গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৮ জুলাই, ২০১৬

৫ম বর্ষ ১৭তম সংখ্যা ।। ১৯ জুলাই ২০১৬
















পড়ুন সূচিপত্রে লেখকের নামে ক্লিক করে অথবা পৃষ্ঠা পালটে

সম্পাদকীয়



প্রথমেই বাংলা ছোটগল্পের অনন্য কথাকার ‘বনফুল’এর ১১৮তম জন্মদিনে জানাই আমাদের বিনম্র প্রণতি । ‘গল্পগুচ্ছ’র এই বিশেষ সংখ্যা তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি ।

সভ্যতার উষালগ্নে গল্পের সৃষ্টি । মানুষ মুখে মুখে গল্প তৈরি করেছে । সভ্যতার সমবয়সি হয়েও ছোটগল্প বলতে এখন আমরা যা বুঝি তা নিতান্তই আধুনিক কালের ফসল,সাহিত্যের আর সব শাখার তুলনায় নবীনতম । বাংলা সাহিত্যে সার্থক ছোটগল্পের প্রবর্তক রবীন্দ্রনাথ । পত্রিকার প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথ গল্প লিখতে শুরু করেন । ১৮৭৭ সনে কিশোর রবীন্দ্রনাথের প্রথম ছোটগল্প ভিখারিণী প্রকাশিত হয় ‘ভারতী’ পত্রিকায় । এর চোদ্দ বছর পরে তার দ্বিতীয় ছোটগল্প ‘দেনা পাওনা’ প্রকাশিত হয় । আর ‘দেনা পাওনা’কেই প্রথম সার্থক ছোটগল্প বলা হয় । ছোটগল্প কথাটিও রবীন্দ্রনাথই প্রথম ব্যবহার করেন । সেই হিসাবে বাংলাসাহিত্যে ছোটগল্পের বয়স মাত্রই একশো বছর ।

রবীন্দ্রোত্তর কালে বাংলা ছোটগল্পর অবয়ব রচনায় নতুনতর মাত্রা যোগ করেছিলেন বনফুল বা ডাক্তার বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৯ - ১৯৭৯ ) । স্বল্প পরিসরে, ক্ষুদ্র অবয়বে তাঁর অজস্র সার্থক ছোটগল্প সমৃদ্ধ করেছে বাংলা সাহিত্যকে । আমি এও মনে করি, এখন অতি ক্ষুদ্র অবয়বে গল্প নির্মাণ বা অণুগল্পের যে ধারণা বা ভাবনা,তার বীজ রয়েছে ‘বনফুল’এর গল্পনির্মাণ প্রকরণের মধ্যেই । অতয়েব গল্পগুচ্ছ তার বিশেষ অণুগল্প সঙ্খ্যা প্রকাশের জন্য ‘বনফুল’এর জন্মদিনটিকেই বেছে নিয়েছে ।

এই সংখ্যাটি গল্পগুচ্ছর দ্বিতীয় ‘অণুগল্প সংখ্যা’ । আগেরটি প্রকাশিত হয়েছিল গত মে মাসে । বলেছিলাম গল্পগুলি যেন  ২০০ থেকে ৩৫০ শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে । এই নির্দেশ প্রকাশিত লেখাগুলিতে সম্পূর্ণভাবে মানা সম্ভব হয়নি  । এ কথা মানি যে, শব্দসীমার শিকল পরালে সার্থক সৃষ্টি হয় না। আবার একথাও ঠিক যে অণুগল্প রচনার ক্ষেত্রে শব্দসীমার শৃঙ্খলা থাকাটাও জরুরি, নতুবা অণুগল্প রচনার ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হবে নৈরাজ্যের জগৎ । ইতিমধ্যে ‘পরমাণু গল্প’ অভিধায় কিছু লেখা ‘ফেসবুক’ নামক ‘সব-জান্তা’, ‘সব-পেয়েছি’র বাজারে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে । জীবনের কোন খন্ড অনুভুতি দশবারোটা শব্দের বাঁধনে নাকি ‘গল্প’ হচ্ছে ।

