এই সংখ্যার
লেখকসূচি – বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরেন চট্টোপাধ্যায়, প্রদীপভূষন রায়, রুখশানা
কাজল, মানসী চট্টোপাধ্যায়, সুধাংশু চক্রবর্তী, ব্রতী মুখোপাধ্যায়, দেবাশিস কোণার, জয়া চৌধুরী ।
গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।
মঙ্গলবার, ৩০ জুন, ২০১৫
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
এক
শুন সব নরনারী শুন দিয়া মন
মহর্ষি বাল্মিকী কথা করি নিবেদন।
রত্নাকর মহাদস্যু পেটে নাই ভাত
ঘরে তার মেম্বার সব মিলে সাত।
অর্ধাহারে দিন কাটে চুরিবিদ্যা সার
ধীরে ধীরে হয়ে গেল ওয়াগন ব্রেকার ।
চুরি বাদ দিয়ে রতন অন্যকিছু পারেনা ।
কিন্তু এই একটি ব্যাপারে সে দক্ষ । তার হাতযশ প্রশ্নাতীত । একডাকে চেনেও সবাই ।
তার নামে সারা তল্লাট কাঁপে । সাহসী জোয়ানও বাপের নাম ভুলে যায় সদর্প হুঙ্কারে । কোথাও কোনও
চুরি ডাকাতি হলে সবাই জানে – এ রতনের
কাণ্ড । রাত হলেই তার ভূত তাড়া করে । পুলিশের বাঘা বাঘা সাহেবরা স্যালুট দেয় ।মাঝে একবার চোররত্ন দেওয়ার প্রস্তাব
উঠেছিল । কে যেন ব্যাপারটা কেঁচিয়ে দিয়েছে । সুবল দারোগা রতনকে মাঝে মাঝে বাড়িতে
কল করে – বাপ রতন, তোমার কেরদানি একটু মিনিমাইজ কর , সামনে পঞ্চায়েতের ভোট , চাকরি রাখা দায় । বলা
বাহুল্য রতন শুনেও শুনে না । শুনলে তার দিন চলে না । রতন বলে – সাহেব মা বাপ, উসব রিকুয়েস্ট নাই
কইরবেন। পুলিশদের সাথে কথা বলার সময় সে অল্পস্বল্প ইংলিশ গুঁজে দেয় । এর কারণ দুটো
। প্রথমত রতন প্রমান করতে চায় সে ওঁচা চোর
নয়, পেটের মধ্যে বিদ্যে পুরে রাখা একজন কোয়ালিফায়েড চোর । তার জাত আলাদা। দ্বিতীয়ত
সাহেবরা খাতির করলে নিজেকেও ভদ্দরলোকের মতন লাগে। তখন ভস ভস করে ইংলিশ বলে নিজের
পেস্টিজ বজায় রাখতে হয় । সুবল দারোগা অবশ্য বেশি অনুরোধ করেনা । জানে এরা সুবোধ
বালক হয়ে পড়লে তারই সমুহ বিপদ । গিন্নীর রাইস
কুকার টি এদের প্রাইজ মানির উপর নির্ভরশীল । মা কালীর দয়ায় বেতনের টাকা ছোঁয়াই
হয়না তার । ব্যাঙ্কের গোকুলে সমূলে তা
বাড়তেই থাকে প্রিয় ভুঁড়িটির মত । ভাগ্যিস সার্ভিস লাইফের প্রথমদিকে বেশ কিছু গুনধর
মানুষের সাথে সংযোগ হয়েছিল তার , এই অভিজ্ঞতা
আজ খুব কাজে লাগে । বাতাসে চোরের গন্ধ সে বুঝতে পারে । মন্দ লাগেনা এই সৌরভ । অদ্ভুত এক গৌরবে ও মাদকতায় ভরে যায় বুকপকেট ।
নতুন থানায় পা রাখলেই বাতাস কানে কানে বলে দেয় এখানের চোরঘনত্ব কত। অপরাধমাত্রার জটিল অঙ্ক গুলি
অনায়াসেই কষতে পারে একদা মাধ্যমিকে অঙ্কে কুড়ি পেয়ে পাশ করা সুবলবাবু। চোরঘনত্বের
সাথে আয়ের সমানুপাতিক সম্পর্কটি তার করায়ত্ব ।মদনপুর থানায় পা রেখেই সুবল বুঝতে
পেরেছিল এ মাটি সোনা ।দুনম্বরি কয়লা খাদান
, কোল মাফিয়া আর ওয়াগন ব্রেকারি । শালা
বৈকুণ্ঠে চলে এসেছি । গিন্নিকেও বলেছিল সে কথা
বুঝলে গিন্নি এখানে চার বছর থাকলেই
মার্সিডিজ কার কলকাতায় ষোলশ স্কোয়ার ফুটের
দুটো ফ্ল্যাট , আর বেনামে পঞ্চাশ লাখ ।
তার মত সৎ পুলিশ অফিসারের চাহিদা আর
কতটুকু । গিন্নি তো আনন্দে বিশ বাঁও জলে । টুক করে কর্তাকে কিস করে গেয়ে ওঠে সাতকাহন
–তোমার মত সৎ লোক পুলিশ লাইনে থাকলে দেশে আইনের শাসন চলত, দেশ টা সগগো হত। বউয়ের শংসা পত্রের ছত্রে ছত্রে সুখ । বুক ভরে
ওঠে । রতনদের ডেকে মিষ্টি খাওয়ায় । রতনের দল ও আনন্দে নাচে – বাপের জম্মে বহুত লাল
পাগড়ি দেইখলম , হুজুর আপনি গড । চোর
ছ্যাঁচোড়দেরও ইজ্জত দিতে জানেন ।
সুবল দারোগা রতনের পিঠে হাত রাখে । চোর
বলে নিজেকে ছোট করিস কেন? তোরা আমাদের বন্ধু । তোদের পাশে থাকাই আমাদের কাজ । দেশ
শুদ্ধু শান্তিনিকেতন হলে খাব কি ? যেখানে রোগ বালাই নেই সেখানে ডাক্তার মাছি তাড়ায়
।তোরাই তো আমাদের ভাতঘর বাপধন ।
রতন বুঝতে পারে – এ জীবনটা
ফ্যালনা নয় , বেফালতু নয় ।কত উবগারে লাগে। পড়াশুনা করেও যখন চাকরি বাকরি হল না (
পড়াশুনা বলতে অষ্টমমান ) তখন বাপ বলেছিল - খালি আড়বাঁশি বাজাল্যে দিন চইলবেক ?
