গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ২৪ মার্চ, ২০১৬

৫ম বর্ষ ১০ম সংখ্যা।। ২৫ মার্চ ২০১৬

এই সংখ্যার লেখকসূচি - দময়ন্তী দাশগুপ্ত  তাপসকিরণ রায়, পার্থ রায়, রুখসানা কাজল, নীহার চক্রবর্তী, সুবীর কুমার রায়, সংযুক্তা মজুমদার ।

                      সূচিপত্রে লেখকের নামে ক্লিক করুন

দময়ন্তী দাশগুপ্ত

ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা

পথেঘাটে মাঝে মধ্যেই ঈশ্বরের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়ে থাকে। এই সেদিনও হয়েছিল - কলকাতা শহরে যে বেশে তাকে পাওয়া সবচেয়ে দূর্লভ,অর্থাৎ কিনা ট্যাক্সিচালক। অশোক সেন-এর স্মরণসভা থেকে ফিরে দশদ্রোণে মা-কে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ফিরছিলাম। রাত দশটা বেজে গেছে। ওই রাস্তায় অত রাতে বাস বন্ধ হয়ে যায়। অন্য কেউ হলে থেকেই যেত হয়ত। কিন্তু যতক্ষণ আমার পদযূগল আছে ততক্ষণ আমি ও নিয়ে বিশেষ চিন্তা করি না। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে অটো বা রিক্সা কিচ্ছু না পেয়ে হাঁটা দিলাম। একটা স্টপেজ মতো হেঁটেও ফেললাম। এর আগে আমাকে স্টপেজে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক স্কুটারচালক হাসি হাসি মুখে এগিয়ে এসে বলেছিলেন,‘এখন তো বাস পাবেন না’। মনে হল, ভদ্রলোকের হয়তো মনে হয়েছিল আমাকে কিছুটা এগিয়ে দেওয়ার কথা,কিন্তু মুখ ফুটে ঠিক বলতে পারলেন না। যাইহোক,হঠাৎ একটা হলুদ ট্যাক্সি থামল ঘ্যাঁচ করে – ‘যাবেন নাকি?’ দেড়শো টাকা চাইল। আমার মনঃপুত হল না। আরে বাবা,ভি আই পি কী নিদেন পক্ষে চিনার পার্ক পৌঁছাতে পারলেও কিছু না কিছু পেয়েই যাব। বলি,নাহ্‌,যাব না। আবার হাঁটা দিই। এবারে একটা সাদা গাড়ি এসে দাঁড়াল,সেটা ট্যাক্সি বা এমনি গাড়ি ঠিক বলতে পারব না। একশো টাকা চাইতে উঠে বসলাম। জয়া সিনেমার-র কাছে নামিয়ে দিয়ে গেল। বাড়ি ফিরে বললাম, দেখলে তো কেমন চলে এলাম,মিছিমিছিই চিন্তা করছিলে। মনে মনে ভাবি,রাখে কেষ্ট, হাঁটে কে?
অনেকদিন আগে,কালান্তরে চাকরি করার সময় একদিন পার্কসার্কাস থেকে এক ভদ্রলোক আমাকে অমনিই পৌঁছে দিয়েছিলেন। আমি অন্যান্য রানিং গাড়ি যেগুলো যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়,তেমন ভেবে হাত দেখিয়েছিলাম। সেই ভদ্রলোকও গাড়ি থামিয়ে কেবলমাত্র আমাকে তুলে নিয়েই আবার রওনা দিলেন। অর্ধেক রাস্তা উনি গাড়ি চালাতে চালাতে মোবাইলে কথা বলে গেলেন আর আমি পিছনে বসে আক্রমণ করলে জলের বোতল না ছাতা কোনটা আত্মরক্ষার জন্য বেটার হবে ভেবে গেলাম। আর বাকি অর্ধেক রাস্তা আমার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন দূরবস্থা নিয়ে গম্ভীর আলোচনা করে গেলেন। ভদ্রলোক প্রবাসী বাঙালি,কয়েকদিনের জন্য এসেছেন। নামার সময় ভাড়া দিতে গেলে বললেন,কী মুশকিল,আমি তো এপথেই যাচ্ছিলাম,আপনার জন্য আমার তো বাড়তি কোনো তেল পোড়েনি। অকাট্য যুক্তি। আমিও আর কথা বাড়াই নি।
কিছু কিছু অভিজ্ঞতা,কিছু কিছু মানুষের কথা ফিরে ফিরে আসে মনে। ঈশ্বরের দেখা পাওয়া, তাও গাড়ি সমেত,কলকাতা শহরে,সে কি সোজা কথা?

‘তাই হেরি তায় যেথায় সেথায় তাকাই আমি...’।

তাপসকিরণ রায়

আছি, নেই


এমনটা নাকি হতে পারে। খুব অসুস্থ, মৃত্যু শয্যার লোকটা অনেক সময় দেখতে পায় যমদূত তাকে নিতে এসেছে। এর সত্যি মিথ্যার প্রমাণ দেওয়া যাবে না। 
জন্মজন্মান্তরের কথা শুনেছি। কিন্তু তার প্রমাণ কি পেয়েছি ? তবু ভাবতে হয়, মনে আস্থা রাখতে হয়। অনেক মুনি-ঋষিদের কথায় উঠে আসে এই জন্ম-জন্মান্তরবাদ। মাঝে মাঝে ভাবতে ইচ্ছে হয় অনেক কিছু। দেহ নয় , আত্মা নাকি অমর. আচ্ছা তা না হয় মেনে নিলাম, কিন্তু আমার আজের অস্তিত্ব সত্তাকে জন্মান্তর কি এমনি ভাবে ধরে রাখতে পারে ? নাকি কোন সমষ্টি আত্মার মাঝে সে মিলিয়ে যায় ? আমরা চাই, না হয় এ জন্মের কথা ভুলে যাবো, কিন্তু আমার এই খণ্ড-একক অস্তিত্বই যেন থেকে যায় আমার পরজন্মে। তা না হলে মৃত্যুতেই যদি সমস্ত নিজত্বের ইতি ঘটে যায় তবে কতটা বিমর্ষ, আস্থাহীন হয়ে যাব আমরা!
এ প্রসঙ্গে আমার রাজস্থানের এক বন্ধুর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। তার নিজের জীবনের ঘটনার কথা তিনি গল্পচ্ছলে বলে ছিলেন। প্রমাণ না থাকলেও বন্ধুর কথা আমরা বিশ্বাস না করে পারি না। এবার সেই বন্ধুর গল্পটাই আপনাদের শোনাই--
আমি প্রায় দু মাস ধরে রোগ শয্যায় পড়ে ছিলাম। ডাক্তার আসল রোগ ধরতে না পেরে নানান রোগের ওষুধ দিয়ে যাওয়ার ফলে আমি সুস্থ হবার বদলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। একদিন হঠাৎই আমার বুকের ধড়ফড়ানি শুরু হয়ে গেল। আমার হার্ট যেন বারবার লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছিল ! প্রচণ্ড বুকের ব্যথায় আমি বারংবার চীৎকার দিয়ে উঠছিলাম। এক সময় আমার মনে হল আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি। চোখে অন্ধকার নেমে আসছিল। চোখের সামনে কিছু হলুদ ফুলকি ফুলকি নজরে আসছিল। ব্যাস, আর কিছু আমার মনে নেই।
তারপর এক সময় আমি যেন জেগে উঠছিলাম। ঘরের লোকদের চীৎকার-চেঁচামেচি শুনতে পারছিলাম। বাবার ক্ষীণ গলা আমার কানে ভেসে এলো, ডাক্তারের নাম্বার লাগলো না--কোন ড্রাইভার এত রাতে...
মা আমার গায়ে হাত রেখে চীৎকার করে উঠলেন, ওগো আমার ছেলে মরে যায়নি তো ? স্ত্রীর কান্না কানে এলো। আমার ছেলে মেয়েরা বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়ে ছিল। আমি অনুভব করতে পারছিলাম, বিবশ একটা অনুভব আমায় জড়িয়ে ধরে ছিল। হঠাৎ আমি দেখতে পেলাম আমার অস্তিত্ব আমার দেহ থেকে আলাদা একটা ছায়ায় পরিণত হয়ে গেছে। আর এ কি ! আমি আমার মধ্যে থেকে উঠে বসেছি ! 
--হ্যাঁ, সাব, বোলিয়ে, ড্রাইভার দরজার সামনে এসে বলে উঠেছিল। 
বাব দেখলেন, ড্রাইভার হবে, কালো চাদর জড়িয়ে এসেছে। 
--হসপিটাল জানা হায়, তুরন্ত চলো--বাবা বলে উঠলেন।
আমি আর এক আমিকে দেখতে পাচ্ছিলাম ! ড্রাইভার, বাবা, মা, এমন কি মনে হল আমিও নিজের দেহটা তুলে ধরে গাড়িতে  উঠিয়ে দিতে সাহায্য করলাম। 
মেডিকেল ভেন তীব্র গতিতে মেট্রো হসপিটালের দিকে ছুটে চলছিল। আর আশ্চর্য হয়ে আমি দেখি, গাড়ীর স্টিয়ারিংয়ে আমি নিজে বসে আছি!
বাবা মুহ্যমান বসে আছেন আমায় ধরে। স্ত্রী আমার মাথার কাছে। আমার মা ঘরে থেকে গেছেন হবে তাঁর নাতি নাতনীকে পাহারা দিতে। 
তীব্র গতির মধ্যে আমি ব্রেক কষলাম। ক্যাঁচ করে একটা আওয়াজ হল। হসপিটালের মেইন গেটে পৌঁছে গেছি, গাড়ির ঝাঁকুনিতে আমি যেন আমার অন্য সত্তাকে আবার হারিয়ে ফেললাম। খুব হালকা অনুভবে বুঝতে পারছিলাম যে আমার দেহ হসপিটালের স্টাফরা স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাচ্ছে। 
এদিকে বাবা এসে অনেক খুঁজেও মেডিকেল ভেনের ড্রাইভারকে খুঁজে পেলেন না। 
পরদিন দিব্বি আমি চোখ মেলে তাকালাম। আমার সামনে আমার বাবা, মা, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, সবাই তখন দাঁড়িয়ে। 
সে দিনের ঘটনার ব্যাপারে অনেক ভেবেও কোন কুল-কিনারা করতে পারিনি, আমি যদি নাই মরে থাকি তবে কি আমার সেদিনের সেই বিচিত্র অনুভূতিগুলি শুধু অনুভূতি মাত্র ছিল ?


