গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৬

পলাশ কুমার পাল

    জাতীয়তা

                                                   

'বন্দেমাতরম্! বন্দেমাতরম্!...' ধ্বনি শুনেই বীরেনবাবু ঘরের জানলা দিয়ে বাইরে চোখ মেললেন।
স্বাধীনতা দিবস স্মরণের জন্য গতকাল রাত থেকে স্থানীয় রাজনৈতিক কার্যালয়ে প্রস্তুতির যে গুঞ্জন শুনেছিল, সকালে তার নিদর্শন দেখে বীরেনবাবু একটু থমকে গেলেন। সজ্জিত জাতীয় পতাকার মাঝে মাঝে সেই রাজনৈতিক দলের পতাকা।
ষাটোর্দ্ধ প্রাক্তন শিক্ষক বীরেনবাবু স্বাধীনতাকে অন্তর থেকে উপলব্ধি করেন। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর এই হেন স্বাধীনতা উপলব্ধিকে মুখোশী বলে তাঁর মনে হয়। দলে দলে ভাগ হয়ে কি স্বাধীন থাকা যায়? আদর্শবাদী বীরেনবাবুর মতে মানুষে মানুষে একাত্মতা ও ভালোবাসাই হল স্বাধীনতা। তবু বলার কিছু নেই। তিনি যে এই অঞ্চলের নতুন ভাড়াটে।
এইদিকে 'বন্দেমাতরম্' ধ্বনিতে পতাকা উঠছে ক্রমশ। বৃত্তাকার ভিড়ের মধ্যে হঠাত্‍ 'বন্দেমাতরম'-এর বদলে উচ্চারিত হল 'মায়াদেবী জিন্দাবাদ'
মায়াদেবী বর্তমান শাসক দলের প্রধান নেত্রী। এক ব্যক্তির কণ্ঠস্বরে উপস্থিত সকলের সুর মিলে গেল। 'বন্দেমাতরম্'-এর সাথে সাথে 'মায়াদেবী জিন্দাবাদ'ও উচ্চস্বরে ব্যঞ্জিত হতে থাকল।
না! বীরেনবাবু আর ঘরে থাকতে পারলেন না। তিনি বাইরে বেরিয়ে এলেন।
"এই, তোমরা কী করছো? বন্দেমাতরমের বদলে এইসব?"

সকলে বীরেনবাবুর দিকে তাকালেন। হঠাত্ই এইরূপ প্রশ্ন যেন কারোর বোধগম্য হয়নি। পতাকার দড়িটা বেঁধে স্থানীয় পৌরসভার চেয়ারম্যান রতনবাবু জুতো পায়ে পতাকা উত্তোলনের বেদী থেকে নামতে নামতে বললেন, "এরই নাম স্বাধীনতা।"
"আপনি জুতো পায়ে...?"
"ঐ যে বললাম। তবে, আপনি কে হে মশাই? ফটফফট করছেন! পরনে পোশাক নেই, পায়েতে জুতোও নেই!"
"জুতো থাকলে এই প্রশ্নটাও করা হত না হয়তো!" বীরেনবাবু ভয়শূন্য চিত্তে বলে উঠলেন। আজকে তিনি যেন এই রাজনৈতিক দলের ক্রুটিটাকে সংশোধন করে তবেই ছাড়বেন। নতুন এলাকায় আসার পর রতনবাবুর অনেক কুকর্মের কথা শুনেছেন। তবু...
"আপনি দাদাকে অপমান করছেন!" জমায়েতের মধ্য থেকে কয়েকজন প্রভুভক্ত ঘেউ ঘেউ করে উঠল।
"আমি কাউকে অপমান করছি না। ভুলটা সংশোধন করতে..."
বীরেনবাবুর কথা শেষ হওয়ার আগেই অজ্ঞাত পরিচয় ষণ্ডামার্কা সেই লোকগুলো হুমকির সুরে জানিয়ে দিল, "আপনি এই এলাকায় নতুন। ভুল বা ঠিক যাই ঘটুক, আপনি চুপ করে থাকবেন! এই এলাকায় সবাই নীরবই থাকে। তাছাড়া আপনার তো একটা মেয়ে আছে না?"
লোকগুলোকে 'উলঙ্গ রাজা'র স্তাবকের মতো মনে হল বীরেনবাবুর। তবু তিনিও চুপ করে গেলেন। তিনি বুঝলেন এদেরকে এইভাবে বোঝানো সম্ভব নয়। তাছাড়া তার তো একটা মেয়ে আছে।