাকবে
নীপা অবাক হয়ে বলেছিল, কেন নাম ধরে ডাকব না কেন, আমি তো বড়...মাথা নাড়িয়েছিল রণেন---না, আমি মাকে বলেছি। মা ছোটকাকে ঠাকুরপো বলত, কি সুন্দর লাগত, তুমিও বলবে।আর কিছু বলেনি নীপা। কে জানে, হয়ত এই ডাকার মধ্যে কোন স্মৃতি লুকিয়ে আছে ! ছোটকাকে দ্যাখেনি নীপা। ওদের দু-ভাইয়ের মাঝে এক বোনও ছিল, ছোটবেলায় বাগানের পুকুরে পদ্মফুল তুলতে গিয়ে জলে ডুবে মারা যায়, তাকেও দ্যাখেনি নীপা। ওই পুকুরটা এখন মাটি দিয়ে বোজানো আছে, তার উপরে ফুলের টব রাখা। রণেনই সব দেখিয়েছিল নীপাকে। সেসব অনেকদিনের কথা।
রণেনের বৌ শাশ্বতী, সেও ডাক্তার। বিয়ের পর রণেনের দেখাদেখি সেও নীপাকে বলে বৌঠান। ওদের বাচ্চা-কাচ্চা নেই। নীপাদেরই ছোটটাকে নিজের করে নিয়েছে। রণেনকে খবর দেওয়ার কথা শুনে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল রমেন, নীপা বাধা দিয়ে বললেতুমি সব তাতেই অমন না, না কোর না তো ! তারপর ঠাকুরপো শুনে  একটা চ্যাঁচামেচি করুক। দাঁড়াও, আগে ওদের খবর দিই। 

(২)
আজ আর অফিসে যাওয়া হল না রমেনের। নীপাও আজকে ছুটি নিয়ে নিল। যদি কিছু দরকার হয়! রণেনরা তো আর বাড়িতে বসে থাকতে পারবে না, তাদের হাসপাতালের ডিউটি। শাশ্বতী চেম্বারে যাবার আগে রমেনের ঘরে ঢুকে বলে গেল,-----আজ তুমি একদম বাইরে বেরোবে না , দাদা। মনে রেখো, এটা আমি বললাম। বৌঠানের কথা তুমি শুনবে কি শুনবে না, তোমার ব্যাপার। কিন্তু আমি শুধু শাশ্বতী নই, ডাক্তারও, এটা ভুলে গেলে খুব খারাপ হবে। দাদা, বেরিয়ো না, শুয়ে থাকো আজকের দিনটা , কেমন?’
নিস্পৃহ মুখে শুনল রমেন, উত্তর দিল না। সেই থেকে গায়ে চাদর চাপা দিয়ে শুয়ে আছে। এখন বেলা প্রায় একটার কাছাকাছি। রণেন হাসপাতালে। শাশ্বতীও তার  নিজের চেম্বারে। হঠাৎ করে মাঝের একটা দিন ছুটিতে বাড়িতে বসে থাকতে ভালই  লাগছিল নীপার। রমেনও শোবার ঘরে শুয়ে আছে, গায়ে হালকা একটা চাদর। স্নানে যাবার আগে একবার ঘরে এলো নীপা। রমেনের গায়ে হাত দিয়ে দেখল, তেমন গরম নয়। মাথার চুলে  একটু বিলি কেটে দিল, রমেন কোন কথা বলল না, চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল। মনে হল ঘুমিয়ে পড়েছে। মাথায় হাতটা একটু রেখে বাইরে বেরিয়ে এলো নীপা, স্নানে যাবে। স্নান সেরে এসে খেতে দেবে রমেনকে।
স্নান সেরে আরো দু/একটা টুকিটাকি কাজ সেরে বেলাদিকে কি যেন বলে আবার ঘরে এলো নীপা।  রমেনকে উঠিয়ে খেতে দেবে। ঘরে ঢুকে দ্যাখে বিছানা  খালি, রমেন নেই। বাথরুমে গেছে হয়ত, ভেবে বিছানাটা হাত দিয়ে একবার টেনে দিল নীপা। বাচ্চাদের মত স্বভাব রমেনের। শুয়েছে দ্যাখ, যেন একটা বাচ্চা ছেলে   বিছানায় খেলা করেছে। হাসি হাসি মুখ করে বাথরুমের দিকে চেয়ে রইল নীপা। কিছুক্ষণ তাকিয়ে বুঝতে পারল, বাথরুমের দরজা এদিক থেকে বন্ধ রয়েছে। সেকি, তাহলে কি বাইরের বাথরুমে গেল? দোতলায় বারান্দার শেষে আরও একটা বাথরুম আছে। ঘর থেকে বেরিয়ে সেদিকেই গেল নীপা। কিন্তু সেই বাথরুমটাও বাইরে থেকে বন্ধ। চিন্তিত মুখে সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়াল নীপা। তিনতলায় আগে যাবে, নাকি একতলায় নেমে দেখবে ঠিক করে উঠতে পারছিল না। রমেন কি ওপরে রণেনের ঘরে নাকি মেয়েদের ঘরে গেল! সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে হাঁক দিল---বুধুয়া, এই বুধুয়া...
বুধুয়া বাড়ির গ্যারাজ ধোয়া-মোছা, নিচে শাশ্বতীর চেম্বার পরিষ্কার করার লোক। সপ্তাহে একটা দিন রবিবার  শাশ্বতী বাড়িতে চেম্বার করে। সে বাচ্চাদের ডাক্তার।  নিচে গ্যারাজের একটা দিকে ছোটোখাটো একটা চেম্বার বানিয়ে নিয়েছে। রমেনই বলেছিল, একটা দিন অন্ততঃ বাড়িতেই থাকুক মেয়েটা, রুগী না এলে তো শাশ্বতীর ছুটি।  নীপার ডাকে একতলায় সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়াল বুধুয়া।
--দ্যাখ তো, দাদা  নিচে কোথায় গেছেন, দোতলায় নেই। চেম্বারে আছে কিনা...বলে ওপরে ছুটল নীপা। অসুস্থ মানুষ টা গেল কোথায়, এইতো তাকে শুইয়ে রেখে স্নানে গেল নীপা। এর মধ্যে যাবে কোথায়!

(৩)
আজ সাত বছর হল রমেনের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। রণেন, শাশ্বতী  খোঁজ পাওয়ার জন্য কিছু করতে বাকি রাখেনি। নীপা আর অফিসে যায় না। রণেনই দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। শাশ্বতী বাইরের চেম্বার ছেড়ে দিয়েছে, শুধু বাড়িতেই চেম্বার করে। তার সময়ের কিছু পরিবর্তন হয়েছে। সকাল এগারোটা থেকে সে চেম্বারে যায়, ঠিক একটা বাজার কিছু আগে দোতলায় উঠে আসে।  নীপাকে নিয়ে খাবার পর বেলা তিনটে নাগাদ  নীপা ঘুমিয়ে পড়লে সে আবার সন্ধ্যে  অবধি চেম্বার করে। নীপা সারাদিন শান্ত, ধীর-স্থির হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে বেলাদির সঙ্গে এটা-সেটা  নাড়াচাড়া করে রান্না ঘরে। মুখে কোন কথা বলে না। শুধু বেলা একটার কাছাকাছি সময় হলে কেমন অস্থির হয়ে ওঠে। দোতলা, তিনতলার বাথরুমগুলো খুলে উঁকি মারে, সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়ায়, এদিক/ওদিক দ্যাখে আর তারপর চীৎকার করে ডাকে----বুধুয়া...এই বুধুয়া...!      