পার্থ রায় / দুটি গল্প

নারী

পত্নীর অকাল বিয়োগের পরে ৩২ বছরের সুবিনয় আর নারী সঙ্গ করে নাই। প্রভুত সংযমের পরিচয় দিয়া নিজের কৌমার্য সে অক্ষত রাখিয়াছিল। আত্মীয় পরিজন ও বন্ধু বান্ধবদের পুনর্বিবাহের প্রস্তাবও মৃদু হাস্য ও     এক অনমনীয় কঠিন নীরবতা দিয়া প্রত্যাখ্যান করিয়া রাখিয়াছিল। মনের কোনে পুনর্বিবাহের সুপ্ত ইচ্ছা যে হয় নাই, তাহা নয়। আসলে প্রয়াতা পত্নী সুনয়না কে সে অতন্ত্য ভালবাসিত। গৃহে টাঙ্গানো হাস্যমুখি সুনয়নার ছবির দিকে চোখ পড়িলেই তার ঘর বাঁধিবার সুপ্ত ইচ্ছা এক নিমেষে উধাও হইয়া যাইত।কিন্তু সুস্বাস্থ্যের অধিকারী সুবিনয়ের নিশীথ কালে একাকী শয্যায় শরীর কামার্ত হইয়া পড়িলে, নিদ্রা দেবী ধরা ছোঁয়ার বাহির হইয়া যাইত এবং এক অসহনীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হইত। একদিন কথা প্রসঙ্গে প্রাণের বান্ধব রতন কে তাহার এই অবস্থার কথা সসংকোচে প্রকাশ করিয়া ফেলিল।রতন প্রকৃত বন্ধুর মতো ইহা উপলব্ধি করিল। সে উহা লইয়া কোন প্রকার হাস্যরসের উপক্রম করিল না। রতন বিবাহের পূর্বে বারবনিতা সঙ্গ করিয়াছিল। এই ব্যাপারে তাহার পূর্বলব্ধ অভিজ্ঞতা কাজে লাগাইল। সুবিনয়কে সোনাগাছি নামে কলিকাতার সুপরিচিত গণিকালয়ে যাইবার পরামর্শ দিল। কিন্তু সুবিনয় একাকী সেথায় যাইবার সাহস অর্জন করিতে না পারিয়া, প্রিয় বন্ধু কেও সঙ্গ দিবার প্রস্তাব করিল। যদিও, প্রস্তাব দিয়া বিবেকের দংশন অনুভব করিয়াছিল বিবাহিত বন্ধুর সাংসারিক অবস্থানের কথা ভাবিয়া। কিন্তু তাহাকে অবাক করিয়া দিয়া রতন সম্মত হইল।

এক সন্ধ্যা অন্তে দুই বন্ধু রতনের পূর্ব পরিচিতা এক বারবনিতার ক্ষুদ্র গৃহে উপস্থিত হইল। রতন ও সেই বারবনিতার কথোপকথনে সুবিনয় জানিতে পারিল মেয়েটির নাম লীলা। লীলার মধ্যে বেশ একপ্রকার ঘরোয়া  সুশ্রী ভাব আছে, নমনীয় এবং উদ্ভিন্নযৌবনা।রতন হাস্যালাপের মাধ্যমে জড়সড় সুবিনয়কে স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টায় রত হইল এবং লীলাকে ইশারায় বুঝাইয়া দিল, কি করিতে হইবে। কিয়ৎক্ষণ পরে, রতন সিগারেট আনিবার ছলে বাহির হইয়া গেলো। লীলা সুবিনয়ের হাত ধরিয়া অন্দরমহলে একটি কম আলোর কক্ষে লইয়া গেলো।বহুকাল পরে স্ত্রী লোকের স্পর্শে সুবিনয় নিজের অভ্যন্তরে নিদ্রিত সিংহটির জাগিয়া উঠিবার ইঙ্গিত পাইল। কক্ষে প্রবেশ করিয়া দৃষ্টিক্ষমতা অভস্ত্য হইলে পর, সুবিনয় একটি বেশ পরিপাটি করিয়া গোছান শয্যা দেখিতে পাইল। উহাতে একটি নিদ্রিত দুগ্ধপোষ্য শিশুকে দেখিয়া সুবিনয় যৎপরোনাস্তি বিস্মিত হইল। এইরূপ স্থলে,এইরূপ পরিবেশে ঘুমন্ত শিশুটি বেমানান বলিয়া প্রতীয়মান হইল। সে কিঞ্চিৎ উচ্চস্বরেই শিশুটির পরিচয়  জানিতে চাহিল। ইতিমধ্যে, লীলা অভ্যস্ত হস্তে স্বীয় বক্ষাবরণী উন্মোচিত করিতেই বহু অত্যাচারেও অটুট,নিটোল দুইটি স্তন সুবিনয়কে আমন্ত্রণ জানাইল। তাহার প্রশ্নের উত্তর লীলা দিবার আগেই, শিশুটি ক্রন্দন করিয়া উঠিল। ত্রস্ত্য হইয়া লীলা কহিল,“যাহা করিবার সত্বর করো,উহাকে মাই দেই নাই অনেকক্ষণ। আমার বুক টাটাইতেছে।সুবিনয়ের মুখ দিয়া কিছু বাহির হইল না। সত্যিই লীলার ভরাট স্তনবৃন্ত হইতে দুগ্ধ নির্গত হইতেছিল। এক প্রবল অপরাধ বোধে এবং অভূতপূর্ব বিবেক দংশনে আক্রান্ত সুবিনয়ের মুখ দিয়া কোন কথা বাহির হইল না, জ্যা মুক্ত তীরের ন্যায় সে ছুটিয়া বাহির হইয়া গেল।শাঁসালো খদ্দের হইতে বঞ্চিত হইয়াও,শিশুটির তৃষ্ণার্ত মুখে স্তন দিবার মুহূর্তে লীলার মুখমণ্ডল হইতে বারবনিতার মুখোশ অদৃশ্য হইয়া এক মাতার তৃপ্ত হাসিমুখ আর বাৎসল্যের দৃষ্টি দেখা হইতে মূর্খ সুবিনয় বঞ্চিত হইল    



সেদিন বৃষ্টি হয়েছিল


         বাইরের আবহাওয়ার মত নিজের ভেতর টাও যেন গুমোট হয়ে আছে অতসীর । এক পশলা বৃষ্টির খুব দরকার। মেয়ের গায়ে আজ এই প্রথম হাত তুলল । কতই বা বয়েস । সবে ছয় পূর্ণ হোল, ক্লাস টু তে উঠলো । মর্নিং স্কুল থেকে এসে, দুপুরে একটু ঘুমায় । অতসীই এই অভ্যাস করে দিয়েছিল যাতে সন্ধ্যেবেলা পড়তে পারে । ঘুমিয়ে আছে একটা ছোট্ট পরীর মত, ফুলো ফুলো গালে এখনও চোখের জল শুকিয়ে আছে। দেখে টনটন করে উঠলো বুকটা। নিজের নিষ্ঠুর আচরণে নিজেই অবাক ও হোল, ভেতরে ভেতরে কুঁকড়েও গেলো । কি এমন অন্যায় করেছিল ? শিশু মনে যেটা করেছে, সেটা তো এই বয়েসে ঠিকই করেছে । বড় দের ব্যাপারে ওদের জড়ানো ঠিক হয়নি । টুসি ওর ক্লাসের বন্ধু রুমেলা কে ফেয়ার কপিটা দিয়ে দিয়েছে আজ । কাল রবিবার স্কুল ছুটি । সোমবার ফেরত দেবে । কারণ রুমেলা অ্যাবসেন্ট ছিল জ্বরের জন্যে। অথচ, টুসির যেবার শরীর খারাপ হোল, রুমেলার কাছে ক্লাস নোটটা চেয়েছিল । রুমেলা দেয়নি কারণ ওর মা বারন করেছে । ছোট্ট রুমেলা সরল মনে সত্যি কথাটা বলে দিয়েছিল টুসিকে । অতসী শুনে অবাক হয়ে গেছিলো কারণ রুমেলার মা ঝুমা খুব মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে ওর সাথে । এমন ভাব করে, যেন অতসী ওর খুব ভালো বন্ধু। সেই থেকে রাগ পুষে রেখেছিল অতসী । যদিও, ঝুমাকে সেটা বুঝতে দেয়নি কখনো। মনে মনে নিজেকে স্বান্তনা দিয়েছিল এই বলে যে সুযোগ আসবে একদিন । আসলে, স্কুলে টুসি আর রুমেলার মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়া নিয়ে । অবশ্য, এখন বুঝতে পারছে রেষারেষিটা ছোট্ট মেয়ে দুটোর মধ্যে নেই, ঝুমার মনে রয়েছে । খাতাটা দেওয়ার কথা শুনেই, পুরনো ব্যাপারটা মনে পড়তেই মেয়েকে চেপে ধরেছিল অতসী । একটা অসহ্য রাগে দু হাত দিয়ে ঝাঁকাচ্ছিল চুপ করে থাকা টুসিকে। কেন দিয়েছিস ? বল, কেন দিয়েছিস ? আমাকে জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিলনা ? তোর শরীর খারাপের সময়, দিয়েছিল ওর ক্লাস নোটের খাতা?”। শেষে আর রাগ চেপে রাখতে পারেনি, ঠাস করে এক চড় মেরেছিল ওর নরম গালে। দুই চোখে অভিমানে আহত, অবাক দৃষ্টি নিয়ে টুসি মায়ের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠেছিল। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল,“মাম্মি, তুমি আর পাপা-ই তো বলেছ মানুষের বিপদে সাহায্য করতে হয়। ও তো আমার বন্ধু। এইটুকু শিশুর মুখে এমন মোক্ষম কথা শুনে থমকে গিয়েছিল অতসী । আবার তাকাল ঘুমন্ত মেয়ের দিকে। একটা হাত দিয়ে বুকের কাছে টেনে নিল। খেয়াল করেনি, যে বৃষ্টির জন্যে ভেতরটা ছটফট করছিল সেটা কখন অঝোর ধারায় নিজের দু চোখে নেমেছে । মেয়ের গালে গাল রেখে মনে মনে বলল, “ তুই এমনই থাকিস, আমার সোনা । তুই ঠিক কাজ করেছিস । আমরাই ভুল। বাৎসল্যে টনটন করে ওঠা মায়ের দুই স্তনের মাঝে পরম নিশ্চিন্তে মুখ রেখে ঘুম ভাঙ্গা টুসি ফিসফিসিয়ে বলল, “আই লাভ ইউ মাম্মি। খুশির বৃষ্টির ঝাপটা বেড়ে উঠল। গুমোট ভাবটা কখন যেন উধাও হয়ে গেছে।মেয়েকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে কোন মতে অতসী বলল,“আই লাভ ইউ টুউ, সোনা




