গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১৫

৫ম বর্ষ প্রথম সংখ্যা।।২৫শে অক্টোবর২০১৫।।৭ই কার্তিক১৪২২

এই সংখ্যার লেখকসূচি - সুবীরকুমার রায়, অসিত চট্টোপাধ্যায়, আবু রাশেদ পলাশ, মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী, রুখসানা কাজল, হাসান ইমতি, দীপঙ্কর বেরা ও নির্মলেন্দু কুন্ডু ।

সম্পাদকীয়

‘গল্পগুচ্ছ’ চার পেরিয়ে পাঁচে পা দিল । দেখতে দেখতে চারটি বছর পেরিয়ে গেল । এটি অতয়েব ‘গল্পগুচ্ছ’র পঞ্চম বর্ষের প্রথম সংখ্যা । গল্পগুচ্ছর লেখক, পাঠক ও সমস্ত শুভানুধ্যায়ী – যারা বিগত চারবছর সঙ্গে ছিলেন, এখনও সঙ্গে আছেন তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ । আমি নিশ্চিত, তারা সঙ্গে থাকবেন যতদিন গল্পগুচ্ছ থাকবে । শারদ-উৎসব শেষে সকলকে জানাই বিজয়ার আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা ।

সুবীর কুমার রায়

কমল 

নতুন চাকরীতে ঢুকেই কমলকে সহকর্মী হিসাবে পাওয়া ভাগ্যের কথা। ওর সব ভালো, শুধু কানে বেশ কম শোনা, সব কথায় মাইরি বলা ও চুড়ান্ত কৃপণতাই ওকে আদর্শ মুরগীতে রূপান্তরিত করে ছেড়েছে। আমার থেকে তার নিজের ও চাকরীর, উভয়েরই বয়স অনেকটাই বেশী।
এ হেন কমলের বিয়েতে অফিসের সবার নিমন্ত্রণ। অফিসের ঠিক নীচের ফুলের দোকানের তপনকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম, সে ইঞ্চি দু’-এক আকন্দ তারপরে ইঞ্চি খানেক জবা দিয়ে মোটা দুটো গোড়ের মালা তৈরী করে দিতে পারবে কী না। মালা দুটোয় ইঞ্চি তিনেক লম্বা অপরাজিতার লকেট মতো থাকবে। আমার কথা শুনে তপন তো অবাক। বললো, “তা পারবো, কিন্তু ঐ মালা নিয়ে আপনি কী করবেন”? বললাম “সেটা তোর জানার দরকার নেই, তুই দুটো মালা তৈরী করে দিতে পারবি কী না সেটা বল, আর জবা ফুলগুলো কালী পূজার জবা দিবি, যেগুলো অনেক রাতে ফুটে বড় আকার ধারণ করে”। সে সম্মতি জানিয়ে চলে গেল। 

খবর পেয়ে ম্যানেজার জানালেন ঐ সব সঙ্গে নিয়ে গেলে, তিনি আমার সাথে যাবেন না। বললাম অফিস থেকে সকলে মিলে একটা উপহার তো দেওয়াই হচ্ছে। এটা আমরা কয়েকজন, বন্ধু হিসাবে অতিরিক্ত দেব। যাহোক্, সন্ধ্যার পর মালা নিয়ে বিয়েবাড়ি যাবার পথে দোকান থেকে একটা মাত্র নিরোধ কনডোম প্রায় বিনা পয়সায় কিনে, ফুলের মালার সাথে নিয়ে যাওয়া হ’ল।
 
বিয়ে বাড়িতে নতুন বরকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করা হয়েই থকে। এটাই রীতি, কিন্তু সেটা বিয়ের দিন। বৌভাতের দিন এই জাতীয় ব্যাপার, বিশেষ হতে দেখি না। কিন্তু এখানে দেখছি পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে, এক ঝাঁক নিমন্ত্রিত কমলের ওপর হামলে পড়েছে। যেন তার পিছনে লাগার জন্যই তারা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে এসেছে। হঠাৎ আলো চলে যাওয়ায় দেখা গেল জেনারেটার তো দুরের কথা, একটা মোমবাতি পর্যন্ত বাড়িতে নেই। অন্ধকারে বেশ কিছুক্ষণ বসার পর আলো আসলে পরেশ বললো, “কমল তুমিও একটা ফুলের মালা গলায় দাও। বিয়ের দিন তো দু’জনের তেমন ভালো ফটো তোলা যায় নি, আজ তোমাদের দু’জনের একটা ভালো ফটো তুলে দিচ্ছি, বড় করে বাঁধিয়ে নিও”। কমল একটা চেয়ারের ওপর উঠে বাবার ফটোতে ঝোলানো মালাটা খুলে নিজের গলায় পরতে পরতে বললো, “ফটোর দাম কী  আমায় দিতে হবে মাইরি”? 

খেতে যাবার পথে একটা খুব সুন্দর দেখতে মেয়েকে দেখিয়ে ঠাট্টা করে কমলকে বললাম, “তোমার তো একটা হিল্লে হয়ে গেল, ঐ মেয়েটার সাথে আমার একটা ব্যবস্থা করে দাও না”। উত্তরে সে শুধু বললো “কী যে বল মাইরি”। দোতলায় খাবার জায়গায় যাওয়ার পথে নতুন বউকে মালার প্যাকেটটা দিয়ে বললাম, “বৌদি প্যাকেটটা এখন খুলবেন না”। কমল চিৎকার করে “সুবীর, চ্যাংড়ামো কোরনা মাইরি” বলতে বলতে খাবার জায়গায় নিয়ে গিয়ে বসালো। মুখোমুখি দুটো সারিতে আমরা অফিস কর্মীরা বসেছি, শুধু আমার ঠিক সামনে একজন অপরিচিত ব্যক্তিত্বপূর্ণ চেহারার ভদ্রলোক মোটা কাচের চশমা পরে খেতে বসেছেন। কিছুক্ষণ পরে কমল খাবার জায়গায় হঠাৎ এসে হাজির হয়ে ভদ্রলোকের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বেশ জোরে জোরে বললো, “সুবীর তুমি যে মেয়েটাকে বিয়ে করার কথা তখন বলছিলে, সে এনার মেয়ে। ইনি একটা কলেজের হেড অফ্ দি ডিপার্টমেন্ট”। আমার তো খাওয়া মাথায় উঠলো। ভদ্রলোক একবার শুধু তাঁর মোটা কাচের চশমার ভিতর দিয়ে আমাকে জরিপ করে নিলেন।

খাওয়া দাওয়া শেষে নীচে এসে নতুন বউ-এর কাছ থেকে প্যাকেটটা নিয়ে খুলে দেখি, জবা ফুলগুলো বেশ বড় বড় হয়ে গেছে। আহা! মালার কী রূপ। একটা মালা কমলকে পরিয়ে দিয়ে নতুন বউকে বললাম, “বৌদি রাতে এই মালাটা কমলকে বলবেন আপনাকে পরিয়ে দিতে।”। কমল চিৎকার শুরু করে দিল— সুবীর চ্যাংড়ামো কোর না মাইরি। যাহোক্ আমরা ফিরে এলাম। পরে কাজে যোগ দিয়ে সে জানালো, “তোমাদের নামে খুব নিন্দা হয়েছে মাইরি”।

দিন যায়, কমলকে নিয়ে ভালই সময় কাটে। বছর খানেক পরে একদিন, সেদিন সে অফিস আসে নি, বিকালের দিকে অফিসে এসে জানালো যে তার মার অবস্থা খুব খারাপ। সে কিছু টাকা তুলতে চায়। তার ব্যাঙ্ক এাকাউন্টে সবসময় অনেক টাকা থাকলেও, সাধারণত সে খুব একটা টাকা তোলে না। তার মা অনেকদিন ক্যানসারে ভুগছেন জানতাম, তাই জিজ্ঞাসা করলাম “মা এখন কেমন আছেন”? সে করুণ স্বরে উত্তর দিল ভালো না গো। সেফে টাকা উঠে যাওয়ায় তাকে টাকা তুলতে দেওয়ার ব্যবস্থা করা গেল না। অগত্যা যার পকেটে যা ছিল তাই দিয়ে কিছু টাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হল।