সে কথা থাক । গল্প বা গদ্যকাহিনীর আসরে অণুগল্পের ধারণাটা নিতান্তই নবীন । ফেসবুকের নানান সাহিত্যগোষ্ঠী এবং ওয়েব পত্রিকাগুলিই অণুগল্পের ধাত্রিগৃহ। অণুগল্প তো আদতে ‘গল্প’ই, ছোটগল্পের মান্য সংজ্ঞা আছে, তার আয়তন কেমন হবে তারও স্পষ্ট নির্দেশ পাই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গল্পকারদের লেখায় । অনুগল্প ছোট গল্পের চেয়ে ক্ষুদ্রায়তন হবে সেটা বুঝি, কিন্তু কতছোট, তার কোন স্পষ্ট মিমাংসা এখনও কেউ করেছেন বলে আমার জানা নেই ।  বাংলা সাহিত্যে পত্র-পত্রিকাগুলির চাহিদা মেটাতেই ছোটগল্পের প্রবর্তনা হয়েছিল আর তা প্রবর্তন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ । একইভাবে আজ সময়ের স্রোতে অন্তর্জালবিশ্বে অন্তর্জালের সামাজিক পরিসর ও অন্তর্জাল পত্র-পত্রিকার চাহিদা মেটাতে অণুগল্পে এসে পৌঁছেছি ।

আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও অণুগল্পও আদতে ‘গল্প’ । তাই আমি মনে করিনা ‘ছোটগল্প আর ‘অণুগল্প’র মধ্যে প্রকরণগত কোন প্রভেদ আছে । নাটকীয় আকর্ষণীয়তা, উৎকন্ঠা, চরম মুহূর্ত, লিখনশৈলীর দৃঢ় সঙ্ঘবদ্ধতাই সার্থক ছোট গল্পের বৈশিষ্ট্য । অণুগল্পের ক্ষেত্রেও এই মূলগত বৈশিষ্ট্যগুলি বজায় থাকা চাই । ছোটগল্পের ভগীরথ রবীন্দ্রনাথ যেমন বলে গিয়েছেন যে, ছোটগল্পে থাকেনা ঘটনার ঘনঘটা, বর্ণনার ছটা, থাকে না তত্ব ও উপদেশ । থাকে অতৃপ্তি, যেন মনে হয় ‘শেষ হয়ে  না হইল শেষ’ ।

আবার বলি, ‘অণুগল্প’র ধারণা নিতান্তই নবীন এবং এখনও প্রাথমিক স্তরে । সাহিত্যের আসরে তার স্থিতি স্পষ্ট ও পোক্ত করতে তাকে পেরোতে হবে আরো অনেক পথ । পাঠককুলই গ্রহণ ও বর্জনের মধ্য দিতে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে অথবা যাবে না । কারণ, নিশ্চিতভাবেই অণুগল্পের মোড়কে ‘না-গল্প’কে তারা গ্রহণ করবেন না, করেনওনি কোন দিন । তাই, রবীন্দ্রনাথের অমোঘ পংক্তি উদ্ধার করেই শেষ করি

“... তোমার টানাটানি টিঁকবে না ভাই,
     রবার যেটা সেটাই রবে



ঝর্ণাচট্টোপাধ্যায়



বনফুল--বাংলা ছোটগল্পের বড় গল্পকার
 

পৃথিবীর যে কোন ভাষার সাহিত্যে আমরা উপন্যাস
, রম্যরচনা, ভ্রমণকাহিনি, জীবনী, আত্মজীবনী, বিজ্ঞানভিত্তিক রচনা ইত্যাদির পাশাপাশি পাই ছোটগল্পও।  বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ  আসনটি অবশ্যই ছোটগল্পের, একথা বললে অত্যুক্তি করা  হয় না। আর বনফুলওরফে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় সেই ছোটগল্পকারদের মধ্যে একজন শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পকার।  

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৯৯ সালের ১৯শে জুলাই বিহারের পূর্ণিয়া জেলার (বর্তমানে কাটিহার জেলা) মণিহারি গ্রামে। পিতা সত্যচরণ মুখোপাধ্যায়, মাতার নাম মৃণালিনী দেবী। পিতা  ছিলেন চিকিৎসক।

