গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

রুখসানা কাজল

পিতা

নীল কাভারের সোফায় বসে দীর্ঘ ভারী নীলপর্দার দিকে তাকিয়ে আছে মুক্তি।একটু আগে পর্দার কিছু অংশ নিঃশব্দে টেনে সরিয়ে দিয়েছে। পর্দার ওপাশে   কেবল কারো চাদর ঢাকা ক্ষীণ পায়ের কিছুটা দেখা যাচ্ছে। মুক্তির দৃষ্টি সেদিকেই   নির্নিমেষবদ্ধ। অই পায়ের সামান্য নড়াচড়ায় সে ক্ষিপ্র উঠে দাঁড়ায়,  পাঁজরে পাঁজরে রক্ত বাড়ি খায়, বোঝে, বেঁচে আছে আব্বা বেঁচে আছে!  
কালিবালি সন্ধ্যা নেমেছে। এখুনি মাগরিবের আজান হবে। আজান শেষে এই সময় মুক্তির অদম্য ক্ষুধা পায়। বহু বছরের অভ্যাস। সারাদিন কিছুই খায় না সে। স্রেফ জল খেয়ে দিব্যি কাজ করে যায়। কিন্তু এই সময়ে আর পারে না। প্রচন্ড ক্ষুধায় নাড়িভুঁড়ি ঘুরছে। তবু মুক্তি বসে থাকে।আজ সে না খেয়েই থাকবে। অসুস্থ মানুষটাকে একা রেখে কিছুতেই সে খেতে যেতে পারবে না। 
  
 এক আজান শেষ না হতেই আরেক আজান সুর তুলেছে। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।ঢাকা শহরে এত মসজিদ!একই পাড়ায় অনেকগুলো। নামাজীদের সংখ্যাও অগুনতি। আজানের যে পবিত্র আহবান ভাল করে বোঝাও যায়না।এক মসজিদের আজান অন্য মসজিদের আজানের সাথে কাড়াকাড়ি মাখামাখি করে শেষ হয়ে যায়। আব্বা বলেন যেখানে পাপ বেশি সেখান ধর্মস্থান নাকি বেশি থাকে!    
“মুক্তি!” চমকে ভারী শরীরে চপল বালকের মত দ্রুত ফাঁকা পর্দার মাঝখানে এসে উত্তর দেয়, জি আব্বা।” “একটু চা খাওয়াবি বাপ! মন বড় চাইছে রে!” মুক্তি অসহায় হয়ে পড়ে। বাপটার ক্যান্সার জেনে গেছে সে। সময়ও বেঁধে দিয়েছে ডাক্তাররা। বাঁধাধরা খাওয়ার লিস্ট। এমন রোগীকে কি চা দেওয়া যায়? যদি ডাক্তাররা রাগ করে? যদি অসুখ আরো বেড়ে যায়?যদি ধরাবাঁধা  দিনের আগেই তার বাপটা মরে যায় ?পাহাড়ের মত শরীর নিয়ে মহাসংকটে পড়ে  মুক্তি। কি করবে সে ? চা না খেয়েই যদি বাপটা মরে যায়? সামান্য চা! বাপটাকে তাও  সে দিতে পারল না এই ভেবে কি সে বেঁচে থাকতে পারবে?মুক্তির উঁচু উঁচু দাঁতগুলো   কিছু না করতে পারার সংকটে তীব্র হয়ে ঠোঁট ঢেকে আরো বেশি বেরিয়ে আসে। কাশেম সাহেব বহু কষ্টে ঘাড় ঘুরিয়ে মুক্তিকে দেখেন। একরাশ মায়ায় তার মন ভিজে  উঠে, সঙ্গীতা কই রে ?” “বাসায় গেছে। শরীর কি খারাপ লাগছে আব্বা?” “না রে বাপ।কাছে আয় । অত দূরে দাঁড়িয়ে আছিস যে? আমার কি ছোঁয়াচে রোগ হয়েছে নাকি! আর এই পর্দা সরা।”

পর্দা সরিয়ে কাছে আসে মুক্তি। কাশেম সাহেব ষড়যন্ত্র করছে এরকম সুরে বলেন, যা তুই খেয়ে আয়। আর আসার সময় এক গ্লাস দুধ চা আনবি। বাপ বেটা ভাগ করে খাব বুঝলি।” খুব খুশী হয়ে উঠে মুক্তি ।আব্বার শরীর কি তবে ভাল হয়ে যাচ্ছে? বড়  ডাক্তার সংগীতাকে বলেছে, মিরাক্যাল হতে পারে। দু মাসের জায়গায় উনি হয়ত দুবছর বেঁচে গেলেন!” বিপ্লব আর সংগীতা মুক্তিকে জড়িয়ে কেঁদে  ফেলেছিল, বড় ভাইজান তোমার আব্বা যেন তাই বেঁচে থাকে।” খুশি খুশি গলায়  মুক্তি বলে, সংগীতা আসুক আব্বা তারপর —

