মালতীর মা একসময় তরুণ যুবক
শান্তদের বাড়িতে কাজ করত । বাড়ি ছিল তার ওপার বাংলার পাবনায় । কিন্তু দেশভাগের সময়
সর্বস্বান্ত হয়ে পশ্চিমবাংলায় চলে আসে পরিবার সহ । তারপর অনেক বছর গেছে । একে-একে
স্বামী আর মেয়ে তার জীবন থেকে একেবারে সরে গেছে । কিন্তু পাবনা আর পাবনার মানুষকে
সে কখনো ভুলতে পারেনি । বিশেষ করে তার চেনা-জানা আশেপাশের পাশের মানুষদের কথা
শান্তদের বাড়িতে কাজ করতে করতে ভেবেই গেছে । ভাবতে ভাবতে তার দু’চোখ জল ভরে
এসেছে বারবার । কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছে আবার সে কাজ করতে শুরু করেছে ।
এক বছর পাবনায় খুব বন্যা হয় । বহু
মানুষ আর গবাদি পশু জলের স্রোতে ভেসে যায় । অনেকের ঘর-বাড়ির খুব ক্ষতি হয় । সে খবর
চলে আসে মালতীর মায়ের কানে । আবার সে বেতারেও শোনে । শুনে তার মন খুব খারাপ হয়ে
যায় । একদিন কাজ বন্ধ করে একা-একা কাঁদতে থাকে । মনে পড়ে যায় তার কত চেনা মুখ ।
মনে পড়ে ঘর-বাড়ি আর পুব-দুয়ারি সিঁদুরে আমগাছের কথা । চোখের সামনে তার ভাসে রসুল
করিমের ছেলের মুখ । রসুল করিম একদিন উৎখাত করেছিলো তার পরিবারকে বাসস্থান থেকে ।
তবু তার ছেলের মায়াবী মুখটা সে ভুলতে পারেনি । মনে পড়ে তার মাঝিপাড়ার আমিনার কথা ।
আমিনার সঙ্গে সে একদিনবন-বাদার ঘুরে কত খেলে বেড়িয়েছে । আরও কত স্মৃতি মালতীর মার
কান্না-ঝাপসা চোখের সামনে ভাসতে থাকে ।
তরুণ যুবক শান্ত মালতীর মাকে
কাঁদতে দেখে খুব অবাক হয় । ওর মনে হয়,এ কোন বন্যার জন্য সে কাঁদছে ? প্রথম বন্যা
তো দেশভাগের যন্ত্রণা । তার কাছে ছুটে যায় । কান্নার কারণ জেনে আকাশ থেকে মাটিতে
পড়ে শান্ত । ও তাকে বলে,’’এ বাংলাতেও তো বন্যা হয়েছে । বহু
মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত । আর এখন এ বাংলাই তোমার দেশ । এখানেই তো তোমার পরিচিতি । তবে
কাঁদো কেন শুধু-শুধু ?’’ মালতীর মা শান্তকে চমকে দেয় বলে,’’আমি তো
বিদেশের মাটিতে পড়ে আছি । এমন কপাল আমার । কিছুই ভালো লাগে না । চলে যেতে মন চায় ।
কিন্তু সে আর বুঝি সম্ভব নয় ।‘’ তার আরও কথা শুনে যারপরনাই
বিস্মিত শান্ত । মালতীর মা খুব দরদী মানুষ । তাই সস্নেহে শান্তকে বলে,’’আমার এ মাথার
যত চুল,সেই হিসাবমত বেঁচে থাকো । কিন্তু আমাকে পাবনার কথা ভুলিয়ে
দিতে চেয়ো না,সোনা আমার ।‘’
শান্ত গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে
মালতীর মার কাছে থেকে উঠে আসে । তারপর ও ওর বন্ধু মিলনকে একটা চিঠি লিখতে বসে
মালতীর মার ব্যাপার নিয়ে । ও লিখতে থাকে আনমনে । লিখতেই থাকে বিরামহীনভাবে । লিখতে
লিখতে শান্তর চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে । মালতীর মার প্রতি শ্রদ্ধায় বারবার মাথা
নত হয় ।
শান্ত লেখে বন্ধু মিলনকে,’’যে বিশ্বাসে
পাখী বাসা গড়ে,যে বিশ্বাসে মা তার শিশুকে কোলে নেয়, তেমনি
বিশ্বাস মালতীর মার তার ফেলে আসা দেশের প্রতি ।‘’ আবার শান্ত
লেখে,’’মালতীর মার দুর্জ্ঞেয় জগতকে বোঝা আমার কম্ম নয় রে । পুঁথিগত
বিদ্যা এর কাছে তুচ্ছ । কত বলেছি তাকে । কিন্তু বারবার সেই এক কথা তার,পাবনাই আমার
দেশ । এ দেশে পড়ে আছি নামমাত্র ।‘’ শান্ত একটু থামে । আবার শুরু করে
।
‘’আশ্বিনের প্রখর আকাশের মতো মালতীর
মার বুক জুড়ে আছে সে দেশের অপরিমেয় আলো । আমরা তার কী বুঝি ? আমরাও তো
আমাদের দেশকে ভালোবাসি । দেশের জন্য আমরা গর্বিত । কিন্তু দেশপ্রেম কি ওতপ্রোতভাবে
মিশে আছে আমাদের সারা সত্তায় তার মতো ? মনে হয় তো না । কার মধ্যে দেশের
ধূলি-কণা সোনার মতো জ্বলজ্বল করে ? সেই একজন । দুখিনী মালতীর মা ।‘’
শান্তর মন তারপর থেকে অশান্ত হতে
শুরু করে ওর দেশপ্রেমের সঙ্গে মালতীর মার দেশপ্রেমের তুলনা করতে গিয়ে । তারপর আর
কলম চলতে চায় না । ও থেমে যায় । এরপর বাইরে বেরিয়ে এসে চোখে-মুখে জল দিয়ে উঠোনে
চেয়ার নিয়ে বসে মুক্তো-বাতাসে বুকের বদ্ধভাব দূর করার জন্য ।