প্রথম জীবনে ভর্তি হন সাহেবগঞ্জ রেলওয়ে স্কুলে। সেখানে থাকাকালীন হাতে লেখা একটি সাহিত্য পত্রিকা, যার নাম ছিল বিকাশ’, তাতে প্রকাশিত হয় প্রথম দিকের  কিছু লেখা। এর পরে মালঞ্চ নামে একটি খ্যাতনামা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় বলাইচাঁদের একটি কবিতা। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের নজরে পড়েন। এইসব সাহিত্য চর্চার ফলে বলাইচাঁদের লেখাপড়ার ক্ষতি হবে মনে করে তিনি সাহিত্য চর্চা করতে নিষেধ করেন। বলাইচাঁদ বনফুলছদ্মনামে লিখতে শুরু করেন। অল্প বয়সে লুকিয়ে সাহিত্য চর্চা করার জন্য যে নামটি তিনি  গ্রহণ করেছিলেন, আজীবন সেই ছদ্মনামই তিনি ব্যবহার করে গেছেন।
স্কুলের পর কলেজের  শিক্ষাগ্রহণ প্রথম হাজারিবাগ কলেজ, তারপর কলকাতা মেডিকেল কলেজ। চাকুরী জীবন শুরু করেন প্রথম পাটনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল,  পরে আজিমগঞ্জ ও ভাগলপুর। সাহিত্য রচনার পাশাপাশি সারা জীবন চিকিৎকের দায়িত্ব পালন করেছেন।  
  
সাহিত্যসেবা করেছেন দীর্ঘ ৬৫ বছর ধরে। চিকিৎসকের দায়িত্বের সঙ্গে সঙ্গে এই দীর্ঘ সময় ধরে রচনা করেছেন অজস্র ছোটগল্প, যার সংখ্যা প্রায় ৫৮৬ টি। রচনা করেছেন প্রায় ৬০টির মত উপন্যাস, নাটক ৫খানি, কিছু একাঙ্ক নাটক, কবিতা, অন্যান্য রচনার পাশাপাশি একটি আত্মজীবনীও তিনি লিখেছেন, যার নাম পশ্চাৎপট


কি ধরণের বিষয় নিয়ে তিনি লিখতেন
? তাঁকে নিয়ে বিশেষতঃ তাঁর ছোটগল্প নিয়ে আলোচনার প্রাক্কালে এই প্রশ্ন আসবেই। বনফুলের রচনার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন মানুষকে, তাই তাঁর রচনায় স্থান  পেয়েছে মানুষ, তাঁর ভাল-মন্দ সব কিছু নিয়েই । মানুষের পরিচয় কেবলমাত্র ভাল মানুষ নয়, ভালোমন্দ মিশিয়েই মানুষ। তাঁর রচনায় নীতিবাগীশতা যেমন ছিল না, আবার অন্যায় করলে তার জন্য শাস্তিও প্রাপ্য ছিল। জীবন সম্বন্ধে তাঁর যেমন কোন মোহ ছিল না, আবার তেমনি বিশেষ কোন আদর্শের প্রতিও ঝোঁক ছিল না। সম্পূর্ণ কথকতার ভঙ্গী নিয়ে তিনি লিখে গেছেন। তাই সাহিত্যের জগতে তাঁকে একজন বিজ্ঞান নিষ্ঠ বুদ্ধিবাদী লেখক বলা যেতেই পারে।
উপন্যাসও লিখেছেন অনেক। কয়েকটি উপন্যাস যথেষ্ট সমাদর লাভ করেছিল। সবগুলিই যে উৎকর্ষতার বিচারে সমাদর লাভ করেছিল, তা বলা যাবে না, কিন্তু উপন্যাস, ছোটগল্প যাই হোক না কেন, রচনার বিষয়বৈচিত্র লক্ষ্য করার মত।