সুবীর কুমার রায়

কৌশানির এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা

প্রায় চার দশক আগে হঠাৎ নৈনীতাল, আলমোড়া, রাণীক্ষেত, কৌশানি, ইত্যাদি জায়গা ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ এসে গেল। সত্যি কথা বলতে কী, সেটাই আমার প্রথম একা একা দুরপাল্লার ভ্রমণ শুধু নয়, সেটা আমার প্রথম হিমালয় দর্শন, ও তার প্রেমে পড়া। টেলিফোন ভবনের এক পরিচিত ভদ্রলোকের সুপারিশে পোস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফ রিক্রিয়েশন্ ক্লাবের সাথে ঐ সব জায়গা ঘুরতে যাওয়া। আমরা দলে মোট তেত্রিশজন ছিলাম, যদিও সঙ্গীদের একজনও আমার পূর্বপরিচিত নয়। অন্যান্য জায়গা ঘুরে কৌশানিতে এসে এক বিচিত্র ঘটনার সাক্ষী হওয়ার সুযোগ হয়েছিল, যা আজও মাঝে মাঝে স্মৃতিপটে উদয় হয়।
আমাদের দলে একজন ভদ্রলোক ছিলেন, তাঁর নাম ব্রজেশ্বর মুখার্জী। ট্রেন ছাড়ার পর থেকেই লক্ষ্য করলাম, তিনি সবার অতি প্রিয়পাত্র। ছোটখাটো ম্যাজিক দেখাতে পারেন, এবং তাই হয়তো ম্যজিক দেখাবার কিছু উপকরণও তিনি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। হলদোয়ানি থেকে আমরা একটা স্টেটবাস রিজার্ভ করেছিলাম। কৌশানি যাবার পথে অল্প সময়ের জন্য বাস দাঁড় করিয়ে, কয়েকজন ব্যক্তিগত প্রয়োজনে রাস্তায় নেমেছিলেন।   তাঁদের কাজ শেষ হবার আগেই, হয়তো বা শুরু হবার আগেই, আমাদের বাস ঘন ঘন হর্ণ বাজিয়ে, ছেড়ে  দিল। কোনমতে ছুটে এসে চলন্ত বাসে লাফিয়ে উঠে তাঁরা যখন উত্তেজিত হয়ে ড্রাইভারের পূর্বপুরুষদের  উদ্দেশ্যে চোখা চোখা শব্দবাণ প্রয়োগ করতে উদ্যত হ’লেন, ঠিক তখনই ড্রাইভার তাঁদের বাসের পিছন দিকে দেখতে বললো। পিছনে তাকিয়ে একটা বড় বাস ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়লো না। জানা গেল কৌশানির গান্ধী আশ্রমে আগে এলে আগে পরিষেবা নীতিতে ঘরের বুকিং দেওয়া হয়। পিছনের বাসটা আমাদের আগে সেখানে হাজির হলে, আমাদের এত লোকের থাকার জায়গা পেতে অসুবিধা হতে পারে। ব্যস, যাঁরা কিছুক্ষণ আগে ড্রাইভারের পূর্বপুরষদের উদ্দেশ্যে গালমন্দ করতে যাচ্ছিলেন, তাঁরাই এবার ড্রাইভারের উত্তরপুরুষ, এমন কী সম্ভাব্য উত্তরপুরুষদের উদ্দেশ্যেও শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ উজাড় করে দিতে কার্পণ্য করলেন না।
যাহোক, শেষপর্যন্ত আমরা পিছনের বাসের লোকজনের ঠিক আগে ঢোকার সুবাদে, আগে থাকার জায়গা   পেলাম। তাঁদেরও ছড়িয়ে ছিটিয়ে ব্যবস্থা হয়ে গেল। যদিও এখানে থাকা-খাওয়ার জন্য কোন চার্জ লাগেনা উল্লেখ করা আছে, তবু আমাদের কাছ থেকে মাথাপিছু দশ টাকা করে দাবি করা হ’ল। কৌশানি আমি পরেও গেছি, এখনকার মতো তখন কিন্তু এত হোটেল বা থাকার ব্যবস্থা ছিল না। থাকার জায়গার বেশ অভাব ছিল বলা-ই বোধহয় ঠিক হবে। দশ টাকার মূল্য সেই সময় খুব একটা কম ছিল না। যদিও দশ টাকায় একজনের প্রতিদিন থাকা খাওয়ার খরচ হয়তো কমই, তবু ফলাও করে কোন চার্জ লাগেনা বলে টাকা দাবি করাটা কিরকম হাস্যকর বলে মনে হ’ল। আশ্রমে পর্যটকের সংখ্যা অনেক হওয়ায়, রাতে আমরা আশ্রমের প্রধান, বা মহারাজের অনুমতি নিয়ে সকলকে রাতের খাবার পরিবেশন করলাম। আমাদের দলপতির ব্যবস্থাপনায় আমাদের রাতে শোয়ার ব্যবস্থাও মন্দ হ’ল না। আমাদের দলের তেত্রিশ জনের মধ্যে অনেক মহিলা ছিলেন, যাঁদের অনেকেরই অবসর নেওয়ার সময় প্রায় হয়ে এসেছে। এছাড়া, বেশ কিছু বয়স্ক ভদ্রলোকও ছিলেন। দলে আমরা সাতজন তেইশ-চব্বিশ বছরের যুবক ছিলাম। আমার সাথে কারো পূর্বপরিচয় না থাকলেও, তারা একই জায়গায় কর্মরত হওয়ার সুবাদে সবাই সবার বন্ধু। আমাদের দলপতি, অর্থাৎ গ্রুপ সেক্রেটারি আমাদের ‘সেভেন স্টার’ আক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর ঐ ছয়জন সহকর্মীকে ভালোই চিনতেন, আর তাই আমার ওপর তাদের সামলে রাখার ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন।

