গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৬

রূপক সান্যাল

বদল

       অনেক আগেই ব`লে রেখেছিল শিবানী,   বার আমাদের এখানে পুজো দেখবি শহরের পুজো তো অনেক দেখেছিস।” মৌমিতা বলেছিল “হ্যাঁ, যাব”। তারও অনেক দিনের ইচ্ছে, গ্রামের পুজো দেখবে, কিন্তু হয়ে ওঠে না, কিছু না কিছু একটা সামনে এসে যায়। শেষমেস এবার সম্ভব হলো।

      একমুখী  লাইন, উল্টো দিক থেকে কোনও ট্রেন আসার ব্যাপার নেই। সম্প্রতি এই লাইনগুলো সব ব্রড-গেজ হয়েছে। ট্রেনের জানালা দিয়ে দুপাশে দেখতে থাকে মৌমিতা। এখানে কোনও ঝুপড়ি বা বস্তি নেই। শুধু ধান ক্ষেত, নদী-ডোবা আর ছোট ছোট ঝোপ ঝাড়। আবার অনেক পাকা বাড়িও হয়েছে। যদিও এরকম গ্রামীণ পরিবেশে পাকা বাড়ি একটু বেমানান লাগে।

       ট্রেন থেকে নেমে মৌমিতা দেখল, সেই গ্রামও আর আগের মতো নেই। সর্বত্র শহরের ছোঁয়া। যদিও একটু দূরেই দেখা যায় বিস্তীর্ণ সবুজ ফসলের ক্ষেত। ট্রেনথেকে নেমে একটা ছোট বাজারের মধ্য দিয়ে শিবানীদের বাড়িতে যেতে হয়। বাজারে সব রকমের দোকানই আছে  এমনকি টিভি বা কম্পিউটারএর দোকানও। বাজার ছাড়িয়ে কিছুটা গেলে একটু গ্রামীণ পরিবেশের আভাস পাওয়া যায়।

      সকালের জলখাবার খেয়েই বেরিয়েছিল মৌমিতা। শিবানীদের বাড়িতে দুপুরের ভাত খেয়েই বেরিয়ে পড়ল ওরা। মৌমিতা একাই এসেছে, সঙ্গী হিসেবে দু`একজন বন্ধুকে বলেছিল, কিন্তু এই পুজোর দিনে কেউই বের হতে রাজি হলোনা।

     ব্যাটারি চালিত রিক্সা এদিকটায় এখন বেশ চলছে, ওরা তা-ই একটা ভাড়া ক`রে নিলো। রিক্সা ক্রমশ ঢুকতে থাকলো গ্রামে। চারদিকে সবুজ ধান ক্ষেত, কোথাও বা ধানের শীষ বেরিয়েছে কেবল, মাঝে মাঝে ডোবা বা পুকুর, তাতে লালনীল-  শালুক  ফুটে আছে,   চরাচর নিস্তব্ধ –শোনা যায় শুধু ঝি ঝি পোকার ডাক ।শহুরে মৌমিতা দুই চোখ দিয়ে যেন গোগ্রাসে গিলছে প্রকৃতিকে। দূর থেকে ভেসে আসছে ঢাকের শব্দ, হয়ত ওখানে একটা পুজো আছে। একটা ডোবার পাশে একটা গাছ দেখে মৌমিতা শিশুর মতো নেচে উঠল। গাছটা সত্যি অদ্ভুত  একসাথে আম আর অশ্বথথ গাছের মিশেল।

      প্রায় ছ-সাতটা পুজো হয় এখানে, একসময় ওদের সবই দেখা হয়ে গেল। শিবনীর চার বছরের ছোট্ট মায়েটা খুব দুরন্ত। সে কোলে থাকতে চায় না, শুধু দৌড়ে বেড়ায় আর বার বার এখানে ওখানে চলে যায়। সব শেষে দেখা হ`লো শিবানীদের পাড়ার পুজো। ছোট্ট আয়োজন, কিন্তু আন্তরিক। ভেতরে যেতেই দু-এক জন সাদরে ডেকে নিয়ে বসতে দিল।

      সেখান থেকে বের হবার সময় শিবনীর মেয়েটা মণ্ডপের পেছনের দিকে কিছুটা জায়গা ফাঁকা দেখে ওখান দিয়ে ঢুকে পড়ল আর মায়ের আঁচল ধরে টানতে লাগলো। বলে “ঠাকুরের পেছনে কেন রঙ নেই?”যতবার তাকে টেনে আনা হয়, বোঝান হয় যে, আমারা শুধু সামনেটা দেখি তাই পেছনে রঙ থাকার দরকার নেই  কিন্তু সে বোঝে না। চারদিকে এত আয়োজন, কিন্তু সেসবে তার মন নেই, তার শুধু ওই একটাই প্রশ্ন।মৌমিতাও অনেক বোঝানোর চেষ্টা করল, কিন্তু বিশেষ ফল হ`লো না, শেষে একরকম জোর করেই টেনে নিয়ে যাওয়া হ`লো ওকে। যেতে যেতে মৌমিতার কানে বাজতে থাকে কথাটা  আমরা শুধু সামনেটাই দেখি।প্রতিমাই বালো আর মন্ডপই বালো  সৌন্দর্য শুধু সামনেই। দর্পণে শুধু সামনের ছবিই প্রতিবিম্বিত হয়, পেছন তো সবারই জানা। কিন্তু এই ছোট্ট মেয়েটি যে জানে না!