পরদিন কাছা নিয়ে কমল অফিস জয়েন করলো। গতকাল তার মা মারা গেছেন জেনে, আমরা সবাই তাকে সহানুভুতি জানালাম। ম্যানেজার বললেন “গতকাল তোমার মা মারা গেছেন, আজ অফিস জয়েন না করলেই ভাল করতে। এই সময়টা খুব সাবধানে থাকতে হয়, তার ওপর গতকাল তোমার ঝামেলাও গেছে। দু’চারদিন ছুটি নিয়ে অফিসে আসা উচিৎ ছিল।

উত্তরে কমল বললো “আমিতো মাকে কনট্রাক্টে পুড়িয়েছি, তাই আমার তেমন কষ্ট বা ঝামেলা পোহাতে হয় নি। আমি শ্মশানে গিয়ে মুখাগ্নি করে চলে এসেছি, আবার ঘন্টা দেড়েক পরে একবার গিয়ে গঙ্গায় অস্থি ফেলে কাছা নিয়ে ফিরে এসেছি। বাকী সব ঝামেলা ওরাই সামলেছে। কিছু ফালতু খরচা হয়ে গেল, তা আর কী করা যাবে মাইরি। তাছাড়া বাড়িতে থাকলে অনেক ঝামেলা। অনবরত লোক আসবে। তাদের চা খাওয়াও, মিষ্টি খাওয়াও। তার থেকে অফিসে  থাকা অনেক ভাল”। 

আসল খবরটা আরও পরে জানা গেল। সেদিন কমল যখন অফিসে টাকার জন্য এসেছিল, তার অনেক আগেই তার মার মৃত্যু হয়। পাছে সহকর্মীর মার মৃত্যুর খবর পেয়ে অফিসের কেউ তার বাড়ি বা শ্মশানে যায়, সেই ভয়ে সে তার মার অবস্থা খারাপ বলেছিল। কারণ তাহলে তাদের আবার শ্মশানবন্ধু হিসাবে শ্রাদ্ধে বা নিয়মভঙ্গে নিমন্ত্রণ করার প্রশ্ন আসবে। 

নিয়মভঙ্গ তো দুরের কথা, কমলের মার শ্রাদ্ধেও যে অফিসের কেউ তার বাড়ি যাওয়ার সুযোগ পায় নি, একথাটা বোধহয় না বললেও চলবে।



অসিত বরণ চট্টোপাধ্যায়

কুসুম বুড়ির গল্প



এ তল্লাটে এমন কেউ নেই যে কুসুম বুড়িকে চেনে না বা তার গল্প শোনেনি। না। কুসুম বুড়ি কোন ভি আই পি মেয়ে ছিল না। নিতান্তই সাদামাটা মহিলা। উচ্চতায় প্রায় পাঁচ ফিট পাঁচ ইঞ্চি। দোহারা গড়ন।গায়ের রং শ্যামলা। ঠোঁটের কোনায় ছিল একটা মানানসই আব্ যাকে আমরা ডাক্তারী পরিভাষায় বলি সিস্ট। বিশ্রী লাগতো না। বরং হাসলে এমন লাগতো যা ঠিক বলে বোঝানো যাবে না। কিন্তু মনে রাখার মত।
 

আমি ওকে বিধবা অবস্থাতেই দেখেছি। শুনেছি, দুর গাঁয়ের জমিদার বাড়ীর মেয়ে ছিল।কিন্তু এতটাই সাদামাটা জীবনযাপন করতো যে দেখে আমার অন্তত কোনদিন তা মনে হয়নি। বাড়ীতে সে একা। তার স্বামী অঘোর সেন ছিল বিশাল লাক্ষা কারবারী। কুসুম,পলাশ কুল গাছে লাক্ষা চাষ করত আর মরসুমে লাক্ষা গাছ থেকে কেটে নামিয়ে তা
  ছাড়িয়ে মন মন লাক্ষা বিক্রি করত বলরামপুর ঝালদার লাহাকুঠিতে। এ তল্লাটে লাক্ষাকে লাহা বা লা বলা হতো। লাক্ষা থেকে গালার বিস্কুট তৈরী করে একসময় বিদেশে রপ্তানী হতো।কুসুম গাছের ডাল থেকে লাক্ষা ছাড়াতো নিজের হাতে। ও এত পরিস্কার লাক্ষা ছাড়াতো যে ওর ছাড়ানো লাক্ষা নাকি দেড়গুন দরে বিক্রী হতো।

এহেন পয়মন্ত কুসুমের দুর্ভাগ্য একটাই, তার সাতটা সন্তানের কোনটাই বাঁচেনি। সন্তান জন্মানোর দু তিন মাসের মধ্যেই অজানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেত। গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার,বদ্যি, কবিরাজ, বড় ডাক্তার, তাবিজ,কবচ মাদুলি, বা ঠাকুর থানে হত্যে দিয়েও কোন সুফল হয়নি। তাই হয়ত লাক্ষার কাজে ডুবে শোক ভুলে থাকার চেষ্টা করত। শুনেছি অষ্টমবারের মত ও পোয়াতি হয়েছিল। সে যখন চার মাস পোয়াতি তখন অঘোর সেন কলেরায় মারা যায়।সে বছর কলেরায় গ্রামের অনেকেই মারা গেছিল।কেন যে কুসুম মরল না তা কুসুমের ভগবানই জানে। কেননা ওর স্বামীর মলমুত্র ঘেঁটেও কলেরাকে আলিঙ্গন করতে পারেনি। সে অফশোষ ও কোনদিন ভোলেনি।

ভেঙে পড়েনি কুসুম। মৃত্যু নিয়ে এতটাই নাড়াচাড়া করেছিল যে স্বামীর মৃত্যু তার মনে কোন রেখাপাতই করেনি। বরং সমস্ত শোক উপেক্ষা করে অষ্টম ও শেষবারের মত সন্তানের জন্ম দেওয়ার প্রস্তুতি নেয় সে। যথাসময়ে জন্মাষ্টমীর শুভলগ্নে জন্ম নিল এক ফুটফুটে পূত্র সন্তান। পড়শি ধাইমার অক্লান্ত পরিশ্রমে আঁতুড়ের ধকল পেরিয়ে সেরে উঠল।আর আর বারের মত ছয়দিনের মাথায় ষষ্ঠি পুজো বা ষাঠারো পুজো হলো, নয়দিনের দিনে নরাতো এবং একুশ দিনের দিন একুশা উদযাপণ করে আঁতুড় ছেড়ে স্নান সেরে শুদ্ধ হয়ে ছেলের পরিচর্যায় মেতে উঠল। ছেলের নাম দিল কেষ্ট। গ্রামের সবাই ভেবেছিল বড় জোর তিনমাস তারপর তো কুসুম আবারও একলা হবে।

না।এবার সংস্কারমুক্ত কুসুম আর পাঁচজনের কথা শুনে গ্রামীন সংস্কারে জড়িয়ে পড়ল। তখনকার দিনে নসংস্কার ছিল মৃতবৎসা বা যে মেয়ের সন্তান বারবার মারা যায় সে যদি তার সন্তান ঠাকুরকে সাক্ষী রেখে বিক্রি করে এমন কোন মহিলাকে যার সন্তান অসময়ে মারা যায়নি তাহলে সেই বিক্রিত সন্তান দীর্ঘায়ু হয়ে বেঁচে থাকে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। গ্রামের নন্দ বাঁড়ুজ্যের স্ত্রী দামিনিকে একসের আতপ চাল আর পাঁচসিকে পয়সার বিনিময়ে কেষ্টকে বিক্রি করে দেয় শ্রীশ্রী রাধা গোবিন্দ জিউকে সাক্ষী রেখে। তার কয়েক মাস পরে নন্দু বাঁড়ুজ্যে কেষ্টকে নিয়ে সপরিবারে স্থায়ীভাবে চলে যায় জামসেদপুর।
অশুভ ছায়া পড়ার ভয়ে নীরবে দামিনীর প্রস্তাব মেনে নেয় কুসুম।

এর পরেই কুসুমের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। জীবন
  অন্যখাতে বইতে শুরু করে। লাক্ষা ব্যাবসা ছেড়ে দেয়। সমস্ত গাছ বিক্রি করে দেয়।শুরু হয় নুতন জীবন। তালতাল মাটি আনতে থাকে পাশের জমি থেকে। সেই মাটি দিয়ে গড়তে থাকে মা ষষ্ঠির মুর্তি আর ছোট ছোট শিশুমুর্তি। অনেকেই ওকে ব্যাঙ্গ করে ষষ্ঠিবুড়ি বলে ডাকতো। কেউ কখনও ওকে রাগতে দেখেনি। এর সঙ্গে জঙলী গাছগাছড়া দিয়ে তৈরী করতো বাচ্চাদের নানারকম ঔষধ। আলই নামে কবিরাজী ঔষধটি ছিল ধন্বন্তরী। শিশুর জ্বর,তড়কা,অজীর্ণ,বদহজম,খোসপাঁচড়া সবকিছুর ঔষধ তৈরী শুরু করলো। রাতদিন মুর্তি ও ঔষধ তৈরী করত। আর গুনগুন করে শ্রীকৃষ্ঞের অষ্টোত্তর শতনাম আওড়াতো।