কাশেম সাহেবের বুকের ভেতর কুলকুল হাসি উঠে। হায়রে ছেলের বুদ্ধি! তার নিরেট বোকা মুক্তি কিছুতেই বুঝতে পারে না সংগীতা এলে সে চা খেতে পারবে না। সংগীতা তার মেয়ে হলেও ডাক্তার। সে চোখ পাকিয়ে বলবে, নো চা কফি ।সুস্থ হলে সব হবে!বড় ভাইজান তোমার আব্বা কথা না শুনলে আমি কিন্তু চিকিতসা করব না বলে দিলাম।” মুক্তি তখন মূর্তি হয়ে যাবে। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে ঠাঁয় বসে থাকবে তার কাছে । তিনি জানেন মাগরিবের আজান শেষ হলেই রাক্ষুসে  ক্ষুধা পায় মুক্তির। মূহূর্তে খেয়ে ফেলে দুই প্লেট ভাত। তারপর ধীরে সুস্থে শান্তিমত খায় ।
     
           রাহেলা খুব যত্ন করে মুক্তিকে খেতে দিতেন । মুক্তির দেহের আড়ালে ঢাকা পড়ে যেত ছোটখাটো দেহটি।মুক্তি গলে পড়ত মায়ের সামনে।চমচের পর চামচ খাবার তুলে তিনি বলতেন, পেট ভরে খা বাপ। এত কাজ করিস।কি করে তুই সারা দুপুর না খেয়ে থাকিস আমি বুঝি না রে।” মুক্তি খেত আর হেসে হেসে মাকে বলত, দুপুরে খেলে শরীর ভারী ভারী লাগে। ঘুম পায়। ঘুমুলে কে কাজ করবে ? আমাদের ত অইটুকুই জমি! আব্বা তো আর জমি কিনবে না।” শেষের কথাটি অভিমান ভরা। কাশেম সাহেব জমি কেনার পক্ষপাতী নন। যে টুকু জমি আছে তার সবটুকু পাবে মুক্তি। সঙ্গীতা আর বিপ্লব খুশিমনে বড় ভাইকে ওই জমি বাড়ি লিখে দিয়েছে। মুক্তি জানে না। সে জমি খুব ভালবাসে। অন্যের জমি অযত্ন হচ্ছে দেখলেও ভয়ংকর রেগে যায়। জমির মাটি, ফসলের আগাছা, জলসেচ, নিড়ানি সব কিছুতে মুক্তির চরম উৎসাহ। গান গায় আর ছন্দে ছন্দে কাজ করে। মুক্তির হাতের আঘাতে বড় বড়  মাটির ঢেলা অনায়াসে ভেঙ্গে পড়ে। লাঙলের ফলা দেবে যায় মৃন্ময়ী মাটির বুকে।মুক্তি চরম শক্তিতে ছেনে নিয়ে আসে মাটি মায়ের বুকের নির্যাস। যেন অই বুকের দুধ মুক্তির জন্মের শোধ। 
 
            একজন আয়াকে কেবিনে রেখে ক্যান্টিনে আসে মুক্তি। চেনা কর্মচারী মুক্তির খাবার দেখিয়ে দেয়।চারজনের মত খাবার রাখা আছে। সংগীতা ব্যবস্থা করে গেছে। জানে সারাদিন বাদে এই সময় বড়ভাইজান পেটভরে ভাত খায়।মন খারাপ  করে বাসায় গেছে সঙ্গীতা। হাসপাতালের এই ক্যান্টিনে কতবার খেয়েছে সে। পাবনা থেকে সোজা চলে আসত এখানে। সংগীতা এখানকার ডাক্তার। বড় ভাইকে দেখলে আন্তরিক খুশী হত সে। ছোটভাই বিপ্লবের বউও ডাক্তার। সাথে সাথে বিপ্লব জেনে যেত বড় ভাইজান ঢাকা এসেছে। আর ফোনে চেঁচামেচি ঝগড়া অনুযোগ অভিমান শুরু করত। সংগীতার ওখান থেকে বিপ্লবের বাসা ঘুরে আসত সে। তাদের বড়  সুখের সংসার। তিন ভাইবোন ত্রিরত্ন। আম্মা নেই। দুবছর আগে মারা গেছেন। এখন মুক্তিই সব। বিপ্লবের বউ টেবিলে খাবার দিয়ে দু ভাইয়ের বকবক শুনে হাসে আর ভাবে, কে বলবে মুক্তি ভাইজান এদের রক্তের কেউ নয়? 