সুবীর কুমার রায়

  মামা-ভাগনী

আজ অনেক বছর পরে এক মামা-ভাগনীর কথা মনে পড়লো। তাদের দেখা, তাদের সাথে আলাপ হওয়া, ও তাদের সাথে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটানোর স্মৃতি, আজও আমার কাছে একটা অসামান্য প্রাপ্তি হয়ে আছে। তাই প্রায় কুড়ি বছর আগের সেই সুখস্মৃতিকে একটু ঘষেমেজে পরিস্কার করার প্রয়াস নিতেই আজ কলম ধরা।
সেবছর আমরা চারজন উত্তর বঙ্গের বেশ কিছু জায়গা ঘুরে, এক বিকালে জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের ভিতর হলং বনবাংলোয় এসে হাজির হলাম। সঙ্গে একজন দু’বছরের ও একজন সাত বছরের শিশু। পথশ্রমে আমরা কিছু ক্লান্ত হয়ে পড়লেও, বাচ্চাদুটোকে দেখে একবারও মনে হয়নি তারাও সারাটা পথ আমাদের সাথেই এসেছে। বাংলোতে ঢোকার আগেই, দু’জন এসে আগামীকাল ভোরে হাতির পিঠে (এলিফ্যান্ট সাফারি) জঙ্গল দর্শনের আর্জি জানালো। আমরা আরও দু’টো  দিন এখানে থাকবো, তাই তাড়াহুড়ো না করে আগামীকালের পরিবর্তে তারপরের দিন যাবার কথা বলে বাংলোয় প্রবেশ করলাম। আজ ভাবি, পরেও ওখানে গেছি, কিন্তু হলং বনবাংলোয় ঘর পাওয়া যত শক্ত, তার থেকেও শক্ত এই  হাতির পিঠে জঙ্গল দর্শনের সুযোগ পাওয়া, বিশেষ করে খুব ভোরে প্রথম ট্র্রিপে।
পরদিন খুব ভোরে অন্ধকার থাকতে আমাদের ঘরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম চোখে দরজা খুলে দেখি একজন দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে সে খুব নরম সুরে জিজ্ঞাসা করলো, আমরা এখন হাতির পিঠে জঙ্গলে যাব কী না।  তাকে একটু বিরক্ত হয়েই বললাম, “আমরা আগামীকাল ভোরে যাব, এটা তো গতকাল আসার সময়েই বলে দিয়েছি। আজ ভোরে কী করতে এসেছো”?
লোকটি কিন্ত ফিরে না গিয়ে বললো, “বাবু, সব হাতিতে লোক উঠে গেছে, কিন্তু দুটো হাতি লোক না পেয়ে ফাঁকা দাঁড়িয়ে আছে। আপনারা যদি এখন যান, তাহলে খুব ভাল হয়”। 
এই মুহুর্তে সেটা সম্ভব নয়, কারণ ছোট বাচ্চাটা এখনও ঘুম থেকেই ওঠেনি। কাজেই লোকটিকে পরিস্কার জানিয়ে দিলাম যে, “আজ এই ভোরে ঠান্ডায় বাচ্চাকে ঘুম থেকে তুলে তৈরী করে যাওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া গতকাল আমরা অনেকটা পথ পার হয়ে এখানে আসায়, ওরা খুব ক্লান্ত। কাজেই আগামীকাল ভোরেই যাব”।
লোকটি ফিরে না গিয়ে পুনরায় বললো “বাবু সব হাতি একসাথে জঙ্গলে যায়, এই দুটো হাতির জন্য সবাই দাঁড়িয়ে আছে। আপনারা দয়া করে একটু তৈরী হয়ে নিন। খুব বেশী সময় তো লাগে না, ফিরে এসে সারাদিন বিশ্রাম নিন। তা নাহলে আমাদের খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। আমি নীচে অপেক্ষা করছি, খুব দেরী করবেন না”।
কী আর করা যাবে, সবাইকে ডেকে তুলে তৈরী হয়ে নীচে নেমে এসে দেখি, অন্য হাতিগুলোয় পর্যটকরা উঠে বসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সবথেকে বড় ও স্বাস্থবান হাতিটা বিদেশীরা দখল করেছে। সেটা নাকি দলমা থেকে আসা বিখ্যাত কুনকী হাতি। আমাদের জন্য পড়ে থাকা হাতিদুটোরই পায়ের ফাঁকে দুটো বাচ্চা ঘুরঘুর করছে। বুঝতে পারছি সকলে পছন্দ মতো হাতির পিঠে উঠে বসে আমাদের জন্য অবশিষ্ট নিকৃষ্ট হাতিদু’টো রেখে, আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ছোট ছোট বাচ্চা সমেত হাতিদু’টো দেখে জঙ্গলে ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছা উবে গেল। লোকটাকে বললাম “এই হাতিদু’টো আমাদের দিলে আজ আমরা যাব না। দু’টো হাতির সঙ্গেই ছোট বাচ্চা আছে, রাস্তায় অসবিধা হতে পারে।   কাল সকালে আমাদের জন্য ভাল হাতি রেখ, আমরা আগামীকাল যাব”। লোকটা হাল না ছেড়ে আমাদের আশ্বস্ত করে যে তথ্যটি জানালো, তাতে এই হাতি যুগলের পিঠে জঙ্গলে যাওয়ার ইচ্ছা তলানিতে এসে ঠেকলো। হাতিদু’টির সম্পর্ক মা  ও মেয়ের। তাদের বাচ্ছা দু’টোর বয়স দশ মাস ও বার মাস। তাদের নাম ফকলু ও ডলি। অর্থাৎ তাদের সম্পর্ক  অতি আদরের—“মামা ও ভাগনী”। এত ছোট বাচ্চা সঙ্গে করে জঙ্গল ভ্রমণ আর যাই হোক, সুখকর হবে না। কিন্তু নছোড়-বান্দা লোকটির অনুরোধে, শেষপর্যন্ত আমাদের ভাগ করে হাতিদু’টোর পিঠে উঠে বসতেই হ’ল। 
একসাথে লাইন দিয়ে সবাই যাত্রা শুরু করলেও, কিছুক্ষণের মধ্যেই একে অপরের থেকে অনেক এগিয়ে পিছিয়ে আলাদা হয়ে গেল। আমরা যে ডলি-ফকলুর কৃপায় সবার থেকে পিছিয়ে পড়লাম, এটা বোধহয় উল্লেখ করার প্রয়োজন রাখে না। যথারীতি ক্রমে ক্রমে আমরা অন্যান্য হাতিদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম।