ছোটবেলায় দেখতাম যার বাড়ীতেই শিশু জন্মাতো কুসুম বুড়ি সেখানে হাজির। আঁতুড়ঘরে পুবদিকের দেওযালগোড়ায়
  একটি ষষ্ঠিমুর্তি ও একটি শিশুমুর্তি রেখে দিত।আর দেওয়ালে আলতা দিয়ে প্রতিদিন একটি পাঞ্জা ছাপ দিত। ছদিনের মাথায় ষাঠারো পুজা হতো আর কুসুম বিড়বিড় করে শিশুর সুস্থতা কামনা করতো। প্রয়োজনে সেদিন থেকেই আলই খাওয়াতো। এ নিয়ে কারো কোন অভিযোগ শুনিনি। বাচ্চাদের অসুধের পয়সাও নিতে দেখিনি। গ্রামের কোন বাচ্ছা ছেলে রাতবিরেতে কান্নাকাটি শুরু করলে কুসুম একছুট্টে গিয়ে হাজির হতো। রাত জেগে শিশুর পরিচর্যা করতো।

এহেন কুসুমবুড়ির শরীর ভাঙতে শুরু করলো। যেদিন শুনলো নন্দুর ছেলে কেষ্ট মস্তবড় ডাক্তার হয়ে বিলেত যাচ্ছে সেদিন থেকেই
  কুসুম মুষড়ে পড়ল। যদিও দীর্ঘ পঁচিশ বছরে পাঁচ বারের বেশী কেষ্টকে দেখেনি। তবু নাড়ীর টান তো। অজানা আশঙ্কায় ডুকরে উঠতো কুসুম।

কিছু দিনের মধ্যে কুসুম কুঁজো হয়ে পড়ল। গায়ের রঙ কেমন যেন কালো হয়ে গেল। মাথার চুলগুলো ধবধবে সাদা শনের মত হয়ে গেল। ছানিপড়া ফ্যাকাশে চোখ। হাতে ব্যাঁকাটেরা লাঠি। কাঁপাকাঁপা গলায় কথা বলা। এ এক অন্য কুসুম। প্রায়ই একে ওকে বলতো "আমিতো আর বেশিদিন বাঁচবো না,কেষ্টর
  হাতে অাগুনও পাবো না। আমাকে তোমরা সমাধি দিও।"

কোন এক বর্ষার রাত।ঘনঘন বিদ্যুত ঝলকানি।মুষলধারায় বৃষ্টির বিরাম নেই।রাস্তাঘাট চারদিক জল
  থৈ থৈ। একটানা বজ্রপাতের শব্দ।মনে হচ্ছে যেন প্রলয় হচ্ছে। লাহাবাড়ী থেকে ডাক পড়লো কুসুমের। ছেঁড়াছাতা নিয়ে বিদ্যুতের আলোয় ঠাহর করতে করতে লাহাবাড়ী গিয়ে দেখে বাচ্ছাটা চিঁ চিঁ করছে। পাতলা দাস্ত করে নেতিয়ে পড়েছে। কুসুম ছানিপড়া চোখ দিয়ে যেটুকু দেখলো আর স্পর্শ করে যা বুঝলো এ রোগের বিশল্যকরণী ওর কাছে নেই। ছেলের মাকে বললো, "মাগো এর ওষুধ আমার কাছে নেই। বড় ডাক্তারের কাছে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাও। আর মায়ের দুধ খাওয়াও। দুধ খাওয়াতে ছেড়োনি মা।"
এই বলে কোন ঔষধ না দিয়ে বাড়ী ফিরল কুসুম,আর সারারাত লাহাবাড়ীর বাচ্চ্ছাটার মঙ্গল কামনায় ভগবানকে ডেকে চললো।

ভোর বেলায় শোনা গেল লাহা বাড়ীর বাচ্ছা ছেলেটা ভোর রাতে মারা গেছে। হাতুড়ে ডাক্তার বলেছেন আন্ত্রিকে মারা গেছে। ডিহাইড্রেটেড হয়ে গিয়েছিল। ছেলের মা শুনেছে তান্ত্রিকে মেরেছে। অতএব আর যায় কোথা। ডাইনি বুড়ি কুসুম এসেছিল রাতে তাহলে ওই তুকতাক করে গেছে। কয়েক ঘন্টার মধ্যে ষষ্ঠিবুড়ি ডাইনি হয়ে গেল। সকালে গুজব ছড়িয়ে পড়ল সারা গ্রামে। কুসুম ডাইনি হয়েছে।

ডাইনির নজর এড়াতে সব ছেলের মা সাবধান হয়ে গেল। গ্রামের প্রতিটি বাড়ির দরজা কুসুমের কাছে বন্ধ হয়ে গেল। একটু বড় ছেলেরা রাস্তাঘাটে কুসুমকে দেখলেই ডাইনি বুড়ি বলে খেপাতে শুরু করল। দুঃখে অভিমানে কুসুম নিজেকে গৃহবন্দী করলো। অশক্ত অনাহারক্লিষ্ট কুসুমের দিন এমনিতেই শেষ আসছিল ক্রমশ।

আজও বেশ মনে পড়ে সেদিন দুর্গাষষ্ঠী। শিউলি পদ্মের গন্ধে ম ম আকাশ বাতাস। মন্ডপে রঙীন জামা কাপড়ে শিশুর কলরব।

হঠাৎ শোনা গেল কে বা কারা বাড়ীর মধ্যে পাথর দিয়ে কুসুমের মাথা থেঁতলে দিয়েছে। রক্তে ভেসে গেছে মেঝে। মাটির ষষ্ঠী ও শিশুমুর্তি গুলো রক্ত স্নানে হাবুডুবু।

রক্তাক্ত মহাষষ্ঠীতে বিসর্জনের বিষন্ন সুরে মুহূর্তে থেমে গেল শিশুর কলরব।


রুখসানা কাজল

মা

                            বাইরে ধু ধু রোদ্দুর। গেটটা অনেক উঁচুতে।  বেয়ে উঠার ক্যারিক্যাচারটা তখনো ঠিক জানেনা রুমকি। বিশাল এই বাড়িটাই ওর স্বপ্নের জগত। বাগানের বড় বড়  গাছের সাথে মুখ উঁচু করে গল্প করে। গান শোনায়। নতুন শেখা কবিতা শুনিয়ে জানতে চায়, কেমন হলো ? মা শিখিয়ে দিয়েছে কাল রাতে। গাছেরা মুচকি হাসে। হিংসুটে গলায় কাঁটাঝোপের ষড়াগাছটি বলে ওঠে, একদম মিথ্যা কথা। ওর মা  ত খুব অসুস্থ সেই কবে থেকে। কথা বলবে কেমন করে যে কবিতা শেখাবে?” মহাশিরিষ বকে দেয় ষড়াগাছকে। রুমকি সরে আসে কাঁটাঝোপকে এড়িয়ে। ওর  মা সত্যি  অসুস্থ। কিছুদিন হাসপাতাল কিছুদিন বাসা। কেবল শুয়ে থাকে। মার রুম থেকে ওষুধের গন্ধের সাথে ভেসে আসে মিস জোন্স আর মুটকি এক নার্সের সদা ব্যস্ততা। রুমকি কৃষ্ণচূড়ার হলুদ গা জড়িয়ে কেঁদে ফেলে। মিথ্যে বলেছে সে।    
                         মা যেদিন শাড়ি ধুতে দিত একসঙ্গে অনেকগুলো শাড়ি দিত। শাড়িগুলো ছিল অন্যরকম সুন্দর। ঘন বড় পাড় আর আঁচল জুড়ে কারুকাজের রহস্য বুনট। সারা দুপুর রুমকি রোদ্দুরে নেড়ে দেওয়া শাড়ির নীচে টমির সাথে খেলত, গল্প করত। ভাইয়াটা একদলা সাদা চর্বির মত ঘুমিয়ে থাকত রেনুদির  কোলে। মাঝে মাঝে কোনো শাড়ির উড়ে আসা আঁচল খুব কাছে টানত রুমকিকে।  আরে এটা ত কথা ও কহানী শাড়ি। মানুষ আছে,পাখী, ফুল,নৌকা,স্বস্তিকা আরো কত কিছু। সারা দুপুর বসে থেকেও রুমকি কোন কহানি খুঁজে পেত না । বয়েই গেল।  নিজেই গল্প বানিয়ে টমিকে শুনাত। সেই গল্পে রাজা আসত, রাক্ষস, জলদৈত্য,  দুটো তিনটে ধূলো ওড়ানো যুদ্ধ ত থাকতই । কিন্তু সব গল্পের শেষে  একজন মা থাকত। খুব হাসি খুশী সুস্থ মা। তার চুলে বেলিফুলের মালা দোল খেত। চোখে কাজল। রুমকির মার মত রোগা অসুস্থ ফ্যাঁকাসে মরা মরা মা নয়। 

