গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

পাঠ-প্রতিক্রিয়া


মেটামর্ফিক পোট্রেট / সীমা ব্যানার্জী রায়

আলোচক – ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

সীমা ব্যানার্জী রায়ের প্রথম উপন্যাস ‘মেটামর্ফিক পোট্রেট’ পড়লাম । প্রথম উপন্যাসের ক্ষেত্রে নেকেরই লেখায় কিছু আড়োষ্টতা দেখা যায়, সীমার ১১৮পৃষ্ঠার উপন্যাসটিতে আমি কিন্তু কোন আড়ষ্টতা পেলাম না। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বেশ সাবলীল আগ্রহ-সঞ্চারি লেখা । সীমা তার উপন্যাসে চার নারী চরিত্র ও এক পুরুষ চরিত্রের ছবি আমাদের সামনে এনেছেন । কিন্তু আমার বিশ্লেষণে সীমা একটিই পোট্রেট এঁকেছেন, তাঁর উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র দীপ্তর পূর্ণাবয়ব ‘পোট্রেট’ । তার জীবনের টানা-পোড়েনই সীমা ব্যানার্জী রায়ের আঁকা ‘মেটামর্ফিক পোট্রেট’।

নিতান্ত শৈশবে পিতৃহারা দীপ্ত চরম দারিদ্রের মধ্যেও মা মৃদুলা দেবীর স্নেহ ও পরিচর্যায় এবং আপন মেধায় উচ্চশিক্ষিত হয়ে আমেরিকা প্রবাসী হয়ে উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন । দীপ্তর প্রথম প্রেম পূর্ণতা পায়নি, তার জোবনে আসা প্রথম নারী তার জন্য অপেক্ষা করেনি । দ্বিতীয় নারী পরমা দীপ্তকে ভেঙে চুরমার করেছেন পরপুরুষে আসক্ত হয়ে । আর তৃতীয় নারী দীপ্তর দ্বিতীয় স্ত্রী, প্রথম বিবাহ-বিচ্ছিন্না আপান নিজে কিছু না পেয়েও আবার গড়লেন দীপ্তকে । মৃত্যু আপানকে টেনে নেওয়ার আগে ‘দীপ্তর চার অধ্যায়’ নামে নারীজীবনের চার চরিত্রে কাহিনী । দীপ্তও তখন জীবনের উপান্তে পৌছেছে । আপান তার ‘চার অধ্যায়’ কাহিনীর শেষ পৃষ্ঠায় লিখেছিল “এই উপন্যাস পাঠ করে যদি একজনও বিবাহ-বিচ্ছেদকে ত্যাগ করতে পারেন তাহলে আমার এই লেখার সার্থকতা”। বইটা বুকে চেপে ধরে হাহাকার করে ওঠে দীপ্ত “বিনা দোষে সবাই আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছো কেন সবাই ?” হয়তো ক্ষণিকের জন্যও তার দুই সন্তানের জননী তাকে ভেঙ্গে চুরমার করে চলে যাওয়া পরমার কথাও মনে পড়েছিল দীপ্তর । এই কাহিনীনির্যাসেই সীমার প্রথম উপন্যাস ‘মেটামর্ফিক পোট্রেট’ ।

লেখিকা গত ২৯ বছর ধরে আমেরিকার টেক্সাস প্রবাসী, কিন্তু বাংলার জল-হাওয়ার আবহে লালিত মূল্যবোধ আর সংবেদনশীলতা কিছুমাত্র বর্জিত হয়নি তার ব্যক্তিগত জীবনচর্যায়, সেটা বোঝাযায় উপন্যাসটির চরিত্র নির্মাণ ও বিন্যাসে । আমার মনে হয়েছে স্বামী-স্ত্রীর পরীক্ষিত ভালোবাসার পরেও বিবাহ বিচ্ছেদ কেন অনিবার্য হয়ে যায় সেই প্রশ্নের উত্তরের অন্বেষণই এই উপন্যাসের সারাৎসার ।

দীপ্তর মা মৃদুলা দেবী এবং প্রথম স্ত্রী পরমা দুটি ভিন্ন ধরণের চরিত্র । মৃদুলা চরম দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে তার সন্তানদের মানুষ করেছেন, প্রতিষ্ঠিত করেছেন আর পরমা কুড়ি বছর বিবাহিত জীবনের পরেও আর এক পুরুষের টানে দীপ্তকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল দুই সন্তানকে সেই বিচ্ছেদ কতটা প্রভাবিত করবে তা না ভেবেই । সুখী হয়নি পরমা মোটেই, পেয়েছিল স্বামীর ঘর ছাড়া উৎশৃঙ্খল ব্যাভিচারির পরিচিতি । আবার দীপ্তর দ্বিতীয় স্ত্রী স্বামীর সন্দেহ ও মানসিক নির্যাতনে বিবাহ বিচ্ছিন্না আপান দীপ্তকে বিয়ে করে সুখী হয় । নারীর পরম কামনা সন্তানও চায়নি দীপ্তর কাছ থেকে । পরমা-দীপ্তর দুই সন্তানের মা হিসাবেই নিজেকে তৈরি করেছিলেন । দীপ্তর ভালোবাসার জীবনে আসা তিন নারী রূপসা, পরমা ও আপানের চরিত্রনির্মাণ, বিন্যাস আর সম্পর্কের নানান টানা-পোড়েন পাঠকের আগ্রহ সঞ্চার করবে বলেই আমার বিশ্বাস । সেই বিশ্বাস থেকেই বলি সীমার প্রথম উপন্যাস ‘মেটামর্ফিক পোট্রেট’ পাঠক সমাদর লাভ করবে ।

আর একটা কথা বলে নিই । কাগজ, ছাপা, বোর্ড বাঁধাই, মারুত কাশ্যপ কৃত শোভন প্রচ্ছদ – সব মিলিয়ে ‘মেটামর্ফিক পোট্রেট’ বেশ যত্নশীল প্রকাশনা ।