গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২ আগস্ট, ২০১৬

শ্যামশ্রী চাকী

কাজলির গল্প

হিমতাবাড়ী থেকে দেড় মাইলের হাঁটা পথ,তারপর বাস রাস্তা ধরে একটু এগোলে ইস্টিসন, দুপুর বারোটায় টেরেন ধরলেই রাতের আন্ধারে বাড়ি।


হাঁস আর মুরগী মিলে খান তিনেক ওই বেতের ঝাঁকায় আর কাপড়ের পুঁটুলিতে সীতাভোগ চিড়া, এই হল পুঁজি। মাথার কাপড়টা তুলে হনহনিয়ে হাঁটাদেয় কাজলি।

ঘর থেকে বেরোনোর সময় মেয়েটা কটা মুড়ি বেঁধে দিয়েছে। তাড়াহুড়োয় ক্ষিদের কথা ভুলে গিয়েছিল কাজলি, এখন পেটে বড্ডো চাগাড় দিচ্ছে। সাঁকোটা পেরোতেই বুড়ো বটগাছটার ছায়ে বসে দুগাল মুড়ি চেবায় কাজলি, সামনের দীঘিতে কাকেরচোখ পানা জল। হঠাৎ মোটরসাইকেলের শব্দ, মাথায় লোহার টুপি তাও মুখটা চেনা চেনা ঠেকে। ঘ্যাচাং করে সাইকেল থামে  কাজলির বোঁচকার সামনে। রায়বাড়ির লালচুলো ছেলে; 'কি রে কাজলি একা কেন রে?'আঁচলটা টেনেটুনে বসতেই এবারে আরো অনেক মোটর সাইকেল ভোঁ ভোঁ করে তেড়ে আসে। 'টা ঠিক মত গুনতেই হাতের মুড়ি ছিটকে যায়।


সন্ধ্যের আকাশটা বড়ো অচেনা ঠেকে কাজলির, বটগাছের পাখপাখালি  বাসায় ফিরে ডানা ঝাপটায়। ছেঁড়াখোঁড়া শাড়িটায় চাপচাপ রক্ত, সারাগায়ে বিষ বেদনা। বিলের জল নিকষ কালো, হাঁসটা ছাড়াপেয়ে  প্যাঁক প্যাঁক করে সাঁতরাচ্ছে। মুরগীদুটো কোথায় কে জানে।


শিয়ালের মত রাতটা ওত পাতে। দূরে একটা হৈ হৈ শব্দ ভেসে আসে টর্চের আলো দেখতে পায় কাজলি, ক্লান্ত মাথা কাত করে ঘুমিয়ে পরে।

আজ সাতদিন হাসপাতালে কাজলি। ছুটি হয়েই যেত, পার্টির বাবুরা বলেছে মটকামেরে থাক। ডাক্তার আসে ওষুধপাতি দেয়। এবেলা মুর্গীর ঝোল আর ভাত ওবেলা রুইএর দাগা। সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী পরা বাবুরা নিয়ম করে ফল দিয়ে যায়। ফলগুলো বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় কাজলি, কচি দুটো খাবে। মাঝে দুদিন পুলিশ এসেছিল, কি বলতে হবে বাবুরা শিখিয়ে দিয়েছে।

গড়গড়িয়ে সেসব বলেছে কাজলি, এতটুকু ভুলচুক হয়নি। কজন মেয়েছেলে মাঝে মাঝে আসে ওকে দেখে মুখটিপে হাসে। আগে গায়ে লংকাবাটার মত লাগলেও এখন সে সব গা সওয়া হয়ে গেছে কাজলির। বরটা একদিন বলে পাড়ায় অকথা কুকথা রটছে কাজলি যেন কান না দেয়। কচিদুটোর খবর জানতে চায় কাজলি। বরটা কোন উত্তর দেয়না বরের গায়ে নতুন জামা,পায়ে রাবারের চটি মসমস করে।পাখিপড়া করে বোঝায়, সেদিন রায় বাড়ির ছেলে গ্রামেই ছিলনা।কাজলি জানে কাজলি কাউকে দেখেনি, কাজলি মানে কাজলির ক্ষিদেপেটে একটা বিষফল গিলেছিলো, কাজলি বিশ্বাস করে ওর সাথে কোন অসৈরণ হয়নি। বড়োবড়োচোখে শুধু হাসপাতালের সিলিং ফ্যানের দিকে তাকায়।


দুদিন হল হাসপাতাল থেকে ফিরেছে কাজলি, শরীর জুতের নেই, মাথাটা টাল খায়।আজকাল ভাতের চিন্তা নেই কাজলিদের। দুপক্ষ থেকেই অনেক টাকা পেয়েছে। পাড়ার সবাই আড়েঠোরে কানাকানি করে কাজলিরা দেখেও দেখেনা। হাসপাতালের মত একটা পাখা ঝুলছে চৌকির ওপড়।কচিদুটোর নতুন জামা বই খাতা। বরটার একটা কাজও জুটেছে রায়দের মিলে। আজ টিভি কিনতে যাচ্ছে কাজলি ওর বরের সাথে নতুন সাইকেলে। এক পশলা বৃষ্টির পর আকাশ ঝকঝকে  শান্ত রাস্তায় ওরা দুজনাসাঁকোর সামনের রাস্তায় মোটরসাইকেলের শব্দে একলা মেয়ে চমকে তাকায় তার একহাতে হাঁসমুরগীর ঝাঁকা আরেক হাতে পুঁটুলি, বারোটার ট্রেন ধরতে যাচ্ছে।