ইস্টেজে কিস্ট সাইজে গান কইরল্যে রাই ভুইলবেক কিন্তুক আড়াই সের পেট নাই ভইরবেক । তার চাইয়ে জুতা পালিশ করগা যা।
আঁতে ঘা লেগেছিল রতনের । সবকিছু ছুড়ে ফেলে
দিয়ে উপোষ করে বুঝেছিল জীবনটা দমতক তিতা ।গলায় দড়ি বাঁধার ইচ্ছে হলেও পারেনি ভয়ে । কানকাটা
ফতুয়াদার সঙ্গে ঠিক তখনই আলাপ। ফতুয়াদা বলেছিল – ই বয়সে সুইসাইড । নেভার । আয় তকে
বাইচবার মন্তর শিখাব ... বেঁচে গেল রতন ।কিন্তু
মাঝে মাঝে বিপ্লবী মনটা খচ খচ করে। আজ ওসি সাহেবের ঘরে বসে সে বুঝল চোরদেরও ইজ্জত
থাকে । লোকটা মাইরি গুরুদেব ।
দুই
রাতারাতি হিসেব বদলে গেল । এ এলাকায়
কলকাঠি নাড়ার লোকের অভাব নেই। চার বছরের যে অঙ্ক কষে সুবল বাগচি মদনপুরে এসেছিল
চার মাসের মাথায় তা ছিচ্ছাতুর । বিনা মেঘে
বজ্রপাত । রাতারাতি অন্যত্র বদলির অর্ডার ।সরকারি
কাজ তো আর থামেনা ।থানায় নতুন ওসি দীনেশ তালুকদার ।অদ্ভুত মানুষ । পাগলাটে টাইপের
। মাথায় ছিট আছে ।দুপুররোদে বনবাদাড়ে ঘুর
ঘুর করে ।টহল দেয় । অপরাধীদের ধরে এনে থানার মধ্যে পড়তে বসায় । যোগ বিয়োগ শেখায় ,
রোগ অসুখে ওষুধপত্তর দেয় ।তবু সারা এলাকা আতঙ্কগ্রস্ত । চুরিচামারি খতম হওয়ার
উপক্রম । দমবন্ধ অবস্থা ।রতনদের যে গ্রুপটা ওয়াগন ব্রেকারীতে হাত পাকাচ্ছিল তারা
পড়ল ফাঁপরে । কেমন যেন মিইয়ে গেল সবাই । ফতুয়াদার মাথায় হাত- ভাই রতন পাততাড়ি
গুটাও , চুরির রাবণরাজ আর নাই রে , সব লাটে উইঠল । জগুয়া বরাবরের ভীতু, বলল – কি
হবেক ফতুয়াদা । ইবরে কি বইপত্তর লিয়ে
ইস্কুল যাব ?
কভি নেহি, ম্যায় হুঁ না ।
কনহ রাস্তা পাইল্যে।
কদিন লুকাই থাক। তারপর জয় রাবন বলে আবার
সগগের সিঁড়ি বানাবো ।
রতন বুঝতে পারে এসব প্রবোধ মাত্র। এতদিনের
মান সম্মান সব ধুলায় গেল। পেটে কুলুপ । চুপ করে বসে থাকলে
সাত সাতটা প্রানি অনাহারে মরবে ।চোখে জল এল রতনের
।কানকাটা ফতুয়াদার মত বিপ্লবী চোরও ভয়ে কিসমিস । শেষবারের মত এক নতুন
রাস্তা খুঁজে বের করার কউসিস করছিল রতন ।প্ল্যান টা তখনই তার মাথায় এল ।
চল একদিন সারের সঙ্গে ভেট করি ।যাইয়্যে
বলি চুরি ছাইড়্যে দিতে পারি সার , যদি হামদের প্যাটের ভাতের কনহ বেবস্থা হয় ।
দুসরা কনহ জীবিকা। এতগুলা ছিলাপিলা লিয়ে কুথাকে যাব কি কইরব বইলে দেন আইজ্ঞা
। লতুন বড়হ বাবু কনহ বন্দবস্ত কইরত্যে
লাইরবেক , তখন বইলবেক বাপধন যা করছিলিস
করগা । ব্যাস খেল খতম ।
কথাটা লুফে নিল ফতুয়াদা - দা আইডিয়া, চোর
না হইল্যে তুই শালা পধানমন্তিরি হতিস ।
এসব কাজে দেরি করার কোনও
মানে হয়না ।সেই অনুযায়ী শুক্রবার বিকেল চারটায় মুখরিত হয়ে ওঠে মদনপুরের আকাশ
বাতাশ, পুয়াপুর মোড় ।“ দুনিয়ার চোর জোট বান্দহ , চুরি হামরা ছাইড়তে চাই যদি দুসরা জীবিকা পাই ‘’ এইসব শ্লোগানে মুখরিত
চারপাশ ।মদনপুর এর আগে এমন দৃশ্য দেখেনি । সব ভাবনা এক সময় পরবের আকার নেয় ।
থানার সামনে বিশাল সমাবেশ দেখে একসময়
বেরিয়ে আসে দীনেশ তালুকদার ।পিলে চমকে যায় তার মতন ঝানু ওসিরও ।দ্রুত নিজেকে সামলে
নিয়ে বলে – কি ব্যাপার ?
আমরা আপনার সংগে দেখা কইত্তে চাই ।
ঠিক আছে , একজন ।
বুকে সাহস নিয়ে এগিয়ে আসতে হয় রতনকেই ।
দাবি দাওয়া লেখা কাগজ টা দারোগা বাবুর হাতে দিয়ে
নিজেকে খানিক হাল্কা অনুভব করে রতন । তালুকদার সাহেব পড়তে থাকে কাগজটা
মাননীয় ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক
মদনপুর থানা
আমরা দীর্ঘদিন ধরে যে জীবিকাটির সাথে যুক্ত আজ তা আপনার আবির্ভাবে এক
উজ্জ্বল প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড়িয়ে । আগামী দিনে বিপন্ন মানুষ এই রাস্তায় হাঁটবে
কিনা তা নিয়েও সংশয় , ভয় । যেহেতু আমরা আর কোনও কারগরি বিদ্যা অর্জন করিনি তাই
বর্তমানে অনাহারে বা অর্ধাহারে দিনযাপন
করতে হচ্ছে এই বিধ্বস্ত পরিবারগুলিকে ।পাশে দাঁড়ানোর মত কেউ নেই ।আপনি অবগত আছেন –
বিপুল ঐশ্বর্যময় এই ঈশ্বরের দুনিয়ায় উপোষ করে মৃত্যু বরণ এক নারকীয় অপরাধ এবং
করুণার অযোগ্য । আপনার হৃদয়হীনতার কারনে আমাদের চুরিশিল্প সংকটের সামনে দাড়িয়ে।
বিলুপ্তপ্রায় এই কুটীরশিল্পটিকে আঁকড়ে এখনও যারা প্রাণপণ অক্সিজেন নেওয়ার চেষ্টা করছে তাদের দুর্দিন আসন্ন ।অপরাধ
দমনে আপনার প্রয়াসকে আমরা সাধুবাদ জানালেও
আমাদের সাম্প্রতিক দুরবস্থার জন্য আপনার ভুমিকাকে অস্বীকার করা যাবেনা । এরপর যে
মৃত্যুর মিছিল শুরু হবে সেই মরন উপত্যকা
রচনার জন্য ইতিহাস কি আপনাকে ক্ষমা করবে ? সংবিধানের কত নম্বর ধারায় আছে
জানিনা কিন্তু সেই ধারা অনুসারে মানুষের
বিকল্প জীবিকার ব্যাবস্থা না করে তার
পেশায় হস্তক্ষেপ তার পেটে লাথি মারা এক
ন্যাক্কারজনক কর্ম ।আমরা মানবাধিকার কমিশনে বা তস্কর উন্নয়ন মঞ্চে যেতে পারতাম .।যাইনি .। আগে বিষয়টি আপনাকে জানানো জরুরী তাই । আমরা জানি আপনি
মানবিক দৃষ্টিভঙ্গীতে এই সমস্যাগুলি বিবেবনা করবেন । দাবীগুলি নিম্নরূপ
১ সমস্ত তস্কর শিল্পিদের বিকল্প জীবিকার
বন্দোবস্ত করতে হবে
২ বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা না হলে
মাসান্তে চোরভাতা মঞ্জুর করতে হবে।
৩ দীর্ঘদিন এই পেশায় যুক্ত থেকে যারা আজ
বৃদ্ধ , অথর্ব ... তাদের অবদানের কথা স্মরনে রেখে পেনশনের ব্যবস্থা করতে হবে ।
৪ এই দাবিগুলি পূরণ না হলে আমাদের
কর্মসূচী বৃহত্তর আন্দোলনের দিকে যাবে ,
আমরন চলবে ।
সারা ভারত তস্কর শিল্পী
সংসদ
মদনপুর
শাখা ।
তালুকদার সাহেব মন দিয়ে কাগজটি পড়তে থাকে
। একবার দুবার তিনবার । পড়া শেষ হলে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় – কার
লেখা ?