                         রেণুদি মার শাড়িগুলো রোদ্দুরে মেলে দিয়ে গেছে। একটা কালো কাঞ্জিভরমে মন আটকে যায় রুমকির । লাল মেরুনে ঘন কাজের পাড় আঁচল। বাপি যখন শরতের  আকাশে মেঘের খেলা দেখাতে মধুমতি নদীর পাড়ে নিয়ে যায় রুমকি আকাশ দেখে না। নৌকা দেখে। জীর্ণ পাল খাটিয়ে কোথায় যে যাচ্ছে নৌকাগুলো! বাতাসে  ফুলে  ওঠছে পাল। কাঞ্জিভরমটা রোদ্দুরে দিলে এরকম ফুলে ফুলে দুলে ওঠে । রুমকি আর টমি সেদিন নদী নদী খেলা খেলে। রুমকি কল্পনা করে সেই নদীর ঘাটে কালো মেরুন কাঞ্জিভরম পরে কাশফুল হাতে নিয়ে বাপিকে গান শোনাচ্ছে মা, অমল ধবল পালে লেগেছে – রুমকি টমির গলা জড়িয়ে  চুপিচুপি বলে, দেখিস টমি, মা একদিন ঠিক ভাল হয়ে যাবে!” টমিও লেজ নেড়ে সায় দেয়।

                      ওরা চলে আসে দেওয়াল ঘেঁষে লিলি ফুলগাছের কাছে। দুপুরটা যখন নরম হয়ে বিকেলের হাত ধরে গল্প করে তখন লিলিফুলগুলো ফুটতে শুরু করে। ঠায় বসে থাকে রুমকি। লিলি কুঁড়িটি একটু ফুলে ওঠে কাঁপতে কাঁপতে একটা পাপড়ি তার সাদা হাত বাড়িয়ে দেয়। ওমনি একটু হলুদ রেনু সুগন্ধ নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। আর একটি একটি করে পাপড়িগুলো খুলে হেসে হেসে লিলিফুল হয়ে  যায়। একটি ফুল ফুটে উঠলে রুমকি আর একটি কুঁড়ির সামনে ছুটে যায়। মিস জোন্স বলেছে, লিলিগাছ মা হচ্ছে। এরকম সময়ে  ঈশ্বরের কাছে যা চাইবে ঈশ্বর তোমাকে তাই দেবে।” রুমকি সেই সদ্য ফোটা লিলিফুলকে আকুল হয়ে বলে, আমার মাকে ভাল করে দাও লিলিফুল।”
  
                       খুঁজে খুঁজে রেণুদি জোর করে ধরে এনেছে। হাত মুখ ধুয়ে দিতে দিতে বুনো বাউরা বলে বকাঝকা করে রুমকিকে নিয়ে আসে মার রুমে। মার বিছানায় কোল জড়িয়ে শুয়ে আছে ভাইয়া। রুমকি দরোজার কাছে পর্দা আঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সারাক্ষণ শুয়ে থাকা মাকে আজকাল ওর ভাল লাগে না। একটু কাছে গেলেই মুটকি নার্স হিস হিস করে। ভয়ংকর শাসায়, যেওনা যেওনা, শব্দ    করোনা, আস্তে ধর, কি মেয়েরে বাবা, ছেলে হলে ভাল হত। সেদিন  বাপির শেখানো কবিতা শোনাতে গিয়েছিল। এমন জোরে হাত মুচড়ে দিয়েছে যে এখনো  ব্যাথা পায় রুমকি। চোখ দিয়ে কাছে ডাকে মা। রেনুদি ঠেলে দেয়, যা সোনা। রুমকি যায় না। ওর গা থেকে মাটি ফুল আর বুনো ঘাসের সবুজ গন্ধ ভেসে আসছে। গন্ধটা  গলে গলে অভিমানে ভাসিয়ে নিচ্ছে রুমকিকে । মার দিকেও তাকাচ্ছে না। কালো শালের নিচ থেকে লম্বা সুন্দর একটি  সাদা হাত  অনেক কষ্টে ধীরে ধীরে কাঁপতে কাঁপতে বাড়িয়ে দেয় মা। গোলাপবালাটা যেন আলোকস্তম্ভ। রুমকি রেনুদির হাত ছাড়িয়ে ছিটকে বেরিয়ে  আসে, এরকম মা চাইনা। চাইনা। রুমকির পায়ের নিচে অভিমান। সামনে পেছনে আকাশে  বাতাসে অভিমানে ডুবে যাচ্ছে সব । সমস্ত  অভিমান নিয়ে রুমকি লিলিবনে ঘাসের উপর কেঁদে লুটিয়ে পড়ে, আমার মাকে ভাল করে দাও ঈশ্বর। আগের মত করে দাও।” 

                        ছোটচাচা মোগলাই কাপে চা খাচ্ছে আর খুব হাসছে। সেজচাচা জমানো চুটকিগুলো মাকে শোনাচ্ছে। মাঝে মাঝেই চোখ মুছে নিচ্ছে। বাগানের এক কোণে শুধু সাদা ফুলের গাছ। বাপির পছন্দ। রুমকি মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। চৌধুরী শাড়ি বিতানের বেস্ট শাড়িটা পরেছে মা। মিস জোন্স  আর মুটকি নার্স টেবিল সাজাচ্ছে। রেনুদি সেনাপতির মত ডিরেকশন দিচ্ছে। একটা সাদা পিরিচে মার প্রিয় বেলিফুল তুলেছে বাপি আর ভাইয়া। তাতে একটি সাদা গোলাপ শুভ কামনা হয়ে সবার সাথে হাসছে। মুটকি নার্স হেসে বলছে, মেয়ে তো নয়, যেন  ঝড়!” মা রুমকিকে দুহাতে আরো গভীর করে জড়িয়ে ধরে। মার কোলে  মার গন্ধ নিতে নিতে লিলির পাপড়ির মত সাদা সুন্দর হাত ধরে রুমকি বলে, জানো মা আমি লিলি ফুল ফুটতে দেখেছি!”  
                                   