আমরা জানি বাংলা সাহিত্যে তাঁকে ইংরাজি সাহিত্যের ছোটগল্পকার ও হেনরির সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে। ও হেনরির নামটীও তাঁর নিজের নয়
, এটি ছদ্মনাম। ও  হেনরির রচনার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল, গল্পের শেষে চমক বা আমরা  যাকে বলি surprising ending.এছাড়া বাস্তব ঘটনার প্রতিফলন বলা হয় তাঁর ছোটগল্পকে। যদি বনফুলের রচনার দিকে লক্ষ্য রাখি, আমরা এই দুটি গুণই তাঁর রচনায় দেখতে পাই। সাধারণ নিত্য জীবনের ঘটনা উঠে আসে তাঁর ছোটগল্পগুলিতে। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চাওয়া-পাওয়া, নিত্য সংঘর্ষ, মান-অভিমান, প্রেম, প্রণয়, ঈর্ষা, কলহ, হিংসা, অসফলতা, অবহেলা কোন অনুভূতিকেই বাদ দেননি তিনি, সব দুহাতে কুড়িয়ে নিয়ে মালা গেঁথেছেন।  এসবই তাঁর রচনার বিষয় হয়েছে বলে তাঁর ছোটগল্পগুলিও হয়েছে এত মধুর। গল্পের আয়তনেও হার মানিয়েছেন তিনি সকলকে। কোন কোন গল্প মাত্র এক পৃষ্ঠা/আধ পৃষ্ঠার হলেও তার ভিতর ধরে রাখতে পেরেছেন হয়ত কোন জীবনের প্রায়  সত্তর বছরের ঘটনাবলীকে। এখানেই  তাঁর রচনার মুন্সীয়ানা। আর গল্পের শেষে চমক তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অজস্র ভাললাগা গল্পের মধ্য থেকে মাত্র কয়েকটি গল্প এখানে অতি সংক্ষেপে আলোচনা করলেই বোঝা যাবে তাঁর গল্পের শেষে চমকটা কিরকম ছিল।


প্রথম গল্পটির নাম হল
সুলেখার ক্রন্দন।

বিছানায় শুয়ে একটি মেয়ে কাঁদছে। দুধের মত ধবধবে সাদা বিছানায় শুয়ে একটি অল্পবয়সী মেয়ের কান্না সকলকে ভাবাচ্ছে। পরিবারের লোকেরা নানাজনে নানারকম মনে করছেন। এমন কি স্বামীর সঙ্গে কোনরকম অশান্তি
, মনোমালিন্য  কিনা তাই নিয়েও সকলে চিন্তা করছেন। এমন সময় জানা গেল মেয়েটি অর্থাৎ সুলেখা কাঁদছে দাঁতের ব্যথায়।
চমক তো বটেই, কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের যে অসামঞ্জস্য, তা নিয়েও কাহিনি রচিত হয়েছে। এও কিন্তু বাস্তব।


দ্বিতীয় কাহিনিটির নাম
জাগ্রত দেবতা।

আগেই বলেছি বনফুল বিশেষ কোন মোহ বা বিশ্বাস নিয়ে চলতেন না
, জীবনকে দেখেছেন একেবারে বাস্তব ভাবে। কিন্তু অন্ধ বিশ্বাস যে মানুষের মনকে কিভাবে ছেয়ে ফেলে এই গল্পটি তারই প্রকাশ।
গ্রামের জাগ্রত দেবতা ছিলেম বাবা মহাদেব। তাঁর প্রচুর নাম-ডাক, দুরদুরান্ত থেকে লোক আসে, পুজো দেয়। বাবা মনস্কামনা পূর্ণ করেন। বাবা দয়া করেন কাউকে না কাউকে। প্রতিবছর বৈশাখী পূর্ণিমায় তাঁর পূজার দিনে কৃপা পেয়ে থাকেন একজন,  সেই ব্যক্তির ভর হয়, পরে সে  পাগল হয়ে যায়। কিন্তু তার জন্য গ্রামবাসীর মনে দুঃখ নেই, সবই মহাদেবের কৃপা। পাগলের উপর দেবতার অশেষ কৃপা বর্ষিত হয়েছে বলেই সে পাগল হয়েছে। দিকে দিকে দেবতার মহিমা প্রচারিত হয়। গ্রামবাসীরা দেবতার কৃপালাভে সচেষ্ট থাকেন, সন্তুষ্ট থাকেন।  
  
একবার পুজার দিন কোন মানুষ পাগল হয়েছে বলে জানা গেল না। গ্রামবাসীরা ভয়ে তটস্থ। সকলেই সংবাদ নিচ্ছে কেউ পাগল দেখেছে কিনা, কোন সংবাদ পেয়েছে কিনা। যখন কারো সংবাদ পাওয়া গেল না, সকলে মনে করলেন দেবতা রুষ্ট হয়েছেন। ভয়ে তারা দেবতার কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন। এক ব্যক্তি ছিলেন  দেবতার অন্ধ ভক্ত। তাঁর মনে কিন্তু দেবতার কৃপা সম্বন্ধে কোন অবিশ্বাস নেই, সে প্রতিদিন রোদ, জল, ঝড় সমস্ত কিছুকে উপেক্ষা করে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায় দিনের  পর দিন পাগলের খোঁজ নিতে। দেবতা কৃপা করবেন না, তা কি কখনও হতে পারে!
গ্রামবাসীরা তাঁকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। যাক, একজন তাহলে পাগল  হয়েছে, দেবতার মাহাত্ম্য কি মিথ্যা হতে পারে!  
গল্পের শেষে চমক তো আছেই, সঙ্গে আছে দেবতার প্রতি অন্ধবিশ্বাস নামক অতি পরিচিত আমাদের সমাজের কুসংষ্কারের বাস্তব ছবিটি।