রতন বলে – সার ।আমার ।
নিজে লিখেছ ?
আজ্ঞে ।
চুরি ছেড়ে দাও ।
খাব কি হুজুর ?
এই প্রতিভা নিয়ে তুমি ছিচকে চুরি কর , এ
আমার লজ্জা । দেশের লজ্জা ।
তবে কি কইরব সার ।
রাজনীতি কর ।চুরি করার সবচেয়ে বড়
প্ল্যাটফর্ম । পুকুর চুরি দেশ চুরি কত কি করতে পারবে । তোমার হাই অ্যাম্বিশান নেই
?
আছে ।
তাহলে অইসব চুনোপুঁটি ভাবনা ছেড়ে বড় কিছু ভাব
। রাজনীতিতে এখন তোমাদেরই রমরমা । যাও বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করে দিলাম , কেমন ?
অতপর রত্নাকর জয়রাম বলে
রাজনীতি আঙিনাতে আইল সদলে ।
দিন রাত কাটে তার হায়ার স্ট্যাটাসে
কৃপা প্রার্থী ভিড় করে তার চারপাশে ।
রত্নাকর নামে তাকে ডাকে না তো কেহ
উইঢিবি ভেঙে উঠে অন্য কোন দেহ ।
মহামুনি বাল্মীকির ফুরালো আখ্যান
হরিদাস পাল কহে শুন পুণ্যবান ।
(এই লেখকের আর একটি সুখপাঠ্য গল্প পড়ুন এই লিঙ্ক'এ http://galpogucchho.blogspot.in/2015/05/blog-post_89.html)
(এই লেখকের আর একটি সুখপাঠ্য গল্প পড়ুন এই লিঙ্ক'এ http://galpogucchho.blogspot.in/2015/05/blog-post_89.html)
সৌরেন চট্টোপাধ্যায়
টানা গা-জ্বলানো
গরমের পর অবশেষে বর্ষা এসেছে। বুদ্ধিটা কূটজীবি উকিল ভানু মিত্তিরই বাতলে ছিল, নব-বর্ষার আগমন উপলক্ষে আমাদের আদি-অকৃত্রিম
অকৃতদার ভুলোদা অর্থাৎ ভোলানাথ সমাদ্দারের দক্ষিণ কলকাতায় পৈত্রিক বাড়ির তিনতলার
বিশাল ঘরে জমিয়ে ফিস্টি হবে। সরু চাল আর ভাজা মুগডালের খিচুড়ি সঙ্গে ইলিশ
মাছ ভাজা। ইলিশটা আমাদের বলাই, অর্থাৎ পাতিয়ালার বলবিন্দর সিং স্বতঃপ্রনোদিত হয়েই স্পনসর
করেছে। আমি আর রেণু মানে বিজ্ঞানের অধ্যাপিকা রেণুকা বসু রান্নার দায়িত্বে।
খিচুড়ির তোড়জোড় শেষ, অথচ বলাইচাঁদের পাত্তা নেই। আমরা উদ্বিঘ্ন চিত্তে তাঁর (ইলিশ সহ) আসার প্রতীক্ষায়। রুপোর কেস থেকে পরপর দুটো
সিগারেট যে ভাবে উড়ে গেল, তা দেখে মনে হচ্ছে অমন শান্ত,
সমাহিত ভুলোদাও যেন কিঞ্চিৎ উত্তেজিত। সিঁড়িতে দশাসই দেহের
ভারি জুতোর শব্দের সঙ্গে দরাজ গলায় “মনো মোওর মেঘেরোওও সঙ্গীইইইই --উড়েএ চলে দিক-দিগন্তেরোও পানেএএএ ----” গাইতে গাইতে
হাতে এক জোড়া নধর ইলিশ নিয়ে বারমুডা পরিহিত
রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ বলাই দরজা দিয়ে প্রবেশ করল। গরমের দোহাই দিয়ে ভুলোদা এ ক’দিন যে ভাবে পাশ কাটিয়ে গেছে সে আর কহতব্য
নয়। আমরা চার মূর্তি অনেক চেষ্টা করেও তাঁর মুখ থেকে কোন কথামৃত বের করতে না পেরে
শেষে আজকের এই মরিয়া প্রচেষ্টা। বলাই দুহাতে দুই মৎস সুন্দরীকে ঝুলিয়ে খানিকটা ভাংরা আর
কিছুটা ভারত নাট্যমের ভঙ্গীতে ভূলোদার নাকের ডগায় একটা কিম্ভূত নাচের মুদ্রা করে
বলল, এক্কেবারে পদ্মার
ম্যাডাম দাদা, কেনার
সময় পরিস্কার ঢাকাইয়া বাঙাল ভাষায় দর কষাকষি করল জানেন! --- “তোমার কীর্তির
চেয়ে তুমি যে মহৎ, তাই তব জীবনের রথ পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার
বারম্বার।” আমিই বা কম যাই কেন! কালোয়াতি কায়দায় গলাটা একটু খেলিয়ে ঠাকুরের ‘শাজাহান’ ঝেড়ে
দিলাম। --- তা ঠিক,
ভানু মিত্তির ওর হাত থেকে মাছ দুটো নিতে নিতে
সোল্লাসে ঠেকা দিল, বলাই সিং-এর
এমন ইলিশ-কীর্তির জন্য ওর সব কু-কীর্তি ঢাকা পরে গেল আজ। --- আরে স্বামিজী বলেছেন না, ‘জন্মেছিস যখন একটা দাগ রেখে যা।’
তাই বলাই একবারে ডাবল দাগ টেনে দিয়েছে। কোমরে
আঁচল জড়িয়ে আঁশ-বঁটিটা
নিয়ে গুছিয়ে বসে রেনু ফুট কাটল। --- বলাই এর ককটেল নাচটা মন্দ না, তবে চণ্ডীগড়ের ভি. পি. রামন কিন্তু একটা দারুণ কীর্তি করে গিয়েছেন
সেটা জানি, তিনি ১৯৯০ সালে ৭ এপ্রিল থেকে ২৭ এপ্রিল
পর্যন্ত একনাগারে ৪৮১ ঘন্টা ৩০ মিনিট ডিস্কো নেচেছিলেন। সোনার ফ্রেমের চশমার পিছনে
দুটো চোখে সেই বিখ্যাত চিকচিকে হাসি দিয়ে যেন পণ্ডিত বিরজু মহারাজের একটা ছোট্ট
নাচের মুদ্রা দেখিয়ে দিয়ে বললেন ভুলোদা, তা তোমার এত দেরি হল কেন গো বলাইবাবু?