পরদিন আশ্রমের একজন আমাদের বললেন, “আপনারা টেগোরের দেশ থেকে এসেছেন শুনে, মহারাজ আজ সন্ধ্যায় টেগোরের গান, কবিতা ইত্যাদি নিয়ে আপনাদের একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে অনুরোধ করেছেন”। প্রসঙ্গক্রমে তিনি আমাদের অনুষ্ঠান শেষে মহারাজকে চার্জের ব্যাপারটা একটু বিবেচনা করার অনুরোধ করতেও পরামর্শ দিলেন।
সন্ধ্যার পর নির্দিষ্ট বড় হলঘরটায় আমরা সবাই হাজির হলাম। অনেকেই জমায়েত হয়েছেন, বিদেশী বেশ কিছু নরনারীও হাজির হয়েছেন দেখলাম। আশ্রমের কিছু কর্মচারী ও সন্ন্যাসীসুলভ ব্যক্তিত্বদের আসন গ্রহণ করতেও দেখলাম। আর দেখলাম, তাঁদের পাশে বসে একজন বিদেশীনিকে ফুলের মালা গাঁথতে।
আমাদের মধ্যে অনেকেই চলনসই রবীন্দ্র সংগীত বা রবীন্দ্র কবিতা জানেন। প্রবীর মুখার্জী নামে একজন, ও   তাঁর স্ত্রী, উভয়েই খুব ভালো গান করেন বলে শুনলাম। যাহোক, এই প্রবীর মুখার্জী প্রথমে গান শুরু করলেন। “এসো আমার ঘরে। বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে।।” গানটা শেষ করা মাত্র ঐ বিদেশীনি মালা গাঁথা ছেড়ে হঠাৎ টানা টানা বাংলায় প্রশ্ন করে বসলেন, এশো এশো আমার ঘরে এশো আমার ঘরে, টু হুম? প্রবীর মুখার্জী একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে উত্তর দিলেন, টু গড্। যাঁরা গান জানেন, বা একা গাইতে সক্ষম, তাঁরা একাই গাইলেন। সমবেত কন্ঠেও বেশ কিছু গান গাওয়া, ও কবিতা আবৃত্তিও হচ্ছিল। শীতের রাতে, নির্জন পাহাড়ের কোলে, বাঙালি, অবাঙালি, বিদেশী, সকলেই অনুষ্ঠানটি বেশ উপভোগও করছিলেন। এই পরিবেশে স্বাভাবিক ভাবেই ব্রজেশ্বর মুখার্জীর মনে ম্যাজিক দেখাবার ইচ্ছা জাগবে, এতে আর আশ্চর্য হবার কী আছে? এই ক’দিনে তাঁর বেশ কিছু ম্যাজিক দেখা হয়ে গেছে। এটাও জানা হয়ে গেছে, যে তিনি একজন ভারত বিখ্যাত ম্যাজিশিয়ানের দলের সাথে যুক্ত, এবং ম্যাজিকের বেশ কিছু উপকরণ তিনি সঙ্গে করে নিয়েও এসেছেন। কিন্তু রবীন্দ্র সংগীত বা রবীন্দ্র কবিতার সাথে ম্যাজিকের কোন সম্পর্ক না থাকায়, মহারাজের কাছে অনুমতি চাওয়া হ’ল। মহারাজ তাঁকে আধঘন্টা মতো সময় ম্যাজিক দেখাবার অনুমতি দিলেন।
ব্রজেশ্বর মুখার্জী খুব খুশি হয়ে ঘর থেকে ম্যাজিকের সরঞ্জাম নিয়ে আসলেন। উপস্থিত সমস্ত দর্শকও খুশি। কিছু পরেই তিনি ম্যাজিক দেখাতে শুরু করলেন। প্রায় প্রতিটা ম্যাজিকেই তিনি দর্শকদের মধ্যে থেকে কাউকে না কাউকে, তাঁকে সাহায্য করবার জন্য ডেকে নিচ্ছেন, কিন্তু কোনবারই আমাদের দলের কাউকে কিন্তু ডাকছেন না। আশ্রমের কেউ, বা আমাদের দেশের বা বিদেশী কোন পর্যটককে তাঁর কাছে ডেকে নিচ্ছেন। পর পর বেশ কিছু খেলা দেখাবার পর, তিনি একটা দড়ি কাটার খেলা দেখাবার সময়, এই প্রথম হঠাৎ আমাকে ডেকে বসলেন। আমি তাঁর কাছে যেতে, তিনি একটা দড়িতে গিঁট দিয়ে, আমার হাতে একটা কাঁচি দিয়ে, দড়িটা কেটে ফেলতে বললেন। আমার মনে হ’ল দড়িটা বোধহয় কাটা উচিৎ হবে না, এবং সেইজন্যই তিনি এই খেলাটায় বাইরের কাউকে না ডেকে, নিজের দলের থেকে আমাকে ডেকে নিয়েছেন। আমি খুব নীচু গলায় সত্যিই দড়িটা কাটবো কী না জিজ্ঞাসা করায়, তিনিও খুব আস্তে শুধু বললেন, “হ্যাঁ কাটো”। আমি দড়িটা তাঁর কথামতো কেটে দিলাম, ও এতক্ষণে বুঝতে পারলাম যে তিনি আকন্ঠ পান করে আছেন।
এবার আবার একটা নতুন খেলার শুরু। এবার আবার আশ্রমের একজন মালি জাতীয় কর্মীকে ডেকে, একটা  ছোট রঙচঙে লাঠি দেখিয়ে, সবাইকে শুনিয়ে বললেন যে এটা তাঁর যাদুদণ্ড, এটার সাহায্যে তিনি যা খুশি তাই করতে পারেন। এবার হঠাৎই তিনি ঐ যাদুদণ্ডের সাহায্যে কর্মীটির গাল, মাথা, কোট, ইত্যাদি থেকে কয়েন বার করে বললেন, আমার যখনই পয়সার দরকার হয়, আমি আমার এই যাদুদণ্ড দিয়ে তৈরি করে নিই। আশ্রমের সবাইকে দেখেই মনে হচ্ছিল, ম্যাজিক জিনিসটার সাথে তারা পূর্বপরিচিত নয়। ব্রজেশ্বর মুখার্জীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আশ্রমের কর্মীটি হঠাৎ বলে বসলো, “বাবু এ যাদুদণ্ড মুঝে দে দিজিয়ে”। ওর কথায় অনেকে হেসে উঠলেও, আশ্রমের কেউ কেউ গম্ভীর হয়ে গেলেন।  
বেশ চলছিল, হঠাৎ ব্রজেশ্বর মুখার্জী কোথা থেকে একটা লিকলিকে সাপ বার করে বসলেন। সাপটা রবার বা ঐ জাতীয় কিছুর তৈরি হলেও এত সুন্দর ফিনিশিং যে, যে কেউ এটাকে জীবন্ত সাপ বলে ভুল করতেই পারে। শুধু তাই নয়, ব্রজেশ্বর মুখার্জী মাঝে মাঝে কিছু একটা করছেন, যার ফলে সাপটা কিলবিল করে তাঁর হাত থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে, এবং তখন তার কাটা জিভটাও জীবন্ত সাপের মতই বাইরে  বেরিয়ে আসছে। মুহুর্তের মধ্যে আশ্রমের সবাই ভয়ে দাঁড়িয়ে পড়লে, ব্রজেশ্বর মুখার্জী অশান্ত পরিবেশ মেরামত  করতে বলে উঠলেন, “ঠিক আছে আমি সাপটাকে বাইরে ছেড়ে দিয়ে আসছি”। তিনি দ্রুত হলঘরের বাইরে গিয়ে একটু পরে ফিরে আসলেও, ফল কিছু হল না। ততক্ষণে হলঘর প্রায় ফাঁকা। আশ্রমের মহারাজ, ও দু’-একজন ছাড়া সবাই প্রায় হল ছেড়ে চলে গেছেন। আমরা ছাড়া দর্শকদের প্রায় সবাই এরপর আর অনুষ্ঠান চলার সম্ভাবনা নেই বুঝতে পেরে হয় বেরিয়ে গেছেন, নাহয় চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছেন।
ব্রজেশ্বর মুখার্জী পরিবেশটা শান্ত করার জন্য তবু আবার বললেন যে তিনি সাপটাকে বাইরের জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছেন। উত্তরে আশ্রমের একজন কর্তা শুধু “কাজটা আপনি ভালো করেন নি। এখানে কোন সাপের উপদ্রব নেই, কাজেই এখানে সাপটাকে আপনি না ছাড়লেই ভালো করতেন।” বলে, ব্রজেশ্বর মুখার্জীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। আমরা কিছুক্ষণ বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকে নিজেদের ঘরে ফিরে আসলাম। আজ রাতে কিন্তু আমাদের খাবার পরিবেশন করতে দেওয়া হ’ল না। তাঁরা সরাসরি আপত্তি না করলেও, “প্রয়োজন নেই, আমাদের তো লোক আছেই, তারাই পরিবেশন করে দেবে” ইত্যাদি বলে এড়িয়ে গেলেন। ভয় করছিল সেই কর্মচারীটা আবার যাদু দণ্ডের লোভে রাতে না ঘরে আসে।
পরদিন আমরা চলে আসার সময় কিন্তু আশ্রমের প্রায় সবাই, এমনকী স্বয়ং মহারাজ আমাদের বাস পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। থাকা খাওয়া বাবদ চার্জ কিছু কমিয়ে দেওয়া বা আবার আসার অনুরোধ করা হলেও, পরিস্থিতিটা কিন্তু কিছুতেই আর মেরামত করা সম্ভব হ’ল না। আমরা ফিরে আসলাম।

 



