গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শনিবার, ২৫ জুন, ২০১৬

সুবর্ণা রায়



বালিচরের জলকন্যা

মঞ্জুদি খাবার জল দিতে এসেছিল। শাড়িটা পেটের অনেকটা ওপরে পড়ে, প্রথমে দেখলেই মনে হয় সন্তানসম্ভবা। অনেকবার বলেও ঠিক করাতে পারি নি। ফাঁকা ফাঁকা দাঁত বার করে হাসে। আর পারলে টেনে কুঁচিসমেত শাড়িটা আর একটু ওপরে তোলে।
মঞ্জুদির মুখ আজ মলিন। জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে?
মঞ্জুদির বড় মেয়ে আঠারো, মামাবাড়িতে থেকে মানুষ। তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। মঞ্জুদি খুব খুশী কারণ জামাই বলেছে মেয়েকে আরো পড়াবে। কিন্তু বিয়ে দেবার সামর্থ্য স্কুলে সামান্য আয়া হয়ে হয় না। কলের কাজটা যাবার পর, ওর স্বামী এখন শালপাতার থালা বানায় বাড়িতে। সবে শুরু করেছে। কিছুদিন আগেই সে যন্ত্র কিনেছে বেশ কিছু টাকা দিয়ে। এখন কুড়িয়ে বাড়িয়েও প্রায় পাঁচহাজার টাকার ঘাটতি।
বললাম,আচ্ছা যদি আমি দিয়ে দি?
মঞ্জুদি আশা করে নি। বাজ পড়ার মত চমকালো। তারপর অবাক চোখে তাকিয়ে রইল।
একটু কৌতুকমেশানো স্বরে বললাম,কিন্তু একটা শর্ত আছে।
মঞ্জুদির অবিশ্বাসী মুখ আবার মেঘে ঢেকে গেল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
বললাম, আমাকে এখানে এমন একটা সুন্দর জায়গা দেখাও,যা দেখলে আমি সত্যি চমকে যাব।
মঞ্জুদি এই প্রথম মন খুলে হাসল। বেশ খানিকটা চেনে আমায়। "দিদি,তুমি কি গো"বলে শাড়ির কুঁচি আর একটু তুলে চলে গেল ঘরের বাইরে। ফার্স্ট বেল পড়ে গেছে।

মিশনের চৌহদ্দির বাইরে বেরোলেই শালের জঙ্গল শুরু। প্রথমে খানিকটা ফাঁকা ফাঁকা। পায়ে হাঁটা একটা সরু লাল পথ ঢুকে গেছে জঙ্গলে। মঞ্জুদি আগে আগে চলেছে।
শহর থেকে অনেক দূরে, গভীর গ্রামে শিক্ষার ব্রত নিয়ে কাজ করা মানুষগুলো ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছে মিশনটা। শুরুতে দশটা ছেলেমেয়ে,টিনের চালের ঘরে পড়তে আসতো। সেই ঘরটা এখন স্টোর রুম,সেভাবে দরকারও পড়ে না। প্রাইমারী, সেকেন্ডারী স্কুল,হোস্টেল মিলিয়ে এখন আয়তনে বিশাল। একটা আমন্ত্রণে একবার এসেছিলাম। তারপর ইচ্ছা প্রকাশ করায় 'দিদিমণি' হতে বিশেষ বেগ পেতে হয় নি।

মঞ্জুদি কথা বলছে এক দুটো। দুপুরের কড়া রোদটা এখন টের পাওয়া যাচ্ছে না। বেশ খানিকটা ঢুকে এসেছি আমরা। অনেকদূরে টালির চালের কিছু ঘর দেখা যাচ্ছে যেদিকে জঙ্গলটা একটু হালকা। হালকা কারণ সেখান দিয়ে তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে একটা সরু নদী। লালি। গায়ে ঘসা লেগে যাচ্ছে শালের গুঁড়ির। সামনে একটা ছোট্ট টিলা, দেড় মানুষ উঁচু হবে। সরু রাস্তাটা বাঁদিকে মিলিয়ে গেছে বনে। রাস্তা ছেড়ে মঞ্জুদি টিলার দিকে চলল।

খুব কৌতূহল সেই সকাল থেকে হচ্ছিল,কিন্তু চেপে রেখেছিলাম, মিষ্টি সারপ্রাইজের রেশ দীর্ঘস্থায়ী করতে। তাই চুপচাপ পিছন পিছন চললাম শুকনো পাতার ওপর খচমচ শব্দ করতে করতে।টিলায় চড়তে একটুও বেগ পেতে হল না। ওপরটা একজনের বসার মতো সমতল। সেখানে উঠতেই মঞ্জুদি সামনের দিকে আঙ্গুল দেখালো।

বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। টিলার ঠিক নীচেই বেশ বড় একটা খাদ। খাদের গায়ে লাল আর বাদামী ছোপ ছোপ। লালি এখানে বেশ একটু চওড়া। আর গভীরও। জলের রংটাও কেমন নীলচে সবুজ। খাদটা যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে নদীর ধার অবধি সাদা বালি আর হলুদ পাথর মেশানো চর। ভাবলাম ভুল দেখছি। পুরুলিয়ার জঙ্গলে নদীর ধারে বালি কি করে আসতে পারে? চশমাটা নাকের ওপর ঠেসে ভালো করে দেখলাম। হ্যাঁ! বালির চর। কমলা রঙের সম্পূর্ণ গোল সূর্যের রঙে ঝিকমিক করছে বালি। শ্যাওলাধরা কিছু বড় পাথরও রয়েছে এদিক ওদিক। খাদটা অর্ধবৃত্তের মতো হয়ে চরটাকে আগলে রেখেছে। শুধু এই জায়গাটুকুই এরকম। তারপরে আবার সেই গতানুগতিক। অনেকটা যেন বিদেশের কোনো লাগুন। ছবির মতো সুন্দর।

হাঁ করে প্রকৃতির অপূর্ব লীলা দেখছি,ঠিক সেই সময় জল থেকে একটা মেয়ে উঠে এলো বালির চরে। এই নিস্তব্ধ,বিরল জায়গায় কাউকে দেখবো আশা করি নি। বেজায় চমকে গেলাম। মেয়েটি সম্পূর্ণ নগ্ন। চুল খোলা। জল থেকে উঠে চরের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। গরমের দেশ,তার ওপর এপ্রিলের শুরু। বালি পাথর বেশ গরম থাকার কথা এখনো।

মঞ্জুদিও হাঁ হয়ে গেছে। তবে সামলেও নিল। নিজের আঞ্চলিক ভাষায় চিৎকার দিয়ে উঠল, "পাগল হয়েছিস নাকি? অ্যাই মেয়ে! যা,ঘরে যা!" রীতিমত ধমকে জঙ্গল কেঁপে উঠল প্রায়। কিছুটা দূরে বলে বয়স আন্দাজ করা যাচ্ছে না ভালোভাবে। তবে অল্প বয়সেরই মেয়ে। মাথা তুলে এদিকে দেখলে একবার।
"কোথায় থাকিস? বলাঝুড়ি?" মঞ্জুদি আঙ্গুল দেখলো দূরের টালির চালগুলোর দিকে।
"না", মেয়েটা উত্তর দিল শুয়ে শুয়েই মাথা নেড়ে। তাকিয়ে আছে এদিকে।
"তবে কোথায়?"
নিরুত্তর।
আমি মঞ্জুদির হাত ছুঁয়ে ইশারা করলাম। চুপ করতে মেয়েটা দুহাতের ওপর মাথা রেখে জলের দিকে তাকিয়ে পুড়তে থাকল। থাকুক।

কেন যেন মনে হচ্ছিল,ওকে একলা থাকতে দেওয়াটাই সঠিক হবে। কোনো ভয় নেই হাবেভাবে। আছে নির্লিপ্ততা। হয়ত আশেপাশেই থাকে। সময় হলে উঠে চলে যাবে। একটি মেয়ের প্রকৃতির সাথে এই সঙ্গমে বাধা হতে ইচ্ছে হল না। কজন পারে ভালোবাসতে এভাবে? নাহয় নাই জানলাম ওর নাম,ধাম।
মঞ্জুদির হাত ধরে আলতো টান দিয়ে টিলা থেকে নেমে আসার প্রস্তুতি নিলাম।

মেয়েটা উঠে বসেছে। দুহাতে হাঁটু জড়িয়ে জলের দিকে চেয়ে আছে। নীলচে সবুজ জলে আর কনে দেখা আলোয় মেয়েটার পরিতৃপ্ত মুখ দেখতে পেলাম যেন। শান্ত সমাহিত। মেয়েটা এদিকে তাকিয়ে হাসছে। একবার হাতও নাড়ল। মুখটা চেনা লাগছে কেন? আমি স্মৃতি হাতড়াচ্ছি। মেয়েটা খুব আস্তে জলে নেমে যাচ্ছে আবার। আমি হাতড়াচ্ছি অন্ধের মতো। মেয়েটার পা ডুবে গেল,তারপর হাঁটু,কোমর,বুক।
হে ভগবান! ওটা তো আমি! বলেই বুঝতে পারলাম,মঞ্জুদিও ঠিক একই কথা বলে উঠেছে তাকালাম মঞ্জুদির দিকে আর দুজনেই হো হো করে হেসে উঠলাম। বালির চরে কেউ নেই তখন।
আমি আর মঞ্জুদি ফেরার পথ ধরলাম লঘু পায়ে। একটা খোলা আকাশের নীচে শালের জঙ্গলে তখন পাখিরা বাসায় ফিরতে ব্যস্ত। আমরাও ফিরছি। সবাই ফিরে যায় একদিন। আর সেখানে আমার আর মঞ্জুদির কোনো পার্থক্য নেই। অনেক ভিতরে সব মেয়েই হয়ত এমন।

আমাদের হাসি থামছে না। আমি মঞ্জুদির হাতটা জড়িয়ে ধরে জোরে জোরে একটা জনপ্রিয় হিন্দীগান গাইতে শুরু করলাম। কি আশ্চর্য! কুঁচির শাড়িটা ঠেলে তুলে মঞ্জুদিও গলা মেলালো!