বুড়ো হরলাল এখনো নিজেকে তার
পাড়ার মাথা বলে মনে করে । সব ব্যাপারে আগে ছোটে । কান খাঁড়া করে সব শুনে নিজের মত
জানায় । তার মতগুলো এ যুগের মতো নয় । আগের বিশ্বাস নাকি এ যুগ চলে না । তাই নাকচ
হয়ে যায় তার সব কথা । হরলাল হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরে নিজের স্ত্রীকে বলে,সব মরুক গা ।
স্ত্রী মুখ-ভার করে বলে ওঠে,তোমার সম্মান বলে কিছু নেই ? যাও কেন ওদের মধ্যে,শুনি ?
হরলাল ফোকলা হেসে উত্তর দেয়,অতীত আর
স্মৃতির কোন সম্মান আছে ? নেই বলেই তো কারো পিছু ছাড়ে না । আমি সেই অতীত আর
স্মৃতির প্রতিনিধি । কেউ আমাকে থামাতে পারবে না ।
সেদিন জিতে গেলো হরলাল । তার পাড়ায় এক প্রবীণ মানুষ কেষ্ট
দত্ত মধু ঢালীর মেয়ের উঁচু বুকে রাতের অন্ধকারে মোলায়েম করে হাত দিয়েছে । সে নিয়েই
কথা হচ্ছিলো । হরলালের থেকে কেষ্ট দত্ত বছর পাঁচেকের ছোটো হবে । তাই সবাই মিলে
হরলালকেই চেপে ধরল । রাগত-স্বরে তাকে বলা হল,’’আপনি কী বলেন এ ব্যাপারে ?
শুনে হরলাল একচোট হেসে বলে উঠলো,’দোষ আমি
কেষ্টর দেখছি না । মধু ঢালীর মেয়ের উঁচু বুক থেকে অতীত নড়ে উঠতেই পারে । এমনই সে ।
বিদেয় দিলেও আবার ফিরে আসে । এই আমার মতো । তার কথা
শুনে তরুণ যুবক দিনেশ বলে,’এর মানে কী ?
আপনি কেষ্ট হারামির পক্ষে’
?
হরলাল সহাস্যে জবাব দেয়,’বিপক্ষে তো নয়ই । কীভাবে হওয়া যায় ? আমি পুরনো মানুষ । পুরনোদের নিয়েই চলতে ভালোবাসি । আমার অমন
ইচ্ছে হবে কিনা বলতে পারছি না । এ যুগ যত অপমান করবে অতীতকে,ততই সে ফুঁসে উঠবে’ ।
তার কথা বিলক্ষণ বুঝল হরলালের
প্রতিবেশী রাখাল দাস । তাই সে উত্তর দিলো বলিষ্ঠ-কণ্ঠে,’যুগ ভাগ কর না কেউ । অমৃত আর গরল বুঝতে সবাই একসাথে
হও । নইলে কপালে সবার কষ্ট আছে । হরলালদাকে তোমরা তো মানুষ বলেই ভাবো না । দেখিনি
বুঝি আমি’ ? তার কথা শুনে অনেকেই লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলো ।
হরলাল রাখাল দাসের কাঁধে হাত দিয়ে বাড়ির দিকে আসতে আসতে বলল,’বেশ বলেছ,ভাই । তবে আমি আর ওদের মধ্যে যাবো না । আমাকেই কোনোদিন
কেষ্ট দত্তর লোক বুঝে পিটুনি দেবে । তার কথায়
সহমত হয়ে রাখাল দাস বলল সখেদে,’হ্যাঁ,দাদা । আর নয় । এখনো সম্মান বলে তো আপনার কিছু আছে’ ।
অচিন-জননী
শিবেন মিত্তির গলি মানেই পতিতাদের গলি । একটু বেলা বাড়া
থেকে সন্ধে পর্যন্ত মেয়েরা গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেজে-গুজে । ওদের মাঝে এক বুড়ী মতো
মহিলাকেও দেখা যায় । অসিত অফিসে আসতে-যেতে তাকে দেখে । কখনো দেখা যায় সে হাসি-খুশি । কখনো বা খুব বিষণ্ণ । অসিত দেখে খুব অবাক হয় । তার ব্যাপারে ওর উৎসাহ খুব বেশী । কিন্তু অত
মেয়ের মাঝে তার কাছে যেতে ও সাহস পায় না ।