হেলেদুলে বেশ চলেছি। হাতিদু’টোর একবার পাশেপাশে, প্রায় মায়ের শরীর লেপ্টে বাচ্চাদুটো চলেছে। স্ত্রী, কন্যা ও অপর শিশুটিকে নিয়ে, আমি ডলির মার পিঠে বসে। ভোরের শিশিরে জঙ্গলের ঘাস, লতাপাতা এখনও বেশ ভিজে। হঠাৎ আমাদের হাতিটা একটা ফ্যাঁচ করে বিকট আওয়াজ করে, মুখ ঘুরিয়ে মুহুর্তের মধ্যে পিছন দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। পেট ও  পিঠের রোমগুলো কী রকম সুচের মতো তীক্ষ্ণ হয়ে গেল। ঘটনাটা এবার বোঝা গেল। গাছের ঝুরির মতো একটা বেশ শক্ত সরু লতায় পা জড়িয়ে ভিজে মাটিতে ডলি আছাড় খেয়েছে। মা হাতি তার শুঁড় দিয়ে লতাটা ছিঁড়ে, বাচ্ছাকে টেনে তুলে, আবার মুখ ঘুরিয়ে আগের মতো এগিয়ে চললো। এখন তার শরীর ও পথ চলা, আবার আগের মতোই স্বাভাবিক।  শুধু ডলি পাশ থেকে একটু সরে গেলেই, শুঁড় দিয়ে টেনে প্রায় চার পায়ের নীচে টেনে নিয়ে আসছে। বড় বড় কানের জন্য হাতির নাকি পিছনে দেখতে অসুবিধা হয় শুনতাম, এখন তো দেখছি পিছনের দিকে থাকলেও সন্তানের প্রতি তার সজাগ দৃষ্টি আছে।  
আরও কিছুটা পথ এগিয়ে, আমরা একটা সরু খালের মতো জায়গায় এসে পৌঁছলাম। আমাদের ঠিক পিছনে ফকলু তার  মার শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। নীচু খালের মতো জায়গাটায় জল নেই বটে, কিন্তু নরম কাদায় ভর্তি। আগের হাতিগুলোর কৃপায় তার হাল বড়ই শোচনীয়। হাতিটা মাথা নীচু করে কাদামাখা পিচ্ছিল খালটায় নামার উপক্রম করতেই, আমার একটা ভয় মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো— হাতিটা পা পিছলে পড়ে যাবে নাতো? তাহলে হাতিটার কিছু না হলেও, আমাদের হাতি চাপা পড়ে মারা গিয়ে Guinness World Records এ নাম ওঠা কেউ আটকাতে পারবে না। মাহুতটি আবার জাতীয় ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা বোঝে না। সে তখন মাথা নীচু করা হাতির মাথার ওপর প্রায় আধঝোলা অবস্থায় বসে, হাতি সামলাতে ব্যস্ত। তবু তাকে আমার বিশুদ্ধ হিন্দীতে জিজ্ঞাসা করলাম—“ও ভাই, তুমারা হাতি কাদায় পা পিছলে গির যায়গা তো নেহি? মেরা সাথ বাচ্চি হায়। হাতি গির জায়গা, তো হামারা প্রাণ নিকাল  যায়গা”। মাহুত মাথা নীচু করা হাতির মাথায় নীচের দিকে মাথা করে প্রায় ঝুলন্ত অবস্থায় একটু বিরক্ত হয়েই বললো, “কুছ হোগা নেহি, প্রেমসে বৈঠিয়ে”। আমরাও এবার সামনে নীচের দিকে ঝুঁকে বসে আবার সেই একই কথা বলতে যাব, এমন সময় ঐ কাদামাখা খালে সামনের দু’পা, আর খালের ওপরে পিছনের দু’পা অবস্থায় হাতিটা আগের মতোই রোম খাড়া করে, বিকট আওয়াজ করে ঘুরে দাঁড়ালো। না আমরা কেউ পড়ে যাই নি, তবে ডলি খালের কাদায় আবার পা পিছলে পড়েছে। ফকলু ওর থেকে দু’মাসের ছোট হলেও, মামা হবার সুবাদে সম্মানের দিক থেকে বড় বলেই বোধহয় অনেক স্মার্ট। এখনও একবারও পড়েনি। ঈশ্বর সর্বজ্ঞ, তাই বোধহয় হাতির এই বিপদের কথা চিন্তা করেই তাদের শরীরে শুঁড় নামক একটি ক্রেন জুড়ে দিয়ে সমস্যার সমাধান করে দিয়েছেন। ঐ ক্রেনের সাহায্যেই এবারও ডলি উদ্ধারপর্ব সমাপ্ত হল।  
আমরা খানতিনেক গন্ডার, দু’টো বাইসন, কয়েকটা হরিণ, ময়ুর ইত্যাদি দেখে ফেরার পথে সঙ্গের শিশুটি হঠাৎ তার এক হাতের গ্লাভস্ খুলে মাটিতে ফেলে দিল। কী করবো ভাববার আগেই, ফকলুর মা শুঁড় দিয়ে গ্লাভসটা তুলে আমাদের হাতে দিয়ে দিল। আরও কিছুটা পথ এসে হঠাৎ আমাদের হাতিটা দাঁড়িয়ে পড়ে আস্তে আস্তে একদিকে কাত হতে শুরু করলো। অবস্থা এমন দাঁড়ালো, যে আমরা হাতির পিঠে কাত হয়ে পড়ে যাবার ভয়ে, হাওদার লোহার সিক ধরে বসে আছি। মাহুত জানালো ডলি দুধ খাবে। আমাদের প্রমোদ ভ্রমণের চেয়ে একটি শিশুর মাতৃদুগ্ধ পান করা অনেক জরুরী, তাই ঐভাবে অনেকক্ষণ কাত হয়ে হাতির পিঠে বসে রইলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে ডলির গ্রীন সিগনাল পেয়ে, আমরা আবার সোজা হয়ে বসে এগিয়ে যাবার সুযোগ পেলাম।
ফিরে এসে একে একে হাতির পিঠ থেকে নামার পরে ডলি ও ফকলু একসাথে শুঁড় উঁচিয়ে আমার স্ত্রীকে ধাক্কা মেরে  এগিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করলো। ও ভয় পেয়ে প্রায় ছুটেই পিছিয়ে যেতে লাগলো। মা হাতিদু’টো ও মাহুত যুগলকে  দেখে মনে হ’ল, তারা এই দৃশ্য বেশ উপভোগ করছে। ডলি ও ফকলুকেও যতটা নিরীহ ও শান্ত মনে করেছিলাম, এখন দেখছি তারা আদৌ তা নয়। মাহুতরা জানালো ওরা খাবার চাইছে। ব্যাগ থেকে বিস্কুট বার করে ছোট ছোট করে ভেঙ্গে ওদের মুখে দিলেও, অর্ধেক পাশ দিয়ে পড়ে যাচ্ছে। ছোট বাচ্চাদের ভাত খাওয়াবার সময় যে দৃশ্য মায়েদের রোজ   দেখতে হয়, অনেকটা সেইরকম। পরে দেখেছিলাম বড় হাতিদের খিচুড়ির মতো খাবার কলাপাতায় মুড়ে খেতে দেওয়া হচ্ছে, আর মাহুতরা ঐ খাবারের ছোট ছোট গ্রাস, পরম যত্নে ডলি, ফকলুকে মাতৃস্নেহে হাতে করে খাওয়াচ্ছে। খাওয়াবার চেষ্টা করছে বললেই বোধহয় ঠিক বলা হবে, কারণ সেই গ্রাসের সিংহভাগই মুখ থেকে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে।
আমরা পশু দর্শন থেকে একেবারে বঞ্চিত হই নি। কিন্তু তবু মনে হচ্ছিল, আজ একটা পাখির দর্শন না পেলেও আমাদের দুঃখ পাওয়া উচিৎ হ’ত না। জঙ্গলে গিয়ে পশুপাখির দর্শন তো অনেকেই পায়, আমরাও পেয়েছি, ভবিষ্যতেও পাব। কিন্তু আজকের ভ্রমণের এই অদ্ভুত স্বাদ, ক’জনের ভাগ্যে জোটে? আমরা ভাগ্যবান, তাই ডলি ও ফকলুর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছি। মনে মনে কামনা করলাম মামা-ভাগনী সুখে শান্তিতে থাকুক।
                                

