গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৬

সুকান্ত পাল

রূপাই

         আশার হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। দুইপাশে ছেলে আর মেয়ে —অভ্যস্ত সে। রূপকের চলে যাওয়া বেশ কয়েকদিন হল। যাওয়ার আগে পরপর তিন চারদিন তেমন কিছুই খায় নি সে শুধু মদে ডুবে থাকত —কি যে হয়ে ছিল জিজ্ঞেস ও করে নি।কি লাভ জিজ্ঞেস করে, শুধুই কথা কাটাকাটি ঝগড়া পাড়া-প্রতিবেশীও অতিষ্ঠ হয়ে গেছিল। আশে পাশে অনেকের সাথেই তো ঝগড়া। প্রায় প্রতিদিন স্বামী-স্ত্রী ঝগড়া মারামারির পর্যায়ে চলে যেত রাত ১২টা -১টা কোন ঠিক নেই।

    আশা যেন একটু শান্তি পেল লোকটা মরে যাওয়াতে। একটু অন্তত: ঘুমোতে পারবে নিরিবিলিতে। কানাঘুষোতে শোনা যায় আশায় নাকি রূপককে জোর আঘাত করেছিল তাই বুকে ব্যথা লেগে মারা গেছে। পরিকল্পনা করে মা ও মেয়েতে রূপককে মেরে ফেলেছে। কেউ কেউ আবার বলে দিন-রাত এরকম ঝগড়া করলে কখন করবে পরিকল্পনা, তাছাড়া কোন মেয়ের পক্ষে স্বামীকে মেরে ফেলা কি সহজ। অবশেষে যে যার কাজে মন দেয়। ভুলে যায় সব কিছু। সেদিন অনেক লোকের ভীরে কথা ওঠে। অতিষ্ঠ আশা একটু নিরিবিলি খোঁজে। সন্ধ্যায় হ্যারিকেনটা নিভে যায়— তেল নেই। প্রতিদিনের ন্যায় অন্ধকার নামার সাথে সাথেবিদ্যুৎ চলে গেছে। ছবি মাসী হ্যারিকেনটা নিয়ে গিয়ে তেল ভরে নিয়ে আসে। এমনিতে চাইলেও কোন দিন একফোঁটা তেল দেয় না সে। যাত্রীরা একে একে ফিরে এসে নিজের নিজের ঘরে চলে যায়। শ্মশানে খাবার এর জোগাড় ভাল ছিল না। তাছাড়া তরল সোমরস না থাকলে শ্মশানের মজায় মাটি।
    আজ ঘুম থেকে উঠে হঠাৎ মাটির কোঠাতে একটা ভগ্ন বাক্সের দিকে চোখ যায় আশার। শাশুড়ির বিয়ের বাক্স। তার স্বামী ছাড়া কেউ হাত দিত না। সেমাঝে মাঝে কিছু কাগজ নিত ও রাখত । পয়সা থাকত না কোনোদিন না হলে দশটা টাকার জন্য তার সাথে ঝগড়া কেন করবে। চপ-মুড়ি বেচে যে টাকাটা কামাত মদেই খরচ করে খালি হাতে প্রায় ঘরে আসত। সপ্তাহের চাল ডাল আর তরকারী সব বাকীতে। মেটাতো কখনও কখনও। দুধ বিক্রি করে, মুড়ি ভেজে আশায় মেটাতো অনেকটা।

    কিন্তু রূপক প্রথম প্রথম খুব ভালবাসত তাকে। মেলা ঘুরতে নিয়ে যেত। সুযোগ পেলে হাতটা চেপে ধরত। আদর করে তাকে রূপাই ডাকত। শহরে সিনেমা দেখতে যেত কখনও কখনও। সেই সব দিন ভুলেই গেছে আশা। লোকটাই তো আর নেই। সেবার দীঘা থেকে ফিরে আসার সময় হোটেলের ম্যানেজার ফোন নাম্বার দিয়েছিল। পরে যদি আসেন ফোন করে আসবেন ভাল রুম রেখে দেব। কি আনন্দই না করেছিল দীঘাতে তিনদিন তিনরাত সমুদ্র দেখা, হোটেলে থাকা আর দুজনে ঘোরা।

    তারপর প্রথম মেয়ে, দুবছর পরে ছেলেটা। শারীরিক আর মানসিক কোন চাহিদা আর নেই। ছেলেমেয়ে নিয়ে আশার প্রায় অন্য এক সংসার। ওদিকে রূপক প্রায় একা। কাজ থেকে ফিরে চুপ করে খেয়ে শুয়ে পড়ত সে। আশার কাজ সেরে বিছানায় যেতে যেতে তার নাক ডাকার আওয়াজ। আস্তে আস্তে দূরত্ব যত বাড়তে থাকে রূপকের অন্যদিকে আসক্তি বাড়ে। মদ, গাঁজা এমনকি পাড়ার এক ছেলের মুখে অন্য এক হোটেলওয়ালীর প্রতি আসক্তির কথা শুনে ঘৃণায় আর রাগে আরও দূরে সরে যায় আশা। রূপক খুব নিচে নেমে গেছে।

    বাক্সটাতে ধুলো জমে আছে। অজানা উৎসাহে কোনরকমে টেনেঝেড়ে-ঝুরে খুলে ফেলল। একটা পাশবুক, একটা কাগজের টুকরো তাতে বাংলায় লেখা আছে “প্রধানমন্ত্রী বিমা যোজনা” ৩৩০ টাকা বাৎসরিক কিস্তিতে ২ লাখ টাকা পাবে পরিবারের বাকী সদস্য, LIC এর কিছু কাগজপত্র।

    আর একটা ছোট চিরকুট সেই দীঘার হোটেলের ফোন নম্বর। তখন ফোন ছিলনা রূপকের। বাবার দেওয়া ফোনটা আশা নিজের কাছেই রাখত। আর একটা ফটো আশার বিয়ের আগের — চেয়ে পাঠিয়েছিল দেখাশোনার সময়। বিয়ের পর কোনদিন দেখেনি এ-বাড়িতে ছবিটাকে। ছবির পিছনে লেখা ছোট্ট কবিতা—

“রূপাই আমার নদীর মত
কল্লোলিনী গতি
রূপাই আমার হৃদয় জুড়ে
আঁধার ঘরে জ্যোতি।”

ছলছলে চোখে —গতিহীন রূপকের রূপাই—অন্ধকার চোখে তাকায় শূন্যতায়। ঘরটা ঘরই আছে জ্যোতিটাই ফিকে হয়ে গেছে।