--- আর কেন! কলকাতায় সাড়ে সতেরো ফোঁটা বৃষ্টি হলেই তো ট্রাফিক ঘেঁটে
ঘনীভূত হয়ে যায়, গাড়ি নিয়ে আসাটাই তো ঝকমারি,
তাই অগত্যা খানিকটা টানা রিক্সায় আর খানিকটা
পয়দলমে দাদা। --- তা
বটে! অবশ্য কলকাতার রিক্সা আর উত্তরমেরুর
স্লেজগাড়ির মধ্যে খুব একটা তফাৎ নেই। বিখ্যাত অভিযাত্রী ক্যাপ্টেন এম.লিন্ডসে
১৯৩৪ সালের ১৮জুন থেকে ৫
সেপ্টেম্বর পর্যন্ত
গ্রীনল্যান্ডের পশ্চিম থেকে পূর্ব পর্যন্ত বরফে ঢাকা ১৭৩৮
কিলোমিটার পথ একা একটি স্লেজগাড়িতে চেপে আড়াআড়ি পাড়ি দিয়েছিলেন সেটা জানো কি?
ভুলোদার ব্রেকিং নিউজ শুনে বলাই সর্দার ওর
রবি-গান আর ‘ভাংরা-নাট্যম’ থামিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে
আছে দেখে ভুলোদা বলে উঠলেন, --- এ কী! বলাই, অমন একপায়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছো কেন সেই থেকে? বসো বসো। আর এ রকম দাঁড়নোর আগে মনে রেখো,
তামিলনাড়ুর এন, রবি ১৯৮২ সালের ১৭-১৮ এপ্রিল একটানা ৩৪ ঘন্টা
এক পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে ছিলেন। আর সবচেয়ে বেশি দিন একটানা দাঁড়িয়ে থাকার রেকর্ড
করেছেন ভারতের উত্তরপ্রদেশের স্বামী মৌজগিরি মহারাজ। তিনি ১৯৫৫ থেকে
১৯৭৩ সাল অবধি একটানা ১৮ বছর দাঁড়িয় তপস্যা করেছিলেন। ঘুমানোর
সময় তিনি একটা কাঠের তক্তায় হেলান দিয়ে ঘুমোতেন। ১৯৮০ সালে ৮৫ বছর বয়সে তিনি
দেহত্যাগ করেন। --- ভানু
তোর খিচুড়ি-ইলিশের
জোড়া নৈবেদ্যয় ভুলোদার জিভে যে আজ মা সরস্বতী রে!
ভানুর কানের কাছে
বলে আমি ওর ডান হাতটা টেনে নিয়ে খুব জোরে ঝাঁকিয়ে দিলাম।
--- হ্যান্ডশেক করলে না কি হে
চাটুজ্জে!
বেশ বেশ, ভুলোদার চোখ আমার দিকে তাকিয়ে চিকচিক করছে আবার, তবে হ্যান্ডশেকের বিশ্ব রেকর্ডটাও জেনে রাখো,
ফিনল্যান্ডের রেইনার ভিক্সট্রম ১৯৮৮ সালের ১৫
মে মাত্র আট ঘন্টায় ১৯৫৯২ জনের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেছিলেন। মানে ঘন্টায় গড়ে ২৪৪৯
জন। --- বোঝো কান্ড!! আমি অস্ফুটে বললাম। --- নে,
এবার সামলা! মাছের টুকরোগুলোয় নুন-হলুদ মাখিয়ে কড়াইয়ে ছাড়তে ছাড়তে হাতের উলটো
পিঠ দিয়ে নাকের ডগায় ঝুলে আসা মোটা চশমাটা ঠেলে জায়গায় পাঠিয়ে ফিসফিস করে বলল
রেণু। --- কথা বলেও বিশ্ব রেকর্ড করা যায় বুঝলে রেণু,
রেণুর ফিসফিসানি শুনে ভুলোদা মুচকি হেসে
বললেন, মাদ্রাজের এস,
ই, জয়রামন নামে এক ভদ্রলোক ১৯৮৯ সালের ৮ জুন থেকে ২৩ জুন
পর্যন্ত একনাগারে ৩৬০ ঘন্টা কথা বলে রেকর্ড করেছেন।
সবাই মেঝের ওপর গোল হয়ে আসনপিঁড়ি হয়ে বসেছি। ভুলোদার বশংবদ চাকর গোবিন্দ কলা
পাতায় গরমগরম খিচুড়ি পরিবেশন করেছে, সঙ্গে ইলিশের গোবদা গোবদা ভাজা পেটি। আহা! ঝমঝমে বর্ষায় এর চেয়ে উপাদেয় আর কিছু হতে
পারে না কি! --- উফ্! এই ভানুটা নির্ঘাত মহাভারতের আমলে রাক্ষস ছিল
আর ভীমের হাতে মরেছিল, এ জন্মে বদ উকিল হয়েও স্বভাব যায়নি! মনে হচ্ছে হাঁরি কড়াইগুলো অ খেয়ে শেষ
করবে আজ!
ভানুকে এক গামলা
খিচুড়ি তিনটে পেটি দিয়ে শেষ করে এক চোখ বন্ধ করে মনের সুখে কড়মড় করে একটা মুড়ো
চিবুচ্ছে দেখে রেণু আর না বলে পারল না। --- আহা! ও আর এমন কি খেয়েছে! ভুলদা
মাছের ডিমের বড়ায় কামড় দিয়ে বললেন, ফ্রান্সের মাইকেল
লোটিটো এক আশ্চর্য মানুষ। ১৯৫৯ সাল থেকে তিনি ধাতু ও কাঁচ খাচ্ছেন। চিকিৎসকরা তাঁর
পেটে এক্স-রে করে দেখেছেন তিনি প্রতিদিন ৯০০ গ্রাম
ধাতু অনায়াসে খেয়ে হজম করে ফেলতে পারেন। ১৯৬৬
সাল থেকে তিনি যা
খেয়েছেন তা হল, ১০টি বাইসাইকেল,
সাড়ে চার দিনে একটি ধাতু নির্মিত সুপার
মার্কেটের ট্রলি, ৭টা বড় টেলিভিশন সেট, ৬টি ঝাড়লন্ঠন, ভেনজুয়েলার ক্যারাকাসে একটা সেশনা এরোপ্লেন এবং এরকম আরও অনেক কিছু। সে তুলনায়
ভানু তো নেহাৎই দুগ্ধপোষ্য শিশু। --- বাপ্ রে!! আমাদের চোখ ছানাবড়া।
আষাঢ়ের সন্ধ্যে দ্রুত ঘনিয়ে আসছে, আড্ডা আর গল্পের মাঝে রেণু আর বলাই-এর দ্বৈতকন্ঠে ‘মধু গন্ধে ভরা,
মৃদু স্নিগ্ধ ছায়া ---‘ শুনে দিল তর হয়ে
গেল। আমরা স্বতঃস্ফুর্ত মনেই হাততালি দিয়ে উঠলাম। --- এত সুন্দর গলার গান এইটুকু শুনে কি মন ভরে! ভুলোদা যেন নিজের মনেই বললেন, ১৯৮৯ সালের ২২ এপ্রিল থেকে ৩ মে পর্যন্ত একটানা ২৬২ ঘন্টা গান গেয়েছিলেন
প্যাস্টর এস. জেয়াশীলান।
অনুষ্ঠানটি হয়েছিল ভারতের রামনাদের এশিয়ান গ্লাসহাউস বিল্ডিং-এ।
আর এই হাততালিরও একটা বিশ্বরেকর্ড আছে মনে পড়ে গেল, তামিলনাড়ুর ভি.জয়রামন ১৯৮৮
সালের ১২ ফেব্রুয়ারী
থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারী টানা ৫৮
ঘন্টা ৯ মিনিট হাততালি দিয়েছিলেন। প্রতি মিনিটে গড়ে ১৬০ বার
তালি দিয়েছিলেন।
সারা দিনের জমাটি আড্ডার শেষ পর্বে ভুলোদার প্রিয় মকাইবাড়ি বাগানের দারুণ
ফ্লেভারের চা নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছি আমরা। চায়ে আরাম করে চুমুক দিয়ে কেস থেকে
সিগারেট বাছতে বাছতে ভুলোদা বললেন, --- দুজন অসাধারণ মানুষের কথা আজ না বললে ভারি
অন্যায় হবে বুঝলে! একজন
হলেন পৃথিবীর বিস্ময়কর প্রতিভা মোজার্ট। তিনি তিন বছর বয়সে বীণা বাজান, প্রথম সুর সৃষ্টি করেন পাঁচ বছর বয়সে, প্রথম সোনাটা রচনা করেন সাত বছর বয়সে এবং প্রথম সম্পূর্ণ