আবু রাশেদ পলাশ

  ভবপুরে পরকথা
                                          

সোনাতলা গ্রামের রমিজা এখন ঘোমটা পরা পল্লীবধূ । ওকে প্রথম দেখে শতরূপী সূর্য মনে হয়েছিল আমার । সকালে সূর্য দেখেছ কেউ ? ও যখন ভূমিষ্ঠ হয় তাকালে রক্তাক্ত আভা দেখা যায় । ভেতরে তার আগ্নেয়গিরি আর তপ্ত লাভা  যে পুড়ে সে অঙ্গার হয়। আবার মরণকালে লালরঙা শাড়ি পড়ে সে । রমিজারা সূর্যের ন্যায় । ওদের চোখে তাকিয়ে দেখ সূর্যের সমস্ত রূপ সেখানে বিদ্যমান ।
আটপাড়া গ্রামের দিলু শেখের সাথে বিয়ে হয়েছে রমিজার । শহরমুখী সড়কটার কোল ঘেষে ওদের বাড়িটা । ভেতরে টিনের দুচালা ঘর । পর্দা রক্ষার খাতিরে বাঁশের বেড়া দেওয়া হয়েছে চারপাশে । বড় ঘরের মেঝেতে বসে দিনমান কাঁথা সেলাই রমিজা । ভেতরে ভেতরে ভালবাসার মানুষকে নিয়ে স্বপ্ন বুনে সে । দিলু শেখ বাড়ি ফিরলে অজুর পানি এগিয়ে দেয়, খেতে বসলে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করে তাকে । দিলু বলে-
-একখান নলা খাবানি বউ, দেই ?
রমিজা কথা বলেনা সহসা । লজ্জায় চোখগুলো নিচে নামিয়ে নেয় সে । তারপর ঘোমটাটা আরেকটু লম্বা করে টেনে দেয় মাথার উপর । দিলু শেখ আবার বলে-
-শরমাও ক্যান, আমি না তোমার সোয়ামী ? নেও একখান নলা খাও বউ ।
রাতে বিছানায় শুয়ে সুখ দুঃখের গল্প করে দুজন । কত কত কথা বলে সময় ধরে  চাঁদটা জ্বলতে জ্বলতে একসময় নিভু নিভু ভাব আসে ওর । দিলু শেখের কথা ফুরায়না সহসা । কথার পিঠে কথা চড়ে ওরা রূপকথার গল্প তৈরি করে যেন, সে গল্পে না বলা কত কথা ভাষা পায় !  
প্রথম কয়েক বছর রমিজার সংসারটা এমনই ছিল । তারপর কেমন করে যেন দিলু শেখ বদলে গেল হঠাৎ করেই ।এখন কাজের অজুহাতে মোরগ ডাকা ভোরে বাড়ি ছাড়ে সে । তারপর আর সারাদিন দেখা পাওয়া যায়না তার । ও যখন বাড়ি ফিরে জলন্ত প্রদীপটা তখন নিভু নিভু । এসে কথা বলেনা রমিজার সাথে । রমিজা নিঃসন্তান । পাশের বাড়ির করিম শেখ, এক বছর হল বিয়ে করেছে সে । এর মধ্যেই ঘরে ফুটফুটে সন্তান তার । ওর বউ নংক বিকেলে ছেলেকে কোলে নিয়ে পাড়া ঘুরে । দেখলে রমিজার মধ্যেও মাতৃত্ব জেগে ওঠে তখন  বিয়ের পর মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষগুলোর মধ্যে সন্তানের বাসনা থাকে খুব । রমিজার কেবলই মনে হয় দিলু শেখের দুঃখটা হয়তো এ কারণেই । সে জন্য মনে মনে নিজেকেই অপরাধী ভাবে সে  রাতে সংসারের কাজ সেরে ও যখন বিছানায় যায় দেখে দিলু শেখ শুয়ে পড়েছে আগেই । রমিজা এলে পেছন ফিরে শোয় দিলু । সোহাগী রমিজা স্বামীর জন্য উতলা হয় তখন । সংকোচ বোধ করলে ভেতরের মানুষটা যেন বিদ্রোহ করে তার সাথে । রমিজা বলে-
-অমন কইরে শুইছেন যে,শরীর নি ভালা আপনের ?
-ভালাই । ঘুমাও । জালায়ওনা অহন ।
-আপনেরে কেমুন অচেনা ঠেকে আজ
-সুরতনি বদলায়ছে আমার । দিলে ঘা দিওনা কইলাম ।
কথা বাড়ায়না রমিজা । বাড়ানোর প্রয়োজনও নেই । ভালবাসাহীন এ সংসারে তার কথা যে ফলহীন এটা সে জনে । পরমুহূর্তে স্বামীর পাশে শুয়ে বালিশে হেলান দেয় রমিজা  শত সহস্র ভাবনা এলে ভেতরটা আঁকুপাঁকু করে তখন । অন্তরচক্ষু আস্ফালন করে সময় ধরে । একসময় রাতের নিস্তব্ধতার কাছে নিজেকে সঁপে দেয় সে । সকালে রমিজা ঘুম থেকে উঠে দেখে দিলু বিছানায় নেই । তারপর আর সারাদিন খোঁজ পাওয়া যায়না তার ।
তাড়াইল গ্রামের টঙ্কু বাবা মারা গেলে পিতার ব্যবসার উত্তরসুরি হয় । পাড়ায় পাড়ায় মেয়েদের প্রসাধনী ফেরি করে বেড়ায় সে । এখন তাড়াইল গ্রামে ওর খোঁজ পাওয়া দুষ্কর । সকাল-সন্ধা বাইরে থাকে টঙ্কু । বাড়ি ফিরে রাত করে । এখানে ওর বাড়িটা গোমতী নদীর উত্তরে ।খোলা বাড়ি, চারপাশে দৈন্যতার ছাপ । গোমতী পাড়ে দাঁড়ালে ভেতরটা চোখে পড়ে সহসায় । বাড়ির পেছনে একটা পুরনো কবর । জংলা হয়ে আছে  ভেতরে একটা গর্ত হয়েছে ওর । গরীব মানুষের কবর পরিচর্যা করেনা কেউ । আর কবছর পর হয়তো অস্তিত্ব হারাবে ওটা ।
একই পাড়ার আনাড়ির সাথে মন দেওয়া নেওয়া করে টঙ্কু  গোমতী পাড়ে পুরনো নৌকা মেরামতের অপেক্ষায় থাকে । বিকেলে নৌকার গলুইয়ে বসে গল্প করে দুজন । আনাড়ি হাঁক দেয়-
-রূপসী মাইয়া দেইখা ভুইলনা আমারে ।
-ডরাসনি, ভরসা নাই ?
-আছে নিযজস । তবু মুনে ডর আহে যে ?
-তাইলে বশীকরণ তাবিজ দে আমারে ।
টঙ্কুর কথা মনে ধরে আনাড়ির । তারপর ঠিকই একদিন টঙ্কুর হাতে বশীকরণ তাবিজ বেঁধে দেয় সে । তখন আনাড়ির কৈশোরিক চপলতাগুলো মুগ্ধ করে টঙ্কুকে । ভেতরে ভেতরে অস্ফুট ভালবাসা জেগে উঠে তার । রাতে সঙ্গীহীন বিছানায় শুয়ে ঘরে বউ আনার পাঁয়তারা করে সে । সামনে মাঘ মাস । হ্যা, এবার মাঘের শীতেই আনাড়িকে বিয়ে করে ঘরে তুলবে টঙ্কু ।
