গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।
মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৬
সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায়
কাদায়
পা টেনে টেনে কোনরকমে উঠে আসছিল সরল। এত শুনশান জায়গায় নিজের নিঃশ্বাসের শব্দে ভয়
হয়। সারা শরীরে পাঁকআর ঝাঁঝি লেপটে আছে
জলকাদা ঢুকে
লুঙ্গিটা ভারি হয়ে উঠেছে। হাতে প্লাস্টিকে মোড়া দুটো ছেঁড়া শাড়ি । আরও প্রায় আধ
মাইল হেঁটে পৌঁছবে মালোপাড়া । পিছনে কিছু একটা সরে যাওয়ার আওয়াজ। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে
পরে সরল। কেউ কি পিছু নিল? চুপচাপ
দাঁড়িয়ে পরে সরল। যেমন করে হোক আড়ালে আড়ালে পৌঁছতেই হবে আজ
দুটো
ভাত পেঁয়াজ তেলে মেখে খেয়ে নে মা। সে আসবে ঠিক দেখিস। কাল মাঝরাতে তোকে পিঠে করে
টেনে এতটা জল বেয়ে এখানে এনে রেখে গেছে। তখনও গা পা দিয়ে রক্ত ঝরছিল। রাতে রাতে
ফিরে গেছে তোকে বেহুঁশ দেখে। এসে পড়বে ঠিক। তুই দুটো মুখে দে রে মা... একটানা
বলছিল বলাই মালো। ঘরে কোন মেয়েছেলে নেই। এ গাঁ সে গাঁ ঘুরে গান গেয়ে ভিক্ষে করে
চালায়।
মানুষ জেবন বড়
বালাই
ঘরটি না থাক ধম্ম
যে চাই
কারে ডাকি পরাণ
ভরে
মন্দির আছে
বিধাতা নাই ...
ক'দিন আগে বলাইকে ধরে কিছু লোকজন শাসিয়ে
গেছে এবার ভোটে নাম তুলতে হবে আর নাম তোলার আগে বাপুধম্মটি বলতে হবে । বলাই হেসে
হেসে মাথা নাড়ে আর গায়। শাসানি যে তার গায়ে তেমন লাগে তা মনে হয় না।সরল কি বুঝে ময়নাকে
এখানেই এনে তুলেছে কে জানে ।লোকজন যখন লাঠি সোটা নিয়ে ময়নার ভাঙা আস্তানার দিকে
দৌড়চ্ছিলতখন সরল আর কিছুই ভাবতে পারে নি।কিসের বুদ্ধিতে কে জানে চট করে নিজের
গামছায় খানিক কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে সেটামোড়ল বাড়ির খামার ঘরের চালে ছুঁড়ে
দিয়েছিল। মুহূর্তের মধ্যে ঘুরে গেছিল ভিড়টা। সেই ফাঁকে সরলময়নার নড়বড়ে ঘরের দরজা
ভেঙ্গে ওকে প্রায় বেহুঁশ অবস্থাতেই বার করে এনে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল।তারপর প্রায়
ঘন্টাখানেক পাড় ধরে ধরে টেনে এনেছে ময়নার জলে ভারি শরীরটাকে। পাড়ে উঠেওকে ফেলে
রেখেই দৌড়েছে বলাইকাকার কাছে। তারপর দুজনে মিলে কোনরকমে মেয়েটাকে তুলে এনে ফেলে
রেখেই নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে সরল। ভিজে গায়ে গাঁয়ে ফিরলে লোকে ভাববে রোজের মতইমাঝ
রাতেজাল নামিয়ে ফিরল বুঝি নদী থেকে।