সিম্ফনী তৈরি করেন আট বছর বয়সে। তিনি প্রতি বছর একটি করে সিম্ফনী তৈরি করেন। মোজার্ট
মাত্র পঁচিশ বছর বেঁচে ছিলেন। এই সামান্য সময়ে তিনি ৬০০-র মত সিম্ফনী, অপেরা,
সোনাটা, মাসেস ইত্যাদি সঙ্গীতের বিভিন্ন বিষয় রচনা করে গিয়েছেন। আর একজন হেলেন
কেলার। তাঁর নাম তো জানোই তোমরা। মাত্র উনিশ বছর বয়সে তিনি এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে
অন্ধ ও বধির হয়ে যান। ছ’ বছর বয়স থেকে অ্যান সুলিভান নামে এক শিক্ষকের প্রচেষ্টায় তিনি লিখতে ও পড়তে
এবং বলতে শেখেন। পরে তিনি ব্যাদক্লিফ কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯০৪ সালে অনার্সে সেরা
নম্বর নিয়ে স্নাতক হন। তিনি বহু বই লিখেছেন এবং অন্ধ ও বধিরদের উন্নতির জন্য
দৃষ্টান্তমূলক কাজ করে গিয়েছেন। আমরা চারজন অর্বাচীন বিস্ময়ে একেবারে হতবাক।
এবার ঘরে ফেরার পালা। দু ঘন্টার টানা বৃষ্টিতে নীচের রাস্তায় জল থৈ থৈ করছে।
বলাই আর আমি যাব উত্তরে, ভানু আর রেণু দক্ষিণে। --- এই বর্ষায় গাড়ি-টারি পাওয়ার সম্ভাবনা বোধ হয় নেই,
কপালে বহুৎ তকলিফ আজ। অগত্যা ‘থাকিতে চরণ মরণে কি ভয়,
নিমেষে যোজন ফরসা ---” বলাই রবি ছেড়ে
কাজীদাকে স্মরণ করল। --- ওটা কোন ব্যাপারই নয়, ভুলোদা নির্বিকার গলায় বললেন, ১৯০০ সালে অস্ট্রেলিয়ার যোহান হারলিংগার
ভিয়েনা থেকে প্যারিস পর্যন্ত মত ১৪০০ কিলোমিটার পথ পায়ের বদলে হাতে হেঁটে
বিশ্বরেকর্ড করেছিলেন। তিনি প্রতিদিন গড়ে ১০ঘন্টা করে মোট ৫৫ দিনে ঐ পথ
হেঁটেছিলেন। নীচে নেমে এসে একহাঁটু জল ভেঙে এগোতে এগোতে কোন কষ্ট আর অসুবিধার কথা আর
মাথাতেই এলো না।
(এই লেখকের গল্প 'চিঠিচাপাটি' পড়ুব এই লিঙ্কে http://galpogucchho.blogspot.in/2015/05/blog-post_53.html)
(এই লেখকের গল্প 'চিঠিচাপাটি' পড়ুব এই লিঙ্কে http://galpogucchho.blogspot.in/2015/05/blog-post_53.html)
মনোজিৎ কুমার দাস
আমি
অহনা , একজন বাঙালি মেয়ে । গ্লোবাল
ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারপ্রাইজের সাউথ এশিয়ার বর্তমান কান্ট্রি ডিরেক্টর রঞ্জন রায়ের
একমাত্র মেয়ে আমি অহনা। আমার মা সোহিনী রায় আমাদের পরিবারের সর্বেসর্বা। আমার একমাত্র দাদা রোহন রায় মা- বাবার আদুরে ছেলে , আর আমি অহনা তাদের একমাত্র
আহ্লাদে মেয়ে।
বর্তমানে আমার মনটা বড়ই অশান্ত । বলতে গেলে এখন আমি এক
ধরনের ঘোরের মাঝে দিন কাটাচ্ছি। যে আমাকে ভালোবাসার জন্যে পাগল ছিল সে কি এখন আমাকে
আগের মত ভালবাসে, সে কি অধরা থেকে যাবে?
বহুজাতিক কোম্পানীর চাকরীর সূত্রে বাবা - মাকে নিয়ে এ শহর থেকে ও
শহরে, এদেশ থেকে ওদেশে পাড়ি দিতে
হয়েছিল এক সময়। নতুন নতুন জায়গা ও নতুন নতুন মানুষের দেখার অভিজ্ঞতা তাদের অনেক। দাদা
ও আমার জন্মের পর মা - বাবার সঙ্গী হয়ে দেশের বাইরে আর কখনো যাননি।
বাবা ঢাকা থেকে বদলীর খবর মাকে জানালে মা কেন যেন খেপে
যেতেন। বাবার কাছ থেকে খবর শুনে মা বিড় বিড় করে বলতেন- আর ভালো লাগে না, বাচ্চা বাচ্চা দুটো ছেলে
মেয়েকে আমার একার পক্ষে ঘর সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়ে।
আবার
বদলীর অর্ডার,
তাও দেশের
বাইরে,দেশের ভেতরে হলেও কথা ছিল।
বাবা
ঢাকার অফিসের প্রধান হিসাবে কয়েক বছর আছেন। সেবার ডিসেম্বরের মাঝামাঝি বাবার প্রোমশন
ও বদলীর অর্ডার এলো, সামনের জানুয়ারির এক তারিখে দিল্লির রিজিওনাল অফিসে সিইও পদে জয়েন করতে
হবে। বাবার বদলীর খবর জেনে মায়ের মাথায় যেন পাহাড় ভেঙে পড়লো। বাবার বদলীর চাকরী, এনিয়ে তার তেমন মাথা ব্যথা
নেই। তিনি ঢাকা অফিসে প্রথম জয়েন করার পর এর মাঝে দেশের বাইরে সিঙ্গাপুর, গৌহাটি, চেন্নাই ও কোয়ালামপুরে চাকরী
করে এসেছেন।
আমার
মা গৌহাটির বাঙালি মেয়ে। মায়ের ঠাকুরদা বরদাপ্রসাদ চৌধুরী পৈত্রিক বাড়ি ছিল বরিশালের
আগৈলঝরায়, সাতচল্লিশের দেশভাগের কালপর্বে দাঙ্গায় ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ
হয়ে বহু হিন্দু পরিবার দেশ ত্যাগ করে । তাদের সঙ্গে চৌধুরী পরিবারও দেশ ছাড়ে। বরদাপ্রসাদের
পূর্বপুরুষদের আসাম মুলুকে কিছু জমাজমি ছিল। তাই বরদাপ্রসাদ অন্তসত্ত্বা স্ত্রী ও বৃদ্ধা
মাকে নিয়ে প্রথমে গৌহাটির শ্মরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। ওই শ্মরণার্থী ক্যাম্পেই
মায়ের বাবা বিজন চৌধুরীর জন্ম । এক সময় অনেক সংগ্রাম করে মায়ের ঠাকুরদা বরদাপ্রসাদ
গৌহাটিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। তার একমাত্র ছেলে বিজনকে মানুষের মত মানুষ করাই
ছিল তার ধ্যানজ্ঞান । মৃত্যুর আগে তিনি দেখে যেতে পারেন
তার ছেলে বিজন সত্যিকারেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
বড়
পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে বদলী হতে হয় মা তা জানলেও এবারও কিন্তু তিনি অস্বস্তি প্রকাশ
করে বাবাকে বললেন-রঞ্জন, আবার তোমার বদলীর অর্ডার ! রোহন , অনা’র পড়াশোনার ব্যাপার তাহলে আমার ঘাড়েই এসে পড়লো। তুমি এক জায়গায় স্থিতু
হয়ে চাকরী করতে পারলে না!