দিলু শেখ বাড়ি না থাকলে আজকাল প্রায়ই নংক এসে গল্প করে রমিজার সাথে । দুজনের মধ্যে সখ্যতা হয় দিনে দিনে । নংক বলে-
-ওবু ভাইজান অহনো গোসসা কয়রে আছেনি ?
-কি জানি ? মানুষটা বদলায়ছে মেলা ।
-সবুর দেও । পুলার খায়েশ অইছে মুনে কয় ।
নংকর কথার সহসা জবাব দেয়না রমিজা । ভেতরটা তখন হাহাকার করে তার । করিমের ছেলেটা উঠানে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ায় । ওর দিকে দৃষ্টি গেলে একাকি আনমনা হয় সে । কিছুক্ষণ পর নংক আবার হাঁক দেয়-
-বুজান পুলারে দেইখো, আমি আহি 
নংক চলে গেলে রমিজা উঠে আসে দাওয়া থেকে । শিশুটাকে কোলে তুলে নেয় সে । তারপর নরম হাতে হাত রাখে ওর । এরমধ্যে একদিন আটপাড়া গ্রামে ফেরি করতে আসে টঙ্কু । দিলু শেখের বাড়ির দহলিজে ফেরিওয়ালার ডাক শুনলে নংক এসে ভেতরে নিয়ে যায় তাকে । তারপর কাঁচের চুড়ি আর মাথার ফিতা সওদা করে ওরা । রমিজার দিকে দৃষ্টি গেলে পলকহীন তাকিয়ে থাকে টঙ্কু । আচমকা ওর চাহনি দৃষ্টি এড়ায়না রমিজার । নিজের মধ্যে অস্বস্তি কাজ করে তখন । পরক্ষণে  ভেতরে চলে যায় সে । টঙ্কু চলে গেলে হাঁক দেয় নংক
-ও বু, আয়ে পড়লা যে ?
-পুলাডার চাওন দেখছনি, গাও জলে ।
- ছাড়ান দেও পুরুষ মানুষ অমনি ।
সেদিন রাতে বিছানায় শুয়ে ভাবনায় পড়ে টঙ্কু । আটপাড়া গ্রামে দেখে আসা অচেনা রমণীর চক্ষুযুগল ভেতরে জ্বালা ধরায় তার । তার পুষ্পিত মুখশ্রীতে নিজের সত্তাকে খুঁজে ফিরে সে । এরপর ফেরি করার নাম করে মাঝেমাঝেই আটপাড়া যায় টঙ্কু  সন্ধানী চোখ দুটো মনে মনে রমিজাকে খোঁজে । কিন্তু সহসা দেখা পায়না ওর ।
অগ্রহায়ণ মাস- ধান কাঁটার মওসম । এ সময় নতুন ধান উঠে গেরস্তের গুলায় । ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসব করে মেয়েরা । পাড়ায় পাড়ায় ফেরিওয়ালাদের আনাগুনা বাড়ে । বাহারি পণ্যের পসরা নিয়ে বাড়ি বাড়ি যাতায়াত করে ছেলেরা । টঙ্কুও ব্যস্ত হয় সবার সাথে । কদিন থেকে আনাড়ির সাথে দেখা হয়না তার । ও যখন বাড়ি ফেরে গ্রামের পথে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার । বাঁশবনে ঝি ঝি পোকাদের অবিশ্রাম আওয়াজ শুনা যায়  ওরা জেগে থাকে রাতের শেষ অবধি । রাতে ঘরে ফিরে টঙ্কু আনাড়ির রেখে যাওয়া তরকারি পায়  চপলার কথা মনে হয় তখন । পরদিন আবার ভোরে বাড়ি ছাড়ে সে । সকালে আনাড়ি এসে দেখে টঙ্কুর ঘরে তালা দেওয়া । রৌদ্রোজ্জল মুখে আমাবস্যার বান ডাকে তখন । বেশ কদিন ধরে মনে মনে টঙ্কুকে খোঁজে আনাড়ি ।
আজ রমিজার মন খারাপ । রাতে কোন একটা ব্যাপার নিয়ে দিলুর সাথে কলহ হয়েছে তার । দিলু মেরেছে তাকে । চোখগুলো ফুলে আছে এখন । যে দেহ ভালবাসার কাঙাল, তাকে ভালবাসা দিয়েই তুষ্ট করতে হয় । মন খারাপ হলে বড় ঘরের জানালার পাশে আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে থাকে রমিজা । মেঘাচ্ছন্ন আকাশে তখন শালিকের আনাগুনা বাড়ে । ওদের দিকে তাকিয়ে রমিজা নিজের মধ্যে লুকায়িত কোন অস্তিত্বকে খোঁজে বেড়ায় হয়তো, যার কাছে নিজেকে বিসর্জন দিতে ইচ্ছে করে তার । ভালবাসাপূর্ণ যে দেহে ভাটা পড়েছে এখন, একদিনতো সেখানেই জোয়ার ছিল তার । আবার অস্তিত্বে ঢেউ লাগলে জোয়ার হতে কতক্ষণ । রমিজা মনগাঙে জোয়ারের অপেক্ষা করে দিনের পর দিন । দিলু শেখ বাড়ি না থাকলে এরমধ্যে আবার একদিন দহলিজে ফেরিওয়ালার আওয়াজ শুনা যায় । আজ নংক নয়,রমিজা ডেকে ভেতরে বসায় তাকে । তারপর আবার পলকহীন চক্ষুযুগল দৃষ্টিগোচর হলে প্রশ্ন করে
-অমন কইরে কি দেহ, রূপ জালাইছে মুনে কয় ?
-তোমারেই দেহিগো আপনা মুনে অয় যে ।
-কেমুন কতা কও,গাও জলে কইলাম
-জলেনি ? গাওযে আমারো জ্বলে, বুঝনা ?
টঙ্কু চলে গেলে ভাবনায় পড়ে রমিজা । এরপর কিছুদিন অচেনা মানুষটার দেখা পায়না সে । কয়েকদিন বাড়িতে অলস সময় কাটায় টঙ্কু । বড় ঘরের পেছনের পুরনো কবরটা পরিষ্কার করে  তারপর বাঁশের বেড়া দেয় চারপাশে । এটা নহিলার কবর  টঙ্কুর বড় বোন । নহিলার কথা মনে আছে কারো ? আহ! কি স্নেহভরা চাহনি ছিল ওর  মরার আগে জন্ডিস হয়েছিলো নহিলার, মুখটা কেমন ফ্যাঁকাসে হয়ে গিয়েছিল তখন, হলুদ হলুদ । জন্মের পর মাকে দেখেনি টঙ্কু । ওকে ভালবাসা দিয়ে বড় করেছে নহিলা  কদিন ধরে ওর কথা মনে হয় তাই  তখন বন্ধুহীন বন্ধুর পরিবেশে একটা স্নেহময়ী হাতের স্পর্শ অনুভব করে সে ।
এখন আটপাড়া গ্রামে গেলেই রমিজার সাথে দেখা হয় টঙ্কুর । রমিজা ডেকে নিয়ে ভেতরে বসায় তাকে । সুখ-দুঃখের গল্প করে দুজন । বিকেলে ক্ষুধার্ত টঙ্কু আহার করে বাড়ি ফেরে । এগুলো দৃষ্টি এড়ায়না নংকর । টঙ্কু এলে এ বাড়িতে আনাগুনা বাড়ে তার  গতিবিধি লক্ষ্য করে রমিজার । টঙ্কু বলে-
-ভাই জানলে গোসসা অইবোনি ?
রমিজা বলে-ছাড়ান দেও । দিল পাক থাকলে ডর কিয়ের ?