আবু রাশেদ পলাশ


মা


কঠিন স মানুষের কাছে তার জীবনে দুঃসময় যেন জানা ছিল তার । ভালবাসা প্রত্যাশী এ জীবনে এক মুঠো সুখের জন্য সংগ্রাম করেছে সে । যে সংসার নিজের হাতে তৈরি করেছে এতকাল আজকাল সেখানেও কেন যেন অস্তিত্বহীন ঠেকে নিজেকে । ভাবনা হয় নিজের ঘরে কতটুকু নিরাপদ সে ! এক এক করে দিন গেলে সম্পর্ক ফিকে হয় আরও । তারপর একদিন নিজ শয্যায় মেয়ে মানুষের গোঙানোর আওয়াজ শুনা যায় হয়তো ।
মোহনপুর গ্রামে শফিমোল্লার বড় বাড়ী । ধনু নদীর তীর ধরে যে কাঁচা সড়কটা উত্তরে প্রবাহিত তার ঠিক শেষ মাথায় বড় বাড়ীটা । স্থানীয়দের ভাষায় খুনকার বাড়ী । এ পাড়ায় পোক্ত গৃহস্থ শফিমোল্লা । বাড়ীতে পাকা দালান আছে তার । গোয়ালে হালের বলদ আর চাষবাসের জন্য বিস্তর সম্পত্তি । কখনও কখনও মানুষের মূল্যায়ন অর্থেও হয় । সে ক্ষেত্রে সংসারে সচ্ছলতার ঘাটতি নেই শফিমোল্লার । পাড়ায় দাপুটে মানুষ সে । সবাই সমীহ করে তাকে । পরিবারে স্ত্রী ছাড়াও চার ছেলে আর একমাত্র কন্যা আছে তার ।
শফিমোল্লার সন্তানদের মধ্যে ছেলেরা বড় । পরপর চারটি ছেলে সন্তানের পর আলেয়া বেগমের মেয়ে সন্তান প্রসব পুলকিত করে এ বাড়ীর সবাইকে । খুশীতে হালের বলদ জবাই করে পাড়ায় ভোগ দেয় শফিমোল্লা । তবে মনে আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হয়না তার । মেয়ের গাঁয়ের রঙ যে পাড়ার অন্য দশটা মেয়েদের থেকেও ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ এটা ভেবেই কেন যেন ভেতরে আফসোস হয় পরমুহূর্তে  সত্য হয়তো আজন্মকাল অপ্রকাশিতই থাকে তবে ভেতরে চাপাকষ্ট পোষে রাখে সে । খুনকার বাড়ীতে সন্তানের আগমন পাড়ায় উৎসাহ সৃষ্টি করে ঘরে ঘরে । গাঁয়ের বউ-ঝিরা মেয়ে দেখে কানাকানি করে-
-হুনছনি চাচি, খুনকার সাবের বউ বেটি বিয়াইছে কাইল ?
-হাঁচানি, সুরত কেমুন কওতো ?
-এককেরে কাইয়্যার ডংগো চাচি । দেকক্যা আহ পিত্তি জ্বলে ।
উত্তর পাড়ার হরবলা বিবি সম্পর্কে দাদি হয় তিতলির । শফিমোল্লার দূরসম্পর্কের আত্মীয়া । নবজাতকের মুখ দেখতে এসে রীতিমত হৈচৈ করে সে । খুশি মনে প্রথম আঘাতটা হয়তো সেই দেয় বাড়ীর সবাইকে 
-আয়গো খোদা ভাইপোর ঘরে বেটিনি ? অমুন সুরত জম্মে দেহিনায়গো ।
কিছুদিন এভাবেই মোহনপুর গ্রামের ঘরে ঘরে শফিমোল্লার মেয়েকে নিয়ে কানাকানি করে বউরা । তারপর একদিন হয়তো পার্শ্ববর্তী গ্রামে খবর পৌঁছায় । আত্মীয়তার ছল করে অথবা অল্পপরিচিত কারও মাধ্যমে আরও সুদূর কোন গাঁয়েও হয়তো সত্য-মিথ্যা মিশ্রিত খবর পৌঁছে একদিন । সে গাঁয়ে শফিমোল্লাকে চোখে দেখেনি কেউ  কিন্তু নাম শুনেছে তার । বিকেলে পার্শ্ববর্তী চায়ের দোকানে বসে হয়তো একদিন গল্পে মজে তাকে নিয়েই ।
-হুনছনি কাহা, খায়ের ঘরেনি কাউয়া বিয়াইছে বউ ?
-হাঁচানি, কেডা কইলো কওতো ?
-গণ্ডামারা গেদুমুন্সী মিছা কওনের মানুষনি ?
তারপর দিনে দিনে বয়স বাড়ে তিতলির । এক এক করে জীবনের নিগুঢ় সত্যগুলোকে একদিন বোঝতে শিখে সে । আলেয়া বেগম বাজার থেকে কিনে আনা সস্তাদরের প্রসাধনী মেখে মেয়ের রঙ ডাকার চেষ্টা করে লোকসমাজে । প্রয়োজন না হলে বাইরে যাওয়ার অনুমতি মিলেনা তিতলির । পাশের বাড়ীর ছকু,মকু আর হনুফা খেলাধুলার ছল করে জল কাদায় গড়াগড়ি খায় । ওদের দেখে উৎসাহী হলে চোখ রাঙায় আলেয়া বেগম ।
-ঠ্যাং ভাঙুম ডরাইস কলাম । বাপের গোস্যা অইবো ।
অতিউৎসাহী ভাইদের মধ্যেও বোনের প্রতি ভালবাসা অকৃএিম । প্রত্যহ সন্ধ্যায় বাজার থেকে ফেরার পথে বাহারি খেলনা কিনে আনে সবাই । কিন্তু এসবে আগ্রহবোধ করেনা তিতলি । অন্তরাত্মা যখন বাইরের টানে ব্যাকুল হয়, ভেতরে স্বর্গসদৃশ জীবন ব্যবস্থাকেও তখন নরক মনে হয় সবার কাছে । একাকী আবদ্ধ জীবনে হয়তো নিজেকে খাঁচায় বন্ধী পাখি মনে হয় তিতলির । ভেতরে বিনাভাষী আর্তনাদ হয় তবুও সহসা অনুমতি মিলেনা আলেয়া বেগমের । মাঝে মাঝে রশিদের মেয়ে হনুফা এসে খেলা করে ওর সাথে । ও এলে পুতুল বিয়ের আসর জমায় দুজন । তিতলি বলে-
-ল, পুতুলের বিয়া দেই আইজ । পুলা কই আমার ? হনুফা বলে-
-নিয্যস, আমি আইজ বেটি লমু কলাম ।
পাড়ায় হনুফার সাথে গলায় গলায় ভাব হয় তিতলির । সুযোগ পেলে দুজনে বসে খোশ গল্প করে ওরা । তারপর আরেকটু বড় হলে হয়তো মায়ের নিষেধের কারণ বোঝতে পারে তিতলি । দিনে দিনে বাইরের জগতে অতৃপ্তি আসে তার । সবার মধ্যে নিজেকে কেমন বেমানান ঠেকে যেন । তবুও দিনের পর দিন যে ব্যাপারগুলোকে এড়িয়ে চলতে চায় সে, কেন যেন বারংবার সে সত্যিগুলোই সামনে এসে দাঁড়ায় ওর । গায়ের রঙ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে বিব্রত হয় আরও বেশী । তারপর প্রায়ই ঘরে এসে বিছানায় অশ্রু বিসর্জন দেয় সে । পশ্চিমপাড়ার আহালুর বউ জুলেখা দিন মজুরীর খোরাক নিতে এসে তিতলিকে নিয়ে কথা উঠালে প্রতিবাদ করে আলেয়া ।
-মিছা কওকে বউ, বেটি মোর কালানি ? সুরত শ্যামলা মালুম অয় ।
মোহনপুর প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ভাল কোন বন্ধু পায়না তিতলি । সহপাঠীদের মধ্যে কেউই খুব আগ্রহ করে মিশতে আসেনা ওর সাথে । অথচ পড়াশোনায় কত ভাল সে ! একই ক্লাশের হাসু মাঝেমাঝে ওর সাথে দুএকটি কথা বলে এই যা । তবুও দিন শেষে হাসুকেই একমাত্র বন্ধু মনে হয় তিতলির । টিফিন পিরিয়ডে ছেলেমেয়েরা স্কুলের মাঠে বউছির আসর জমায় । তিতলি নিশ্চুপ বসে থাকলে হাসু খেলায় নিতে চায় ওকে । সে বলে-
-লও খেলি এক লগে ?
হাসুর কথায় আগ্রহবোধ করেনা অন্যরা । একই ক্লাশের জরি বলে-
-শিগগির আয় হাসু । হেরে নিমুনা কেউ 
হঠাৎ কি বোঝে সহপাঠীদের কথায় রাজী হয়না হাসু । তিতলির সাথে বসে খোশগল্পে মাতে সে । যৌক্তিক আর অযৌক্তিক বাক্যের মিশেলে নানা আজগুবি গল্প । রূপকথার ন্যায় । তারপর মাঝেমাঝেই একাকী থাকলে হাসু এসে ভাব জমায় তিতলির সাথে । ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গাঢ় হয় ওদের মধ্যে ।
তিতলি আর হাসু একই ক্লাশে দশ বছর সহপাঠী । কত সুখ দুঃখের স্মৃতি ওদের ! এরপর কি ভেবে স্কুলে শেষ বর্ষে এসে দুজনের বন্ধুত্ব প্রেমময় সম্পর্কে গড়ালো  যাদের দেহের চামড়া কাল তারাও দর্শননন্দিত তিতলিকে দেখে হয়তো তাই মনে হয় হাসুর । না হলে দুরন্ত যৌবনের প্রথম বেলায় কোন পুরুষের চোখে নিজেকে দেখার কারণ খুঁজে পায়না মেয়ে । তিতলি কালকেশী, কালরঙা আর ওর কাল হরিণ চোখ । তাতে কি, গুণেরতো অভাব নেই ওর । আমরা যারা চামড়ার চক্ষু দিয়ে মেয়েদের সৌন্দর্য খুঁজি ,তিতলিদের আসল সৌন্দর্য বোঝার সামর্থ্য নেই তাদের । ওরা যে চন্দ্রমুখী । জানো,ওরা যে আকাশে প্রজ্বলিত হয় সেখানেই জোছনা ছড়ায় নিগুঢ় আমাবস্যাতেও ।
তিতলি আর হাসুর সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি কোন কারণে  ভালবাসা দেহ মন মিলে হয় ।হাসুকে কোনদিন নিজের করে পায়নি তিতলি । উঠতি যৌবনে মেয়েদের শরীরের ভাঁজে ভাঁজে মাংস বৃদ্ধি পায় আর ছেলেদের চাহনির গাঢ়ত্ব । সামনে বিপরীত লিঙ্গের কেউ দৃষ্টিগোচর হলে ক্ষুধার্ত চোখদুটো রীতিমত চিবিয়ে খেতে চায় ওদের । নবকৈশোরে লোকচক্ষুর অন্তরালে কতবার তিতলির দেহে হাত দেওয়ার চেষ্টা করেছে হাসু ! কদিন না যেতেই সত্যিটা বোঝতে পারে তিতলি । হাসুরা কাল মেয়েদের সাথে দেহের আদান প্রদানে যত আগ্রহী, মন বিনিময়ে ততটায় অনাগ্রহ ওদের ।
কলেজে ভর্তি হওয়ার পর তিতলির মনে হয় এবার হয়তো দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হবে সবার । কিন্তু ওকে কলেজে পড়াতে রাজী হয়না বাড়ীর কেউ । বুড়ো হরবলা বিবি ভাইপোর বাড়ীতে বেড়াতে এসে প্রথম অনাগ্রহ প্রকাশ করে ।
-মাইয়্যা বশ করবিনি শফি ? পুলা দেকক্যা বিয়া দে শিগগির ।
আলেয়া বেগমও আপত্তি করে তিতলির ইচ্ছায় । সে বলে-
-অতো পইড়্যা কি অইবো কন দেহি ? শিগগির পুলার খোঁজ নেন ।