এদিকে বলাই সেই
থেকে সেঁক তাপ দিয়ে দিয়ে হুঁশ ফিরিয়েছে মেয়েটার। কিন্তু এক্কেবারে সাদা চোখে
তাকিয়ে থাকা ছাড়া মেয়েটার মধ্যে বেঁচে থাকার কোন লক্ষনই নেই। এই চব্বিশঘন্টায়
একবারো বাথরুমেও ওঠেনি।
খুব
সাবধানে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিলসরল। কেউ পিছু নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। তবু নদীর ঢালে
ঢালে এগোনোই ভালো।বেঁচে আছে কি ময়না? এত টান লাগছে বুকে কিসের লেগে কে জানে।ওর তো কেউ হয়না মেয়েটা।
প্রানের বন্ধু ছিললখাই। সেই লখাইকে বাড়ির লোক ধরে করে বিয়ে দিল সাতগাঁর ময়নার
সাথে। ছোট ফুটফুটে ময়না বউ হয়ে এল, সাথে
এল লখাইয়ের ডিঙ্গি। ময়নার বাপ যৌতুকে আরও কিসব দিয়েছিল আর দিয়েছিল এই মাছধরার নতুন
চকচকে ডিঙিখানা।লখাইয়ের বাপ বলল বউয়ের পয়ে শহর বাজারে এবার নিজের মাছের দোকান
দেব।কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেই নৌকায় বসে ভোরের ধরা মহাশোলের কষকষে ঝোল দিয়ে
ভাত খেতে খেতেই বনবিবির এক থাবার টানে চলে গেল লখাইয়ের বাপ। সেই থেকে লখাইয়ের মা
কথায় কথায়ময়নাকেদুষত । সরল ওদের বাড়িতে গিয়েও দেখেছে কারনে অকারণে ময়না মার
খাচ্ছে। এর মধ্যে বাপ হওয়ার সখ জাগল লখাইয়ের । ছোটখাট ময়না মাথা নিচু করে বাড়ির
কাজ করত গালমন্দ খেতে খেতেই।লখাই তবুকদিন ময়নাকে আগলে রাখছিল মায়ের থেকে । ছেলে হল
ময়নার। ফুটফুটে ছেলেকে মোটা করে কাজল পরিয়ে ময়না কোলে নিয়ে বের হত ।মাঝে মাঝে সরু
গলায় সুর টেনে টেনে আদর করত 'গোপাল
আমার , কানাই আমার... ' লখাই,
ময়না, কোলের
ছেলে সব দেখে সরলেরও মাঝে মাঝে ঘরবসতের ইচ্ছে হত বই কি!এর মধ্যেই লখাই বলল
মনিহারিরপলান ঘোষের দিঘীতে জাল মেরে মাছের শ্যাওলা ছাড়াতে হবে। সরলকেও ডেকেছিল
কিন্তু ক'দিনের জ্বরে
সরলের তখন বেহাল অবস্থা। গাঁয়ের আর দুজনকে নিয়ে লখাই গেল শ্যাওলা ছাড়াতে, ফিরে এল তিনদিন পর পচা ঢোল হয়ে। দিঘীর
দামে পা জড়িয়ে জলে পড়েছিল নাকি। কিন্তু জলে বাস করা লখাই জাল ছাড়িয়ে ঘাটে উঠতে কেন
পারেনি সেটাই আশ্চর্য। কেউ বলে জলের মধ্যে বুড়ো কালকেউটে ছিল। ছোবল দিয়ে শেষ করে
দিয়েছে। কেউ বলে গলায় দাম ঢুকে দম আটকে গেছিল হয়ত।
আছাড়
কাছাড় দিয়ে কাঁদছিল ময়না আর শাপ দিয়ে দিয়ে কাঁদছিল লখাইয়ের মা।কাঁদতে কাঁদতেই দৌড়ে
ঘরে গিয়ে ঘুমন্ত নাতিটাকে তুলে এনে নিজের ঘরে আটকে দিয়েছিল। দু বছরের মধ্যে যে বউ