টঙ্কু চলে গেলে বড়ঘরের মেঝেতে বসে কাঁথা সেলাই রমিজা । খানিক পরে হাতে একটা বাটি নিয়ে এগিয়ে আসে নংক । তারপর হাঁক দেয়-
-ছালুননি আছে বুজান ? দিবানি, ভাত খামু ।
-ছালুননি ? বিয়ানেই শেষ ।
-মিছা কও ক্যান, ফেরিওয়ালা খাইলো দেখলাম । অত দরদ কিয়ের কওতো ?
-কেমুন কতা কও, মুখ সামাল দিও কইলাম 
-মিছানি বুবু ? হাঁচা কইতে দোষ কি ?
পরক্ষণে এক দুই কথায় কলহ করে ওরা । রাতে দিলু শেখ বাড়ি ফিরলে টঙ্কুকে নিয়ে বিভিন্ন আশালীন কথার তুবড়ি ছুটে নংকর মুখে  তারপর দিলু শেখের ঘরে মেয়ে মানুষের কান্নার আওয়াজ শুনা যায় । টঙ্কুকে খেতে দেওয়ায় রমিজাকে মারে দিলু শেখ । দিলু মারলে ডাঙায় তোলা চিতল মাছের মত কাতরায় রমিজা । পাষণ্ডটা ভ্রূক্ষেপ করেনা সে দিকে । সকালে ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে যায় সে । পথিমধ্যে রমিজার সাথে দেখা হয় তার । দিলু বলে-
-আজ আর ছাড়িনায় গো । বাঞ্জা মাগীর বিষ অইছে মুনে কয় 
সহসা কথা বলেনা নংক । দিলু চলে গেলে ভেতরে ভেতরে বুনো হাঁসি হাঁসে সে ।
রমিজার পিঠে দিলু শেখের মারের দাগগুলো কাল হয়ে থাকে  টঙ্কুর দৃষ্টিগোচর হলে শিউরে উঠে সে । তারপর বলে-
-লও যাই ।
-কই ?
-বদরগঞ্জ বড় হুজুরের দরগা, হেরে কইলে সব ঠিক কইরে দিব নিজ্জস ।
তারপর একদিন টঙ্কুর হাত ধরে বাইরে পা রাখে রমিজা । উদ্দেশ্য বদরগঞ্জ, বড় হুজুরের দরগাহ   ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়না এ পাড়ার কারোরই ।ওরা গেলে এক এক করে কানাকানি করে লোকজন ।
-ও আহালুর মাও,রশিদের বউ, পেচির নানি খবর হুনছনি ?
-কি কওতো ?
-দিলুর বউনি বাড়ায় গেছে হুনলাম ।
-সব্বনাস, দিলু কই খবর দেও হেরে ।
দিলুকে খবর দেওয়ার প্রয়োজন হয়না । পাড়াপড়শিরা কানাকানি করলে জেনে যায় সে । করিমের বউ নংক সত্য মিথ্যা মিশ্রিত করে কুৎসা রটনা করে গ্রামে ।
-বারো ভাতারি মাইয়া এমুনি,হুনছনি চাচি অচিন পুলা তার লগে কি ডলাডলি । সুরত দেখলে পিত্ত জ্বলে ।
আটপাড়া গ্রামের জুলু মাতব্বর । মুখে বাদশাহি গোঁফ তার, লোকে বলে ওসমানী গোঁফ । এ গাঁয়ে  সালিশ করে বেড়ায় সে । গাঁয়ের মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষ গুলো জমের মত ভয় পায় তাকে । জুলু মাতব্বরের কানে খবর পৌঁছলে, এখান থেকে কয়েকজন লোক পাঠায় সে টঙ্কুকে ধরে আনতে  বদরগঞ্জ বাজারে গিয়ে খোঁজ পাওয়া যায় ওদের । তারপর আটপাড়া এনে বেঁধে রাখা হয় টঙ্কুকে  গাঁয়ের ছেলেরা সুযোগ বুঝে প্রহার করে তাকে । কেউ কেউ অশ্লীল ভাষায় গালি দেয় মাঝে মাঝে । পরদিন তাড়াইল থেকে লোক গেলে সালিশ হয় আটপাড়া গ্রামে । দিলু শেখের মত জিজ্ঞেস করলে বলে দেয়-
-ঐ বউ ঘরে নিমুনা আমি । অবশেষে জুলু মাতব্বর মীমাংসা দেয় সালিশের ।
-তাইলে রমিজারে টঙ্কুই নিকা করবো, কি কন হগলে ?
-হ, ঠিক কতা ।সমস্বরে সায় দেয় সবাই ।
-নিকা আগামী শুক্কুরবারে অইবো তাইলে ।
জলু মাতব্বরের কথায় রাজি হয়না টঙ্কু । ও রাজি না হলে গ্রামের ছেলেরা চড়াও হয় আবার  অবশেষে জুলু মাতব্বরের কথায় ঠিক থাকে । আগামী শুক্রবারই হুজুর ডেকে টঙ্কুর সাথে রমিজার নিকা পড়াবে সবাই । টঙ্কু বাড়ি ফিরলে ওর সাথে কথা বলেনা আনাড়ি । নিজের ঘরে শুয়ে অশ্রু বিসর্জন দেয় মেয়েটা  পরদিন বিকেলে টঙ্কুর দেওয়া জিনিস ফেরত দিতে আসে সে । তারপর বলে-
-মুখখান আর দেখায়োনা আমারে,মুনে এই আছিল কওনাই ক্যান ?
টঙ্কু কোন কথা বলেনা  বলার প্রয়োজনও নেই । ও অনুভব করে,বিশ্বাসে যখন ফাটল ধরে তখন সম্পর্ক কাঁচের ন্যায় । সে সম্পর্কে আর যায় হোক সারাজীবন একসাথে থাকা যায়না 
রমিজা এখন সোনাতলা বাবার বাড়িতে থাকে । দিলু শেখের ঘরে জায়গা হয়নি তার । অথচ একদিন এ মানুষটাকেই নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছিল সে । কি দেহ,কি আত্মা । সেদিন ওকে ফিরে পেতেই বদরগঞ্জ গেছিল রমিজা । বশীকরণ তাবিজ এনেছিল সে । এখনও রমিজা অপেক্ষা করে শুক্রবারের আগেই ফিরে আসুক দিলু । কিন্তু সে আর ফিরে আসেনা তার কাছে ।
বিকেলে বাড়ির বাইরে এলে নহিলার কবরটা চোখে পড়ে টঙ্কুর  কদিন আগে সেটা পরিষ্কার করেছে সে । দশ বছরের স্নেহ পাগল যে মানুষটাকে রেখে নহিলা পরবাসী হয়েছে,সে নহিলাকে আবার টঙ্কু খুঁজে পেয়েছিল রমিজার চোখে । ভেজা ভেজা চক্ষুযুগল দেখে মনে হয়েছিল, ওটা ওর বোনের চোখ ।
এখন সম্পর্কের দোলাচলে দোদুল্যমান তিনটি প্রাণ আস্ফালন করে নিজেদের মধ্যে । সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়েও সঠিক পথের সন্ধান করতে পারেনা কেউ । এক এক করে দিন ঘনিয়ে যায় । তারপর একদিন সকালে বুকফাটা আর্তনাদ করে আনাড়ি । এ পাড়ায় মরেছে কেউ । বিকেলে অস্তগামী সূর্যটার দিকে তাকিয়ে দেখে রক্তাক্ত সেও 




