বৃষ্টিটা সন্ধ্যে থেকেই টিপটিপ করে নেমেছিল।
এখনঝম ঝম করে শুরু হল। রাত প্রায় সাড়ে
এগারোটা বাজে । মৈনাক এপার্টমেন্টের দোতলার
উত্তর মুখো ফ্ল্যাটের গৃহবধূ শুভ্রা, একমাত্র ছেলে
বুবুনকে খাইয়ে, ঘুম
পাড়িয়ে দিয়ে স্বামী সাগ্নিকের অপেক্ষায় বসে বসে টিভিতে একটা সিনেমা দেখছিল। সিনেমা দেখার চেয়ে, সাগ্নিকের আসার অপেক্ষায় সময় কাটাচ্ছিল বললেই ঠিক হবে।
ঠিক তখুনি কড়কড় করে একপ্রকাণ্ড
বাজ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির কলিং বেলটাও
বেজে উঠলো। শুভ্রা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল। প্রত্যাশামতই দেখে সাগ্নিক এসেছে। জামা কাপড়ে কাদা মাখামাখি হয়ে একেবারে কাক
ভেজা সাগ্নিকপ্রায় ভূতের মত দরজায় দাঁড়িয়ে। সাগ্নিককে চেনাই যাচ্ছে না। শুভ্রার মাথাটা গরম
হয়ে গেল। কোন কথা বললে শোনে না মানুষটা। নিজে যা ভালবুঝবে, তাই করবে। এই ভাবে বৃষ্টিতে ভিজলে নির্ঘাত বড় কোন অসুখ বাঁধাবেই বাঁধাবে। একে তো বুবুন কে নিয়ে টেনশন। তার ওপর
এই মানুষটার গোঁয়ার্তুমি।
সন্ধ্যে বেলা
শুভ্রা বার বার বারণ করেছিল,বর্ষাকাল, তার মধ্যে সন্ধ্যের পর ঐ রাস্তায়
যাওয়ার দরকার টাই বাকি ? কম দূর তো
নয় ? এখান থেকে
প্রায় পচিশ কিমি হবে। দিনের বেলা গেলেইতো হত।
টেনশনপ্রিয় শুভ্রার নিষেধ করার যথেষ্ট কারণও ছিল । শুনশান
হাইওয়েতে দিনের বেলাতেই বাস লরিগুলো যে পরিমাণ বেপরোয়া
হয়ে চলাচল করে, সন্ধ্যে
নামতে না নামতেই তাদের বেপরোয়া স্পীড আরও
বেড়েযায়। ছোট গাড়িগুলোকে তোয়াক্কা না করে প্রায় পিষে দিয়ে চলে যায় যেন। প্রায়ইছোট
বড় অ্যাকসিডেন্টের খবর পাওয়া যায়। রাস্তায় কোন পুলিশি টহলের ব্যবস্থানেই তেমন।
তারপর এই ভরা বর্ষায় রাস্তাঘাট ভেঙে চুরে একাকার। প্রশাসনের তরফে মেরামতির কোন
হেলদোল নেই । রাস্তার বড় বড় গাড্ডা কাটিয়ে বাইকনিয়ে যেতে হবে ঐ পথে। তাই শুভ্রা
দুশ্চিন্তা করেছিল
- কাল সকালে না হয় যেও”। কিন্তু চিরদিনের গোঁয়ার সাগ্নিক শোনেনি সে কথা।
সন্ধ্যে বেলা
হন্তদন্ত হয়ে এসে বলেছিল,
-দিলবার এই মাত্র খবর দিল, ভাগলপুর থেকে একজন
বড় পীর বাবা এসেছেনআদিনা সোনা মসজিদে । একেবারে ধন্বন্তরি। কাল সকালে তিনি
আবার কিষাণগঞ্জে চলে যাবেন। সুতরাং আজ
রাতেই দেখা করতে হবে । এ সুযোগ কিছুতেই হাত ছাড়া করা যাবে না। দিলবার এ পাড়ার ছেলে। রাস্তার মোড়ে
ছোট্ট মুদিখানা দোকানের মালিক সে। সাগ্নিককে দাদা বলে ডাকে। খুব শ্রদ্ধা করে। শুধু
মাত্র সাগ্নিকের জন্য সন্ধ্যে বেলা খদ্দের ভরা দোকান বন্ধ করে চলে এসেছিল।
সাগ্নিকের বাইকে চেপে সন্ধ্যে সাড়ে ছটায় রওনা দিয়েছিল ওরা দুজন। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা
বাদে শুভ্রাকে দুশ্চিন্তায় কাতর করে এই কাকভেজা হয়ে ফিরল এখন।
-কতবার করে বললাম, রাতে না গিয়ে সকালে যাও।
কোন কথাই শোনো না তুমি। তাড়াহুড়ো করে রেইন কোটটাও নিয়ে গেলে না। কি ভেজাটাই না ভিজেছো বলতো? আর এত কাদা মাখামাখি হল কি করে ? নিশ্চয় গাড়িগুলো কাদা ছিটোতে ছিটোতে গেছে ? তাড়াতাড়ি কাপড় জামা পাল্টে
গরমজলে স্নান করে নাও । আমি খাবার গরম
করছি। তা এত দেরী হল কেন তোমাদের ?
দরজাটা বন্ধ করতে করতে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলল শুভ্রা।
-আর বোল না, একটা কাদা ভর্তি ডোবায় পড়ে গিয়েছিলাম আমরা দুজন । সাগ্নিক বলল।
-এঃ মা, কি করে পড়লে ? সত্যি, তুমি কি আমাকে একটুও শান্তিতে
থাকতে দেবেনা সাগ্নিক ?
কোথায় লেগেছে
দেখি। শুভ্রা ব্যস্ত হয়ে বলল।
-একটা লরিকে পাশ কাটাতে
গিয়ে। না তেমন লাগে নি।
-দেখেছো, এই জন্যই আমি রাতে যেতে মানা করেছিলাম। চিন্তিত মুখে বলল শুভ্রা।
-রাতে না গেলে ওনাকে যে পেতাম না। কাল সকালেই কিষাণগঞ্জ চলে যাবেন । কি ভিড় জানো ? বিশাল লাইন
পড়েছিল। সেই লাইনে দাঁড়িয়ে যখন পীরের কাছে পৌঁছলাম তখন
রাত দশটা। এই নাও ধরো, এই তাবিজটা এখুনি বুবুনের
গলায়বেঁধে দাও । আর এই প্যাকেটে মন্ত্র পড়া চমেলির তেল দিয়েছেন, কাল থেকে
চল্লিশদিন পর্যন্ত ঘরের উত্তর পশ্চিম কোণে এই তেল দিয়ে প্রদীপ জ্বেলে রাখতে হবে।
তাহলেই বুবুন সেরে উঠবে বলেছেন। প্রতিদিন নিয়ম করে প্রদীপ জ্বালাতে ভুলো না যেন।
-বেশ, এখন রাখো এগুলো ।