গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১৬

সুনীতি দেবনাথ

নন্দিতার কথা


   
আমি নন্দিতা। আমার মত সাধারণ গতানুগতিক মেয়েদের সংখ্যারই ছড়াছড়ি। আমাদের খবর চারদেয়াল সাপটে রাখে, আগলে রাখে। বাইরের পৃথিবীকে বাই বলে একদিন আমার মত গোবেচারীরা অন্যের অন্দরমহলে ঢুকে পড়ে। যেখানে জন্ম সে ঘর তাকে তাড়াবার জন্য ব্যস্ত যে যেখানে এলাম শুরুতে স্বাগত জানালো। আমি খুশি এ আমার একান্ত আমার ঘর! সে আর আমি । ভাল চাকরি । ভাল কামায় । অভাব নেই, মানুষটা খোলামেলা। কোন ঝঞ্ঝাট নেই। প্রথম দেখায় মনে হলো এমনটাই তো চেয়েছি।
        
তাই গোড়ার কথা,  নিপাট খোলা খাতাটা তোমার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। আলতো হাতে নিলে ঝপাৎ করে বন্ধ করে রেখে দিলে পাশের শেলফে।  কিছুটা হতবাক আমি,অনেকটা স্তব্ধ আর প্রশ্নবোধক !
রেখে দিলে যে বড়
?
হা হা সে কী অট্টহাসি
! আমি চুপসে গেলাম।
জানি তো সব বেশী আর কি চাইবে? সবাই যা চায় তাই তো? ও হবে।
মনে মনে ভাবছিলাম কি হবেআর সেটা পড়েই যেন বলে উঠলে
খাড়া বড়ি থোড় আর থোড় বড়ি খাড়া!

আমি গুটিয়ে তখন শামুকের খোলশে। মুখটা আমার মনের আয়না হলো বুঝি, শুকিয়ে খটখটে। ভাবতে চাইলাম কী নিষ্ঠুর! আবার থমকে গেলাম। ও তো মনের কথা পড়তে জানে! কিভাবে পারে বিস্ময় জাগে! বললো পিঠে আলতো ছুঁয়ে, আরে মুষড়ে গেলে কেন? জানি তো সব, আমার দরকার নেই নতুন করে জানার,  সুইট ম্যাডাম! ওর ছোঁয়ায় কেঁপে উঠেছিলাম! আমার অন্তরাত্মা থরথর করছিল! তবু কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস না করে পারিনি, ম্যাডাম বলা কেন? জবাব,  নিমাই ভট্টাচার্যের ম্যাডাম বই পড়োনি? ভাল লাগে।

       তাহলে মন্দ না লোকটা, বেশ রোমান্টিক! প্রাণে আমার পুলক জাগে! সাহস করে বলে ফেললাম, তুমি কি সবজান্তা? ও নির্বিকার নির্বিকল্প হয়ে উত্তর দিয়েছিল, না কমজান্তা। জেনে কি হবে? কিছুটা বিষণ্ণতা যেন টপকে বাতাসে উড়ে গেল। পাত্তা দিলাম না, আমি তখন পুলকিত! আর সেই আমার প্রথম ভুল। এসব শুরুরও শুরুর কথা। ওর বিষণ্ণতার বিষয়ে মনোযোগ দিলে হয়তো পরবর্তী ইতিহাস অন্য হতো। কিছুটা ছাটকাট করলে নৌকোটা তরতরিয়ে চলতো। সেই অনেকদিন আগে সে ভুল করলো খাতাটা না পড়ে। আমি ভুল করলাম ওর বিষণ্ণতার কারণ না জেনে। এভাবে ভুলের পথে চলে চলে আমরা দু 'দুটো জীবন নিয়ে ভুল চক্করে হারিয়ে গিয়েছিলাম।