দেবাশিস কোনার

কান পেতে রই


      হানাই ফোন করল শেষ অবধি । ফোন না করে তার উপায়ই বা কি ?ব্যবসা তো তাকে করতে হবে ? ব্যাপারটা এমন নয় যে , একদিনেই সব মিটে যাবে । তাকে আর কখনও এই কাজে ফিরে আসতে হবে না ? হানাই খুব গরীব মুসলমান যুবক । তার ব্যবসাটা খুব একটা আকর্ষণীয় নয় । তবে করে - কম্মে খেতে পায় এই যা । ২৪ ঘণ্টা চক্কর কাটতে হয় । হাজার লোকের সঙ্গে কথা বার্তা বলতে হয় । তারপর হল গে তোমার ফাইনাল ডিল । অনেক সময় সবকিছু ঠিক হয়ে যাওয়ার পরেও কেস কেঁচিয়ে যায় না , তা নয় । 
         এই ব্যবসায় দুটো জিনিসে বেশ সজাগ থাকতে হয় । চোখ আর কান সদা সর্বদা খুলে রাখতে হয় । না হলে সর্বনাশ । কে যে কোথা থেকে এসে তোমার ক্ষতি করে দেবে তা তুমি বুঝতেই পারবে না । হানাই সেই কারনে খুব ভেবে চিন্তে কাজ করে । করলে কি হবে , বিপদ যখন আসে তখন তো আর বলে কয়ে আসে না ? হানাইয়ের জীবনে এমন অভিজ্ঞতা আগে প্রায় হয় নি বললেই চলে । 
         রতন দত্তের বিঘা ১২ জমি । সেই জমির বিচালি কেনবার বরাত পেল হানাই । ফাইনাল ডিল হয়ে গেছে এবার খড় বা বিচালি যাই বলুন তুলবে হানাই । ঠিক এই সময়ে রতন বাবুর ছেলে মিলন এসে বলল ,' বাবা বলেছে খড় না বাঁধতে ।' হানাই তো অবাক । সে বলল ,' পাকা কথা হয়ে গেছে , আমি লোক ঠিক করে ফেলেছি । এখন না বললে তো হবে না ।'
        মিলন পাকা খেলোয়াড় । 
     হানাই শুনেছে ছেলেটি নাকি কি সব শুকনো নেশা ভাঙ্গ করে । রতন বাবুর খামার বাড়িতে লোকে লোকারণ্য । খর বা বিচালি বাঁধতে এসেছে তার জনা দশেক লেবার । আসে পাশের বহু মানুষ এতো জন সমাগম কেন , তা দেখার জন্য এসেছে । আর এসেছে মিলন আর তার নেশার সাথি কয়েকজন । 
        'বল , বাপজান ! তুমি কি বলবে ?' - হানাই অতি ভদ্র ভাবে প্রশ্ন করে ?
রতন দত্ত কলকাতায় চাকরি করেন । তার স্ত্রী - পুত্র - পরিজন সকলে গ্রামে থাকেন ।এই নেশাখোর ছেলেটিকে নিয়ে তার যত চিন্তা । হানাইয়ের হয়েছে যত বিপদ !
 
      মিলন বলে ,' তুমি খুব কম টাকায় বাবাকে ঠকিয়ে খরটা কিনেছ । যাক , যা করেছ করেছ । আমি কিছু বলবো না । তবে আমাকে শ'খানেক দিতে হবে ।'
      'আর যদি টাকা না দিই ?' রাগত স্বরে প্রশ্ন করে হানাই ।
       ' তাহলে খর বাঁধা বন্ধ রাখ !' মিলন জবাব দিল ।
   রতন বাবু গণ্য মান্য মানুষ । তাকে অযথা বিরক্ত করবে না ভেবেছিল হানাই । সে ও তো গরীব ।শেস মেস একশ' টা টাকা দিয়েই দিল হানাই । বড় লোকের ছেলে বলে কথা । তার ওপর সকাল বেলা এই সব অশান্তি কার আর ভাল লাগে ?
    রতন বাবুর খরচ প্রচুর । একদিনে সমস্ত খরটা বাঁধা হয় নি হানাইয়ের । দ্বিতীয় দিনে আবার একই কাণ্ড । আবার মিলন তার দলবল নিয়ে হাজির । আবার একশ টাকার দাবী । এবার আর ধৈর্য রাখতে পারল না হানাই । তার ছেলে যে গাঁজার নেশা করে সে কথা জানতেন না রতন বাবু । সব শুনে তিনি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরলেন । ছেলেকে পাঠালেন রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে । হানাই যে তার কত বড় উপকার করেছে তা তিনি জনে জনে বলেছেন । হানাইয়ের কাছে তার পুত্রের কাজের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন তিনি ।

