প্রথম
প্রথম যেমন সব ছেলেরই সাইকেল চালানোটা নেশার মতো হয়ে যায়,
আমার ক্ষেত্রেও তাই ছিল। অথচ এমন কোন সাইকেল নেই, যেটা চালাবার সুযোগ পাওয়া যায়। ষষ্ঠীতলায়
অনুপ নামে একটা ছেলে ছিল। সে আমার প্রায় সমবয়সি হলেও,
কাছেই একটা ঘড়ির দোকানে কাজ করতো। সে একটা সাইকেলে চেপে
দোকানে যেত। খুব ছেলেবেলা থেকে সে সাইকেল চালাচ্ছে,
তাই সাইকেলের প্রতি তার তেমন কোন আকর্ষণ নেই। অনুপ আমাদের
পরিচিত ছিল। শেষে অনেক ভেবে তাকে সাইকেলের কথা বললাম। সে আমাকে বললো, দুপুরে সে সাইকেলটা নিয়ে আসতে পারে এবং
বিকেল পর্যন্ত আমি তাকে নিয়ে সেই সাইকেল চালাতেও পারি,
তবে এর মধ্যে তার দুটো শর্ত আছে। এক, সে নিজে সাইকেল চালাবে না। শুনে তো আমি
আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম। আর দ্বিতীয় শর্ত,
তাকে রোজ আইসক্রীম ইত্যাদি খাওয়াতে হবে। মরেছে, এখানেই তো ঝামেলা দেখা দেবে। রোজ রোজ
তাকে আইসক্রীম খাওয়াবার মতো পয়সা কোথায় পাব?
অন্য সময় হলে নাহয় অঞ্জনের দৌলতে রাধামোহনের কাছ থেকে বাকীতে
নিয়ে, তাকে
যত খুশী আইসক্রীম খাওয়াতে পারি, কিন্তু সাইকেল চালানোর সময়,
ঐ ভরদুপুরে রাধামোহনকে কোথায় পাব? কিন্তু এত কিছু ভাবতে গেলে সাইকেল পাওয়া
যাবে না। তাই রাজী হয়ে গেলাম। আশ্চর্য, আইসক্রীমের পয়সা নিয়ে এত ভাবনা হ’ল, অথচ
দুপুর বেলা সাইকেল চালালে স্কুলের কী হবে,
তা কিন্তু একবারও ভাবলাম না,
মনেও হ’ল না।
শুরু
হ’ল স্কুল পালানো। দুপুর বেলার
চড়া রোদে অনুপকে সামনে বসিয়ে, সাইকেল চড়া শুরু হ’ল। আইসক্রীমওয়ালা দেখলে, কাঠি আইসক্রীম খাওয়ানোও শুরু হ’ল। এর জন্য সুযোগ মতো পয়সা হাতানোও শুরু হ’ল। একদিন সাইকেল নিয়ে দু’জনে জগাছা দিয়ে গিয়ে, বম্বে রোড পর্যন্ত গেলাম। অসম্ভব গরম ও চড়া রোদে ঘেমে নেয়ে অনুপকে সামনের
রডে বসিয়ে, অকারণে
সাইকেল চালাচ্ছি। অনুপের সব থেকে বড় গুণ, সে কখনও নিজে সাইকেল চালাতে চায় না। বম্বে রোড থেকে আবার একই পথে ফিরে
কদমতলা হয়ে যোগমায়া সিনেমা হলের কাছাকাছি এসে দেখি,
একটা পাগলী রাস্তার মাঝখানে বসে আছে। তার পাশেই, সম্ভবত সে নিজেই, অনেকটা বড় বাইরে করে রেখেছে। অভিজ্ঞ অনুপ
আমাকে আগেই সতর্ক করে দিল। আমিও যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে পাগলীর কোন পাশ দিয়ে যাব, ঠিক করতে শুরু করে দিলাম। শেষপর্যন্ত
পাগলীকে দক্ষ হাতে কাটিয়ে চলে গেলাম বটে, তবে ঐ এক সের বড় বাইরেকে কাটাতে পারলাম না। ফলে সাইকেলের সামনের চাকায়, বস্তুটা মাখামাখি হয়ে গেল। রিম, স্পোক্,
টায়ার, সর্বত্র নারীবরে মাখামাখি। ঐ অবস্থাতেই কোন মতে আমাদের খেলার ছোট্ট
মাঠটায় এসে, পুকুরে
সাইকেল নামিয়ে, অনেক
চেষ্টায় সাইকেল পরিস্কার করা হ’ল। ঐ রোদে প্রায় চোদ্দো-পনের কিলোমিটার পথ ডবলক্যারী করে,