            বাহাত্তর সালের মার্চ মাস। ছিন্নভিন্ন বাংলাদেশে একমাত্র মাথা উঁচু করে দুলছে স্বাধীন বাংলার লালসবুজ পতাকা। কাশেমরা অস্ত্র জমা দেবে কি দেবে না ভাবছে। এত তাড়াতাড়ি দেশের স্বাধীনতা আসবে ভাবেনি কেউ। আরো বৃহৎ যুদ্ধেরজন্যেমানসিকপ্রস্তুতিনিচ্ছিল ওরা। চীনের ভূমিকায় যুদ্ধের প্রথম দিকে বেকায়দায় ছিল ওদের দল। শেষ সিদ্ধান্তে যুদ্ধে নেমেছে। তবে ভারতের সাহায্য নিতে নেতাদের মনে লেগেছে। অথচ কাশেমরা পরিষ্কার বুঝেছিল ভারত রাশিয়া ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে এত বলিষ্ঠ আর কেউ নাই। যুদ্ধশেষে নেতৃত্ব জানায় যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে পুঁজিপতিজোতদার শোষকদের শেষ করতে হবে। টালমাটাল মনের অবস্থা । মাগরিবের আজান শেষে চা খাচ্ছে বাড়ির রাখাল ছুটে আসে । পাশের বাসার বাদলদের পুকুরঘাটে একটি নবজাতক ট্যাঁ ট্যাঁ করছে। সন্ধ্যারমুখে শেয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খেলে ঝামেলা যাবে এই ভেবে কারা যেন ফেলে গেছে ।

          বাদলরা তখনো ভারতে। ফাঁকা বাড়ি পড়ে আছে জংলা ভুতের মত।  কে ফেলল ? তাদের এই পাড়াতে সবাই সবাইকে চেনে। হিন্দু মুসলিমের পাশাপাশি বাস। ঘর উঠোনে সবার যাতায়াত। দু ঘর হিন্দু পরিবার আছে কাশেমদের বাড়ি  লাগোয়া। কিন্তু তাদের তো কোন মেয়ে নেই! কাশেম তুলে নিয়ে আসে বাচ্চাটাকে। কাশেমের মা বুকে জড়িয়ে ধরে। আহারে কার ধন কে ফেলে গেছে। কাশেমের বাবা দরাজ গলায় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়, ওরে ও কাশেম  এবার তোর সত্যিকারের যুদ্ধ শুরু হল। দে এখন ছেলেটাকে অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান। তবেই বুঝব তুই সাচ্চা কম্যুনিস্ট ।” কাশেম যেন একটি মহাকাজ পায়। অস্ত্র জমা, আরো এক যুদ্ধ, ভারত বিরোধ সব ফেলে বাচ্চাটিকে নিয়ে মেতে উঠে। নাম রাখে মুক্তি। কাশেমদের ঘরবাড়ি, উঠোন, পুকুর মুক্তিই মুক্তি। কোর্ট অফিসে চাকরি পেয়ে যায় কাশেম। মুক্তির একবছর বয়সে বন্ধুর বোন রাহেলা বেগমকে বিয়ে করে। মুক্তি মা পায়।  কেবল কাশেম তখনো বুঝে উঠতে পারে না কে ফেলে গেল মুক্তিকে ?
 
            বাদলদের পাশের বাসায় সন্তোষ ঘোষের শালীর বিয়ে। অনেক খেটে  খুটে বিয়েটা উতরে দেয় কাশেমরা। বর ভারতের বাসিন্দা। বিয়ে শেষে বর কনেকে তুলে দিতে গিয়ে চমকে উঠে কাশেম। আট বছরের মুক্তির মুখ যেন সন্তোষ ঘোষের শালীর মুখের হুবহু। সেই রকম উঁচু উঁচু দাঁত। মায়াভরা অসহায় চোখ। কিছু  বলতে গিয়েও চেপে যায় সে। আধ ঘোমটার আড়ালে সন্তোষের শালী হাতজোড় করে  একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কাশেমের দিকে। সে চোখে পদ্মা মেঘনা যমুনা ভাসমান।