রুখসানা কাজল

  ধর্মচোর
                           

সাদা জালি টুপিটা কান পর্যন্ত ভাল করে টেনে নেয় রামকানাই।   মসজিদের বারান্দায় গোপাল ঘরামির লম্বা ছায়া পড়েছে। ছায়ার ভেতর বেঁটেখাটো মানুষটাকে মনে হচ্ছে বেশ রোগা আর দীর্ঘ। ভেতরে জোহরের নামাজ হচ্ছে। নামাজ শেষে নামাজীরা এক  টাকা পাঁচটাকা দশ  টাকা  এমন কি জুম্মাবারে কেউ কেউ বিশ টাকাও ভিখারীদের ভিক্ষে দেয়। ভিক্ষার আসনের নজরানা দিয়ে সে হিসেবে তার রোজ কামাই কম থাকে না। খেয়ে পরে অনেক টাকাই তার হাতে থাকে। আজিমপুর  এক ছোট বিস্কুট ফ্যাক্টরিতে কাজ করে গোপাল। পনের দিন পর পর দেশে যায়। ওর হাতে জমানো টাকা পাঠিয়ে দেয় রামকানাই আর রমজান। টুকটাক জিনিসও পাঠায় কখনো সখনো। বউ তার হিসাব মত সংসার চালিয়ে চালের টিনে, কাপড়ের ভাঁজে কিছু টাকা জমায় ভবিষ্যৎ চিন্তা করে। দুর্দিনের দিনগুলো মেয়েরা ভোলে না কখনো।    
রামকানাই থাকে সোনারগাঁ হোটেলের পেছনে ঝুপড়ি বস্তিতে বন্ধু রমজানের সাথে। সন্ধ্যা হলে ভিখারির ছেঁড়াফাটা জামাকাপড় পালটে ভাল পোশাক পরে সে ফার্মগেট, হাতির ঝিল, কোন কোনদিন শাহবাগ, শিশুপার্ক  ঘুরে আসে। ছোলা বাদাম খেতে খেতে রমনা পার্ক, টিএসসি, পাবলিক লাইব্রেরীর নানা অনুষ্ঠান দেখে। এখন অনেক কিছুই বোঝে রামকানাই।  গলার শিরা ফুলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যখন শ্লোগান দিয়ে মিছিল করে সে বুঝতে পারে  কিসের জন্যে  মিছিল মিটিং ফেস্টুন নিয়ে উত্তাল হয়েছে এই ছেলেমেয়েরা। রমজানের ওসবে কোন আগ্রহ নেই। সে সন্ধ্যা হলে কারওরানবাজারের এক দোকানে কাজ করে। সংসারে পুষ্যি বেশি তাই রমজানের খাটুনিও বেশি। তিন তিনটে বাচ্চাকাচ্চা তার উপর বুড়ি মা বিধবা বোন। রাতের খাবার খেতে খেতে রমজান রামকানাইয়ের কাছে শুনে নেয়  সারাদিনে কোথায় কি হল সেই সব বৃত্তান্ত।    
পাঁচবছর আগে গ্রামে কামকাজের অভাবে না খেয়ে মরতে বসেছিল রামকানাই। বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ন্যাংটাকালের বন্ধুর বউকে বসত ভিটের বগলে   ক্ষেতি  শাক তুলতে দেখে তামাশা করে বলেছিল রমজান , ও বউদি এড্ডু চা  বিস্কুট খাওয়াও না ক্যান কও ত শুনি! আজকে আর ছাড়ান দিচ্ছি না কিন্তুক, চা খায়ি তমে যাব।” ছেঁড়া আঁচল  সামলে বউ  কলাপাতা বেড়ার ফাঁক ধরে  ছুটে রামকানাইকে ডেকে এনেছিল। ততক্ষণ রামজান বাড়ির  উঠোনে বুড়ি ঠাকুমার সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে । চালভাজা গমভাজা খেয়ে সে বুড়ি তখন হেদিয়ে আছে ক্ষুধায়। রামু এসে দাঁড়াতে রমজান হাঁক দেয়, বউদি খাওয়া কিন্তুক পাওনা থাকল। আবার আসলি না খায়ি যাবনা কলাম। তারপর রামুকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল।    
রামুর লুঙ্গীতে শতছিন্ন গিঁট। গলার হাড় উঁচু হয়ে গেছে।  বাড়ির সামনে পাট ক্ষেতের আইলে বসে  রমজান বলে, ওরে ও রামু আমার সাথে ঢাহায় চল দোস্ত। গাও গেরামে কাম কই ?”  রামু হাতের  চিকন দা দিয়ে পিঠ ঘষতে ঘষতে বলেছিল, ধুরো আমি হাঁপানির  রুগি।  রিশকে চালাতে পারব ন্নাযে। দম বারোও যায় আমার ।”  রমজান না শোনা যায় এমন গলায় কি  ফুসমন্তর দিয়েছিল কে জানে। তিনদিনের মাথায় দেখা গেল পলিথিনের ব্যাগে লুঙ্গি জামা নিয়ে ছেঁড়া স্যান্ডেল পায়ে রমজানের সাথে  ঢাকা গামী  লঞ্চে উঠছে রামকানাই। বউকে বলে এসেছে  পেছন পানের বাঁশঝাড়ের কয়ডা বাঁশ বেচি কদ্দিন সংসার চালাস বউ। ভাগ্যডারে এড্ডু লাড়াচাড়া করে দেহি। গোপনে রমজানের দেওয়া দুশ টাকাও সে দিয়ে এসেছিল বউয়ের হাতে। মিনতি করে বলেছিল মা আর ঠাম্মাকে এড্ডু  ফ্যানাভাত খাওয়াস বউ। পারলি দুডে  আলু না হয় কচুসেদ্ধ এড্ডু সশ্যে  তেল মরিচ পোড়া । তুইও খাস দুএক নলা। বউয়ের চোখে জল  চিকচিক করে  উঠেছিল।   
মানুষ যে বলে ঢাকায় টাকা ঊড়ে সাতদিনেই বুঝে গেছিল রামকানাই। তবে সে তখন আর রামকানাই থাকে না হয়ে যায় রহমান। রমজানের খালাত ভাই। রমজান তাকে দুই দিন ধরে শিখিয়ে দিয়েছে ভিক্ষা করার কলাকৌশল । প্রথমে লজ্জা পেলেও পেটের  টানে সে শিখে নেয় আল্লাহ রসূল আর কয়েকটি আরবি সূরার দু এক লাইন। টুপি মাথায় ছেঁড়া পাঞ্জাবী লুঙ্গী পরে পা খোঁড়ার ভান করে সে ভিক্ষা করতে শুরু করে বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে। আশ্চর্য হয়ে যায়  রামু। অনেক সময় ভিক্ষা চাইতেও হয় না । নামাজ পড়ে বেরুনোর  সময় বেশিরভাগ নামাজিরা  না চাইতেই টাকা দিয়ে যায় লাইন করে বসা ভিখারিদের। রমজান  তাকে শিখিয়ে দিয়েছে মসজিদের একেবারে  দরোজার কাছে বসতে। উল্টোদিকে কালো চশমা পরে আধা অন্ধ হয়ে ভিক্ষা করে রমজান। রামকানাইয়ের খুব ইচ্ছা করে মসজিদের ভেতরে গিয়ে দেখতে। কে  এই মানুষগুলোকে এমন দরাজ দিল দিলো গো! কেউ কি আছে অই নীলসাদা  দেয়ালের আড়াল  জুড়ে? ও কল্পনা করে টুপি মাথায় চেক চেক স্কার্ফ গলায় কোনো দয়ালু ফেরেশতাকে। ইস একবার যদি দেখতে পেত। কিন্তু  রমজান কড়া করে নিষেধ করে দিয়েছে।   কিচ্ছু নাই মসজিদে। খালি কোরান শরিফ কয়ডা ছেপারা আর গাদা গাদা জায়নামাজ। ভিক্ষেই আমাগের ধম্ম কম্ম। এসব জানি আমাগের কি কাম রে রামু !     
প্রথমদিন  ভিক্ষার টাকা গুনে অবাক হয়ে গেছিল রামকানাই। বিনা শ্রমে  উপার্জন খারাপ নয়। গ্রামে তো কেউ পাঁচ টাকাও ধার দেয় না। যাদের টাকা নাই তাদের কাছে ধারে সওদা বেঁচে না কোন দোকানি। কতদিন সে আর বঊ খালি হাতে ফিরে এসেছে দোকান   থেকে।  ঝুপড়ি ঘরে শুয়ে রামু প্রতিদিনের ভিক্ষার টাকায় মনে মনে বাজার করে। বুড়ি ঠাকুমার গুড়ের চা খাওয়ার বড় সখ। মা একটু পান না খেলে বাঁচে না। ছেলেটা ছাগলের দুধ খায় বটে তবে ভাত পায় না বলে লিকলিকে হাড্ডিধরা। বউটার খাওয়া দাওয়ার কোন চাহিদা নাই। সে শুধু চায় দশ হাতের একটি মোটা সূতার শাড়ি, ছায়া, ঘটিহাতা ব্লাউজ। খেত খামারে কাজে কামে বাইরে যেতে হয় বউকে। ছেঁড়া শাড়ির ফাঁকফোকরে লজ্জারা টগর ফুলের মত ফুটে থাকে। ঝুপড়ি ঘরের নীল প্লাস্টিকের ছাদের দিকে তাকিয়ে রামকানাই মনে মনে ছেলে কোলে হাসি হাসি মুখে  সনাতন সাহার কাপড়ের দোকান আর আফজাল ফকিরের মুদি দোকানে নগদ টাকায় বাজার করে।
রামু খুব খুশি। এবার সে সবাইকে পেট ভরে খেতে পরতে দিতে পারবে। হোক  সে ভিখারি। হোক সে ধর্মচোর। তার ভগবান কি বুঝবে না ? সে তো কম চেষ্টা করে নাই কাজের    জন্য । গ্রামে কাজই নাই। বেশিরভাগ বাড়িই এখন দালানের । ঘর ছাইতে, বাতা বাঁধতে এখন আর কেউ ডাকে না। সেই কোথায় মরুভূমির আরব দেশ সেখানে মজুরি খেটে গ্রামের বেশিরভাগ  মানুষ পাকা ঘর তুলেছে। রমজান বলেছে আরবের মানুষ কুকুর বেড়ালের মত দেখে বাঙ্গালীদের।  কথায় কথায়   মিসকিন বলে সপাং সপাং  চাবুকের বাড়ি মারে। স্টার হোটেলের উদ্বৃত্ত খাবার কম পয়সায় কিনে এনে খেতে খেতে সবজান্তার মত জানায় রমজান ,ওরা তো আর মানুষ নারে, শ্যাখ বুঝলি তো , অনেক বড়লোক। ওগের অগুন্তি  টাহা। অই দেশেই তো আমাগের নবীজি জন্মিছেল। ওহানের সবাই আরবী ভাষাতি কথা  কয়। কোরাণের ভাষা --হু হু—যা তা ভাষা না বুঝিছিস !  মুরগীর ঠ্যাং মট করে ভেঙ্গে চুষতে চুষতে রামু বলে, আমাগের দেবতাদের লাহান তাই না ? হেরাও তো বাংলায় কথা কয় না। শেষ তরকারিটা সমান ভাগ করে রমজান জানায়, আরে না তোগের তো লক্ষ লক্ষ  দেবতা তাও আবার সন্দেশ বাতাসা খাওয়ানি সব মাডির মুত্তি ।  আমাগের কোন দেবতা নাইক্যা। আল্লা এক মালিক। আর ওরা হচ্ছে আল্লার পেয়ারা বান্দা।  এক লম্বর খাডি মুসলমান। পোলাও কোর্মা, উটের রেজালা, দুম্বার রোষ্ট খাওয়ানি শ্যাখ। রামুও এই কথাটি  মানে। পেয়ারাই বটে। একেকজনের  কতজন যে বিবি আর কত যে ছেলেমেয়ে! আর কি খাবার দাবার ! শান শওকত ! সোনার গাঁ হোটেলের চকচকে আলোকে পেছনে রেখে দুজনেই দুলে দুলে হাসে।   
গোপালকে নিয়ে হোটেলে খেয়ে ঝুপড়িতে আসে রামু। দাদা অবস্থা তো ভাল ঠেকতিছে না। কি অরবা ? চিন্তায় আছে রামুও। প্রতিবার পুজোর সময় দু একটি মূর্তি ভাঙ্গেচুংগে মুসলমান পোলাপানরা। তা আবার মধ্যস্থতা করে মিটেও যায়। কিন্তু কিছুদিন ধরে ক্ষমতাশীল কিছু মুসলিম হিন্দু পাড়ায় পাড়ায় এসে হুমকি ধামকি দিয়ে যাচ্ছে। তারা আবার হিন্দু বলে না। একাত্তরের পাকিস্তানি জানোয়ারদের মত বলে মালাউন। রমজানের দাদা ছিল মুক্তিযোদ্ধা। জোয়ান লোকটা লাঙ্গল ফেলে যুদ্ধে গেছিল। বাপ মা  কেঁদে পড়েছিল , ও সালাম  যাস না বাজান মরি যাবিনি যে। তুই মরি গেলি আমাগের কি হবিনি বাজান। সালামের বউ ছেলের    দোহাই দিয়ে পথ আটকেছিল। চোখে রক্ত  তুলে বলেছিল সালাম, পথ কাডপি না কলাম বউ। আমার ক্ষেতির কিরা, আউস আমন ফসলের কিরা আমি কেরু কতা মানব না। মারতিভুমি তোগোর  সবার আগি।   
সেই সালাম মুক্তিযুদ্ধোর সার্টিফিকেট নিতে টাকা দিতে হবে জেনে  প্রচন্ড কলহ করেছিল সেই সময়ের চেয়ারম্যানের সাথে। ঘাড়ের শিরা ফুটিয়ে চেয়ারম্যানকে বলেছিল, আরে মাঙ্গীর পুত বঙ্গবন্ধুকে কয়ি তোরে দেহাচ্ছি খাড়া। তুই টাহা নিয়ি মুক্তিযোদ্ধা  বানাস।” এর দুদিন পর ঢাকায় আসবে বলে বাড়ি থেকে লঞ্চঘাটা রওনা হয়। ঢাকায় আর পৌঁছায় না রমজানের দাদা।  গ্রামের উত্তরে মুচিপাড়ার খালে কচুরিপানার ধাপে পোঁতা তার অর্ধনগ্ন  লাশ  পাওয়া যায়। তিনটে রামদার কোপ ছিল শরীরে। সাতক্লাশ ইশকুলে পড়া চাষির  ছেলে রমজানের বাপ ক্ষেতি করতে নেমে পড়ে । রামুর বাপ তার আগেই  বাবার পেছনে পেছনে  ঘরামির কাজে সাহায্য করতে শুরু করেছিল। নকুল ঘরামির সাথে মাঝে মাঝে হাটবারে দেখা হয়ে যেত রমজানের বাপ খবিরের । গামছার একপাশে দুই তিন কেজি চাল আটা কিনে ঘরে ফিরতে ফিরতে বিড়ি সিগারেট ভাগ করে খেত আর গল্প করত দুজন। বিয়েও করেছিল দুজন একই বছরে। দুজনেই  ছেলেদের ইশকুলে দিয়েছিল মানুষ হওয়ার জন্যে। কিন্তু গরিবের কপাল হল খাঁ খাঁ চৈত্রের ফাটা মাঠ । তিন গ্রাম পেরিয়ে ফকির হাটের উলু মিয়ার ঘর বানতে গিয়ে রামকানাইয়ের বাপটা আৎকা মরে গেল। সে কি ধড়ফরানি। বুক আড়াইগাতি নদির ঢেউয়ের মত উঠে আর নামে। ঝাড়ফুক ডাক্তার সব পেছনে ফেলে জোয়ান ব্যাটা নকুল ঘরামি চোখ উলটে মরে গেল। রামকানাই কদিন ধুতি গলায় হাতে চাটু নিয়ে ইশকুলে এসেছে। ছমাস বাদে খুড়ো রামকানাইকে ডেকে বলেছিল, বাপুরে লেহাপড়া আমাগের জন্যি না। বই রাখি কাল থাহি আমার সাথি কামে চল বাবা। রমজানের বাপ মরেছে রোগে ভুগে। চিকিৎসার টাকা যোগাতে ভিটে ছাড়া সবকিছু বিক্রি করেছে ওরা। মুক্তিযোদ্ধার ছেলে বিনা চিকিৎসায় মরে নাই। শুধু ভিটেবাড়ি ছাড়া সব গেছে তার চিকিৎসার পেছনে। সেই চেয়ারম্যানের বড় ছেলে  কিছু টাকা দিয়েছিল খুলনা সদর হাসপাতালে নেওয়ার জন্যে। কিন্তু তার আগেই খবির মরে যায়।  মরার পর খবিরের পেট ফুলে খড়ের পালার মত উঁচু হয়ে গেছিল। কি রোগে যে বাপ মরল রমজান তা আজো জানে না।       