তৃতীয় গল্পটি হল
তাজমহল।

প্রেমের অপূর্ব উদাহরণ এই গল্পটি। এক অতি বৃদ্ধ মুসলমান ভদ্রলোক
, তাঁর স্ত্রীকে কোলে নিয়ে হাসপাতালে লেখকের কাছে নিয়ে আসেন চিকিৎসার জন্য। কিন্তু রোগিণীর শরীরে রোগের এত দুর্গন্ধ যে হাসপাতালে  তো নয়ই, হাসপাতালের বারান্দাতেও তাকে স্থান দেওয়া গেল না অন্যান্য রোগীদের আপত্তিতে। তাঁর মুখের একটি দিক সম্পূর্ণ গলে-পচে গেছে। সেই পচনের ফলে এই দুর্গন্ধ। শেষ পর্য্যন্ত হাসপাতালের সামনে এক গাছের তলায় সেই বৃদ্ধ তার স্ত্রীকে নিয়ে রইলেন। লেখক তাঁকে রোজ দেখে আসেন, ইঞ্জেকশন দিয়ে আসেন। একদিন হাসপাতালে ফিরবার পথে প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে তিনি দেখেন সেই বৃদ্ধ তাঁর শতছিন্ন চাদরের একটি খুঁট ধরে রেখে তাঁর স্ত্রীকে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাবার চেষ্টা  করছেন।  লেখককে দেখে জিজ্ঞাসা করেন তিনি বেঁচে উঠবেন কিনা। স্বভাবতঃই চিকিৎসক লেখক তাঁকে জানিয়ে দেন বাঁচার কোন আশা নেই।
কয়েকদিন পরে তিনি দেখেন হাসপাতালের সামনে মাঠে সেই বৃদ্ধ ইঁট দিয়ে কিছু গাঁথার চেষ্টা করছেন। জিজ্ঞাসা করলে জানান, এটি তাঁর স্ত্রীর কবর, তিনি মারা গেছেন। লেখক জিজ্ঞাসা করলেন সেই বৃদ্ধের নাম কি? উত্তর এল---শা-জাহান।
এই যে প্রগাঢ প্রেম, এও তিনি দেখেছেন মানুষের মধ্যেই। তা আছে বলেই এখনও সুখ আছে, এখনও জীবন এত আনন্দময়।


তাঁর বিখ্যাত ছোটগল্প
নিমগাছদিয়েই আলোচনা শেষ করি। গল্পের আয়তন যেমন ছোট, অনুভূতিতে তেমনই বড় এ কাহিনী।
আগাছার মধ্যে জন্ম নিয়েছে এক নিমগাছ। অযত্ন, অবহেলায় সে বেড়ে উঠেছে। কিন্তু তার ফল ভোগ করছেন সকলেই। কেউ তা থেকে দাঁতন করছেন, কেউ পাতা ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছেন, কেউ বা ডাল কেটে কাজে লাগাচ্ছেন। শুধু একদিন একজন এসে গাছটির দিকে তৃপ্ত নয়নে তাকিয়ে রইলেন। গাছটির ফুল, ফল, সবুজ পাতা সবই তাঁর ভাল লাগল। গাছটির মনে হল, যদি তাঁর সঙ্গে চলে যাওয়া যেত! কিন্তু তা কি করে সম্ভব, তার শিকড় যে ভিতরে ভিতরে অনেকদূর চলে গেছে, আর কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। গল্পটি যদি এখানেই শেষ হত, আমরা খুব অবাক হতাম না কিন্তু গল্পের শেষে বনফুল লিখছেন, এই নিম গাছটি ঠিক যেন ওবাড়ির বৌ টির  মত। চমক এখানেই।
অযত্ন, অবহেলা যাই হোক, সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের বৌ দের থাকতে হয়, হবে  সংসারের  বেড়াজালের মধ্যেই, কোথাও তার যাবার জায়গা নেই। এ যেন মনের ভিতরে ঢুকে গিয়ে চরিত্রের বর্ণনা। এই জন্যই তিনি অন্যতম সফল ছোটগল্পকার হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।    