অবশেষে মেয়ের বিয়েতে আগ্রহী হয় শফিমোল্লা । ভাইয়েরাও পাড়ায় পাড়ায় ছেলের খোঁজ করে । হোসেনপুর গ্রামের আরজু ঘটক । ছোট দারকিনা মাছের মত দেখতে । তিতলির বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় আনাগোনা করে সে । সুযোগ বোঝে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয় শফিমোল্লার কাছ থেকে । এক এক করে অর্ধশত পাত্রের সম্বন্ধ আনে সে । কিন্তু সম্পর্ক হয়না কোথাও । ছেলেপক্ষ আগ্রহ নিয়ে দেখতে এসে ফেরত যায় শেষমেশ । যা হোক এরই মধ্যে আবার বিয়ের সম্বন্ধ আসে তিতলির জন্য । পাত্র দাসপাড়া গ্রামের দাগন ভুঁইয়ার ছেলে সোলেমান । দেখতে ভাল, গঞ্জে ব্যবসা আছে নিজের । শফিমোল্লা বলে-
-হগগল খোঁজ ভালানি আরজু ? আরজু বলে-
-হ, মিয়া ভাই পুলা সরেস । বিয়া মুনে কয় পাক্কা ।  
বিকেলে নূরআলীর চায়ের দোকানে আড্ডা দেয় গেঁয়োরা । শফিমোল্লার মেয়েকে নিয়ে কানাঘুষা করে সবাই ।
-খুনকার সাবনি পুলা দেহে মনা ? বেটির বিয়া দিব হুনি ।
-লক্কনে বুঝন ভার । নাউয়ের বশ করে মালুম অয় ।                  
যাহোক, খুনকার বাড়ীতে পাত্র আসার উছিলায় একটা হৈ হৈ রব বিরাজ করে সবার মধ্যে । ভাইয়ের বউয়েরা আসর জমায় তিতলিকে নিয়ে  তারপর তামাশায় মাতে কতক্ষণ । এসবে আগ্রহবোধ করেনা তিতলি । আমাদের দেশে মেয়ে দেখা কোরবানির হাটে গরু কেনার শামিল । দাঁত হতে দেহের প্রতিটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পরখ করে নেয় ছেলেপক্ষ । বারবার ওদের সামনে এভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে ভাল লাগেনা মেয়ের  তবুও কাল চামড়া ডাকতে দামী প্রসাধনী ব্যবহার করে পাত্রপক্ষের সামনে যেতে হয় তাকে । ওকে দেখে কানাঘুষা করে সবাই । ছেলের সাথে আসা ঠাট্টার সম্পর্কের একজন বলে 
-মাইয়্যা দেহি চাঁদরূপ, সরেস কপাল দেউরার ।

কথাটা হয়তো আহত করে উপস্থিত সবাইকে । যাহোক, এবারের সম্বন্ধটা হাতছাড়া হয়না তিতলির । ওকে দেখে যাওয়ার কদিন পর দাগন ভূঁইয়া খবর পাঠায় এ বাড়ী আত্মীয় করতে আগ্রহী সে তবে শর্ত আছে সামান্য । বিয়ের সব খরচ বহন করতে হবে শফিমোল্লাকে, সাথে মোটা অংকের নগদ টাকা । কথা শুনে আপত্তি করেনা শফিমোল্লা । কালো মেয়ের জীবনে যেখানে ছেলে পাওয়ায় দুষ্কর । সেখানে সোলেমান মন্দ কি ? সুখী হবে মেয়ে । তারপর একদিন শাস্ত্র মেনে বিয়ে হয়ে যায় তিতলির ।
নতুন সংসারে এসে দ্রুত পাকাপোক্ত গৃহিণী হয় তিতলি । শ্বশুরবাড়ীর মানুষগুলোকে নিজের বলে মেনে নিতে সময় লাগেনা তার । যদিও মাঝেমাঝে কফিরন্নেসার তীক্ষ্ণ বাক্য বানে আক্রান্ত হয় সে, তথাপি সংসার খারাপ লাগেনা ওর । বুড়ো কফিরন্নেসা, মোটা পটকা মাছের মত মানুষটা সারাদিন তিতলির পেছনে পরে থাকে সে । মাঝেমাঝে ধমকায়-
-কেমুন বেটি কওতো, ঘরের কামনি করুম মুই ?
তারপর হয়তো বাপ-মা নিয়ে শ্রাব্য অশ্রাব্য কতগুলো কথা শুনিয়ে দেয় তিতলিকে । মাঝেমাঝে দাগন ভূঁইয়া স্ত্রীর এমন ব্যবহারে বাঁধ সাধে । পরমুহূর্তে স্ত্রীকে আড়ালে ডেকে কানাঘুষা করে অনেকক্ষণ । দাগন ভূঁইয়ার অসচ্ছল সংসারে আজ যে ভাতের অভাব সামান্য তা কেবল তিতলির কারণেই । বিয়ের সময় সোলেমান কে মোটা অংকের আর্থিক সহায়তা দিয়েছে শফিমণ্ডল ।
তিতলির বিয়ের কদিন পর ভুঁইয়া বাড়ীতে বেড়াতে আসে আহাদ আলী । নিজের চোখে বোনের গোছান সংসার দেখে পুলকিত হয় সে । আহাদ এলে ওকে পাশে বসিয়ে খোশগল্প করে দাগন ভূঁইয়া  বাড়ীর অন্যদের কুশল জানতে চায় সে । কফিরন্নেসা তাগিদ দেয়-
-খাড়ায় থাইকোনা বউ । মিয়ারে অজুর পানি দেও শিগগির ।
রাতে তিতলির ঘরে বসে খোশ গল্প করে ভাই বোন । হগগল ভালানি বইন ?” জিজ্ঞেস করলে তিতলির সহজ স্বীকারোক্তি-
-হগগল ভালা মিয়া ভাই । পরদিন ফেরার পথে সোলেমানের হাতে মোটা অংকের টাকা গুঁজে দেয় আহাদ । তারপর বলে-
-এইগুলান থও ভাই । নাগলে আবার কইও 
আহাদ আলী চলে গেলে শ্বশুরবাড়ী থেকে পাওয়া টাকাগুলো দাগন ভূঁইয়ার হাতে তুলে দেয় সোলেমান । বিনিময়ে তিতলির দিকে শ্বশুরবাড়ীর সবার মনোযোগ বাড়ে আরও ।
তারপর দিনে দিনে সোলেমানের ব্যস্ততা বাড়ে । শ্বশুরবাড়ী থেকে পাওয়া টাকাগুলো দিয়ে গঞ্জের ব্যবসাটা বড় করে সে । রাতে বাড়ী ফিরলে ওকে অজুর পানি এগিয়ে দেয় তিতলি । খেতে বসে খোশ গল্প করে দুজন
-খাইছনি বউ ? শইল কাতর দেহি মুনে কয় ?
-বেবাগ ভালা  খাইয়া লও শিগগির ।
রাতে একই বিছানায় শুয়ে সুখ দুঃখের গল্প করে দুজন । সে গল্পে না বলা কত কথা ভাষা পায় !  তারপর এক এক করে দিন যায় । দাগন ভূঁইয়ার সংসারে সচ্ছলতা আসে একদিন । বাড়ীতে পাকা দালান উঠে । অন্যছেলেরাও বিয়ে করে সংসারী হয় তার । বছর দুই পর সোলেমানের ঘরে নবজাতকের কান্নার আওয়াজ শুনা যায় ।