বাবা
মাকে বিস্মিত কন্ঠে বললেন - সোহানী, তুমি আমার বদলীর কথাটাই
ভাবলে, প্রোমোশনের কথাটা ভাবলে
না! তুমি হয়তো জান না, ঢাকা অফিসে সিইও এর কোন
পোস্টই নেই।
বাবার কথা শুনে মা অস্ফুটস্বরে কী যেন
বললেন - চাকরীর আগে তোমার সাথে আমার দেখা হলে তোমার কথা মতো এক
জায়গায় স্থিতু হবার মতো একটা চাকরী খুঁজে নেওয়া যেত।
একটা
বেসরকারী কলেজে মাস্টারী করলে বাড়ির ভাত খেয়ে বাড়িতে স্থিতু হতে পারতাম। কিন্তু তাহলে
কি গৌহাটি বসবাস করে তুমি আমার দেখা পেতে? আর আমার সাথে প্রেম করার
কথা নাই বা বললাম। বাবার কথা শুনে মা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললেন ,- তোমার সঙ্গে প্রেম করতে
আমার বয়ে গিয়েছিল। তুমিই আমার পেছনে ঘুরঘুর করেছিলে! ওই সময় আমি ও দাদা তাদের ধারে কাছেই আছি তা তারা ভুলেই গিয়েছিলেন।
বাবা
কোনদিকে ভ্রুক্ষেপ না করেই বলতে থাকলেন - এমবিএ শেষ করার পর চাকরীটা আমার ভাগ্যে জুটলো তোমার বাবারই দয়ায়। তখন
তিনি সাউথ এশিয়ান রিজনের কান্ট্রি ডিরেক্টর। হেড অফিস সিঙ্গাপুরে। তাদের ঢাকার গুলশান
অফিসের সেলস এক্সিকিউটিভ পদে ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় আমি বুঝতে পারলাম, তিনি গ্লোবাল ইন্টারন্যাশনাল
ইন্টারপ্রাইজের বড়সড় পদে আসীন। সত্যি সত্যি বলতে তিনিই ছিলেন ইন্টারভিউবোর্ডের সর্বেসর্বা।
তার মনে কী ছিল আমি সে সময় বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে পারলাম তার মনে একটা সুপ্ত বাসনা
ছিল।
- রঞ্জন, তুমি কিন্ত্র তোমার সীমা
লঙ্ঘন করে যাচ্ছ! মা বাবার উপর কপট রাগ দেখিয়ে
বলে উঠলেন।
বাবা মায়ের কথায় কান না
দিয়ে বলে চললেন,- সেলসএক্সিকিউটিভ পদে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়ার আমি তোমার বাবার সঙ্গে
তার অফিসে দেখা করতে গেলে তিনি আমাকে বললেন
- কনগ্রাচুলেশন
ইয়ং বয়, আই উইস ইওর বেস্ট লাক। ইউ
উইল বি ইয়োংগেস্ট এন্ড স্মার্ট অফিসার ইন আওয়ার ঢাকা অফিস। থাকস এ লট,স্যার। আই উইশ টুএক্সপেক্ট
ইওর ফুল কপারেশন এন্ড হেল্প টু বি এ গুড অফিসার।
আমি
তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার কাছে থেকে সব ধরনের সাহায্য ও সহানুভূতি
প্রত্যাশা করলাম।
তারপর পর থেকেই তিনি আমাকে স্নেহের চোখে দেখতে শুরু করলেন। আমি তাদের ঢাকার অফিসে
জয়েন করার পর সেবার তোমার বাবা মাস ছয়েক ঢাকা অফিসে ছিলেন । মা আমার বাবার কথা শুনে বিরক্তির সাথে বললেন, --তুমি একই কাসুন্দি কত বার
ঘাটবে!
আমি
ঠাকুমার মুখে শুনেছিলাম, আমার বাবা রঞ্জন রায়ের সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠার মূলে ছিলেন আমার মায়ের
বাবা অর্থাৎ আমার দাদু বিজন চৌধুরী। বিজন চৌধুরী তাদের গ্লোবাল ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারপ্রাইজের সুদর্শন আর
চৌকষ অফিসার রঞ্জন রায়কে গৌহাটি অফিসের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছিলেন হয়তো তার মনের সুপ্ত বাসনা চরিতার্থ করার মানসে।
গৌহাটিতে
বদলী হয়ে রঞ্জন রায় নিজেকে ভাগ্যবান বলেই মনে করলেন। ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারপ্রাইজের
কর্ণধার বিজন চৌধরীর সান্নিধ্য পাওয়াটাকে তিনি বড় করে দেখলেন। অন্যদিকে , বিজন চৌধুরী তার বিদুষী ও সুন্দরী মেয়ে সোহানীর জন্য এমন একটা চৌকস ছেলেই খুঁজছিলেন। আমার দাদু বিজন চৌধুরীর মনের ইচ্ছে পূরণ হতে কোন বিপত্তি
ঘটলো না। তিনি একমাত্র মেয়ে সোহানির সাথে রঞ্জন রায়ের বিয়ে সম্পন্ন হবার পর রঞ্জন রায়ের
পদোন্নতি কে আর রোখে!
দাদা
ও আমার জন্ম ঢাকায়। আমাদের পড়াশোনার হাতেখড়ি আমাদের গুলশানের নিজস্ব
ফ্লাটের বাসার পাশের কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। সেবার আমি ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠব , আর দাদা সবে ইন্টার পাশ
করেছে নটর ডেম কলেজ থেকে। দাদা ঢাকার যে কোন সরকারী মেডিক্যাল কলেজে এম.বি.বিএস এ ভর্তির উদ্দেশে ফার্ম গেটের ওখানে নাম করা একটা কোচিং এ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আমাদের
বাসায় দাদার বন্ধুবান্ধব তেমনটা কেউ আসতো না, তবে দাদার কথাবার্তায় আমি
বুঝতাম দাদার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছে , আর তাদের মধ্যে একজন নাকি দক্ষিণ ভারতীয় আর কয়েকজন নাকি খৃষ্টান। আমাদের
বাসা স্কুলের পাশে হওয়ায় আমার অন্তরঙ্গ বান্ধবীরা প্রায় প্রায় আমার সাথে আমাদের বাসায়
আসত। মা একদিন দাদাকে বললেন,- অনা এর তো অনেক বন্ধুবান্ধব আছে, রোহন, তোর কি কোন বন্ধুবান্ধব
নেই?