একাধারে চিকিৎসক, কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার ও বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পকারকে আমার অন্তরের শ্রদ্ধা তাঁর জন্মদিনে।

অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী



মিকি-সৃজন

     সাড়ে তিন বছরের সৃজন পাক্‌কা সন্ত্রাসবাদী হয়ে উঠেছে। ঠাম্মা-দাদু, মা-বাবাকে সে রাতদিন সন্ত্রস্ত করে রাখে। তরল যা কিছু – জল থেকে শুরু করে সাবানগোলা, হাতের নাগালে পেলে সে মেঝেতে ঢালবেই। তার ভাষায় ‘শুকনো পাতা’ – যেমন দাদুর ডাইরি লেখার সাদা পাতা, বাবার হিসেবের খাতা, বিছানার সাদা চাদর, ঘরের দেওয়াল বা মেঝে, কিংবা দাদুর খোলা পিঠ, - দেখতে পেলেই তাতে রঙ-পেনসিল দিয়ে ছবি সে আঁকবেই। বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে নিমেষেই সে ‘ছোটা ভীম’ হয়ে বাধাদানকারীকে আক্রমণ করবে।

     এসব দুষ্টুমি সৃজন করে না কিন্তু। সব করে মিকি। সৃজনের তিন সঙ্গীর একজন হল মিকি। অন্য দু’জন ভলু আর ডগি। তিনজনের মধ্যে মিকিই হল একমাত্র ভিলেন। সারাদিনে দাদু, ঠাম্মা আর মাকে অন্তত একবার করে সে মিকির যাবতীয় সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মের খতিয়ান শোনায়। মিকি মেঝেতে সাবানজল ফেলে রেখেছিল বলেই না আছাড় খেয়ে মায়ের পায়ে লাগল! কাজেই মিকির শাস্তির ব্যবস্থাপত্রে কাউকে না কাউকে স্বাক্ষর করতেই হয়। তবে মিকিকে জঙ্গলে ফেলে দেওয়া হবে, নাকি অন্ধকার ঘরে ‘আউল’-এর কাছে ছেড়ে দেওয়া হবে সেই চরম সিদ্ধান্তটি শেষ পর্যন্ত সৃজনের ইচ্ছানুসারেই নিতে হয়। ছবি এঁকে দেওয়াল নোংরা করার জন্যে মিকিকে কী শাস্তি দেওয়া হবে সেটা সে অনির্দেশ্য কোন ব্যক্তির সঙ্গে ফোনালাপ করেই ঠিক করে। মিকির হাত থেকে কীভাবে সে ভলু আর ডগিকে রক্ষা করবে, সেই দুশ্চিন্তার সাতকাহন তার দাদুকে মনোযোগ দিয়ে শুনতেই হয়। বেলনা ছুঁড়ে ঠাম্মার মাথায় আলু করে দেওয়ার পর তাতে কাল্পনিক ওষুধ সৃজনকেই লাগাতে হয়। মিকি সেটাও পারে না কিনা! 

     কাল রাতে শুতে যাওয়ার সময় দাদু দেখলেন, ভলু, ডগি আর মিকি তার বিছানায় শুয়ে আছে। সকালে উঠেই তিনি সৃজনের কাছে অভিযোগ জানালেন, -- দাদুভাই, তুমি মিকিকে আমার বিছানায় কেন শুইয়েছিলে? রাত্তিরে হিসি করে আমার বিছানা ভিজিয়েছে ও। 

খুব সুন্দর একটি হাসি মুখে এনে সৃজন বলল, -- যাঃ – মিকি তো হিসি করতেই পারে না।
যে এত সব করতে পারে, সে হিসি কেন করতে পারে না – সৃজনের সেই মনোহর হাসিটি দুচোখ ভরে দেখতে দেখতে সেই প্রশ্নটি করতেই ভুলে গেলেন দাদু।   