শ্বশুর সোয়ামী সব খেয়েছে সে তো ছেলেকেও খাবে! শোকে দুঃখেময়না পাগল হয়ে গেছিল। কোলের
খোকাটাকে একটু দেখবে বলে সারাদিন এ দোরে ও দোরেলোকের বাড়ির দেওয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে
কাঁদত।এরই মধ্যে বর্ষা এল ঝেঁপে। শেষরাতে জাল গুটিয়ে বাড়ি ফেরার সময় লখাইদের বাড়ির
নিয়মমাফিক কান্না শুনতে শুনতেই কথাগুলো পরিষ্কার হল... সাপে কেটেছে... মনসার ঝি
ডাইনি বউটাশেষ অবধিকোল থেকে নিল আমার নাতিটাকে বলে চিৎকার করে কাঁদছে লখাইয়ের
মা... দৌড়েছিল সবাই... বুড়ি নাতিকে পাশে নিয়েই ঘুমোয়। মাঝরাতে নাতির কান্নায় উঠে
নাকি দেখেলিকলিকে সবজে লাউডগাটা খোকার পা বেয়ে নেমে যাচ্ছে আর ময়না দরজায় দাঁড়িয়ে
দেখতে দেখতে খিলখিল করে হাসছে... শিউরে উঠেছিল সরল ।সোয়ামী আর ছেলে হারানোর
জ্বালায় বুড়ি ময়নাকে বাঁচতে দেবে না আর... এ সময় সবাই বাড়ির চারপাশে কার্বলিক
অ্যাসিড ছড়িয়ে রাখে। সাপের সাথে বাস করা তো নতুন না। এ বাড়িতে কোন পুরুষ নেই।
এসবগুছিয়ে করার লোক কই আর! সরল নিজেকেই দুষছিল । লখাই নেই,
এখন ওরও তো এসব খেয়াল রাখা উচিত।লখাইয়ের মায়ের ইনিয়ে বিনিয়ে
কান্নার মাঝে ময়নাকে কিন্তু কেউ কোথাও খুঁজে পায় নি সে রাতে।
নাতিটা
কিন্তু মরে নি। সাপে কাটেই নি বোধহয়। অথচ নাতি মরল নাতি মরল বলে কাঁদতে
কাঁদতেইলখাইয়ের মা ময়নার ঘর থেকে জিনিসগুলো ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলবাইরে।পরের
দিন ঘরে ফিরে চতুর্দিকে ওর জিনিস ছড়ানোদেখেও রা কাড়েনি ময়না।ঘরেও তোলেনি
কিছু।শাশুড়ি বুড়ি ওকে দেখেই লাঠি হাতে তেড়ে এসেছিল। পায়ে পায়ে পিছোতে পিছোতে বাড়ির
বেড়া পার হয়ে গেল শেষে। বিকেলের দিকে ছিপ টেনে ফেরার সময় সরল দেখেছিলনদীর ঢালের
গায়ে ভাঙা দেউলের পাশের তস্যভাঙ্গা ঘরটার গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছেময়না।সাধারণত
গাঁয়ের মেয়ে বউরা ওখানে চাতালে বসে দুটো গল্প সল্প করে,
নদীতে নেয়ে উঠে কাপড় চোপড় বদলায়।আর কোথাও ঠাঁইনা পেয়ে ঐ পোড়ো ঘরেই
আশ্রয় নিয়েছিল মেয়েটা।এদিকে লখাইয়ের মায়েরগল্পটামুখে মুখে খুবছড়াল। কেউ বলে বুড়ি
নাকি উঠে দেখেছে বড় বড় দাঁত বেরিয়ে এসেছে ময়নার। ছেলের পা ধরে টান দিচ্ছিল।সেই
টানেই খোকাটা কেঁদেওঠে । নইলে তখনি দাঁত বসিয়ে রক্ত চুষত। কেউবলে রাতে বুড়ি
ঘুমোলেই ময়না নাকি পাড়া বেড়াতেবেরোয়। কারুর ঘরের দরজা খোলা আছে কিনা দেখে...
