গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৬

মৃন্ময় চক্রবর্তী

নীল প্রজাপতি

বসন্ত ফিরে এলো দুপুরের গাড়িতে। আজ  কাজ হয়নি। হাতে টাকা নেই। স্টেশনে নেমে তার বাড়ি যেতে ইচ্ছা করলনা। রেললাইন পার হয়ে মেঠো পথ পেরিয়ে বেশ দূরে তার গ্রাম। হাঁটতে হাঁটতে সে চলল সেই পথেই। মাঠের মাঝখানে পঞ্চানন্দের বিল।গাছ গাছালির নিবিড় ছায়া পুকুরটা ঘিরে আছে। একপাশে দেবতার থান। থানের সামনে নতুন সিমেন্টের চাতালে সে এসে বসল। এখানে বৈশাখের প্রখর রোদ গলতে পারছেনা। ঘন ঠান্ডা নির্জন ছায়ার নীচে বসেই কেমন মন খারাপ হয়ে গেল বসন্তের। হাতে পয়সা নেই একদম নেই। কী করে চলবে দিনগুলো তার! পুজোর পর থেকে কটা মাস তরজা করে মোটামুটি আয় হয়। কিন্তু বাকি কটা মাস তার দিন চলেনা চলতে চায়না। তার ধানজমি নেই, বাগান নেই, পুকুর নেই শুধু এই দেহই সম্বল। অথচ সে সম্বল করতে চেয়েছিল তার কন্ঠকেই। সে তো কবি, কেন সে ঠিকেদারের দরজায় গিয়ে দাঁড়াবে? তার কি কোন মান নেই? হ্যাঁ সে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বড় ব্যবসায়ী না হতে পারে, না থাকতে পারে তার ইস্কুল পাশের কাগজ।কিন্তু সে তো কবি। কবির মান কি অনেক বড় নয়, অনেক উঁচু নয়! কেন তাকে দুটো কথা শোনাবে ঠিকেদার, মা বাপ তুলবে?
অথচ একদিন তার কী সম্মান ছিল! সে ছিল দেখবার মতো ব্যাপার। গাঁয়ে গাঁয়ে বায়না পেত সে। লোক তাকে মাথায় তুলে রাখত, জল দিয়ে পা ধুইয়ে দিত, গলায় পরিয়ে দিত মালা। আসরে নামলেই শয়ে শয়ে লোক তার বশীভূত হয়ে যেত।

সেই সুদিন আর নেই। আজকাল আর লোক আর তরজা, কবি এসব শুনতে চায়না, তারা অল্পজামাকাপড়ের মেয়ের কাঁটালাগা নাচ, অশ্লীল গাজন এসবই ভালবাসে। সুন্দরে তাদের রুচি নেই। এখনো ডাক আসে, তবে কম। তার মান কমে গেছে। গান করে টাকা কম পায় সে এখন। নইলে কে ঠিকেদারের বাড়ি যেত!

বসন্ত গামছা পেতে দেয় চাতালের উপরে। চারপাশে ঘন রাঙচিতা গাছে ফুটে আছে লাল মৌমাছির মত ফুল। রামতুলসির ঝোপ থেকে শুকনো ফুলের রোঁয়া উড়ছে হাওয়ায়। তার বুকের ভেতর মোচড় ওঠে। তাকে কেউ তো ভালবাসেনা আজ আর! ঘরেও তো সে কোনোদিনই মান পায়নি। বউ তাকে বোঝেনি। সে কবি, সে যে টাকা উপায় করার গাছ নয়, তার বউ মানতে চায়নি, খোঁটা দিয়েছে, অপমান করেছে যখন তখন। আর পাঁচজনের মত সে হতে পারবেনা এটা বুঝতে গেলে তাকে যে ভালবাসতে হবে, তার শিল্পী মনকে যত্ন করতে হবে। কিন্তু এমনকরে কেউ তো তাকে ভালবাসেনি কোনোদিন? কেউ বাসবে কি আর? তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে নামে। সে খেয়াল করেনা। সেই জল লুকিয়ে ফেলে সিমেন্ট চাতাল।
বসন্ত এখন আর আগের মত গান বাঁধতে পারছেনা, তার গাছে ফল ধরছেনা আর, তার ভেতরের শিল্পীটা মরে যাচ্ছে। ভাবতে ভাবতে খুব কষ্ট হল তার, খুব!

খুব হাওয়া আসছিল বিলের দক্ষিণ থেকে। হঠাৎ রামতুলসীর বন থেকে উড়ে এলো একটা প্রজাপতি। প্রজাপতিটা তার বাহুতে এসে বসল। কি সুন্দর ঘন নীল রঙ। ডানাদুটো তিরতির করে কাঁপছে। ডানায় দুটো চোখ আঁকা। চোখ দুটো যেন কোনো নারীর।

তার মনে পড়ে গেল বিভাসপাড়ায় সে যেবার গান গাইতে গেছিল, সেখানে একজোড়া  চোখের দেখা পেয়েছিল সে। গভীর কালো চোখ। সে গান গাইবার পর যখন বিশ্রাম নিচ্ছিল তখন সে এসেছিল তার কাছে, জল রেখে আর প্রসাদ বেড়ে বলেছিল, কবি তুমি কেমন করে গান বাঁধো বলবে আমাকে। বসন্ত কথা বলতে পারেনি, সে শুধু দেখেছিল দুটো চোখ গভীর মমতা নিয়ে তাকে পরিচর্যা করতে চাইছে, তার কবিত্বের করতলে অমূল্য কিছু দিতে চাইছে। কিন্তু সেদিন তার কিছু নেওয়া হয়নি। তারপর সে ঘুরেছে গ্রামের পর গ্রাম, রাতের পর রাত কেটে গেছে গান গেয়ে। সে ভুলে গেছে চোখজোড়ার কথা। এই প্রজাপতিটা মনে পড়ালো সবকিছু। আজ সেই চোখ দুটো সে ফিরে পেতে চাইছে। হঠাৎই যেন তার মনে হচ্ছে এমন কেউ তার থাকুক, যখন সবাই তাকে ভুলে যাবে, তখন সে তাকে কবি বলে ডাকবে। বলবে আমাকে গান শিখিয়ে দাও। কথাটা মনে পড়তেই তার মন উতলা হল আবার। সে আবার বিভাসপাড়ায় যাবে, শিগগির যাবে।

আচমকা নীল প্রজাপতিটা চঞ্চল হল, উড়ার জন্য ছড়িয়ে দিল ডানা । বসন্ত মিনতি জানাতে লাগল প্রজাপতিটাকে। কিন্তু সে উড়ে গেল তার বাহু ছেড়ে। বসন্ত ছুটল তার পিছন পিছন, কিন্তু আর সে ফিরলনা।

বিকেলের রোদ পড়ে এসেছে। বসন্ত তার ভারি হৃদয় তুলে রাস্তায় এসে দাঁড়াল। ভাবল বিভাসপাড়ায় গিয়ে কিছু লাভ হবেনা, সে যাবেনা। সেই চোখ হয়ত উড়ে গেছে এই প্রজাপতির মতোই। এখানেই মরবে সে, এভাবেই মরবে। তার জন্য তো কিছু পড়ে নেই এই পৃথিবীতে। সে আর কবি থাকবেনা, তাকে কেউ কবি বলে ডাকবেনা আর। সে আপনমনে গান বাঁধল---
বন্ধুরে তোর কাজল কালো চোখ দেখলাম না

তাই গান বাঁধা মোর বৃথা গেল এই জনমে....