তিতলির সংসারটা হয়তো সারাজীবন এমনই হতে পারতো কিন্তু হয়নি । হাতে টাকা এলে মানুষের স্বভাব পরিবর্তন হয়, সাথে বেশভূষাও । দাসপাড়ায় সোলেমান এখন মোটা টাকার মালিক । পাড়ায় সবাই সমীহ করে তাকে । বয়স বাড়লে সৌন্দর্যে ভাঁটা পরে মেয়েদের । নাজানি, এ কারণেই দিনে দিনে সংসারের প্রতি মনোযোগ কমে সোলেমানের ।  
আজকাল সোলেমানকে বাড়ীতে দেখা যায়না খুব বেশী । রাতে বাড়ী ফিরলে চোখাচোখি হয় তিতলির সাথে  সোলেমান বলে-
-খাওনাই মালুম অয়, খাইয়্যা নেও শিগগির ।
তারপর উত্তরের জন্য অপেক্ষা করেনা সোলেমান । শোবার ঘরে চলে যায় সে । রাতে বিছানায় স্বামীর জন্য উতলা হয় তিতলি । রক্তমাংসের যে শরীর সঙ্গীহীন আর্তনাদ করে তার জন্য শরীরী ভালবাসা দরকার । সোলেমান কিছু না বললে তিতলি বলে-
-শরীলনি ভালা আইজ কতা নাই যে ?
-হগগল ভালা, জ্বালাইওনা  কই ।
তারপর একই বিছানায় শুয়ে ঘুমের বাহানা করে তিতলি । সহসা চোখে ঘুম আসেনা ওর ।
আচ্ছা, হেনার কথা মনে আছে ? কলমাকান্দার বিশু মাতব্বরের মেয়ে হেনা কৈশোরে সোলেমানের সাথে মন দেওয়া নেওয়া করেছিল সে । আজ কত বছর দুজনে দেখা নাই ! সম্প্রতি স্বামী তালাক দিয়েছে ওকে  কারণ, দশ বছরের সংসার জীবনেও স্বামীকে সন্তানের মুখ দেখাতে পারেনি সে । যাহোক স্বামী তালাক দিলে বাপের বাড়ী ঠাঁই হয় হেনার । তারপর চৈত্র মাসের এক বিকেলে দাগন ভূঁইয়ার বাড়ীতে দেখা যায় ওকে । ও এলে পুলকিত হয় সবাই । একদিন ওকে সোলেমানের বউ করতে চেয়েছিল দাগন ভূঁইয়া  বিশু মাতব্বর রাজী হয়নি সেদিন । ফিরে যাওয়ার সময় হেনা বলে-
-সোলেমান ভাইরে আমরার বাড়ীত যায়তে কইয়ো চাচি, দুগা কতা আছে হাঁচা ।
রাতে বাড়ী ফিরে কফিরন্নেসার কাছে হেনার আগমনের কথা শুনে সোলেমান । পরদিন ওকেও বিশু মাতব্বরের বাড়ীতে দেখা যায় । কে জানে, জীবনের শেষ বেলায় এসে পুরনো সম্পর্ক মাথাচাড়া দেয় কিনা ? মাঝেমাঝে হেনাও লোকচক্ষুর অন্তরালে গঞ্জে দেখা করে সোলেমানের সাথে । বসে খোশগল্প করে দুজন । সোলেমানের মিশ্র ব্যবহারে ভাল মন্দ বোঝা ভার । তিতলির কাছেও সত্য প্রকাশিত হয়না সহসা । জেলেপাড়ার হাসেম পোদ্দারের ছেলে জগা সোলেমানের গঞ্জের দোকানে কাজ করে । একদিন ওর মুখেই সত্যি আবিষ্কৃত হয় । জগা বলে-
-একখান কতা কমু গোস্যানি অয় ভাবি ? তিতলি বলে-
-কও হুনি গোস্যা কিয়ের ?
-ভাইরে কেমুন দেহি, সামাল দিয়েন কই ।

এরপর একদিন তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে স্বামী স্ত্রী কলহ করে দুজন । পরদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে বাপের বাড়ী এসে উঠে তিতলি । এক এক করে দিন যায় বউয়ের খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেনা সোলেমান । বাপের বাড়ী সত্য প্রকাশিত হয়না তিতলির । ভেতরে ভেতরে অশ্রু বিসর্জন দেয় সে । একদিন ভাইয়েরা শ্বশুরবাড়ী যাওয়ার তাগিদ দিলে ধলপ্রহরে আবার নিজের সংসারে ফেরত যায় সে  ভূঁইয়া বাড়ীতে তখন শুনশান নীরবতা । নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালে দেখে দরজা ভেতর থেকে আটকানো  মনোযোগী হলে ভেতরে মেয়েমানুষের গোঙানোর আওয়াজ শুনা যায়  তারপর সতর্ক দৃষ্টি দিলে সত্য আবিষ্কৃত হয় । ভেতরে সোলেমান আর হেনা । যুগ যুগ ধরে চলে আসা আদিম খেলায় মত্ত দুজনই ।          



মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী

পুজোর গন্ধ


"
কিরে,বাবলি হাত কাটবি তো" শিবানি কাকিমার স্নেহের ধমকে সচেতন হয় বাবলি। আবাসনের অষ্টমী পুজোর ফল কাটতে বসেছে বাবলি আর সেই সময়েই কাঁথা কাজের পাঞ্জাবী পরিহিত পল্লবের আগমন। কী করে নিজেকে সামলায় বাবলি? পল্লবের মতো রূপবান গুনবান ছেলে তাদের কেন, আশেপাশের আবাসন গুলোতেও নেই। তার হাঁটার স্টাইল, পোশাক, এমনকি নাকের ওপরে চশমাটা কে ঠেলে দেবার স্টাইলটাও যেন স্বতন্ত্র। সে গান গাইতে উঠলে মেয়েরা অজ্ঞান হবার যোগার, তার ঢাক বাজানোর স্টাইলে মেয়েদের মনে ঢাকেরবাদ্যি, পল্লবের ধুনুচি নাচ কেউ মিস করে না, অঞ্জলির ফুলগুলো নেবার ঝুড়ি বাড়িয়ে দিলে সবাই পল্লবের পাতা ঝুড়িতেই দিতে চায়। আর সবাইই ভাবে যদি কোনোক্রমে পল্লবের চোখে লেগে যাওয়া যায় তাই পুজোর সাজের কম্পিটিশন লেগে যায়। সে হেন একটা মানুষ কিনা বাবলির মতো সাধারণ দেখতে তস্য সাধারণ মানের একটা মেয়েকে পছন্দ করে। এটা জানার পরেও পল্লব সামনে এলে বাবলির হাত কাঁপবে না, এতোটা উদাসীন সে নয়। শিবানি কাকিমার কাছে ধরা পড়ে গেল নাকি ভাবে, শত হলেও পল্লবদা'র মা তো। পল্লব এসেই ধুনুচিতে অকারণ ধুনো ঢালল, "এই গন্ধটা ছাড়া পুজোই জমে না।" বাবলি বুঝতেই পারছে পল্লবদা কাজের বাহানা করে এখন থাকবে এখানে।