দাদা বলল, -থাকবে না কেন, ওর মত আমি কাউকে বাসায় নিয়ে আসি নে তাই আর কী। অনা এর জন্মদিনে তোর বন্ধুদের
আসতে বলবি এবার।
- -ঠিক আছে মা।
মা আমাকে অনা বলে ডাকেন।
আমার ইলেভেনথ বার্থ ডে টা আমার জীবনে বিশেষভাবে স্মরণীয়।
সেবার দাদা নটর ডেম কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে ছয় মাস কেটেছে, আর আমি সবে ক্লাস সিক্সে
উঠেছি, ক্লাস তখনো শুরু হয়নি। সামনের
জানুয়ারির পনেরো তারিখে আমার বার্থ ডে। বাবা দেশেই ছিলেন । তাই
ঘটা করেই আমার ইলেভেনথ বার্থ ডে’র উৎসব হলো। আমার বান্ধবীরা তাদের মায়েদের সাথে, আর দাদার বন্ধুরা নিজেরাই
এলো। অনেক হৈহুল্লোড়, গান বাজনা আর খানাপিনার আগে দাদা তার বন্ধুদেরকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে
দিল । দাদা তার অন্তরঙ্গ দক্ষিণ ভারতের কেরালার প্রীতম নামের ছেলেটির পরিচয় বিশেষ ভাবে
করালো। আমার বান্ধবীদের অনেককেই আমার বাবা মা চিনতেন। তাদের মায়েদের
তো চিনতেন না
, তাই আমিও
আমার বান্ধবীদের সাথে সাথে তাদের মায়েদেরও সবার সাথে পরিচয় করালাম। বয়সের তুলনায় শরীর
স্বাস্থ্যে আমি বেশ একটু বেড়ে ওঠায় আমার বান্ধবীদের চাইতে দেখতে আমি বড় ছিলাম। আমি
ও আমার বান্ধবীরা ছাড়াও দাদার বন্ধুদের কয়েকজন রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইল। তাদের মধ্যে প্রীতম
নামের দক্ষিণ ভারতীয় অবাঙালি ছেলেটিও ছিল।
অনুষ্ঠানের
শেষ হওয়ার পর বাবা বললেন,- কেরালার ছেলেটি তো সুন্দর রবীন্দ্র সঙ্গীত গায়! প্রীতমের মাতৃভাষা তামিল হলেও সে কিন্তু কলকাতায় মানুষ
হয়েছে। ও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছে কলকাতার কলাকেন্দ্র থেকে। ভাল বাংলা বলতে পারে। বাবার
মতো আমিও দাদার বন্ধু প্রীতমের রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে মুগ্ধ হলাম। -
রোহন, আসছে রবিবার সন্ধ্যায় আমি
বাসায় আছি,
তোমার বন্ধুর
গান শোনাতে পারবে? -অবশ্যই পারবো। দাদা বলল।
আমাদের
বাসাতে গানের রেওয়াজ ছিল। আমি মায়ের কাছে গান শিখতাম, দাদা ডুগি তবলা বাজাতো। বিয়ের আগে মা
গৌহাটির বাসায় রবীন্দ্র সঙ্গীত শিখতেন ওস্তাদ বারীণবরণের কাছে। গৌহাটি সঙ্গীত কলাকেন্দ্রের
রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানে মা গান গেয়ে প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। ওই অনুষ্ঠানের চিফ গেস্ট
ও গানের বিশেষ আকর্ষণ ছিলেন ভূপেন হাজারিকা। ভূপেন হাজারিকার সঙ্গে স্থানীয় শিল্পীদের
গ্রুপ ফটোতে মাও ছিলেন। সেই গ্রুপ ফটোটা তখনো ড্রয়িংরুমের দেওয়ালে শোভা পাচ্ছিল।
রবিবার
সন্ধ্যায় দাদার বন্ধু প্রীতম এলো। বাবা বাসাতেই ছিলেন। চা পর্ব শেষে
গানের আসর বসল আমাদের বাসায়। বাবা রবীন্দ্র সঙ্গীতের ভক্ত
। তিনি পূজা,
প্রেম ও প্রকৃতি
পর্যায়ের রবীন্দ্র সঙ্গীত সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন। ডুগি তবলা নিয়ে বসলো দাদা । প্রীতম হারমোনিয়াম কাছে টেনে নিয়ে গান ধরলো: -বড়ো আশা করে এসেছি গো , কাছে ডেকে লও,/ ফিরায়ো না জননী--- তারপর সে পর পর আরো দুটো
পূজা পর্যায়ের গান গেল। -ওই আসনতলের মাটির ’পরে লুটিয়ে রব,/ তোমার চরণ- ধুলায় ধুলায় ধূসর হব----- এবং - আমার যে সব দিতে হবে সে
তো আমি জানি-/আমার যতবিত্ত , প্রভু আমার যত বাণী-----
-আন্টি, আপনি এবার গান হারমোনিয়ামটা মায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে ছেলেটি বলল।
মা পূজা ও প্রেম পর্যায়ের দুটো গান গাইলেন। প্রীতম আরো
তিনটে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইল। এবার বাবা আমাকে বললেন,-মা অহনা, তুমি তোমার গান দিয়ে এবার আসর শেষ কর, ডিনারের সময় বয়ে যাচ্ছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি এই গানটি গাইলাম, যা আমি দিন দুয়েক আগে মায়ের
কাছ থেকে শিখেছি। -
রাঙিয়ে দিয়ে
যাও,যাও যাও গো এবার যাবার আগে-/ তোমার আপন রাগে, তোমার গোপন রাগে,/তোমার তরুণ হাসির অরুণ রাগে/ অশ্রুজলের করুণ রাগে----।
তারপর
থেকে প্রীতম মাঝে মধ্যে এসে জানতে চাইতো দাদা বাসায় আছে কিনা। সে প্রথম প্রথম শুধুমাত্র
দাদাকে খুঁজলেও আমি তার চাহনি থেকে এক সময় বুঝতে পারলাম সে শুধুই দাদার খোঁজে আমাদের
বাসায় আসে না। আমি তো সবে এগার পেরিয়েছি, কিন্তু কেউ আমাকে দেখে ভাবতে না আমি সবেমাত্র এগার পেরিয়ে বার বছরে
পড়েছি, আমাকে কেউ পনেরো বছরের কিশোরী
ভাবলেও আমি অবাক হই না।। আমার মা দীর্ঘাঙ্গী ও সুদর্শনা , গায়ের রঙ দুধে আলতায় মেশানো। সবাই বলে
আমি নাকি আমার মায়ের চেহারা ও গড়ন পেয়েছি।
ছেলেটির
বয়স আঠারো থেকে ঊনিশের মধ্যে হবে। ছেলেটির গায়ের রঙ শ্যাম বর্ণ হলেও সুদর্শন ও সুঠাম
দেহী। ছেলেটির বাড়ি ভারতের কেরালার রাজ্যের ত্রিচুর জেলার পুন্ন্যাউর্কুলামে। অল্প
বয়সে বাবা মা মারা যাওয়ায় ভাইদের সাথে বনিবনা না হওয়ায় কলকাতায় পিসির কাছে মানুষ। তার
পিসি কেরালার মেয়ে হলেও তার স্বামী বাঙালি, তাই সে পিসতোত ভাইবোনদের সাথে বাঙ্গালিয়ানা
