গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

লোককথার খোঁজে


[ লেখাটি আদতে একটি উপন্যাসের আলোচনা । সোহরাব হোসেন লিখিত ‘দ্বিতীয়া দ্রৌপদি’ । ]

নতুন পুরনো মিলিয়ে বই আর পত্রিকা মিলে একখানা লাইব্রেরী তো বটেই, বাড়িতে ছোটখাটো একখানি পাহাড় জমে আছে বললেও অত্যুক্তি করা হয় না। সেই  পুরনো পাহাড়ের কিছুটা অংশ সরাতে গিয়ে কয়েকবছর আগে কেনা একটি  পুজোসংখ্যার পত্রিকা চোখে পড়ল। অনেক পত্রিকাই কেনা হয় পুজোর সময়, কাগজওয়ালাও নিয়ে আসে কিছু পত্রিকা। এটিও সেভাবেই কেনা হয়েছিল। সত্যি কথা বলতে কি, এর আগে এই পত্রিকার নামটি আমার শোনা ছিল না। পত্রিকার নামটি হলআরম্ভ, এটি ২০১১ সালের পূজায় প্রকাশিত একটি পত্রিকা।  উল্টেপাল্টে দেখে আবার সেই ছোট উপন্যাসটিতে চোখ আটকাল। লেখকসোহরাব হোসেন। লেখকের দু/একটি ছোট গল্প আগে পড়েছি কিন্তু তার বেশি নয়। এই উপন্যাসটি ২০১১ সালেও পড়েছি, কিন্তু সে পড়া চোখ বুলিয়ে নিয়ে পড়ার মত, গভীরে নয়। এবার মন দিয়ে তাকে পড়া গেল, উপন্যাসটির নাম  দ্বিতীয়া দৌপদী।
মূলতঃ তিনটি ব্যক্তিগত কারণে উপন্যাসটি পড়ার আগ্রহ বোধ করি।
প্রথমতঃ, উপন্যাসটির পটভূমিকা পুরুলিয়া জেলার পঞ্চকোট পাহাড় ও তৎপার্শ্ববর্তী অঞ্চল।  মানভূমের কন্যা হবার সুবাদে এই অঞ্চল সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ ধারনা এবং আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। 
দ্বিতীয়তঃ, পঞ্চকোট রাজপরিবারের সঙ্গে কয়েক পুরুষ ধরে আমার পরিবারের পূর্বপুরুষেরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকার সুবাদে যদি কোন নতুন তথ্য হাতে আসে এই আশায় পড়া।
তৃতীয়তঃ, উপন্যাসের চরিত্রগুলি জনজাতি সমাজের মানুষজন যা আমার গবেষণার বিষয়। এছাড়াও আরো একটি কারণ অবশ্যই মহাভারতের দ্রৌপদী, যা আমার অন্যতম প্রিয় চরিত্র। যদিও উপন্যাসটি এক আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক উপন্যাস।

আমরা দেখেছি, পুরাণকথা ও লোককথার উপকরণ কখনও সরাসরি, কখনও আড়ালে ছড়িয়ে থাকে সাহিত্যে। গ্রামীণ লোকায়ত জীবনে পুরাণকথা কখনও মিশে যায় জনজীবনের সুখ-দুঃখ, হাসিকান্নার কাহিনীর বুনোটে। সাহিত্যে এই উপকরণের প্রক্রিয়া হয় অন্যভাবে। উপকরণ গুলির ছায়ায় সৃষ্টি হয় নতুন নতুন চরিত্র, নতুনতর বিন্যাস, সাহিত্য পায় অন্য  মাত্রা। জীবনের কথা রচিত হয় সমকালের দৃষ্টিতে। এই উপন্যাসটি পড়েও আমার একথাই মনে হয়েছে।  

পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর অঞ্চলের অধিবাসীরা দীর্ঘদিন ধরেই নানাভাবে শোষিত, বঞ্চিত, অবহেলিত, অপমানিত। তাদের নারীরা লাঞ্ছিতা, নিপীড়িতা। দীর্ঘদিনের শোষণ, বঞ্চনা থেকে একরকম বাধ্য হয়েই তারা হাতে তুলে নিয়েছেন অস্ত্র। সমাজে তাদের নাম হয়েছেমাওবাদী। এখানে সেই অস্ত্রধারণ ভুল কি ঠিক, সেই প্রশ্নে আমি যেতে চাই না, সেটি লেখকের নিজস্ব ব্যাখ্যা বা ধারণা। আমি অন্য দৃষ্টিভঙ্গী থেকে কাহিনীটিকে ব্যাখ্যা করতে চাইছি।
কাহিনীটিতে এইরকম একটি তথাকথিত মাওবাদী দলের কথা বলা  হয়েছে, যাদের মধ্যে আছে পাঁচটি পুরুষ ও তাদের দলনেত্রী একটি মহিলা। নেত্রীর  প্রতি কমান্ডারের আদেশ ছিল একজন বিশ্বাসঘাতক সহ-সৈনিককে হত্যা করার যা কিনা স্বজন হত্যার নামান্তর। বেশ কিছুদিন ধরেই দেখা যাচ্ছে, মাওবাদীদের মৃত্যু হচ্ছে বিভিন্ন দলের নেতাদের হাতে, CRPF জওয়ানদের হাতে, এমন কি নিজেদের গোষ্ঠীর লোকেদের হাতেও মৃত্যু হচ্ছে নিজেদের যোদ্ধাদের যারা কিনা একসময়  কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে যুদ্ধ করেছেন, প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন। এই দলটিও সেইরকম এক অন্তর্ঘাতের হাত থেকে বাঁচার জন্য পঞ্চকোট পাহাড়ের অরণ্যানীর মধ্যে নিজেদের লুকিয়ে রেখে বাঁচার চেষ্টায় পাহাড়চূড়ায় আরোহণ করে। গোষ্ঠীর  লোকেদের হাতে গোষ্ঠীরই  মানুষজন হত্যায় এই দলটির নেত্রী ব্যথিত, দুঃখিত। যে কারণে, যে প্রয়োজনে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার স্রোত প্রবাহিত আজ অন্যদিকে। প্রতিবাদের নামে, প্রতিরোধের নামে স্বজন হত্যার এই দুঃখ নেত্রীকে বিচলিত করে।  সে মনে মনে চিন্তা করে, এই রক্তের খেলা আর নয়। সে নিজেই ধরা দেবে। কিন্তু নেত্রীর প্রতি কমান্ডারের নির্দেশ থাকার জন্য সে সহযোদ্ধাদের নিয়ে পাহাড়চূড়ায় আত্মগোপন করতে বাধ্য হয়। যদিও সে জানে, ধরা পড়লে এর পরিণাম মৃত্যু।  

কৌশলে মেয়েটি অর্থাৎ নেত্রী তার সঙ্গীদের ডেকে নিয়ে উঠতে থাকে পাহাড়চূড়ায় যেখানে অরণ্য অঞ্চলের এই আদিম অধিবাসীরা ছাড়া আর কেউ ঊঠতে পারে না, যেখানে উঠবার মত রাস্তাঘাটের পরিচয় এবং ক্ষমতা এই অরণ্যবাসীরা ছাড়া আর  কারো নেই বা থাকে না। পাহাড়চূড়ায় উঠবার সময় সহযাত্রীদের সে কাহিনি শোনায় জনজাতি সমাজের। একদা পঞ্চকোট রাজ, যিনি কিনা ছিলেন একজন  জনজাতি, কিভাবে রাজত্ব করেছিলেন তিনি ও তাঁর বংশধরেরা হাজার হাজার বছর ধরে। কিভাবে একত্রিত হয়েছিল এই জনজাতি সমাজ এই পঞ্চকোটে। উচ্চকোটির লোকেদের সঙ্গে কি ভীষণ লড়াই করে এই জনজাতি বীরেরা রক্ষা করেছিল এই বিশাল অরণ্যভূমি, এই পঞ্চকোট। এসব কাহিনি সে শুনেছে তার পূর্বপুরুষদের কাছে, যা কিনা তারা শুনেছে তাদের পূর্বপুরুষদের কাছে। এই ভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বয়ে চলা ইতিহাসকে জাগিয়ে রাখাই এই অরণ্যের অধিবাসীদের কাজ, এইভাবে সে জাগিয়ে রাখে এই পাঁচজন যোদ্ধাকেও।  
পঞ্চকোট হল পাঁচটি কোট বা ঘের, যাকে বলি বৃত্ত দিয়ে ঘেরা এক পাহাড়, এক  বিশাল অরণ্যভূমি। প্রতিটি বৃত্তকে পার হতে  হয় অসীম সাহস, শক্তি আর ক্ষমতার সঙ্গে। এই পাঁচটি বৃত্ত পার হলে তবেই  পৌঁছানো যায় পাহাড়চূড়ায়। সুরক্ষিত পাঁচটি বৃত্ত হল কাঁটা ও গুল্মরাজির বৃত্ত, ছোটবড় অসংখ্য পাহাড়ী ঝোরা ও পাহাড়ী নদীর বৃত্ত, যেখানে অকস্মাৎ বিপদে ফেলে দিতে পারে হড়কা বান। আছে বড় বড় বৃক্ষরাজির দুর্ভেদ্য বৃত্ত, অসংখ্য পাকদন্ডির  ঘের বা বৃত্ত যা কিনা যে কোন মানুষকে ফাঁদে ফেলতে পারে নিমেষে। আর এইসব পেরিয়ে এসে সবশেষে পার হতে হয় রুক্ষ, খাড়া প্রস্তরময় বৃত্ত। তবেই পৌঁছানো যায় পাহাড়চূড়ায়। এই পাহাড়, এই বনরাজি, এই অরণ্যভূমি তাদের সমাজের। দখল নিতে হবে এই ভূমির, দখলে রাখতে হবে এই মাতৃভূমিকে। সেই কারণেই এই লড়াই, এই প্রতিবাদ, প্রতিরোধ। এভাবেই নেত্রী তার সহযোদ্ধাদের মনে মাতৃভূমি দখলের আশাকে উজ্জিবীত করে  চলে।  