ঘেমে নেয়ে হাঁপিয়ে গিয়ে,
শেষপর্যন্ত যাত্রার পরিসমাপ্তি হ’ল।
একদিন
এক ভীষণ বিপদের সময় জানতে পারলাম, সাইকেলটা আদৌ অনুপের নয়, অনুপ যে দোকানে কাজ করে, সেই ঘড়ির দোকানের মালিকের সাইকেল। সেদিন সাইকেলটা আমি একাই চালাচ্ছি।
কথা ছিল বিকেলবেলা অনুপকে ফেরৎ দিয়ে দেব। দুপুরবেলা বাড়ির পাশের স্ল্যাব ঢালা রাস্তা
দিয়ে বেশ জোরে বড় রাস্তায় এসেই দেখি, ডান দিক থেকে একটা পুলিশের জীপ তীর বেগে এগিয়ে আসছে। ব্রেক কষলাম, সাইকেল দাঁড়ালো না। সাইকেলের কোন ব্রেকই
কাজ করছে না। আমাকে দেখে বিপদ বুঝে পুলিশের জীপ খুব জোরে ব্রেক কষে, তীব্র শব্দ করে, আমার সামনে জীপটা দাঁড় করিয়ে দিল বটে, কিন্তু আমি তীর বেগে সাইকেল নিয়ে গিয়ে
জীপে ধাক্কা মারলাম। সামনের চাকা ভয়ঙ্কর ভাবে বেঁকে গিয়ে,
টায়ার ফেটে গেল। জীপ থেকে দু’তিনজন পুলিশ নেমে, আমাকে খুব ধমকাতে শুরু করলো। দুপুরবেলা হলেও, অনেকেই ঘটনাটা দেখলো। জীপ চলে গেল বটে, কিন্তু আমি বোকার মতো সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে
রইলাম। সাইকেল চেপে যাওয়া তো দুরের কথা, টেনে নিয়ে যাওয়াও যাচ্ছে না। শেষে অনেক কষ্টে সাইকেলের দোকানে টেনে
নিয়ে গিয়ে, সাইকেলটা
সারাতে দিলাম। এত দিন পরে ঠিক কত মনে নেই,
তবে অনেক টাকা চার্জ লাগবে ও অনেকক্ষণ সময় লাগবে শুনে প্রমাদ
গুনলাম। অনুপকে সাইকেল ফেরৎ দেবার সময়, সাইক্লোনিক গতিতে এগিয়ে আসছে। টাকাই বা কোথায় পাব? স্কুল পালিয়ে পরের ব্রেকহীন সাইকেল নিয়ে
পুলিশ জীপকে ধাক্কা মেরেছি শুনলে, বাড়িতে আহ্লাদিত হয়ে, সাইকেল সারানোর টাকা দেবার সম্ভাবনা বড়ই ক্ষীণ। শেষে সন্তুকে দিয়ে ওর
মা’কে বলে, টাকা নিয়ে গিয়ে সন্ধ্যাবেলা সাইকেল ফেরৎ
নিলাম। সাইকেল সারানোর দোকানের কাছেই, একটা চায়ের দোকান ছিল। ঐ দোকান থেকে অনেকবার চা পাতা কিনে নিয়েও গেছি।
দোকানের মালিক যে আবার অনুপের কাকা হয়, জানা ছিল ন।। তিনি কেন যে লালবাজারে পুলিশের চাকরি না করে, চা পাতা বেচতে বসেছেন, কে জানে। তিনি অনুপকে চিনতেন কিনা জানিনা, তবে তিনি অনুপের সাইকেলটা ঠিক চিনতে পেরেছেন।
অপরকে সাইকেল দেওয়ার জন্য ও সাইকেলটা বেঁকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্য, অনুপকে দোকানের মালিক ও তার কাকা, উভয়েই খুব বকাবকি করেন। সেদিনই প্রথম
জানতে পারলাম, সাইকেলটা
ঘড়ির দোকানের মালিকের এবং সেদিন থেকেই আমার অনুপের সাইকেল চালানো বন্ধ হয়ে গেল।
আজ
এত বছর পরে, এ
কাহিনী লিখতে বসে, অনুপকে
খুব মনে পড়ছে। তার ঘড়ির দোকান আজও আছে, কাকার চায়ের দোকানও আছে, হয়তো সাইকেলটাও আছে, শুধু অনুপ-ই আজ আর নেই। নকশাল আন্দোলনের সময় পাইপ গানের গুলিতে তার মৃত্যু হয়।
সে নিজে নকশাল আন্দোলনে জড়িয়েছিল, না নকশালরাই তাকে মেরেছিল বলতে পারবো না।