পাড়ার
বউ ঝিরাও ধীরে ধীরেঐ ঘাট এড়িয়ে চলতে শুরু করল। সরল কখনও কখনও ঘাটে গিয়ে দেখেছে ময়না
নদীরে পারে জল কাদার মধ্যে চুপ করে বসে দূরে কোথায় তাকিয়ে থাকে। মা বাপ মরেছে
সরলের সেই কোন ছোটবেলায়। নিজেরও বে থা নিয়ে মাথা ঘামাতে ইচ্ছে করে না। শুধু এই
মেয়েটাকে দেখেই বুকের ভেতরে যেন মায়া চুঁইয়ে নামে।প্রায় দিনই খানিকটা খাবার কাগজে
মুড়ে ওর ভাঙা দরজার কাছে রেখে আসে সরল।
মাঝে
দুদিন গঞ্জে থাকতে হল। মহাজনের আড়ত থেকে টাকা তুলে চিংড়ির মীন কিনে বিকেলের দিকে
গাঁয়েফিরে দেখে সালিশি সভা চলছে। বর্ষার মধ্যেঘরে ঘরে জ্বর জ্বারি পেটের ব্যামো
ভেদবমি লেগেই থাকে। কিন্তু এবছর এসবেরকারন নাকি ময়না। অবাক হয়ে শুনছিল সরল ময়না
নিজের ছেলেটাকে খেতে না পেরে এখন গ্রামের ছেলেপুলের দিকে হাত বাড়িয়েছে। এমনকি কদিন
আগে বিভু ঘোষের নতুন বিয়োনো ছাগীটাও মরেছে ওরই নজরে। বিভুর ছেলে নাকি দেখেছে
ছাগীটা উঠোনে পড়ে যখন ছটফট করছেতখন ওদের বেড়ার ধারে ময়না একদৃষ্টিতে ওদিকেই তাকিয়ে
দাঁড়িয়ে ছিল । এই ডাইনিকে আর গাঁয়ে থাকতে দেওয়া যায় না... বলছিল অনেকেই।
অসহ্য
লাগছিল সরলের। কিন্তু সালিশি সভায় বিরোধিতা মানে নিজেকে দাগিয়ে দেওয়া। সরে এসেছিল
তখন। ঘন্টাখানেক পর হইহই শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে বুঝেছিল বিধান দেওয়া সারা হয়েছে।
ময়নাকে খুঁচিয়ে মারার উল্লাস স্পষ্ট হয়ে উঠছিল দলটার মধ্যে। চট করে ভেবে নিয়েছিল
সরল। পুলিশ থানা বারো ক্রোশ দূরে। তাছাড়া তাদের খবর দিতে পারলেও আসত কিনা সন্দেহ।
দড়ি থেকে গামছাটা টেনে তাতে তেল ঢেলে আগুনটা ধরিয়ে ছুঁড়ে দিয়েছিল মোড়লের খামারে...
খুব
সরু আলোর রেখা চুঁইয়ে আসছে দরজার ফুটো দিয়ে। পিছনে পায়ের আওয়াজে চমকে লাফিয়ে ঘুরে
দাঁড়ায় সরল। কোমরের হেঁসোটা হাতে উঠে আসে। নাহ,
পিছনে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে বলাই
"যাও কেনে,ঘরে আছে মা আমার... তবে কিছুই খাওয়াতে পারি নাই। দেখ তুমি যদি
পার"
পায়েপায়ে
এগোয় সরল। জানলার পাশে তক্তাপোষের ধারে চুপ করে দাঁড়িয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে আছে
ময়না। গোটা চুলে জট, হাতে
পায়ে এত শ্যাওলা যেন পাকা বোয়ালের শরীর। চকিতে ভেসে আসে ক'বছর আগের দেখা চিকন শ্যামলা ঘোমটা টানা নাকের নথ সামলাতে গিয়ে
হেঁচে কেশে একসা সেই ছোট্ট বউটি।
কাঁধে হাত দিতেই
চমকে পাশ ফেরে আর এই প্রথমবার দুচোখ ভেঙ্গে জল উপচে আসে মেয়েটার । শক্তপোক্ত
সরলকেদুহাতেআঁকড়ে ধরেময়না ডুকরে ওঠে 'খোকা কই! খোকানাই!!'
