আজ খুব অঞ্জনের কথা মনে হচ্ছে।
মনে হচ্ছে, কারণ
আজ যখন স্মৃতি রোমন্থন করে পুরানো সঙ্গী সাথীদের কথা ভাবতে বসেছি, তখন অঞ্জন ইহলোকের মায়া কাটিয়ে ওপারে
চলে গেছে। ওকে নিয়ে কত স্মৃতি, ওকে ভুলি কী ভাবে?
অঞ্জনরা
তিন ভাই। কাবুল, অঞ্জন
ও চন্দন। কাবুল বড়, ওর
সাথে আমাদের খুব একটা আলাপ ছিল না, চিনতাম এই পর্যন্ত। অঞ্জন ও চন্দন পিঠাপিঠি ভাই। অঞ্জন বড়, চন্দন ছোট। দু’জনেই আমাদের আড্ডার, খেলাধুলার সাথী। কাবুল বয়সে সামান্য বড়
হলেও, একটু
দাদা দাদা ভাব নিয়ে থাকতো, তাছাড়া ওর আড্ডা ছিল শঙ্কর মঠে। অঞ্জন আমার থেকে বয়সে কিছু ছোট ছিল।
রাধামোহন নামে একটা আইসক্রীম বিক্রেতা, ছোট বাক্সে কাঠি আইসক্রীম নিয়ে,
পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বিক্রি করতো। কেন বলতে পারবো না, সে অঞ্জনকে ধারে আইসক্রীম বিক্রি করতো, যদিও দেখলেই বোঝা যায়, তার এখনও উপার্জন করার বয়সই হয় নি। ফলে
আমরাও এই কাঠি আইসক্রীম খাওয়ার সুযোগ পেতাম। ধার যত না শোধ হয়, বেড়ে যায় অনেক বেশি।
একদিন
স্কুল পালিয়ে আমি আর অঞ্জন, না অঞ্জন নয়, বলতে হবে আমি আর ঈশ্বর অঞ্জন,
পানার ভেলায়, রেল লাইনের পাশের ঝিলে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছি। পানার ভেলা জিনিসটা
হয়তো এখনকার অনেকেই জানে না বা, শোনেও নি। কঞ্চি বা ঐ জাতীয় কিছু দিয়ে একটা আয়তকার ফ্রেম তৈরি করে, ফ্রেমের ভিতর বড় বড় কচুরিপানা দিয়ে বেশ
মোটা করে ভরতে হবে। চারপাশে কঞ্চির ফ্রেম থাকায়,
পানাগুলো ছড়িয়ে যেতে পারবে না। এরপর সেই কচুরিপানার ভেলায়
চেপে জলপথে স্বচ্ছন্দে যেথা খুশি যাওয়া যায়। সত্যি কথা বলতে কী, ভাল ভাবে যথেষ্ট পরিমান কচুরিপানা দিয়ে
মোটা করে ভেলা তৈরি করলে, তার ওপর একটা হাতিকে চাপিয়ে নিয়ে গেলেও বোধহয় কোন ক্ষতি হবেনা। হাতিটা
একটা উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করলেও, ব্যাপারটা কিন্তু সত্যিই সেরকমই।
অনেকের
কাছেই হয়তো এটা নিছক গল্প বা পাগলের প্রলাপ বলে মনে হতে পারে, আমিও তাই মনে করতাম, যদি না ঐ ভেলায় আমরা একসাথে অনেক ছেলে, এমন কী বয়স্ক লোকেদেরও চাপিয়ে রেল লাইনের
পাশের লম্বা ঝিলে, একদিক
থেকে অপর দিকে নৌকার মতো করে ঘুড়ে বেড়াতাম। অত ছেলে একসাথে চাপলেও কোনদিন কিছু হয় নি।
না ভুল বললাম, একদিন
হয়েছিল, সে
কথা পরে বলবো। এরকম কিছু অদ্ভুত ব্যাপার সত্যিই আছে,
যা না দেখলে শুনে অবাক হতে হয়,
বিশ্বাস করতে মন সায় দেয় না। উদহরণ স্বরূপ বলতে পারি ছাগলকে
কচু পাতা চাপা দেওয়ার কথা।
একটা