রমজান কোনোদিন কোন রাজনীতির ভেতর  যায় না। ভোট দেওয়ার দিন ঘুমিয়ে থাকে। গোপালের সাথে কথা বলে চিন্তায় পড়ে রমজান। দেশে কি আবার পাকিস্তানিরা আসলো নাকি ?  কি অরবি রামু ইন্ডিয়া যাতি চাস ? গোপাল দুই বছর আগে ইন্ডিয়া থেকে ফিরে এসেছে। সেখানে কাজের বড় অভাব আর ধর্মের ছোঁয়াছুঁয়ি জাতপাত মানামানি। তাছাড়া মজুরি  যা পায় একার পেট চলে না তো পরিবার নিয়ে থাকবে কোথায়। ইন্ডিয়া গেলে ধর্মটা হয়ত বাঁচবে কিন্তু পেট ? কোনদিন আর নিজের জমি বাড়ি  হবে না।  গরীবের জন্যে সব দেশ সমান রে রমজান দাদা। কুহানে যাব কতি পারিস ?  তয় ? রমজান প্রশ্ন করে শূণ্য মুখে বসে থাকে। জালি টুপিটা বালিশের নীচে রাখতে রাখতে রামকানাই হাসে, আমাগের আবার জাত কি আর ধম্মোই বা কি ! কিন্তুক দ্যাশ তো আমাগেরও না কি !  -- সত্য । ল্যায্য কথা কিন্তুক – রামকানাইদের  ঝুপড়ি কাঁপিয়ে সামনের রাস্তা দিয়ে ছোট ছোট গাড়ির সাথে কয়েকটি বড় বড় গাড়িও ঢুকে পড়ে ভি আই পি রোডের জ্যাম বাঁচাতে । গোপাল উঠে পড়ে, বাংলামোটর বন্ধ দেহে শালারা দেহি লতুন রাস্তা বানায় নিছে দেখতিসি –  -


নীহার চক্রবর্তী

পিপাসা 

রঘুনাথ গোলদার মারা গেছে সেই কবে । কিন্তু এখনো নাকি তাকে দেখা যায় এলাকায় রাতের আলো-অন্ধকারে । চারদিক যখন জ্যোৎস্নার আলোয় ভেসে যাচ্ছে কিংবা অমাবস্যার গাঢ় অন্ধকার,তখন তাকে দেখা যায় । কেমন পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে নিজের অজানা গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে । দেখে অনেকেই ভয় পেয়েছে । কেউ-কেউ অসুখে পড়েছে । ওঝা ডাকতে হয়েছে । কিন্তু রঘুনাথের আসা-যাওয়া চলছেই ।
বছর চারেক আগে রঘুনাথ গলায় দড়ি দেয় রাধাপুরের মাঠের এককোণে এক আমগাছে । সে নাকি প্রেমে দাগা খেয়েছিল । অনেকেই আজ সে ব্যাপারটা ভুলতে বসেছে । শুধু মনে আছে ওর আত্মহত্যার কথা । সেদিন রঘুর প্রতিবেশী রমেন ঘোষ বলছিল রঘুর আত্মা এ এলাকা ছাড়তেই পারবে না কোনোদিন । কারণ সে মেয়েটি এখন এখানেই আছে । বেশ সুখে ঘর করছে । শেষ ক্ষতি ওরই করবে
শিবানী । রমাকান্ত দাসের মেয়ে । অনেকদিন ওর সাথে প্রেম ছিল রঘুর । মেয়েটাকেও বিশ্বাসও করেছিলো খুব । কিন্তু একই গ্রামের ছেলে বাসব চাকরী পেতেই শিবানীর বাবা ওর সাথেই বিয়ের ব্যবস্থা করে । শিবানীও সেদিন কোন প্রতিবাদ করেনি । সেই কষ্টেই...
কয়েকদিন আগে প্রথম রাতে রঘু নাকি চুপটি করে বসেছিল রমাকান্তর বাড়ির পিছনের জঙ্গলে । দেখেছে হারু । টর্চ মারতেই সেই মুখ । তবে কেমন একটা যেন । আদল বোঝা যায় । কিন্তু তার অদ্ভুত রঙ । দেখেই হারু দ্দে-দৌড় । কদিন ধরে ও বিছানাত পড়েছে । ওঝায় কাজ হয়নি । রমেন ঘোষ পরেরদিন সকালে সব শুনে বলে রমাকান্তর মেয়ে এখন বাড়িতে আছে । সেই লোভে-লোভে এসেছে রঘু । দেখো না কি হয় । তবে রমাকান্ত ওসবে বিশ্বাস করে না । বলে আমি কী করেছি যে রঘু আমাকে বিপদে ফেলবে ? শুনে অনেকেই হাসে । কিন্তু কেউ চায়না কারোর কোন ক্ষতি হোক ।
কিন্তু তার পরেরদিনই শিবানী ঘাট থেকে জল আনার পর কাঁপতে শুরু করলো । গায়ে প্রবল জ্বর এলো । চোখ-মুখ উল্টে করুণ অবস্থা । সঙ্গে-সঙ্গে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল । সেখানেও ও ঠিক হল না । হাসপাতালের কাছে যারা থাকে তাদের কেউ-কেউ বলল,এখানেও এক ভূতের উপদ্রব । রাতেই বেশী দেখা যায় । অনেকেই দেখেছে । তাই এ জায়গা একেবারেই নিরাপদ নয় । জানলা দিয়ে রোগীর গায়ের দিকে নাকি হাত বাড়িয়ে দেয় এসব কথা শুনে রমেন ঘোষ শোনালো,ঘুরতে-ঘুরতে বুঝি রঘু এখানেও চলে আসে । আর এখন তো শিবানী এখানে । হাসপাতাল বদল করাই বুঝি বুদ্ধির কাজ
জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল শিবানীকে । কিন্তু উন্নতি নেই কোন । একেবারে বিছানার সঙ্গে মিশে গেছে । কোন ওষুধেই কাজ হচ্ছে না আর । রমেন ঘোষ পরিস্থিতি দেখে বলে উঠলো,ভূতরা তো ভূতেরই বন্ধু । রঘু মনে হয় এই হাসপাতালের চারদিকে যেসব ভূত ঘুরে বেড়ায়,তাদের ডাকেই এসেছে । শিবানীর দিকে ওর বেশ কড়া নজর পড়েছে । কোলকাতায় গেলে বুঝি এমন আর হবে না । কোথায় নদীয়া আর কোথায় কোলকাতা ডাক্তারদের নির্দেশে শিবানী এবার কোলকাতায় ।
কত সব বড় বড় ডাক্তার । কত আলোচনা । বৈঠকের পর বৈঠক । শিবানীর পরিবর্তন তেমন একটা দেখা যায় না । দিনে যদি বা একটু সুস্থ মনে হয়,রাতে আবার আগের অবস্থা । ওর চিৎকারে পাশের বেডের রোগীরা পর্যন্ত ব্যতিব্যস্ত । ডাক্তাররা হাল ছেড়ে দেয় একপ্রকার । জীবনও সব হাল ছেড়ে দিয়ে একদিন মধ্যরাতে শিবানীকে তুলে দেয় মরণের হাতে । চরদিকে শোকের মধ্যে সেই রমেন ঘোষ উপস্থিত । মুখ-ভার করে বলল অনেকের উদ্দেশ্যে,রঘু খুব জেদি ছেলে ছিল । পড়াশোনাটাও বেশ করেছিলো । চারদিকে যখন অনেকে টাকা দিয়ে চাকরী পাচ্ছিলো,ওই শুধু জেদ ধরেছিল একটি পয়সা না দেওয়ার জন্য । সেই চাকরীও হল না । শিবানী গেলো অন্য ঘরে । রঘু বহু দুঃখে শেষপর্যন্ত মরে ভূতই হয়ে গেলো । এত ব্যথা পেয়েছিলো ও যে নিজেকে কোলকাতার মতো শহরেও ছড়িয়ে রেখেছিলো । এটাই ভবিতব্য ছিল । আর তাই হল
পরের দিন থেকে এখন পর্যন্ত টানা ছ'মাস রঘুকে আর রাধাপুর এলাকায় দেখা গেলো না । রমাকান্ত দাস লোক ঠিক রেখেছিলো রঘুকে দেখার জন্য । কিন্তু তাকে কেউ খবর দিতে পারলো না রঘুর । রমেন ঘোষ বলল,আর দেখা যাবে না ওকে । শিবানীকে নিয়ে ও এখন প্রেতলোকে ঘর করছে


সংযুক্তা মজুমদার

শাখী

শান্তনু আর শিল্পীর মেয়ে শাখী। একদম দুধের শিশু শাখী, মাকে কাছে পেয়েও কাঁদে। ওরা বুঝতে পারেনা কেন কাঁদে। পেট ভর্তি তাও কাঁদছে, পেটে ব্যথার ওষুধ দিলেও কাঁদছে। ওদের ভয় লাগে, কোনও অসুখ হলো না তো? ডাক্তার দেখিয়ে সব রকম পরীক্ষাও করানো হল, কিন্তু কান্না থামেনা। ডাক্তার বললেন, বড় হওয়ার সাথে সাথে কমে যাবে।
বছর দুয়েক বয়েসে একটু কমলো কান্না। কিন্তু যখন তাকে নাম ধরে ডাকা হয় সে তাকায় না, শোনেনা। নাম জিজ্ঞেস করলে বলে ‘‘আমার নাম আফ্রীন।’’ খুব কম কথা বলে। কিন্তু বারবারই বলে আম্মা আব্বু কই? শিল্পীর কেঁদে কেঁদে শরীর খারাপ হয়ে যায়। কি করা উচিত ওরা বঝেনা। নানা লোকে নানা কথা বলছে। কেউ বলছে তুকতাক করা হয়েছে, কেউ বলছে ঝারফুঁক করাও। আর কেউ বলছে সাইক্রিয়া্টিস্ট দেখাও।
শান্তনু কোনও বাজে কথা শোনার লোক নয়। সে মেয়ের সাথে অনেক সময় কাটায়। মেয়ে কথা বলে, খেলা করে, আর থেকে থেকে বলে আমি বাড়ি কবে যাবো? তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে মা বাবা শহরের নাম করা সাইক্রিয়া্টিস্ট-এর কাছে গেলো। ডাক্তার একটু কথার পর জিজ্ঞেস করলেন,‘‘ তোমার বাড়ি কথায় বলো তো শাখী মা।
শাখী উত্তর দিল, ‘‘আমার নাম আফ্রীন, আমার বাড়ি বহরমপুরে।’’ 
‘‘বাড়িতে কে কে আছে মা?’’
 