     ফিরতে ইচ্ছে করছিল না মৌমিতার, কিন্তু ফিরতে হবে, ফেরার ট্রেনের সময় হয়ে এলো। বড় রাস্তায় ওঠার কিছুটা পরে একটু দূরে ওরা দেখতে পেল একটা জটলা, হয়তো কিছু হয়েছে ওখানে। কাছে গিয়ে যা দেখল তাতে চোখ বন্ধ হয়ে এল মৌমিতার। রাস্তার ওপর প`ড়ে আছে বছর কুড়ি-বাইশের একটা ছেলে।কয়েকজন স্থানীয় লোকজন তাকে যখন একটা ভ্যান রিক্সাতে তুললো, দেখা গেল তার একটা কান থেঁতলে গেছে, কপালের ওপর থেকে উঠে গেছে অনেকটা মাংস। জানা গেল - নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সে ব`সে ছিল একটা মোটর সাইকেল-এর পেছনে, ঝোঁক সামলাতে না পেরে প`ড়ে যায়। এতক্ষণ যে দৃষ্টিসুখ পেয়ে আসছিল মৌমিতা, সেটা যেন একটু কেটে গেল।

      সামনেই একটা স্টেশনরী দোকান, শিবনীর মেয়েটার জন্য একটা চকলেট কেনার জন্য ওদের রিক্সা থমল। মৌমিতা নেমে এগিয়ে গেল দোকানের দিকে। চকলেট নিয়ে রিক্সাটার দিকে ফিরে আসতেই একটু দূরে সে দেখল একটা মোটর চালিত একটা ভ্যানরিক্সা। ভ্যানরিক্সা বটে কিন্তু শুধু তিনটে চাকা ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না গাড়িটার। এইটুকু একটা গাড়িতে এতগুলো লোক ওঠে!

      গাড়িটা এসে থামতেই বোঝা গেল যাত্রীরা সবাই অ-সাধারণ। তারা চটাপট নেমে পড়ে রাস্তাটা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। প্রত্যেকের হাতেই একটা করে চাঁদার রশিদ বই। কারুর গলায় রুমাল বাঁধা, কারুর জামার কালার তোলা, কারুর চোখে উৎকট সানগ্লাস। বোঝাই যায় এরা কারা। ওদের মধ্যে দুজন একটা বাড়িতে ঢুকে পড়ে সেই বাড়ির দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিতে লাগলো, বলতে লাগলো –“দাদা, চাঁদাটা এখনো পেলামনা। আজকে কিন্তু দিতেই হবে।”  বাকিরা ওদের গাড়িটাকে ঘিরে ঘুরতে লাগলো  যেন এক্ষুনি তারা গাড়িটা সুদ্ধ তুলে ফেলে দেবে দূরে। মৌমিতা খুব সাবধানে এসে গাড়িতে বসলো। এখান থেকে তাড়াতাড়ি সরে পড়া উচিত।

      স্টেশনের কাছে এসে ওরা একটা চায়ের দোকানে বসলো। সামনেই পুজো মন্ডপ, এই প্রতিমা দেখেই ওরা আজকের ঠাকুর দেখা শুরু করেছিল। কিন্তু কী আশ্চর্য, সকালের শান্ত পরিবেশ নেই এখন। কয়েকটি ছেলে মাইক বাজাছে- অসম্ভব জোরে তার শব্দ, সে গানের একটা শব্দও ঠিক বোঝা যায় না। ছেলেগুলোর মধ্যে একজন প্রকাশ্যেই শুরু করল মদ্যপান, একজন গাঁজা টানতে লাগলো। এখানেও বেশিক্ষণ বসে থাক সম্বব নয়। ট্রেনও এসে গিয়েছিল, ওরা উঠল।

      গ্রামগুলোকে গিলে খাচ্ছে শহর। শহরের ভালো দিক নয়, শহরের বর্জপদার্থ দিয়ে সেজে উঠছে গ্রাম। কোথাও ভাটিয়ালী নেই, ভাওয়াইয়া নেই, আছে শুধু হিন্দী ফিল্মের গান। সাজপোশাকেও গ্রাম্যতা নেই। সস্তার প্রসাধন ব্যবহার করছে মেয়েরা। পাড়ায় পাড়ায় বিউটি পার্লার। শুধু নিজেকে জাহির করা।

      এইসব ভাবতে  ভাবতে ফিরছিল মৌমিতা। জন্মের পর থেকে গ্রামেই থেকেছে বেশি। এই গ্রামকে তার দেখা সেই গ্রামের সাথে মেলাতে পারে না সে। মনটা ভারি হয়ে আসে মৌমিতার। হয়তো এটাই নিয়ম, সবই হয়তো বদলে যায় এভাবে। মানুষও বদলায়, তার পরিবেশও বদলায়, রুচিও বদলায়। কিন্তু বদলটা ভালোর দিকে না খারাপের দিকে সেই প্রশ্ন কেউ করে কী?