শ্রাবণী বসু

বুলান-বট

যাহ্‌ বাবা কোথায় ভেবেছিলাম আজ একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমাব সেটাও হলোনা । ধুস ! জানলার পর্দাটা টেনে রাখতে ভুলে গেছি কাল। যাকগে ! উঠেই পড়ি। নাহ উঠবো না। আজ কোন কাজ নেই, অফিসও নেই। কাজের মেয়েটার আসার সময় পেরিয়ে গেলো,নিশ্চয়ই ব্যাটা ডুব দিয়েছে। উফ ,বাঁচা গেল। নিজের মনে কথাগুলো বলে পাশ ফিরলো স্বর্ণকমল।আচ্ছা কাল রাত্রে গ্যাসটা অফ করেছিলাম?ভাবতে ভাবতে তড়াক করে এক লাফে বিছানা থেকে নেমে রান্না ঘরে দৌড়ল। নাহ , আর শোব না। আজ বরং একটা ছবি আঁকব। অনেকদিন আঁকাই হচ্ছেনা কাজের চাপে। সাইকেলটা রেখে হাঁটতে লাগলো। লাল আঁকাবাঁকা পথটা দিয়ে হাটতে খুব ভাল লাগে ওর।কোথায় কোলকাতা শহর আর কোথায় এই ছোট্ট জায়গাটা ! এখানে চাকরিটা সক্কাল সক্কাল স্নান সেরে আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে স্বর্ণকমল বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল সাইকেল নিয়ে।ঝাঁটিপাহাড়ি স্টেশনের কাছে একটা চা দোকানে পেয়ে ভালোই হয়েছে।ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল সে। যেখানে রাস্তাটা হঠাৎ উঁচু হয়ে গেল সেখানটা টপকে ডান দিকে ঘুরেই একটা তিন রাস্তার মোড় পড়লো।এই জায়গাটার নাম কলেজ মোড় । স্টেশন থেকে হেঁটে এলে দশ মিনিট লাগে।এই মোড় থেকে একটা রাস্তা আরা-র দিকে গেছে। সেই রাস্তা ধরে দশ মিনিট হেটে একটা ছোট্ট গ্রাম আছে ,স্বর্ণকমল শুনেছে,সেই গ্রামটা নাকি ছবির মত সুন্দর।গ্রামের বাইরে একটা প্রকান্ড দিঘি আছে ।দিঘির জলে বড় বড় গাছের ছায়া পড়ে,পুকুরে সারি সারি হাঁস সাঁতার কাটে,ছেলে-মেয়ের দল জলের মধ্যে লাফায় ঝাঁপায়। গ্রামটাতে পৌঁছে একটা প্রকান্ড বট গাছের নিচে বসে পড়ল স্বর্ণকমল। ঝোলা থেকে একে একে সব বার করে আঁকা শুরু করল। কোত্থেকে একটা মেয়ে এসে ঘাড়ের কাছে ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করলো ,”বাবু কি আঁকছো?”স্বর্ণকমল বলল ওইযে প্রকাণ্ড বটগাছটা দেখছো,ওটা আঁকছি। ওর দুঃখ-সুখ আঁকছি ,ওর প্রেম আঁকছি।বলতে বলতে মনে হয় কিছুতা আবেগপ্রবণ হয়ে গেছিলাম।। মেয়েটি বলল,” বাবু তুমি কি বলছো? আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা।আমি বললাম,ঐতো, ঐতো, সামনের বটগাছটা দেখছো ওটাই আঁকছি।মেয়েটি বলল,” বাবু,বটের ঝুরি গুলো গাছের ডাল থেকে মাটিতে কেন নামে ?”আমি বললাম,এটাই বট গাছের বিশেষত্ব। মেয়েটি কি বুঝলো জানিনা,আমার কথা শুনল কিনা তাও জানিনা।মেয়েটি বলল ,”বাবু আমার ও বটের ঝুরির মত লম্বাচুল আছে ,এই দেখো ।বলে মস্ত খোঁপাটা আলগা করে দিল।আমার মনে হোল আমার সামনে একটা নদী বয়ে যাচ্ছে। নদীর কালো গভীর জলে ঢেউ খেলতে লাগলো,হাওয়া লেগে।আমার হাতদুটো বুকের কাছে জড়ো হয়ে গেলো।আমি বললাম তোমার নাম কী নদী? মেয়েটি বলল,আমার নাম বুলান।মেয়েটি আবার প্রশ্ন করল,”বাবু গাছের পাতা গুলো দেখে তোমার কী মনে হয়?”আমি বললাম তোমার কী মনে হয়?মেয়েটি বলল,”কচি কচি গোলাপি পাতা গুলো আমাকে বলে,জীবন খুব সুন্দর।জীবনকে খুব যত্নে রাখতে হয়।আগলে রাখতে হয়।নরম নরম হাল্কা সবুজ পাতা গুলো বলে,জীবনে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হয় আর গাঢ় সবুজ পাতাগুলো বলে,জীবনে অনেক ঝড়,ঝাপ্টা সয়ে বেঁচে থাকতে হয়।যন্ত্রনায় কষ্টে নীল হয়ে গেলেও জীবনটাকে বাচিয়ে রাখতে হয়।বলে মেয়েটি একটি হাত সামনে বাড়িয়ে বলল,বাবু ঠিক বলেছি কী?”মনে হোল যেন বটের একটি সরু ডাল গায়ে এসে ঠেকলো। আমি বললাম-হুম। মেয়েটি বলল,”বাবু বট গাছের লাল ফল গুলোর কথা তোমার বইয়ে কী লেখা আছে?”আমি বললাম,এটাই লেখা আছে যে,ফল থেকে নতুন চারা জন্মায়।মেয়েটি বলল ,”হুমসবুজ পাতার ভিতর লাল লাল ফল গুলোর জন্যই পাখি আসে,ঠুকরে ঠুকরে খায়, ফল গুলো লাল সুন্দর বলেই তো গাছটার যত জ্বালা।নাহলে কেউ ঠুকরাতো না ।না গো বাবু?”কথা ফুরোতে না ফুরোতে মেয়েটি ধূমকেতুর মতো উধাও হয়ে গেল। আমি এদিক সেদিক খুঁজতে লাগলাম। একটি মাঝবয়সি লোক উল্টো দিক থেকে আসছিলেন।গ্রামের মধ্যে অচেনা লোক দেখেই বোধ হয় জিজ্ঞেস করলেন,”বাবু এ গাঁয়ে ? কাদের বাড়ি এসেছেন ?আমি বললাম নানা কারো বাড়ি না ? কাউকে খুঁজছেন মনে হোল তাই জানতে চাইলাম।আমি পাশাপাশি তিন গাঁয়ের লোককে চিনি!আমি বললাম না মানে--- বু-লা-ন। লোকটি হো হো করে হেসে বললেন,” আর বলতে হবেনা ,এবার বুঝেছি। পাগলিটা খুব জ্বালিয়েছে তো! ওর কথায় কিছু মনে করবেন না বাবু।ছোটবেলায় বাপ-মা মরা মেয়ে মাথার ঠিক নেই। মেয়েটার জন্যে গাঁয়ের মাথা হেঁট হয়ে যায়।মেয়েটা মরলে গাঁয়ের হাড় জুড়োয়।কি পাজি মেয়ে জানেন ? যখন তখন গাছে উঠে বসে থাকে।আচ্ছা বলুন দিকি পড়লে কি কান্ড হবে ? মেয়েটার মাথাটা এক্কেবারে খারাপ ,বুঝলেন।যাকগে ওর কথায় আপনি যেন কিছু মনে করবেন না।বলে লোকটি চলে গেল। এবার আমি আঁকায় মন দিলাম।আমার ক্যানভাস আস্তে আস্তে ভরে উঠছে।দেখলাম ক্যানভাসে ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠলো, চুল এলানো একটি মেয়ে।মেয়েটি সরু হাতদুটো দিয়ে ঢেকে রেখেছে তার দীঘল চোখের লাল বটফলের মত মণিদুটো।দশটা আঙুলে গোলাপী হালকা সবুজ ,আর গাঢ় সবুজ রং।ছবিটা হঠাৎ বলে উঠলো বাবু,তুমি আমাকে এঁকেছো ? তুমি যে বলেছিলে বট গাছ আকবে? আমি বললাম তাইতো এঁকেছি।মেয়েটি বললো এ বটের নাম কি? আমি বললাম বুলান বট।