বাইরে বলাই
ঠাকুরের গুণগুণ সুর ভাসে
মানুষ জীবন দুই
মুঠো ছাই
কোথায় রাখি কোথায়
সাজাই
যে জন আছে হৃদ
মাঝারে
পেয়েও তারে চক্ষে
হারাই .....
নিঃশ্বাস ফেলা
দূরত্বে থেমে থাকা জল থইথই দুচোখের ভাষা পড়তে পড়তে দুটো কড়া পড়া হাত ময়নাকে বুকেটেনে
নেয় । আর না, এই সাঙ্ঘাতিক ডাইনিটাকে নিজের
বুকে আগলে রাখার সুযোগ আর হারাতে চায়না সরল।
সঙ্গীতময় দাস
এটা আসলে কোন গল্প নয়, ঘটনার বিবরণ । মনিষীরা বলে গেছেন গল্প লিখতে গেলে চরিত্র গুলোর বুকের দরজা খুলে দেখে নিতে হবে। তার মানে ঐ রকম কোন মানুষের সুখ, দুঃখ, আবেগের সাথে পরিচিতি থাকতে হবে। কিন্তু অকপটে স্বীকার করছি, এখানে যার কথা বলব, তার সুখ দুঃখের কথা জানা, আমার মত মধ্যবিত্ত ভীরু ছাপোষার পক্ষে অসম্ভব। সেটা পারতেন যিনি তিনি আর এক মনিষী। ৯০ বছর বয়েসে এক আজীবন সংগ্রামী ইতিহাসকে পিছনে ফেলে তিনি কিছুদিন আগে চলে গেছেন। তাই এখানে যেটা নিবেদন করব, তা আদৌ কোন গল্প নয়, ঘটনার ধারা বিবরণী বলতে পারেন। আমি একজন খেপ খেলা হিসাবরক্ষক। কয়েক জন ব্যাবসায়ীর অর্থনৈতিক ময়লা সাফ করতে, সপ্তাহে একদিন/ দু দিন করে আমায় তাঁদের অফিসে হাজিরা দিতে হয়। তাঁরা আমার প্রতিপালক, অতএব তাঁদের প্রতি অবিচল শ্রদ্ধা রেখে, তাঁদের যাবতীয় দুর্গন্ধযুক্ত আদান প্রদানকে, আমায় দু হাতে সাবান মাখিয়ে পরিষ্কার করতে হয়। এ রকম দলিত শ্রেণীর কাজ করার জন্য আমার বিশেষ আক্ষেপও নেই। বরং দেখি, লোকে আমাকে বেশ সম্মানজনক চোখই দেখে। এভাবেই আমি এক দোতলা বাড়ির ছাদ থেকে পৃথিবীটাকে দেখি। দোতলা বাড়ির ছাদের একটা সুবিধা আছে । মাটির কাছাকাছি থাকা যায় । মোটামুটি সবকিছু উপর উপর দেখা যায়, কিন্তু কাদা লাগে না। দোতলা বাড়ির মানানসই একটি দু-চাকার মোটরসাইকেলও আছে, যাকে বাইক বললে গাড়ীর কাছাকাছি বোঝায়। তাতে চড়ে আমি সারা কলকাতা চষে বেড়াই।
গড়িয়াহাটের মোড়ে একটা অফিসে আমি সপ্তাহে একদিন যাই। গড়িয়াহাটের ফ্লাই-ওভারের নীচে বাইক পার্ক করার জায়গাও আছে। ঐ পার্কিং স্লটের এক কোনে, পুলিস চৌকিটার পেছনে, সারা বছরই কিছু মানুষের মত জীব বাস করে। এরা যেন রাস্তারই একটা অঙ্গ। রাস্তার কুকুর-বিড়াল, গাড়ী-ফেশটুন এবং এই সব জীবদের বাদ দিলে, রাস্তা ঠিক স্বয়ং সম্পূর্ন হয় না। এক মেঘলা দিনে, সবে বাইকটা রেখে বেরোতে যাব। ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। অগত্যা, মোটর সাইকেলের বাক্স থেকে বর্ষাতিটা বের করে, গায়ে চাপাতে চাপাতে, লাগালাম এক দৌড়। কাজ শেষ করতে করতে সূর্্যেের আলোও শেষ হয়ে গেল । এলাতে এলাতে বাইকের কাছে এসে, মাথায় হাত। বাক্সটা খোলা। চাবি!!! পকেটে হাত দিয়ে দেখি চাবি নেই। বাক্সের ভিতরে গাড়ীর কাগজ ছিল, তাও নেই। বাইকটা চুরি হয়ে যায় নি, আমার পিতৃপুরুষের ভাগ্য বলতে হবে। গলার মধ্যে পুরো উদ্বেগটা ঢেলে দিয়ে, চেঁচিয়ে ডাকলাম স্লটের চৌকিদারকে।
আপনি কি রকম লোক মশাই? চাবি ছেড়ে চলে গেছেন? আমার কি দশখানা চোখ, যে সব
গাড়ির উপর নজর রাখব? “বাইকের কাগজগুলোও পাচ্ছি না” শুনে ওনার মেজাজ আরো সপ্তমে চড়ল।
দাঁড়ান দাঁড়ান , বাইক ছোঁবেন না। অনেক লাফরা আছে। আগে পুলিস ডাকি। কাগজপত্র নেই। বেনামী গাড়ি, পুলিসের হাতে তুলে দিতে হবে।----আমার মাথাটা ঘুরে গেল। পুলিসের হাতে গেলে এখন ছ মাসের কারাগারবাস হবে আমার বাইকের। গাড়ি গেলে খাব কি! এমন সময় ষোড়শী দর্শন। মাথার রুক্ষ চুলে তেলের আভা আছে। হাতে পায়ে ময়লার কালো ছোপগুলো এখনও চেপে বসে নি। মুখের লাবণ্য এখনও মরুভূমিতে শুষে নেয় নি। মোটের উপর রাস্তার
বাচ্চাদের মত এখনও ঘিয়ে ভাজা হয়নি। “কেমন মানুষ গো তুমি। হুড়মুড় করে চলে গেলে? এই নাও চাবি”। চাবি পেয়ে বুকের ধিকপুকুনি কমল। কিন্তু ফাইলটা ! ওটা না পেলে বাইক যে থানায় জমা যাবে – আমার আকুতি ঝরে পড়ে। “ এই নাও। খাতাটা পড়ে গিয়েছিল, বৃষ্টির জামা বার করতে গিয়ে। হুশ নাই না কি”– ঝংকারেও আমার কানে মধু ঝরে পরল যেন। ভগবানকে একরাশ ধন্যবাদ দিলাম। দেও পাঁচ টাকা দেও তো– বলে হাত পাতল মেয়েটা।
আমি তার হাতে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিলাম। ভগবানকে পুজো দিলেও এর চেয়ে বেশি লাগত। এবার আমার অবাক হবার পালা। মেয়েটা বলল – “না পাঁচ টাকাই দেও” “কেন রে! আমি তো খুশি হয়েই দিচ্ছি তোকে। নে হাত পাত”। “না। তুমি জানো না বাবু, পঞ্চাশ টাকা পেলে মাগীটা বলবে এত কমে এই গতর বেচেছিস । ন্যাকামো মারার জায়গা পাও নি। দে বাকি টাকা দে । খুব মারবে বাবু । তুমি আমাকে পাঁচ টাকাই দেও”।
আপনি কি রকম লোক মশাই? চাবি ছেড়ে চলে গেছেন? আমার কি দশখানা চোখ, যে সব