পরিবেশে মানুষ। চার বছরের একটা স্কালারসিপ পেয়ে সে ঢাকাতে পড়ছে। এক সাথে না পড়লেও প্রীতম দাদার প্রিয় বন্ধু , আমার বুঝতে বেশি দেরি হলো না। ও ভাল
কবিতা আবৃত্তি করে আর ভাল রবীন্দ্র সঙ্গীত গায় এটা আমি অস্বীকার করি না। বাবা রবীন্দ্রসঙ্গীত
ভালোবাসলেও তার গান শোনার সময় কোথায়! মায়ের কিন্তু অঢেল সময়। প্রীতম মাকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিয়ে
তার স্নেহ লাভ করে অল্পদিনের মধ্যেই। আমিও অল্পদিনের মধ্যে প্রীতমের গানের মুগ্ধ শ্রোতা
হয়ে উঠলাম।
এভাবে
তিনটে বছর গড়িয়ে গেল। এর মাঝে পদ্মা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। আমি কৈশোর পেরিয়ে বয়:সন্ধিক্ষণের মাঝামাঝি পর্যায়ে
উপনীত হলাম। উপলব্ধি করতে পারলাম আমি ধীরে ধীরে কুঁড়ি থেকে প্রস্ফুটিত
গোলাপে রূপান্তরিত হচ্ছি। পূর্ণ যৌবনবতী হয়ে উঠতে আমার আর বেশি দেরি নেই।
প্রীতমের
সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ট থেকে ঘনিষ্টতর হয়েছে। প্রথম থেকেই প্রীতম আমার প্রতি অনুরক্ত
ছিল। কিন্তু সে সময় আমি ভালোবাসার অতশত বুঝতাম না।
সত্যি
কথা বলতে প্রীতমই আমার এত টুকু বয়সে আমাকে তাকে ভালবাসতে শেখালো। তাই দাদার প্রিয় বন্ধু প্রীতম একদিন আমার প্রিয়তম বন্ধু
হয়ে গেল। তার সুন্দর মুখশ্রীতে আমি মোহনীয়তার আভাস পেলাম। আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি সে খবর জানতে মায়ের বাকি ছিল না, দাদাতো চাইছিলই আমি প্রীতমের
সাথে মেলামেশা করি।
বাবার
কার নিয়ে রাঙামাটিতে লং ড্রাইভে যাবার কথা এখনো মনে গাঁথা হয়ে আছে। দাদা ড্রাইভ সিটে, প্রীতম ও আমি পেছনের সিটে
বসলাম। দাদা কয়েক মাস আগে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছে। রাঙামাটির প্রকৃতিক দৃশ্য দেখে
আমরা মুগ্ধ!
হৈহুল্লড় অনেক
হল, নানা ভাবে পোজ দিয়ে ফটো তোলা হল । মা বাড়ি থেকেই খাবার তৈরি করে দিয়েছিলেন।
সেই খাবার পরিতৃপ্তির সাথে খেলাম। ফেরবার পথে চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই সন্ধ্যা
ঘনিয়ে এলো। ভেতরের লাইট অফ করে দাদাকে সবধানে গাড়ি চালাতে
বলে সিটে গা এলিয়ে দিলাম। প্রীতম জানালার
পাশে
বসে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল। আমার চোখে ঘুম নেমে এলো। এক সময় আমি বুঝতে পারলাম, প্রীতম আমার গা ঘেঁসে বসেছে।
কার ঢাকার দিকে ছুটে চলেছে, আমার শরীরে হাতের স্পর্শ পেলাম। আমার গোলাপী গালে আস্তে একটা চুমু দিয়ে
সে আমার স্তনে আলতো করে হাত ছোঁয়াল। আমার শরীরে শিহরণ বয়ে গেল। আমি ভাবলাম, আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে এভাবে
স্পর্শ করার সাহস পায়নি। আমি কী করবো তা বুঝে ওঠার আগে প্রীতম যেন খেলায় মেতে উঠলো।
আমি শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদ করতে চেয়েও করতে পারলাম না। বাসায় ফিরে বিছানায় চোখ বুঁজলে
ওই কথাটাই মনে ভেসে উঠলো। আমি মনকে এই বলে সান্ত¦না দিলাম, একদিন তো প্রীতম আমারই হবে।
সামনের বছর আমি এইচএসসি পরীক্ষা দেবো। অন্যদিকে প্রীতমের
কোর্সও শেষ হবে আর একবছর বাকী। প্রীতমকে আমি ভালোবাসি । প্রীতমকে ছাড়া বাঁচবো না এমন
একটা আবেগ আমার মধ্যে দানা বেঁধে উঠেছে, আমি এক সময় উপলব্ধি করলাম।
সামনে
এইচএসসি পরীক্ষা, পড়াশোনায় আমি খুবই ব্যস্ত, প্রীতমের পরীক্ষাও সামনে। বেশদিন আমাদের
দেখাসাক্ষাৎ নেই। পরীক্ষা শেষ হবার পর আমি ভাবলাম, প্রীতমের পরীক্ষাও তো শেষ হয়ে এলো ।
দু’জনের পরীক্ষা শেষ হওয়ার
পর----- চুটিয়ে প্রেম করা যাবে ভাবলাম
আমি। কিন্তু বিধি বাম। পরীক্ষার পর প্রীতম লাপাত্তা। দাদার সঙ্গেও তার কোন যোগাযোগ নেই। এক
সময় আমি জানতে পারলাম সে পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর পরই কলকাতা হয়ে সে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে
চলে গেছে। এও জানতে পারলাম সে নিউইয়র্কে , ওখানে নাকি অন্য মেয়েদের সাথে প্রেম করে বেরাচ্ছে। এব মধ্যে আরো কয়েক
বছর গড়িয়ে গেল। আমি এর মাঝে ইংরেজিতে অনার্স করে এম পাশ করেছি। কলকাতায় তার পিসিমার
কানে এটা ওঠায় তিনি প্রীতমকে দেশে ফিরিয়ে আনলো। দেশে ফিরে সে একবার ঢাকায় আসে। আমাদের
বাসায় দু’তিন দিন এলো। সে আমাকে ভুলে
ছিল বলে আমার কাছে ক্ষমা চাইলো। সে আমাকে জীবন সঙ্গিনী করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিলেও
আমি তার চোখেমুখে আগেকার সেই আবেগ উচ্ছ্বাস দেখতে পেলাম না। তারপর সে আমার সঙ্গে ও
আমার দাদার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। আমি সুন্দরী ও বিদুষী, তাই অনেকেই আমাকে প্রেম নিবেদন করতে শুরু করলে আমি কিন্তু প্রীতমের মুখ চেয়ে তাদেরকে প্রত্যাখান করেছি।
এখনো
আমি প্রীতমের অপেক্ষায় বসে বসে আছি। আমি মাঝেমাঝে ভাবি, প্রীতম কি চিরদিনের জন্যেই অধরা থেকে
যাবে।
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)