             অনেক রাতে সন্তোষ আসে। পাবনার সাঁথিয়ায় সন্তোষের  শ্বশুরবাড়ি। আচমকা মিলিটারী নামে সেই গ্রামে। পালাবার সময় মিলিটারিদের হাতে ধর্ষিত হয় ময়না। চৌদ্দ বছরের মেয়ে মরে গেছে ভেবে ফেলে গেছিল। কিন্তু বেঁচে গিয়েও বা কি হলো! যুদ্ধ শেষের আগেই বোঝা গেল অন্তঃসত্ত্বা ময়না। সন্তোষের বাড়িতেই লুকিয়ে ছিল শেষ ক মাস। বাচ্চাটি বেঁচে যাবে ওরা কেউ ভাবেনি। নুন দিয়েছিল মুখে। কিন্তু পরিমাণ ঠিকমত দিতে পারেনি । “ভাইরে আমরাও চলে যাচ্ছি। মিলিটারীর বাচ্চাকে আর সহ্য  করতে পারছিনা। পারলে গোপন রেখ।” গোপনই  রেখেছে কাশেম। মুক্তি এখন ওর আর রাহেলার বড় ছেলে।জহর মাস্টারের আদরের বড় নাতি। বিপ্লব সংগীতার বড় ভাই। তল্লাটের সবাই জানে রক্তবিপ্লবী কাশেম ওর বাপ। সন্তোষরা চলে যাওয়ার পর বাদলরাও চলে যায়। মুক্তির জন্মস্থান এখন তিনতলা বিল্ডিংএর নীচে চাপা পড়ে গেছে। দু দুবার এইচ এসসি ফেল করে মুক্তি মাকে বলে দিয়েছে, আম্মা আমি আর পড়ব না।” রাহেলা বেগম হতফতিয়ে পড়ে , কি করবি তাইলে বাপ? খাবি কি? আমাদের ত অই চাকরি আর একমুঠো জমি সম্বল!” 
   
            পরদিন সকালে সবাইকে চমকে দিয়ে জমিতে চলে যায় মুক্তি। বিপ্লবের সাথে কি যেন কানাকানি করেছে সারারাত। বিপ্লবও সোৎসাহেএগিয়েদেয়ভাইকে। সংগীতা হা করে চেয়ে থাকে। বড় ভাইজান কৃষক হবে? নিজে নিজে কিষাণ হওয়া যায় একথা তখনো বোঝেনি সংগীতা। রাহেলা বেগম খুব খুশি। সে নিজেও কিষাণ পরিবারের মেয়ে। কেবল কাশেমের বুক কেঁপে উঠেছিল, ছেলেটা পড়ল না ! সে কি তবে ব্যর্থ হল! হেরে গেল না ত জহর মাস্টারের কাছে! তার নিজের ভেতর একটি গোপন গর্ব ছিল একজন যুদ্ধশিশুকে সে প্রতিষ্ঠিত করেছে এই সমাজে এই রাষ্ট্রে । রাহেলা বেগম হাত ঝেড়ে উড়িয়ে দিয়েছিল সব দুঃখ, তোমার বাবাও তো  কিষানের ছেলে ছিল। আমার মুক্তি না হয় তার পুর্বপুরুষের মত কিষানই হল!”
            স্যাঁত করে উঠেছিল কাশেমের মন, পুর্বপুরুষ? কার? মুক্তির? কথাটা জানাতেই রাহেলা বেগমের চোখে আগুন জ্বলেছিল । সে আগুন গলে পড়েছিল জ্বলন্ত লাভা হয়ে, ছিঃ ! কুকড়ে গেছিল কাশেম। তার পিতৃত্বের কোথাও কি ভাঁজ  খেলে গেল পুরাতন বস্তাপচা গন্ধ?
 
            সংগীতা মুক্তি একসাথেই কেবিনে আসে হাসতে হাসতে, আব্বা নিজামী শয়তানেরও ফাঁসী হবে। ইস বিপ্লবভাই থাকলে কি যে খুশি হত!” “কখন আসবে ওরা?”  “সন্ধ্যার প্লেনে। বড়ভাইজান দ্যাখ দ্যাখ ফাঁসির খুশীতে মিছিল বেরিয়ে গেছে!” দুজনেই ছুটে যায় বারান্দায়। কাশেম সাহেব একাত্তরের যুদ্ধকালীন আনন্দ অনুভব করেন।তার ডানহাত হাত শক্ত হয়ে উঠে যেন ট্রিগারে চাপ দিচ্ছেন।