গাড়ির উপর নজর রাখব? “বাইকের কাগজগুলোও পাচ্ছি না” শুনে ওনার মেজাজ আরো সপ্তমে চড়ল।
দাঁড়ান দাঁড়ান , বাইক ছোঁবেন না। অনেক লাফরা আছে। আগে পুলিস ডাকি। কাগজপত্র নেই। বেনামী গাড়ি, পুলিসের হাতে তুলে দিতে হবে।----আমার মাথাটা ঘুরে গেল। পুলিসের হাতে গেলে এখন ছ মাসের কারাগারবাস হবে আমার বাইকের। গাড়ি গেলে খাব কি! এমন সময় ষোড়শী দর্শন। মাথার রুক্ষ চুলে তেলের আভা আছে। হাতে পায়ে ময়লার কালো ছোপগুলো এখনও চেপে বসে নি। মুখের লাবণ্য এখনও মরুভূমিতে শুষে নেয় নি। মোটের উপর রাস্তার
বাচ্চাদের মত এখনও ঘিয়ে ভাজা হয়নি। “কেমন মানুষ গো তুমি। হুড়মুড় করে চলে গেলে? এই নাও চাবি”। চাবি পেয়ে বুকের ধিকপুকুনি কমল। কিন্তু ফাইলটা ! ওটা না পেলে বাইক যে থানায় জমা যাবে – আমার আকুতি ঝরে পড়ে। “ এই নাও। খাতাটা পড়ে গিয়েছিল, বৃষ্টির জামা বার করতে গিয়ে। হুশ নাই না কি”– ঝংকারেও আমার কানে মধু ঝরে পরল যেন। ভগবানকে একরাশ ধন্যবাদ দিলাম। দেও পাঁচ টাকা দেও তো– বলে হাত পাতল মেয়েটা।
আমি তার হাতে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিলাম। ভগবানকে পুজো দিলেও এর চেয়ে বেশি লাগত। এবার আমার অবাক হবার পালা। মেয়েটা বলল – “না পাঁচ টাকাই দেও” “কেন রে! আমি তো খুশি হয়েই দিচ্ছি তোকে। নে হাত পাত”। “না। তুমি জানো না বাবু, পঞ্চাশ টাকা পেলে মাগীটা বলবে এত কমে এই গতর বেচেছিস । ন্যাকামো মারার জায়গা পাও নি। দে বাকি টাকা দে । খুব মারবে বাবু । তুমি আমাকে পাঁচ টাকাই দেও”।
আমার মুখ দিয়ে কথা বেরোল না। জিজ্ঞাসা করা হল না কোন মারবে। আমি নীরবে পাঁচ টাকা দিয়ে চলে এলাম। ভালবাসা নয় মমতা বলতে পারেন। প্রতি সপ্তাহে বাইক রাখার সময় চোখ খুঁজত মেয়েটাকে। ও কি করে জানি বুঝে গেল আমার মনের ভাবাবেগ। রাস্তার কুকুরের পিঠ চাপরে বিস্কুট দিলে তারাও গায়ে উঠে আদর খায়। তাই আমার যাবার দিনে ঐ মেয়েটাই অপেক্ষা করত আমার জন্য। আমি যে বাইকটা রেখে খাবারের প্যাকেট টা তুলে দিতাম ওর হাতে। এ ভাবেই একটা ধূসর অভিজ্ঞতা হল মানুষ কুকুরের বাচ্চাগুলোর সম্পর্কে। একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, “হ্যা রে তোর মা বুঝি খুব মারে?” মা!!! মা কে ? ঐ মাগিটা তো আমায় বড় করেছে বেচবে বলে। একদিন আমি যখন ছোট। ওর লোকটা আমার মাকে লাগিয়ে দিল। আমার মা টা ওর লোকটার সাথে চলে গেল। ওর কোলে তখন একটা খানকি। আমার বাপ আর মাগিটা মিলে আমাকে দিয়ে ভিক্ষা করাত। এখন ভাল বাবু পেলে বেচে দেবে আমাকে”। একরাশ ঘৃণা ঝড়ে পড়ছে চিখ বেয়ে। “তুমি কিনবে?”- অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন ।