অঞ্জলির সময় বাবলি সবাইকে ফুল দেয় আবার অঞ্জলি হয়ে গেলে পর পল্লব ঝুড়ি করে সেই ফুল মায়ের পায়ে দেয়। তাদের দু'জনকে একসাথে দেখে পটাশ পটাশ মন্তব্য উড়ে আসে বিভিন্ন দিক থেকে। সব কাজের মধ্যেই কেমন অদ্ভূত চোখে তাকায় পল্লব। শেষ ব্যাচে বাবলির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে অঞ্জলী দিল। সেখানে অঞ্জলীর ফুল নেবার সময়ে আবার প্রসাদী ফুল দেবার অছিলায় দু' দু'বার এমন কায়দা করে হাতটা ধরল সবার সামনে, কেউ খেয়াল না করলেও, বাবলি কেঁপে, লাল হয়ে একাকার। সকালে সাদা খোলের লাল পেড়ে শাড়ি, খোলা চুলেই হোক বা সন্ধ্যায় জমকালো শাড়ি, সবেতেই বাবলিও যেন সুন্দরী।

পরের দিন সকালে জিনস্ টি-শার্টে আরেক রূপের পল্লব তাদের ঘরে হাজির, বড় এক ঝুড়ি শিউলি ফুল নিয়ে। বাবলি জানে,সে যেমন শিউলিফুলের গোড়ে মালা গাঁথে আর কেউ সেটা পারে না, তাই নবমীর দিন এ কাজটা তার ভাগে পড়বেই। তবে ফুল দিতে পল্লব আসবে ভাবেনি। ঝুড়িটা দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে পল্লব। বাবলির জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তরে বলে "আমি আজই চলে যাচ্ছি।" কথাটা শুনছিল কয়েকদিন ধরেই, এমন মেধাবী ছাত্র, সে কতো ভালো চাকরি পেয়েছে, আর চলে যাবে সেই কোন দেশে। তবে সেটা যে এমন পুজোর মধ্যেই হবে বুঝতে পারেনি বাবলি। পল্লবের কথায় একটা কেমন রাগ, দুঃখ, অভিমান গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠে, টসটস করে চোখ দিয়ে জল পড়ে। সারাঘর শিউলির গন্ধে ভরে দিয়ে 'চলে যাচ্ছি' বলে চলেই গেল পল্লব, বাবলির তরফে কিছু বলার সুযোগ দিল না। অবশ্য সুযোগ পেলেও বাবলি কি সত্যিই কিছু বলতে পারত? তখন তো তার স্বর বন্ধ হয়ে গেছে।

"
এখন আপনাদের মিসেস সেনগুপ্তর লেখা একটা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছি । আমাদের এবছরের নতুন সদস্য ডক্টর সেনগুপ্তর ওয়াইফ শ্রীমতি বাবলি সেনগুপ্ত। আমায় বলা হ', এইটি উনি নাকি এই মাত্র লিখেছেন। কবিতার নাম, নস্টালজিয়া
"
আঙ্গুলের ফাঁক গলে, পড়ে যাচ্ছে গুঁড়ো গুঁড়ো স্মৃতি।
এতো বছর, ভেজা বালির মতো চেপে রেখেছিলাম মুঠিতে।
আজ, ধুনোর গন্ধে মুঠি আলগা হতেই,
রঙিন পুঁতির মতো ওরা লাফালাফি চতুর্দিকে।
সুখস্মৃতিরা, ধুনোর ধোঁওয়ায় মিশে,
 
সৃষ্টি করল রামধনু নস্টালজিয়া।
দুঃখরা শিশির হয়ে ভিজিয়ে দিল ঘাস।
আমরা সকলেই হয়ত কম বেশি পরিস্থিতির শিকার,
পুজোর গন্ধ সাময়িক ফিরিয়ে দেয় হারানো সময়।"
চারদিকে হাততালির ফোয়ারার মধ্যে মুখ নিচু করে মালিনী, পূরবী জিজ্ঞেস করে
"
কি হল বাবলিদি? শরীর খারাপ লাগছে? জল খাবে? বাড়ি যাবে? ডক্টর সেনগুপ্তকে ডাকব?"
"
কিছু নাঃ। আসলে এমন বিখ্যাত একজন আবৃত্তিকারের মুখে নিজের কবিতা, নিজের নাম শুনে, ওইঃ, একটু ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম আরকি"
"
কি তোমায় বলেছিলাম না? দেখো তুমি মিছিমিছি ভয় পাচ্ছিলে। আরে বাবা, 'রতনে রতন চেনে' তোমার এতো গুণ, মুখার্জীদার মতো মানুষ তার কদর বুঝবেন না?"
"
কেমন ভালো লাগল না বলো? তুমি এতো বছর, এতো দেশ বিদেশের পুজো দেখেছ, কিন্তু আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের পুজো, ছোটো হলেও, টোটালি ডিফরেন্ট। মি. মুখার্জীই সেই আমাদের ছোটোবেলার পুজোর ফ্লেভারটা ধরে রেখেছেন। দেখলে না? এসেই কেমন জমিয়ে দিলেন ঢাক বাজিয়ে, ফায়ার অ্যালার্মকে ঘোল খাইয়ে ধুনো জ্বালিয়ে। সত্যি বাবা, ঢাকের আওয়াজ, ধুনোর গন্ধ ছাড়া পুজো পুজো লাগে না, বলো?"
"
ভদ্রলোক, এতো বয়সেও কি ফিট আর কি হ্যান্ডসাম"
"
কতো যে গুণ কি বলব, উনি পারেন না, এমন কোনো কাজ বোধহয় নেই। সাথে কোনো অহঙ্কার নেই"
"
আবার দেখো, কাল যখন নবমীর পুজো হবে, উনি একটা অসাধারণ শিউলি ফুলের মালা, মা কে পরাবেন"
"
হ্যাঁ, গো! শেফালি ফুল দিয়ে যে অমন গোড়ে মালা হয়, না দেখলে বিশ্বাসই করবে না"
"
কে গাঁথেন মালা? মিসেস মুখার্জী? মানে, কোথায় পান শিউলি ফুল?"
"
না, না, দেশের থেকে আনান গো। এদেশে শিউলি ফুল কোথায়? তাছাড়া, উনি তো বিয়ে করেননি"
"
কেন?"
"
সে, অনেক গল্প। ওর বাবা মা বলে চূড়ান্ত অর্থডক্স ছিল"
"
আরে, মুখুজ্জে ব্রামহিন বাড়ির ছেলে হয়ে, সে কোন নন-ব্রামহিন মেয়েকে নাকি বিয়ে করতে চেয়েছিল___" আর কিছু কানে ঢোকে না বাবলির।

তাই বুঝি, মা মরা মেয়েটার বিয়ের বিষয়ে শিবানি কাকিমার উদ্যোগ ছিল সবথেকে বেশি? সম্বন্ধ আনা থেকে মেয়ে বিদায় অবধি পরম আত্মীয়ার রোল প্লে করেছিলেন? ধন্যি ধন্যি করেছিল প্রতিবেশীরা। নিশ্চিন্ত হয়েছিল বাবা। সেই পুজোর পরের অঘ্রাণেই বিদায় নিয়েছিল বাবলি। বিয়ের দিনকেও কান্না, রাগ, অভিমান জমছিল, কার ওপর, শুধু বাবলির মনই সেটা জানত। অথচ, কেউ তো বাবলিকে অপেক্ষা করতে বলে যায়নি, এমনকি তাকে বিয়ে করবার, ভালোবাসবার মৌখিক প্রতিশ্রুতিও দিয়ে যায়নি। তবু, বাবলির প্রতি কারোর আচরণ তাকে মনেমনে আশা জাগিয়েছিল।
"
ডক্টর সেনগুপ্তকে একটু ডেকে দাও না, ভাই"
এখন সত্যিই শরীর খারাপ লাগছে বাবলির; কেমন রাগ, অভিমান, দুঃখ, কান্না, দলা পাকিয়ে আসছে গলার কাছে। বাড়ি যেতে মন চাইছে, ধুনোর ধোঁওয়া টা বড্ড সাফোকেটিং।