কিন্তু অসিতের আগ্রহ দিনের পর দিন বাড়তে থাকে । মার কাছে
এসে বলে সেই বুড়ীর কথা । ওর মা শুনে হাসে । অসিতকে বলে,একদিন বুড়ী-মার সঙ্গে কথা বলতেই পারিস । তুই তো আর... কিন্তু মার কথায় কোনোরকম বুকে বল পায় না ও । আমতা
আমতা করে বলে,বোঝোই তো সব । অনেক চেনা মানুষ ও পথ দিয়ে যায় । মা বুঝে এক-মুখ হেসে বলে,তবে দূর থেকে তাকে প্রণাম জানাস । তোর দিদিমা-ঠাকুমার মতো হবে না ?’’ মার কথা শুনে অসিত খুব খুশী হয়ে বলে,সে হবে,মা । খুব প্রণাম করতে ইচ্ছে হয় বুড়ী-মাকে । তুমি তো দেখোনি তাকে । কেমন করে বসে থাকে যে ।
একথার পর বেশ কয়েকদিন অসিত আর বুড়ী-মাকে গলির মোড়ে দেখল না । খুব
বিস্মিত হল । মনে খুব আঘাত পেলো ও । তবু প্রতিদিনের মতো মাথায় আঙুল ঠেকাতে ভুলল না
। একদিন ওর মাথায় আঙুল ঠেকানো দেখে এক মেয়ে পথে উঠে এলো । অসিতের
মুখোমুখি হয়ে স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করলো,কাকে রোজ ভক্তি দেখাও ? আমরা নিশ্চয় কেউ নই ?
কোনোদিক দিক থেকেই আমরা নই । না
বয়সে,না সম্মানে । তাহলে কে গো ? বল না
একবারটি ।
অসিত পথের পাশে উঠে এলো তারপর । মেয়েটাও এলো ওর সঙ্গে ।
এরপর চারদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে অসিত বলল মেয়েটাকে,সেই বুড়ী-মা কোথায় ? কদিন থেকে দেখি না যে । খুব ভালো লাগতো তাকে ।
বিশ্বাস কর আমাকে । আমার ঠাকুমার মতো বেশ খানিকটা । কোথায় সে ? অসিতের কথা শুনে মেয়েটার দু’চোখ জলে
ভরে গেলো । তার গাল বেয়ে টপটপ করে জল পড়তে থাকলো । দেখে অসিত প্রমাদ গুণতে শুরু
করলো । বুঝল নির্ঘাত বুড়ী-মা আর নেই ।
তিনি তো কদিন আগেই মারা গেছেন । সে আপনি কী করে জানবেন ? আমাদের খুব ভালবাসতেন তিনি । হ্যাঁ,আপনার কথাও বলেছেন কয়েকবার । বলতেন দেখেই বোঝা যায় খুব ভদ্র
ঘরের ছেলে হবে । তার জন্য আমরাও আপনাকে চিনে ফেলেছিলাম । নিজেদের মধ্যে আপনাকে
দাদাই বলতাম । বিশ্বাস করুন ।
মেয়েটা একনাগাড়ে কথা বলার পর রুমাল দিয়ে তার চোখ মুছল ।
মুখে তার কষ্টের হাসি । অসিত কি বলবে আর কি করবে বুঝে উঠতে পারলো না । হঠাৎ ওর মুখ
থেকে বেরিয়ে এলো,ওনার কাজ হয়ে গেছে ? আমি কিছু
সাহায্য করতে পারি ? সাথে-সাথে মেয়েটা বলে উঠলো বেশ বলিষ্ঠ
কণ্ঠে,আমরা এখানে শরীর বেচে পয়সা নিই । তুমি তো সে ধরণের মানুষ নও
। আসি ।
মেয়েটা খুব দ্রুত তার জায়গায় আবার ফিরে গেলো । তারপর রঙ-তামাশা শুরু করলো সঙ্গিনীদের সাথে । আর হাতছানি দিক-দিগন্তরে । অনেকক্ষণ হাঁ করে সেদিকে চেয়ে অসিত
হাতের ঘড়ি দেখল । অফিসের সময় পেরিয়ে গেছে ওর
। এবার তাই ঘরেই ফিরে যেতে হবে ওকে । আর এরপরেও অফিসে গেলে বুঝি ওর সবকিছুই মিথ্যা
হয়ে যাবে ঈশ্বরের কাছে ।