দময়ন্তী দাশগুপ্ত



কফি হাউস এবং ভালোবাসার গল্প

কফি হাউসের টেবিলে ওরা মুখোমুখি বসে। লীনা আর রবিউল। চিকেন ওমলেটে গোলমরিচ ছড়িয়ে দেয় লীনা। ছুরি-কাঁটাটা নাড়তে নাড়তে রবিউল বলে, আমি যে জায়গাটায় থাকি সেটা একটা চড়া বুঝলেন দিদি। আশপাশে সব জেলেদের ঘর। ওখানে জেলেরা সব হিন্দু। বড় গরীব জানেন ওরা। অল্পবয়সে একটি মেয়েকে ভালোবাসতাম আমি। অনু হিন্দু ছিল। তাই আমাদের বিয়া হয় নাই। জানেন তো হিন্দু-মুসলমান। ওর এক জেলের সঙ্গে বিয়া হয়েছিল। দুই ছেলেমেয়ে। বড়টা ছেলে সে বাপের সঙ্গে মাছ ধরতে সমুদ্রে যায়। ছোটটা মেয়ে। ওর খুব অসুখ করেছিল জানেন। আমার এক বন্ধু খবর দিল যে আমাকে দেখতে চায়। বুঝছেন তো ছোটবেলার ভালোবাসা। মারা যাওয়ার সময় মেয়েটারে আমাকে দেখতে বলে গেছে। আমি তারে নিয়ে এসেছি। বোনের বাসায় থাকে। আমার বোন, ইস্কুলের টিচার। অনুর মেয়েটা এখন ক্লাস ফোরে পড়ে, চতুর্থ শ্রেণী। আমি মাঝে মাঝে যাই, দেখে আসি। অনুরে নিয়ে আমি একটা গল্প লিখেছি, আমার প্রথম গল্প। পড়ে দেখবেন দিদি।

আপনাদের এখানে হিন্দু-মুসলিম বিয়ে হয়? ‘হয়, আবার হয় নাও।  রফিকুলের ঘটনাটা জানেন তো? তবে ওটার ওপর ধর্মের প্রলেপ দেওয়া হয়েছিল। ক্লাস ডিফারেন্সটাই আসল কারণ – বড়লোকের মেয়ে আর গরীবের ছেলে। ছেলেটাকে খুনই করে দিল মেয়ের বাবা।’

কফির মধ্যে চামচটা নাড়তে নাড়তে অন্যমনস্ক গলায় লীনা বলে, ‘আমার গল্পটা একটু অন্যরকম। ছেলেটি আমার ক্লাসমেট তহমীনার ভাই। আমি তাকে নিজের ভাইয়ের মতোই দেখেছিলাম। সে নাকি একটি হিন্দু মেয়েকে ভালোবাসত। ডাক্তারের মেয়ে, বড়লোক। সম্পর্ক শুরুতেই শেষ আর কী। তাকে নাকি আমার মতো দেখতে, তহমীনা বলেছিল। যোগাযোগ ছিল, আমার বিয়ের পরেও। বুঝেছিলাম আসলে ও আমাকে ভালোবাসত, শুধু মুখেই দিদি বলতো। এরকমটা হতেই পারে। বিয়ে করতে বলেছিলাম অনেকবার। কী অদ্ভুত যুক্তি, মুসলীম মেয়েরা নাকি হিন্দু মেয়েদের মতো হয়না। শেষে এমন কিছু আচরণ করতে শুরু করেছিল, বাধ্য হয়ে ওকে চলে যেতে বলেছিলাম। আমার খুব খারাপ লেগেছিল জানেন? ওর ধারণা মুসলমান বলেই এই ব্যবহারটা করেছিলাম। মানুষ কত সহজে ধর্ম নিয়ে আসে সমস্তকিছুতে।’

কথার মধ্যেই ফোন আসে রবিউলের। ফোনটা নামিয়ে রেখে হাসিমুখে বলে, উত্তরপাড়ায় আমি যাদের বাড়িতে উঠেছি। সুবীর বসু। ভারী ভালো মানুষ। ফেসবুকে আলাপ। এখন এদেশে এসে ওনাদের বাড়িতে না উঠলে ভারী রাগ করেন। আজ ঈদ তো বিরিয়ানি-মাংস রান্না করেছেন। তাড়াতাড়ি ফিরতে বলে দিয়েছেন বারবার করে।

দুটো কফি আর চিকেন অমলেটের দাম দিয়ে ওরা উঠে যায়। আর দুটি ছেলে-মেয়ে ওই চেয়ারে এসে বসে।

ভালোবাসার আরেকটা কোনও গল্প শোনায় তারা পরস্পরকে।