ছাগলকে জোর করে পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে, তার মাথার চারপাশে ভাল করে কচু পাতা দিয়ে ঢেকে দিলে, ছাগলটা মরার মতো পড়ে থাকে। বেশ কিছু কচু
পাতা দিয়ে, ছাগলটার
মাথা এমন ভাবে ঢেকে দিতে হবে, যাতে একটুও আলো না ঢোকে। এরপর পাতা না সরিয়ে তার ওপর দিয়ে হেঁটে গেলেও, সে ঐ ভাবে শুয়েই থাকবে। যদি পাতা দিয়ে
মাথা ঢেকে হাত সরিয়ে নিলে, ছাগলটা শুয়ে না থেকে উঠে পড়ে,
তাহলে বুঝতে হবে কোন ভাবে আলো ঢুকছে। কচু পাতা ছাড়া অন্য
কোন পাতা ঐ ভাবে চাপা দিলে, একই ঘটনা ঘটে কী না, আমার জানা নেই বা পরীক্ষা করে দেখা হয় নি।
অনেকে
বলে ছাগলরা মনে করে, সে
মরে গেছে। ছাগল কী মনে করে ছাগল-ই জানে। মানুষ তার মনের গভীরে প্রবেশ করলো কিভাবে, বা বংশপরম্পরাক্রমে সব ছাগল একই কথা মনে
করেই বা কেন জানিনা। তবে ছাগল যে মরার মতো পড়ে থাকে,
এটা পরীক্ষিত,
প্রমাণিত সত্য। অনেকের মুখেই শুনেছি, লাল রঙের ভিজে গামছা চাপা দিয়ে দিলে, মুরগিরও নাকি একই দশা হয়। সব মুরগিই দক্ষিনপন্থী
এবং লাল রঙে অ্যালার্জিগ্রস্ত কী না, আমার জানা নেই।
সেদিন
অঞ্জন ও আমি, পানার
ভেলায় চেপে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছি। পানাগুলো অনেক দিনের পুরানো ও জল না পেয়ে শুকনো
হয়ে গেছে। নতুন করে পানা দেওয়া হয়ে ওঠেনি। দু’জনে স্কুল পালিয়ে মনের আনন্দে ভাসছি। হঠাৎ অঞ্জন “উরি বাবা,
উরি বাবা” বলে চিৎকার করে, জামা ধরে লাফাতে শুরু করলো। কী হয়েছে বুঝতেও পারছি না, সেও কী হয়েছে না বলে, পানার ভেলার ওপর লাফিয়ে যাচ্ছে। পুরানো
পানার অনেকটাই শুকিয়ে বা পচে গেছে। ওর লাফ ঝাঁপে,
ভেলায় জল উঠতে শুরু করেছে। অবশেষে জানা গেল, ওর পিঠে,
জামার তলায় কী একটা ঢুকেছে। জামা তুলে কিছুই দেখতে পেলাম
না। গেঞ্জিটা গুটিয়ে ওপর দিকে তুলতেই, কালো লিকলিকে একটা সাপ পিঠ থেকে পানায় পড়ে,
জলে নেমে গেল। কিন্তু ততক্ষণে ভেলার যা ক্ষতি হবার হয়ে
গেছে। ভেলার যে অংশেই দাঁড়াচ্ছি, সেখানেই আস্তে আস্তে পা ঢুকে যাচ্ছে এবং ভেলায় জল ঢুকছে। বাধ্য হয়ে
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, পাড়ে
ভিরবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। জায়গা পরিবর্তন করতে করতে, পাড়ের দিকে ভেলা নিয়ে যাওয়ার সময় দু’জনেই পানা ভেদ করে জলে নেমে গেলাম। সারা
শরীর ও জামা প্যান্টে পাঁক মেখে, পাড়ে উঠে ভিজে বই খাতা নিয়ে,
সন্তোষদার বাড়ি এলাম। সন্তোষদার মা আমার মধ্যে তাঁর এক
মৃত ছেলে, অসীমকে
খুঁজে পেতেন। তাই সাত খুন মাফ। গামছা পরে,
জামা প্যান্ট ধুয়ে,
উননে বই খাতা,
প্যান্ট জামা শুকিয়ে,
স্কুল ফেরৎ ভাল ছেলের মতো বাড়ি ফিরে এলাম।