‘‘আম্মা আছে, আব্বু আছে, আর দাদা আছে।’’
‘‘দাদার নাম কি?’’
‘‘আদিল।’’
শান্তনু ডাক্তারবাবুর সাথে আলাদা করে পরে কথা বললো। ডাক্তার বাবু বললেন, যদি জানতে পারেন ঠিক কোথাকার কথা বলছে, গিয়ে দেখতে পারেন। সোনার কেল্লা মনে আছে তো? জাতিস্মর কনসেপ্ট কিন্তু আছে। তবে আমার মনে হয় বড় হবার সাথে সাথে ও ঠিক হয়ে যাবে।’’
বহরমপুর খুব ছোট জায়গা নয়। তাও শান্তনু পাড়ি দিল। রিক্সাওয়ালা, চায়ের দোকান, অটোওয়ালাদের জিজ্ঞেস করতে শুরু করলো সে। খুব বেগ পেতে হলো না। এক বয়স্ক রিক্সাওয়ালা বললেন, ‘‘মালুম হ্য় সাব, নাইনসাফি হুয়া বহুত উনলোগোঁকে সাথ। তিন সাল পেহেলে, এক এক্সিডেন্ট মে উও চার চল বসে।’’
ট্রেনে ফিরতে ফিরতে শান্তনু ভাবে, যে কাল আফ্রীন ছিল, আজ সে শাখী, আবার পরে হয়ত সে অ্যানি হবে, কিম্বা হবে একটা ছোট পাখি।
ডাক্তারের কথা মতই কিন্তু ধীরে ধীরে শাখী আগের কথা ভুলে গেলো সময়ের সাথে। সে এখন মা বাবার কোল আলো করা শাখী। ওকে নিয়ে এবারে ছুটিতে শান্তনুরা মুর্শিদাবাদ যাবে, হাজারদুয়ারি দেখবে।


বুধবার, ৯ মার্চ, ২০১৬

৫ম বর্ষ ৯ম সংখ্যা ।। ১০ই মার্চ ২০১৬

এই সংখ্যায় ১০টি গল্প । লিখেছেন মৌ দাশগুপ্তা, সুবীর রায়, ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়, অসিতবরন চট্টোপাধ্যায়, তাপসকিরণ রায়, রুখসানা কাজল, নীহার চক্রবর্তী, দীপঙ্কর বেরা ও মনোজিৎ কুমার দাশ ।

মৌ দাশগুপ্ত

চর্বিতচর্বণ

         গোপাললাল রোডে আমরা যে ভাড়া বাড়ীতে থাকি তাতে সাকুল্যে বারোটি ঘর। একতলায় থাকেন বাড়ীর মালিকরা। জ্যাঠতুতো খুড়তুতো দুইভাই। রমেন সাধু আর উপেন সাধু। ওপরে পাঁচটি ঘরে দুই ভাড়াটে। সম্পর্কেভাই বটে তবে অহিনকুল সম্পর্কটাই বেশী মানানসই বলা যায়। রমেন সাধু লোকটি বেশ প্যাঁচালো, বদরাগী গোছের। সিড়িঙ্গি চেহারা, সন্দেহসঙ্কুল চোখ।কাশীপুর গানসেল ফ্যাক্টরীতে কাজ করে। ঘরে বউ বেশ শাসন ত্রাসনে রাখে। বাচাকাচ্চা নেই। ছোট উপেন সাধু গোলগাল হাসিমুখ ভালোমানুষ চেহারা, বাড়ীর একতলাতেই ছাপাখানা চালায়। স্ত্রৈনমানুষ বললেও কমই বলা হয়। বউটি আবার বেশ রসময়ী। ঘরের কাজ কর্তাই সামাল দেন, থাকার মধ্যে দুটি যমজ মেয়ে, মামাবাড়ীতে দিদিমা কাছে থাকে তাই চাপও নেই অতএব, কত্রী ঠাকরুন মুখে দোক্তা ঠুসে আলতাপায়ে এর তার বাড়ী ঘুরে,সিনেমা দেখে উইন্ডো শপিং করে আরামসে দিন কাটায়।বর বউ দুটিতে বড় ভাব। সেদিন ঘরবার করছি,কিছুতেই আমার বরের সাথে মোবাইলে যোগাোযোগ করতে পারছিন। টানা সুইচড অফ দেখাচ্ছে, তার মানে বাবু মিটিংয়ে বসেছেন। ঘরের বিবিটির কথা আর মনে নেই। কি যে করি। তখনই শুনি নীচে দুইভাইয়ের মধ্যে তুমুল গোলমাল। এক বাড়ির কর্তা বলছে আর এক বাড়ির কর্তাকে -
-তোর বউটাই যত নষ্টের গোড়া। সারাদিন বাইরে বাইরে এতো ঘোরাঘুরি কিসের? বাড়ীর বউ ঘোমটা টেনে সোয়ামীর সেবা করবে ঘর সামলাবে তা নয়,ধিঙ্গি মাগী সেজেগুজে পরপুরুষের গা ঘেঁষে বসে সিনেমা দেখছে,বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে”। তার উত্তরে নিরীহভাবে অন্য কর্তা বলল
তোর তাতে কি? ও সাজগোজের পয়সা চাইতে তোর কাছে তো যায় না।
- সে আসবেও না,আমি পুরুষমানুষ,বুঝলি?পুরুষমানুষ,তোর মত মাউগ্যা নই,মাগচাটা কোথাকার। - মুখ সামলে কথা বলবি বলে দিলাম,পুরুষমানুষ! তাও যদি বাপ হবার ক্ষ্যামতা রাখতি। বউদি বাঁজা না তুই ক্ষ্যামতাহীন? মুখ খোলাস না সেজদা।
- কি যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা ? বউ সামলানোর ক্ষ্যামতা নেই বাপ হওয়া দেখাচ্ছিস হারামজাদা? অতো ক্ষ্যামতা তো বউকে একদিনের জন্য হলেও ঘরে আটকে দেখা দেখি।
ঝগড়া চলতেই থাকে,রোজকার মত। বুঝলাম উপেনের বউয়ের দেখাদেখি আবার রমেনের বউ কোথাও যাবার কথা বলেছিল বরকে,তার থেকেই এ তুলকালাম। আমার সহানুভূতিটা উপেনের দিকেই যায়। বাড়ীর বয়স্কা বউমানুষের এত বারমুখো হওয়া কিসের?এতে সংসার টেঁকে? বরঞ্চ উপনের বউটার মধ্যে বেশ লক্ষ্মীমন্ত ভাব রয়েছে। ঘরোয়া,সুশীলা।
         কিন্তু এই ফাঁকে আটকে আর বেশী দেরী করা যাবেনা। আমি সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসি। কিটিপার্টির দেরী হয়ে যাচ্ছে। বান্ধবীরা সবাই এসে গেছে বোধহয়,সুরঞ্জন এই কিটি পার্টি ফার্টি পছন্দ করেনা বলে যেতে বারন করে, আজও অফিস যাবার আগে একপ্রস্থ কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে আমাদের মধ্যে। কিন্তু ও নিজে সারাটাদিন অফিসে ব্যস্ত,কোনদিনই ওর ফেরার কোন ঠিকঠিকানা থাকে না ছেলেটাও হস্টেলে,ছুটিছাটাতে কালেভদ্রে বাড়ী আসে,আমার সময়টা কাটে কি করে? অতএব সুরঞ্জনের বারনটাও আর মানা হয়না আমার। যেতে যেতে রমেনের চিপটান মন্তব্য কানে আসে,“পরের বেলা আটিসুটি নিজের বেলায় চিমটি কাটি আমি সদরদরজাটা খোলা রেখেই রাস্তায় পা রাখি।


