গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

নীহার চক্রবর্তী

শুদ্ধ-বেলার গান


খুব দরকার ছিল রাহুলের একটা মেডিক্যাল সার্টিফিকেট । কিন্তু ১৫ই আগস্ট সারা ভারতে ছুটির দিন । এলাকায় ডাক্তার পাওয়াই ভার । নানা ফার্মেসিতে ও ঘুরলো । কিন্তু সবাই ওকে বলল,’’আজ কাউকে পাবেন না ।‘’ বেশ হতাশ হল রাহুল । শেষে খোঁজ পেলো এক ডাক্তারবাবুর । স্মৃতিকণা ফার্মেসিতে বসেছে । রাহুল শুনেই ছুটে গেলো সেখানে ।

কিছুক্ষণ বাইরে বসে থাকার পর রাহুল শুনল ডাক্তার প্রদীপ্ত রায় বসেছেন । সে শিশু-বিশেষজ্ঞ । প্রদীপ্ত নামে অনেককেই চেনে রাহুল । তাই নামটা নিয়ে ওর ভাবার সময় ছিল না । ফার্মেসির এক ছেলে বলল রাহুলকে,’’অপেক্ষা করুন । স্যারের সঙ্গে একটু কথা বলে আসি ।‘’ সে ছেলে রাহুলকে বেশ চেনে । ও স্থানীয় কেদার স্মৃতি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক ।

একটু পরেই ছেলেটি এসে রাহুলকে স্মিত হেসে বলল,’’আরে,আপনার নাম করতেই স্যার লাফিয়ে উঠলো । আপনি তো ডাক্তারবাবুর স্যার । তা উনি বললেন স্যারকে একটু অপেক্ষা করতে বল । আমি রোগীগুলো দেখেই ডাকছি ।‘’ তার কথা শুনে রাহুল উল্লসিত । চোখের কোণে জল এলো । প্রদীপ্ত নামটা তখন ওর মনের মধ্যে আন্দোলিত করতে থাকলো খুব ।

তারপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো । শিক্ষক-ডাক্তার মুখোমুখি কিংবা পিতা-সন্তানের মধ্যে অনেকদিন পর দেখাদেখি । প্রদীপ্তকে দেখে এবার মধ্যবয়স্ক রাহুল নিজেই প্রায় লাফিয়ে উঠলো । মুখ-ভরা হাসি । হাসি আর থামে না । রাহুলকে প্রদীপ্ত এক-মুখ হেসে বলল,’’বসুন,স্যার । কতদিন যে আপনাকে দেখিনি । মনে পড়ে খুব আপনার মুখটা । এখনো বুঝি সেই গো-বেচারা আছেন ? ছাত্ররা এখনো বিরক্ত করে আপনাকে ?’’ ছাত্রের কথায় রাহুল বেশ মজা পেলো । লজ্জাও পেলো খুব । আমতা আমতা করে বলল,’’বুড়ো হতে থাকলে মানুষ তেজী হয় । জানিস তো ?’’ প্রদীপ্ত হেসে ফেলে ওর সঙ্গে সহমত হল ।
তারপর আর কি । রাহুলের কথামতো প্রদীপ্ত একটা মেডিক্যাল সার্টিফিকেট লিখে দিলো । রাহুল তা হাতে নিয়ে ওকে বলল,’’কত দিতে হবে রে তোকে ?’’ শুনে ভারি লজ্জা পেলো প্রদীপ্ত । অস্ফুট-স্বরে বলে উঠলো,’’কি যে বলেন স্যার । এই প্রথম বুঝি আমাকে পাপ কাজ করতে শেখাচ্ছেন ?’’ ওর কথা শুনে রাহুল বাক্যহারা । চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো । হাতে পয়সা ছিল না । এক বন্ধুর কাছে থেকে কিছু এনেছিল ফিজ দেবে বলে ।

হঠাৎ রাহুল প্রদীপ্তর মাথায় হাত দিয়ে বিড়বিড় করে বলতে থাকলো কীসব যেন । প্রদিপ্ত দাঁড়িয়ে উঠে রাহুলকে প্রণাম করে বলল,’’এই আশিস অনেক-অনেক চাই,স্যার । অনেক পেন্ডিং আছে কিন্তু ।‘’ তারপর দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে আনন্দের সাগরে নিজেদের ভাসিয়ে দিলো ।
বাইরে এসে রাহুল মহানন্দে এক প্যাকেট উইলস্‌ ফ্লেক কিনে বসলো । মনে মনে বলল,এ আমার ছেলের টাকায় কেনা । বৌ কিছু বললে আচ্ছা করে শুনিয়ে দেবো না ? ইয়ার্কি পায়া হ্যায় ? পরে অবশ্য রাহুলের বৌ সব শুনে খিলখিল করে হেসে বলে উঠলো,’’ছেলের দেওয়া অমৃত তো । আমার কিছু বলার নেই । যত পারো ধোঁয়া ছাড়ো । এক প্যাকেটের বেশী তো নয় ।‘’