কিন্তু পাহাড়চূড়ায় থাকতে থাকতে নেত্রী ক্রমশঃ বুঝতে পারে, সহযোদ্ধাদের পাঁচজন পুরুষই তার প্রতি অনুরক্ত। ফলে, পরস্পর পরস্পরের প্রতি সন্দেহ এবং ঈর্ষায় জর্জরিত। সকলেই চায় নেত্রীকে করায়ত্ত করতে, প্রয়োজনে একে অপরকে হত্যাও করতে পারে। তাকে আয়ত্ত করতে না পারলে হয়তো বা নেত্রীর জীবনও বিপন্ন। কৌশল অবলম্বন করে নেত্রীও, প্রয়োগ করে তার ক্ষমতা,  সাহস, শক্তি। সে বুঝতে পারে হাতের পাঁচটি আঙ্গুলের সমষ্টিতেই শক্তি,অন্যথায়  শক্তিহীন। হাতের পাঁচটি আঙ্গুলের মত সে ধারণ করে রাখতে চায় এই পাঁচজনকে। একজনের বিশ্বাসঘাতকতা মানেই পতন সকলের, তার নিজেরও। তবে কি সে দ্রৌপদী?

আদিবাসী সমাজের গল্প, কাহিনি, পূর্বপুরুষদের বীরত্বের কাহিনি শোনাতে শোনাতে নেত্রী তার সহ-যোদ্ধাদের নিয়ে উঠে এসেছিল পাহাড়ের চূড়ায়। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রীয় ধর্মপিতাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ করার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি বুঝতে  পারে  প্রতিরোধ করতে হবে নিজেকেও এই পাঁচজনের হাত থেকে। মহাভারতের   দ্রৌপদীর মত তিনিও এক অদ্ভুত প্রস্তাব দিয়ে বসেন সেই পাঁচ সহযোদ্ধাকে, এর একমাত্র উপায় বিবাহ, তিনি পাঁচজনকেই স্বামী রূপে পেতে চান। পঞ্চকোটের পাঁচটি বৃত্তের মত এই পঞ্চস্বামী কে পরাস্ত করে তবেই নাগাল পাওয়া যাবে দলনেত্রীর। পাহাড়চূড়ার উপর অবস্থিত পরিত্যক্ত, ধূলালুন্ঠিত, ভগ্ন দেবমন্দিরের সামনে দ্রৌপদীর মত গ্রহণ করে সে পঞ্চস্বামীকে। কৌশলে এভাবেই নিজের সুরক্ষার ব্যবস্থা করে সে তার দলের সহযোদ্ধাদের হাত থেকে।

মহাভারতের মিথ, প্রাচীন রাজা-রাজড়াদের চলে আসা গৌরবগাথা যা কিনা মিথেরই নামান্তর ও গ্রামীন লোককথার ভিত্তিতে  রচিত উপন্যাসটি সমাপ্ত হয় আগামী দিনের নতুন সূর্য্য দেখার আশ্বাসে। অতীতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভবিষ্যতের দিকনির্ণয়ের ইশারা আছে কাহিনির শেষে। মহাভারতের আখ্যান ও লোককথার ভিত্তিতে ঔপন্যাসিক রচনা করেন নতুন এক কাহিনী সমকালের দৃষ্টিভঙ্গীতে, রচিত হয় জীবনের কথা।