তারপর কতদিন এলো গেলো। কত নিঝুম রাত বিষণ্ণ ডানা ঝাপটে উথাল পাথাল হলো। আমরা দু 'জন সুতো বাঁধা পুতুল হয়ে সংসার করতে লাগলাম। মনে হতো এতে ওর কিছু যেতো আসতো না। কিন্তু আমার যেতো আসতো। আমার প্রতিটা দিন ক্রমে বোবা দীর্ঘ হচ্ছিল, প্রতিটি রাত দমবন্ধ কান্নায় দীর্ঘতর হচ্ছিল। মনে হতো ওর সঙ্গে প্রাণ খুলে ঝগড়া করি, শোভনতায় বাঁধতো। আমি তো বস্তির মেয়ে না। ও কোনদিন আমাকে একটিও কঠোর, অশোভন কথা বলেনি। শুধু যখন ম্যাডাম বলে ডাকতো আমার সারাটা শরীরে আগুন জ্বলে উঠতো। মনে হতো ও কেন বজ্র, ' ফোঁটা বৃষ্টি হতে পারে না?
আমরা পাশাপাশি কাছাকাছি থেকেছি,একে অপরের জন্য আকর্ষণ অনুভব করেছি। কিন্তু কোনদিন দূরত্বের দেয়াল টপকে একাত্ম হতে পারিনি। আজও ভেবে পাইনা আমার খোলা খাতা ও পড়তে না চাইলেও কিভাবে জানি না ওর না- খোলা খাতার সবটা না হলেও অনেকটাই আমি পড়ে ফেলেছি। আমার খাতাটা পড়ে পড়ে ধুলোয় আচ্ছন্ন হলো, ঝাড়পোছ করে একটি বারও ওর  মনে হয়নি খুলে দেখার।  হয়তো ভাবতো চলছে চলুকএমনি করে যায় যদি দিন যাক না। অথবা ভাবেনি কোন প্রয়োজন আছে। ও ভাবতো দরকার নেই, আমি ভাবতাম দরকার। ফারাকটা এখানেই।
 প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা গা ধুয়ে হালকা প্রসাধনে নিজেকে সাজিয়ে প্রতীক্ষা করতাম। আশা দিনান্তে ও এসে আমাকে দেখে খুশি হবে। কিন্তু ভাবাটাই সার। ও কী ধাতুর মানুষ কোনদিনই বুঝতে পারিনি।আমার চাওয়াটা ছোট্ট ছিল। ও এতো কৃপণ! ছোট্ট চাওয়া যে পাহাড় হয়ে আমাকে চূর্ণবিচূর্ণ করছিলো তা সে কখনো কোনদিন বুঝেনি । যাক।

তুমি সোজা স্নানঘরে। সাফসুতরো। পাজামা পাঞ্জাবী হাতের কাছেই পেলে। এ যেন স্বতঃসিদ্ধ। অভ্যেস হবেই ধরে নেওয়া যায় , কোন ব্যতিক্রম নেই, চমক নেই। সোফায় গা এলিয়ে আয়েস। রিম্যুট নিয়ে চ্যানেলে চ্যানেলে ছুটোছুটি,  কিছুই পছন্দ নয়। চলছে। এটা কি অস্থিরতা? কেন? জানি না।  আমি যন্ত্রমানবী পা টেনে টেনে সোজা কিচেনে। খাবার আগেই রেডি হটকেসে। গ্যাসস্টোভে সসপ্যানে জল ফুটছে টগবগ। আমিও ফুটছি। তবে শব্দহীন। জানলার ওপারে নিপাট ভাঁজখোলা কালো ঢাকাই জামদানি হাজারবুটি অন্ধকার। বুটিগুলি চমকাচ্ছে আলোর ফুটকি হয়ে। বোবা অন্ধকারের অন্তরের আগুন যেন আমার বুকে দাউদাউ। ভাবতাম একদিন হয়তো চুপচাপ এসে পা টিপে বলবে, ম্যাডাম কোন সাহায্য? হ্যাঁ তোমার সাহায্য খুব দরকার ছিলো। আমার বুকের ভেতরকার আগুন নেভাতে দরকার ছিল। অথচ তুমি নির্বিকার। একফোঁটা বৃষ্টি হওনি। আমিও যে খোলা আকাশ চাই, সবল উড়াল চাই, বোধহয় কল্পনাতেও কোনদিন ভাবোনি।

        মনে আছে সেই প্রথমদিকে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে, ঠোঁটে টুকরো হাসি ঝুলিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলে, সারাদিন কি করলে? জবাব দিইনি। কেন জানি লাজুক হলাম। আনত মুখে মুচকি হাসি চেপে গেলাম। তুমি তাগিদও দাওনি জবাবের। আমার খোলা পাতা যে তোমার সব পড়া হয়ে গিয়েছিল। তাগিদ দিলে দোনামনা না করে হয়তো বলে ফেলতাম, কেবল গুনগুন সারাদিন, আজ সারাদিন আঁচল উড়িয়ে খোলা চুলে বাতাসের সাথে কানাকানি। আজ সারাদিন আমাদের ঘরের সামনের গুলমোহরের ঝরা পাপড়ি কুঁড়োনো। আঁচল ভরে ঘরে এনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে একসা। আজ দুপুরে মিছিমিছি মিছিলে হেঁটেছি, ঘেমেছি। ময়দানের জমায়েতে স্লোগানে গলা ফাটিয়েছি। আসলে সবই মিছিমিছি।

সেদিন তোমাদের অপিসসুদ্ধু সবাই মন্দারমণিতে পিকনিকে গিয়েছিলে। সবাই বৌবাচ্চা নিয়ে গিয়েছিল। রাত ন' টায় ফিরেছিলে। ঘরে আসতেই অচেনা একটা গন্ধ পেলাম। ভাল লাগেনি নাক কুঁচকে গিয়েছিল। সে রাতে আমার চেনা বিছানায় আমি ধর্ষিতা হলাম। ধর্ষক পুরুষ তুমি, আমার আইনানুগ স্বামী। তোমার মুখে তখন সেই ঝড়ের মুখে প্রথম ও শেষবারের মত তন্দ্রার নাম শুনলাম। ঘোরে থাকা তুমি বারবার চাপা গলায় নামটা উচ্চারণ করেছো। আমি চূর্ণ বিচূর্ণ হলাম। একটা ঘেন্না আমাকে গ্রাস করলো। না আমি কাঁদিনি, শুধু ধিকিধিকি যে আগুন বুকে জ্বলছিল তা দাউদাউ জ্বলে উঠে আমাকে গ্রাস করলো। সেদিন তোমার খাতাটা পুরো পড়া হয়ে গেলো আমার। আমি নন্দিতা জেনে গেলাম একজন অনুগৃহীতা, আশ্রিতা ছাড়া আমি কিছু নই। আমার কোন ঘর নেই, নেই পিত্রালয়, স্বামীর ঘর। আমার যাবারও কোন ঠিকানা ছিলো না। সেদিন থেকে আমি আরও নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। তুমিও আমাকে যেন কিছুটা এড়িয়ে চলতে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে স্নান করে চায়ের টেবিলে মুখোমুখি বসা হলো না। তোমার প্রয়োজনীয় সব সাজিয়ে দিয়ে আমি চলে যাচ্ছিলাম,তুমি কুণ্ঠিত গলায় বললে, সরি। আমি সেদিন সরাসরি তোমার চোখে তাকালাম, স্পষ্ট গলায় বললাম, কেন? এদিন তোমার মাথা নীচু। জবাব দিতে পারনি। আমার বড়মামা বিরাট কোম্পানির মালিক। তাঁর দরিদ্র বোনের মেয়ে আমাকে তুমি বিয়ে করেছিলে কেন তা আমি বুঝে গেছি। কারণ বিয়ের পরপর ম্যানেজমেন্টের উঁচু পদে তোমার প্রোমোশন হলো। কে তন্দ্রা জানি না তার কি হলো তাও জানি না। তোমাকে আমি খারাপ মানুষ ভাবি না। ভদ্রলোক। কেরিয়ারের জন্য তুমি তিন তিনটে জীবন নিয়ে খেললে, এটা মানতে পারিনি আমি।

আমাদের একমাত্র সন্তান রুদ্র এখন আমেরিকাতে। বিশাল এক সফ্টওয়্যার কোম্পানিতে বিশাল পোস্টে চাকরি করছে। দৈবাৎ এদেশে আসে। ওদেশী মেয়ে বিয়ে করেছে। ওখানে গ্রীনকার্ড পাবার ধান্ধায় আছে। আমার কষ্ট হয় না। ওরা ভাল আছে, থাক। কষ্ট হয় কাছে থাকা তোমার জন্য। করুণা হয় মেরুদণ্ডহীন তোমার জন্য। যা হবার হয়েছিল, এরপরও তুমি পারতে গড়ে নিতে। হেরে গেলে।

          একা এক ঘর, একা ঘরে একা আমি, একা তুমি। আজ এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা, মধ্যিখানে চর নেই, আছে এক সেতু। তুমি পার হবার আনন্দে তরতর পেরিয়ে ওপারে। পেছনে সেতুর এপারে একা আমি থরথর কাঁপছি। তুমি হাত ধরোনি বলে ভয়ে আমি একা সেতু পেরোতে পারিনি। আমি পাথর প্রতিমা, নিস্পন্দ, নিষ্কম্প। দেখছি তোমার পেছনটা, তোমার উন্নত মাথা, সবল পেশীর ঘাড়, পিঠ আর তুমি। তুমি দেখোনি তুমি পেরোবার পর সেতু ভেঙ্গে দু' টুকরো। ওপারে তুমি, এপারে আমি একা, নিস্পন্দ। আর আশা নেই।