গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৮ জুলাই, ২০১৬

তাপস মৌলিক



দোকানদারি


    বাসরাস্তার মোড়ে রতনদার চা-দোকানের পাশেই ছিল সুনীলের পান-বিড়ি-সিগারেটের গুমটি। অফিস যাওয়ার সময় রতনদার দোকানে চা খেয়ে, সুনীলের দোকান থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়াতাম। ফিরেও একইরকম চা-সিগারেট। তখন সুনীলের সঙ্গে খানিক গল্পগাছা হত, বিষয় ক্রিকেট। সুনীল ছিল সৌরভের ফ্যান, আমিও। আড্ডা জমে যেত। হাসিখুশি সরলসিধে ছেলে সুনীল। বাজারের সমস্ত দোকানি আর বাঁধা খরিদ্দারদের সঙ্গেই চলত তার খোশগল্প, প্রত্যেকের খোঁজখবর রাখত সে।
    তারপর রিষড়ার পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে টালিগঞ্জে নিজস্ব ফ্ল্যাটে গেলাম। মাসে-মাসে বাড়ি আসি, শনি-রবি রতনদার দোকানে যাই, সুনীলের সঙ্গেও গল্পসল্প হয়।
    হঠাৎ একবার দেখি সুনীলের দোকান বন্ধ। রতনদা বলল, তার মুখে ক্যানসার হয়েছে, এলাকার দোকানিরা চাঁদা তুলে তাকে বম্বের হাসপাতালে পাঠিয়েছে।
    সুনীলদের সংসার যে কায়ক্লেশে চলে জানতাম। ওর বাবা চটকলে কাজ করতেন, মারা গেছেন বহুদিন। বাপের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকায় সুনীলের মা তাকে এই দোকানটা বানিয়ে দেন। তবে মা নাকি সুনীলকে দু’চক্ষে দেখতে পারেন না। আগে ঠিকঠাকই ছিল, সুনীল এক নিচু-জাত বস্তির মেয়েকে বিয়ে করে আনায় মায়ের যত রাগ। সুনীলের রোজগারেই সংসার চলে, তাই কিছু বলতেও পারেন না, মুখ বুঁজে ছেলে-বৌয়ের সঙ্গেই আছেন।
    পরেরবার সুনীলের সঙ্গে দেখা। জিভের অর্ধেকটা অপারেশনে বাদ গেছে, মুখে কাপড়ের একটা মাস্ক, কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। তবে বরাবরের মতোই হাসিখুশি। শুনলাম এক্ষুনি আর ভয়ের কিছু নেই, নিয়মিত চেক-আপ করালেই চলবে।
    মাসখানেক পর ফের দেখি দোকান বন্ধ। সুনীল নাকি সুইসাইড করেছে। আমি হতবাক! গেলবার দেখে তো সেরকম কিছু ঠাহর হয়নি! তবে খেয়াল হল, তার চোখে এক অদ্ভুত শূন্যতা দেখেছিলাম।
    রতনদা বলল, সুনীলের একটা অপোগন্ড ভাই আছে, মায়ের ন্যাওটা। মা ছোটোছেলেকে দোকানটা লিখেপড়ে দিয়েছে। সুনীলকে বলেছে, “তুই তো মরেই যাবি, তোকে আর দিয়ে কী হবে?”
    দু’দিন পরেই সুনীল আত্মহত্যা করে। বৌটা বাপের বাড়ি চলে গেছে।
    ফের দু’মাস বাদে বাড়ি গেছি। অভ্যেসমত সুনীলের গুমটি থেকে সিগারেট কিনে রতনদার দোকানে ঢুকেছি, রতনদা হাঁ হাঁ করে উঠল, “তুমি ওখান থেকে সিগারেট কিনলে?”
    “কেন? কী হয়েছে?”
    “ও দোকান সবাই বয়কট করেছে, পাড়ার কেউ কিচ্ছু কেনে না।”
    তাকিয়ে দেখি, সুনীলের ভাইটা চুপচাপ বসে আছে। দোকান যে একেবারেই চলে না দেখে বোঝা যায়। সুনীলের মা শুনলাম ঠোঙা বানানো ধরেছে, তবে এ এলাকায় ওর ঠোঙা কেউ কেনে না।
    বছরখানেক পরে একদিন দেখি, বিবর্ণ দোকানে ভাইটা সেই একভাবে বসে আছে, চোখের দৃষ্টিতে হা-হা শূন্যতা, যা একদিন সুনীলের চোখে দেখেছিলাম।
    পরের মাসে গিয়ে দেখলাম, দোকান বন্ধ।