সুবীর কুমার রায়

সাধনবাবুর মৃত্যু

         গভীর রাতে বুকের খাঁচাটার ভিতর এক তীব্র যন্ত্রণায় সাধনবাবু অস্থির হয়ে উঠলেন। সঙ্গে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো, এক টুকরো মাংস পিন্ড যেন ওপর দিকে চাগাড় দিয়ে গলার কাছে এসে শ্বাষনালীকে চেপে ধরলো। তিনি একবার চিৎকার করে পাশের ঘর থেকে ঘুমন্ত স্ত্রীকে ডাকবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বার হ’ল না। সাধনবাবু বেশ বুঝতে পারছেন তাঁর পরমায়ু শেষ হয়ে আসছে, অথচ তাঁর কিছুই করার ক্ষমতা নেই। শেষে ধীরে ধীরে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।
সকালবেলা স্ত্রীর চিৎকারে আশপাশের বাড়ি থেকে দু’চারজন ছুটে আসলেন। সাধনবাবুর ছানি কাটা নিথর চোখ দুটি খোলা। তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন স্ত্রী ও আশপাশের প্রতিবেশীদের জটলা। পরিস্কার শুনতে পাচ্ছেন এখন কী কী করণীয়, তাই নিয়ে প্রতিবেশীদের আলোচনা।
-বৌদি, ব্যাঙ্কের চেকবই আর এ.টি.এম. কার্ডটা ঠিক জায়গায় আছে তো?  
-কাউকে কোনরকম কষ্ট না দিয়ে কিরকম হঠাৎ করে চলে গেলেন, আপনি ভাগ্যবতী ম্যাডাম। একবার ভাবুন তো কোন নার্সিংহোমে দিলে কী অবস্থা হ’ত।  
-সে আর বলতে, একবারে ছিবড়ে করে ছেড়ে দিত। আমার ছোট শালার ভায়রাকে মরে যাবার পরেও ঐ ভেন্টিলেশন না কী যেন বলে না, তাই দিয়ে সাত দিন রেখে আড়াই লাখ নিয়ে নিল। আপনার ভাগ্য ভালো। তবে এইভাবে দুম করে চলে যাওয়া তো, শেষ সময় একটু জলও পান নি, আপনি কিন্তু অবশ্যই গয়ায় একটা পিন্ডি দিয়ে আসবেন। তাড়াহুড়োর কিছু নেই, তবে সেই সুযোগে রাজগীর, নালন্দা, বুদ্ধগয়াটাও ঘুরে নেবেন। 
-আর ঘোরা, আমার যা শরীরের অবস্থা। আপনারা একটু চা খাবেন তো, আমি চটকরে চায়ের জলটা চাপিয়ে আসছি। ছেলে মেয়েকে খবরটা দেবার ব্যবস্থা করতে হবে, আমি একা হাতে যে কোনদিক সামলাই
-হ্যাঁ, ডাক্তারকেও তো একটা খবর দিতে হবে। ডেথ সার্টিফিকেট নিতে হবে তো
সাধনবাবু সব কথা শুনতে পাচ্ছেন, একটু ঝাপসা হলেও সব কিছু দেখতেও পাচ্ছেন, কিন্তু অসুবিধাটা হ’ল তিনি মারা যাওয়ায় এদিক ওদিক ঘাড় ফেরাতে পারছেন না। ফলে একটু পাশের লোকজনের কথা শুনতে পেলেও তাদের দেখতে পাচ্ছেন না।
ছেলে,বৌমা, মেয়ে, জামাই, নাতি, নাতনিরা এসে উপস্থিত হ’ল। সাধনবাবুর খুব ইচ্ছে করছে নাতি নাতনিকে একটু জড়িয়ে ধরে আদর করেন। কিন্তু একে তো হাত পা অসা, তার ওপর উপস্থিত সকলে ভয় পেতে পারে ভেবে সে চেষ্টা আর করলেন না।
নাতি নাতনি দুটো আগের মতোই দাদুর কাছে যেতে চাইলেও, তাদের পাশের ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হ’ল। সাধনবাবুর খুব ইচ্ছা করছিল তাদের নিজের কাছে ডাকেন, শেষ বারের মতো তাদের একবার জড়িয়ে ধরে আদর করেন। কিন্তু তাঁর আর সেই ক্ষমতা নেই, অন্য কারোর এই বিষয়ে উৎসাহও দেখলেন না।
ছেলে ও জামাই তাঁর অন্তিম সৎকার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তাঁকে কোন শ্মশান ঘাটে নিয়ে যাওয়া যায়, কিভাবে নিয়ে যাওয়া যায়, ইলেক্ট্রিক না কাঠের চুল্লি, ইত্যাদি ইত্যাদি।
সাধনবাবু অনেক সময়েই মনে মনে ভাবতেন, তাঁর বাবাকে যে শ্মশান ঘাটে দাহ করা হয়েছিল, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁকেও যেন সেখানেই দাহ করা হয়। কিন্তু এখন আর তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোন মূল্যই নেই, হয়তো স্থানীয় নোংরা  
         দুর্গন্ধযুক্ত শ্মশানটাতেই তাঁকে দাহ করতে নিয়ে যাওয়া হবে। এই দাহ করার কথা ভাবতেই তাঁর কিরকম ভয় ভয় করতে শুরু করলো। আগুনে পোড়ার সময় সত্যিই জ্বালা করে না তো, একবার তাঁর হাতে গরম জল পড়ে পুড়ে গেছিল। উঃ সে কী যণ্ত্রনা, আজও জায়গাটায় দাগ হয়ে আছে।
স্পষ্ট শুনতে না পেলেও পাশের ঘরের গুলতানির আওয়াজ তাঁর কানে আসছে। এখন এই ঘরে তাঁর জামাই ও ছেলে ছাড়া আর কেউ নেই। তারা আলমারি খুলে তাঁর সব কাগজপত্র, ব্যাঙ্ক ও পোস্ট অফিসের পাসবই, ফিক্সড ডিপোজিটের সার্টিফিকেট নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। মাঝেমাঝেই আর কিছু আছে বা ছিল কী না, এই নিয়ে মতবিরোধ ও সামান্য তর্কাতর্কিও করছে। ব্যাঙ্কের লকার খোলার সময় মা’র সাথে কে যাবে, তাই নিয়েও মতবিরোধ শুরু হয়ে গেছে।
কিছুক্ষণ পরে মেয়ে ও বৌমা ঘর ফাঁকা দেখে এই ঘরে এসে হাজির হ’ল। কথাবার্তায় বোঝা গেল তারাও একবার আলমারিটা খুলতে চায়, কিন্তু চাবি খুঁজে না পাওয়ায় সেটা সম্ভব হচ্ছে না। মেয়ের খুব ইচ্ছা তার মায়ের গয়না সমান দু’ভাগে ভাগ করা হোক। মা’র যেহেতু আর গয়না পরার সুযোগ নেই, তাই ভাগবটরা যা হবার এখনই হয়ে যাওয়াই  কাম্য। বৌমার তাতে ভীষণ আপত্তি। সমান দুভাগে ভাগ করার কোন প্রশ্নই ওঠে না।
-কেন ঠাকুরঝি, তোমার বিয়েতে বাবা তো তোমায় যথেষ্টই দিয়েছেন, খরচও তো অনেক টাকাই করেছেন বলে শুনেছি। তাতেও তোমার সাধ মেটেনি ?  
-আমার আবার সাধ-আহ্লাদ, আমার জন্য বাবা কী করেছেন শুনি? ছোটবেলা থেকেই আমি নেগলেকটেড, ভালো একটা খেলনা, একটা জামা পর্যন্ত কখনও চোখে দেখিনি, অথচ বাবার তো আয় খুব কম ছিল বলে মনে হয় না। সারাটা জীবন একই গল্প শুনে এসেছি, ভবিষ্যৎ, সঞ্চয়, সিকিউরিটি। আরে বাবা ভবিষ্যতে ভালো থাকবো বলে বর্তমানটা নষ্ট করবো, কোন সাধ আহ্লাদ মেটাবো না? কবে সে টাকা ম্যাচিওর হবে, তার জন্য তীর্থের কাকের মতো ঘাড় তুলে বসে থাকো। ইন্সুরেন্সের টাকাতো আবার না মরলে চোখে দেখা যায় না, সারা জীবন ধরে প্রিমিয়াম দিয়ে যাও। ভবিষ্যতের ভালোর জন্য সারা জীবন কষ্ট করে গেলাম, এখন তুমি এসেছো অধিকার ফলাতে। তোমার বিয়েতে তো তোমার বাবা অনেক শাড়ি, গয়না দিয়েছিলেন, তাই বলে কী তুমি তোমার বাবার সম্পত্তিতে ভাগ বসাবে না। তুমিও বেঁচে থাকবে,  আমিও বেঁচে থাকবো, একবার চোখ বুজুক দেখবো কী করো
-সে যদি দেয় আমি নেব না? সে তো তোমার দাদা, তোমার ভাইপোর ভালোর জন্যই নেব। তোমার দাদা একটু ভালো থাকুক, তুমি বোধহয় সেটাও চাও না। ধন্যি তোমার লোভ
-আমার সংসার নেই, আমার স্বামী একটু ভালো থাকুক, আমার মেয়ে একটা ভালো স্কুলে পড়ুক, তুমি কী সেটা চাইছো ?
         সাধনবাবুর একবার মনে হ’ল একটা উইল করে যাওয়া উচিৎ ছিলো। মেয়ে-বৌমাকে শান্ত করার ইচ্ছাও একবার হ’ল, কিন্তু এর মধ্যে স্ত্রী ঘরে এসে উপস্থিত হলেন। মেয়ে-বৌমার ঝগড়ার কারণ শুনে তিনি নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারলেন না।
-মানুষটাকে এখনও ঘাটে তোলা হয় নি, এরমধ্যে তোমাদের ঝগড়া শুরু হয়ে গেল? সব তোমরা দু’জনে ভাগ করে নাও আর আমি শেষ জীবনে ভিক্ষা করে মরি আর কী। তোমাকে আর তোমার দাদাকে মানুষ করতে গিয়ে আমি সারাটা জীবন কষ্ট করেছি। কত ইচ্ছা ছিলো একটা ভালো সাজানো ফ্ল্যাটে থাকি, একটা গাড়ি কিনি, তা না সারা জীবন উনি অফিস করেই ম’লেন। আমার সাধ আহ্লাদের কথা না উনি ভেবেছেন, না তোমরা। আজকাল সকলের বাড়িতেই নিজেদের গাড়ি আছে। আগে একটা গ্যারেজ সমেত ভালো বড় ফ্ল্যাট কেনা হবে, খুব সুন্দর করে সাজানো হবে, তারপর সব কিছু। তোমরাই তো সেই গাড়িতে চাপবে, তোমরাই তো ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাটে থাকবে না কী ? স্বামী মারা গেলে কি কেউ গয়না পরে না? খুব মোটা মোটা না হোক হালকার ওপর গয়না এবার আমি গড়াবোই, তোমার বাবা তো সেই নবীন স্যাকরার কাছ থেকে ফিনফিনে কয়েকটা চুড়ি আর একটা হার ছাড়া জীবনে কিছুই গড়িয়ে দেয় নি। তোমাদের জীবন আছে আমার নেই? শেষ জীবনটা একটু ভোগ করবো, তাও তোমরা চাওনা ?
সাধনবাবুর মুখের ওপর দু’টো মাছি বসে বড় বিরক্ত করছে। সেদিকে কারো নজর নেই। স্ত্রী গটগট্ করে পাশের ঘরে চলে গেলেন, বোধহয় অতিথিদের জন্য চা করতে। অতিথি নারায়ণ বলে কথা। কলিং বেলটা বেজে উঠলো, বোধহয় ডাক্তার এলেন ডেথ সার্টিফিকেট দিতে।
এই নাও তোমার চা। সাধনবাবুর ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ মেলে দেখলেন স্ত্রী চায়ের কাপ রেখে বাইরের দরজা খুলে দিলেন। বাড়ির কাজের লোক দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকলো।