গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৬

পলাশ কুমার পাল

সখের সিগারেট

ঝকঝকে আলো এবং অসংখ্য দৃষ্টির সামনে দিয়ে স্বরচিত কবিতাপাঠ করে নেমে আসার সময় মাথা নীচু করে নিল মলয়। আবেগের অন্তিম মূহূর্ত পেরিয়ে সে আবার বসার আসনের দিকে এগিয়ে যায়।

জীবনে প্রথম কবিতাপাঠ। তাও বিশিষ্ট কিছু সাহিত্যিকের সামনে। একে তো নিজের লেখা নিয়ে নিজেই বিশ্বাসী নয়। তার মনে হয় পাগলামো এইসব। মায়ের কথাই ঠিক- বেকার জীবনে কর্মের সন্ধান না করে বেকার সময় নষ্ট। তবু কোনো লেখা সম্পূর্ণ করার পর এবং কয়েকটা পত্রিকায় লেখকসূচীতে নিজের নাম দেখে যে আনন্দ তা অন্য আনন্দকে ম্লান করে দেয়। আর সেই নেশায় এমনই এক 'চিত্রা' পত্রিকার সম্পাদকের ডাকে সে চলে এসেছিল এক সাহিত্য আড্ডায়। এই পত্রিকার লেখকসূচীতে যে তারও নাম আছে। -এমনই সে জানে। কবিতাপাঠ শেষে কিছু মৃদু হাততালিতে শব্দের প্রতিধ্বনি দেয়ালে দেয়ালে ঘোরাফেরা করতে করতে হৃদস্পন্দনও বাড়িয়ে দিয়েছিল।
আসনে বসতেই পাশের এক তরুণ সাহিত্যিক তার কবিতাপাঠের প্রশংসা করল। মলয় জানে তার কবিতা বা সেটার পাঠ কতটা গ্রহণযোগ্য বা তাত্পর্যময় উপস্থিত সুধীজনের কাছে। তবু এই প্রশংসা ফুটন্ত আনন্দের নীচে আঁকড়া বাড়িয়ে দিল।
কবিতাপাঠের জন্য পাওয়া স্মারকটা ব্যাগে রাখতে রাখতে ভাবছিল মায়ের হাসিমুখের কথা। মা এটা দেখলে খুব খুশি হবে। বারবার সে পত্রিকার সূচীপত্রে নিজের নামটা খুঁজছিল। স্মারকের সঙ্গে তার লেখাটা যদি মা-বাবাকে পড়ে শোনানো যায়, তাহলে তারা যা খুশি হবে তার তুলনা কোনো কিছুর সঙ্গেই টানা অসম্ভব।
জীবনে তো কখনো বাবা-মাকে খুশি করতে পারেনি। আর্থিক অস্বচ্ছ্বল সংসারে নিজেকে ছোটো লাগে তাই। সংসারকে আর্থিক দিক দিয়ে সবল করার পরিবর্তে বরং সে টিউশন পড়ানো ছাড়া বাকি সময় লেখনীকে সঙ্গী করে ভাবনাতে হেঁটে বেড়ায়। এর জন্য মলয়ের মা বকাবকি করত মলয়কে। আজ মলয়ের মনে হচ্ছে সেই বকাবকি করা সে এবার বন্ধ করবে। কিন্তু বারবার নিজের নামটা সেই পত্রিকার সূচীপত্রে পেল না। একটু অবাক হল মলয়।
ফেসবুকে প্রকাশিত সূচীপত্রটা মোবাইলে ডাউনলোড করা ছিল। সেটা দেখল। দুটো সূচীপত্র মিলছে না। বইয়ের সূচীপত্রে নতুন কয়েকটা নাম সংযোজন হয়েছে তার মতো আর দুজনের নাম মুছে গিয়ে। তবু বিশ্বাস হল না। পাতা উল্টে ভালো করে দেখল। না, কোথাও নেই। ঝকঝকে আলোর মাঝে সারামুখে বাদলা ছেয়ে এলো। বাড়ি গিয়ে মা'কে বলবে কী? সে তো লেখাই দেখাতে পারবে না।
মলয়ের মনে ভাসমান আনন্দের বৈতরণী ভেঙে গেল। বহুদূর থেকে শহরে এসেছিল কবিতাপাঠ করতে এবং সেই সঙ্গে সৌজন্য কপিটা সংগ্রহ করতে। এতদিন ব্লগে লিখছিল। মুদ্রিত হিসাবে এটাকেই সে আত্মপ্রকাশ বলে ভেবেছিল। অথচ! বই ও গাড়িভাড়া বাবদ তার যা খরচা হল তাতে তার মনে হল, এই টাকায় তাদের চারদিন সংসার চলে যেত। কিন্তু... নিজেকে দোষী মনে হল মলয়ের। বাবা-মার কর্মক্লান্ত মুখের ছবি তার বুকে ছুরির মতো বিঁধতে লাগল।
অনুষ্ঠান প্রায় প্রান্তসীমাতে এসে পৌঁছেছিল। মলয় আর বসে থাকতে পারল না। ব্যাগ হাতে বেড়িয়ে পরল। মুখোমুখি সম্পাদক ভবেশের সঙ্গে সাক্ষাত্। সিগারেট টানছে।
- কি? চলে যাচ্ছো?
- হ্যাঁ, ভবেশ দা!
মলয় তাকে প্রণাম করল।
- আবার এসো। দেখা হবে।
- হ্যাঁ, হ্যাঁ! ... দাদা, একটা কথা!...
- কী?
- না, মানে...
আমতা আমতা করে মলয় সব বলল। খ্যাতনামা মানুষ। সমীহ করে বলতে হল। এদের চটাতে নেই হয়তো- তাহলে লেখা স্থান পাবে না যে।
- তোমার কিছু একটা ভুল হচ্ছে। বইটা ভালো করে দেখো। সূচীপত্রে হয়তো নেই। বইয়ের ভিতরের পাতায় নিশ্চয় লেখা আছে!
- কিন্তু...

মলয় কিছু বলার আগেই জ্বলন্ত সিগারেটটা পায়ে পিষে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ভবেশ সিঁড়ির ধাপ ধরে উঠে গেল। অর্ধেক সিগারেটে তখনও আগুন লাল হয়ে। নিভছে না। একটা পোড়া গন্ধ নাকে লাগে। মলয় সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে সিগারেটের দিকে তাকিয়ে দেখে, প্রায় গোটা একটা সখের সিগারেট নীরবে পুড়ছে...