ভাগ্যিস ভগবান আমাকে প্রচুর টাকা দেয় নি। মেয়ের উচ্চশিক্ষার খাতে জমাতে জমাতেই আমি ফতুর। তাই এই রকম লোভনীয় প্রস্তাবে সায় দেওয়া হয়ে ওঠে নি। পারভারসান বঞ্চিত মধ্যবিত্তদের ভীরু স্বপ্নের মধ্যে লুকিয়ে বাসা বাঁধে। কিন্তু সাহসে কুলোয় না। তাই অনেকেই বেশ নীতির দোহাই দিয়ে সান্তনা খোঁজে। যাই হোক, মমতা আর কৃতজ্ঞতার দোআঁশলা অনুভূতির দোহাই দিয়ে আমি যখনই যেতাম কিছু খাবার নিয়ে যেতাম। মেয়েটা মোনালিসা হাসি হেসে খাবার গুলো নিয়ে আমার বাইকের উপর বসত। তারিয়ে তারিয়ে খেত। পারভারসানকে আপাত্য স্নেহে পরিণত করে, আমিও বাৎসল্য রসে আপ্লুত হতাম। এভাবেই পূজো মানে দুর্গাপুজো, বাঙ্গালীর সবচেয়ে বড় উৎসব দরজায় কড়া নাড়ল। মহালয়ার আগে একবার গিয়েছিলাম, মেয়েটাকে দেখি নি। তারপর আর ও রাস্তা মাড়ানো হয় নি। অষ্টমীর দিন। বালিগঞ্জ আলোর মাদকতায় মসগুল হয়ে আছে। এ প্যান্ডেল ও প্যান্ডেলে ঘুরে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ একটা গোলমালে আকৃষ্ট হয়ে পতঙ্গের মত পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। রং চটা ময়লা শালোয়ার কামিজ পড়া মা-দুর্গা ধু-লুন্ঠিত। পেশীবহুল অসুর তখনো হাত তুলে দাড়িয়ে আছে। তার সোনার পাঞ্জাবী অষ্টমীর বারোয়ারি ভোগের কল্যাণে মায়ের ভোগে গেছে। মাইকে তখনও ডাক হচ্ছে—অষ্টমীর ভোগ নিতে যারা যারা ইচ্ছুক তারা আমাদের কার্যালয়ে এসে ভোগ সংগ্রহ করুণ। কি ব্যাপার! কানে যা উড়ে এল তা থেকে আসল তথ্য ছেঁকে নিলে যা দাড়ায় তা হল এই যে, মেয়েটা মায়ের ভোগ প্রসাদ নিয়ে এক ছুটে বেরোতে গিয়ে ধাক্কা মেরেছে। এবং সোনলি পাঞ্জাবি ভোগে মাখামাখি। তা সে বাবু সেই পাঞ্জাবীর শোকে উতলা হয়ে, ভিখিরী মেয়েটাকে উত্তম-মধ্যম দিয়েছে। মেয়েটা রক্ত আর অশ্রুতে হোলি খেলে মুখ তুলে তাকাল। আরে এ তো আমারই সেই মমতা । সেই আদর মাখানো স্ট্রে। কিন্তু যতই হোক, আয় আয় ... চুক... চুক... করে ডাকা যায়, কিন্তু কোলে তোলা যায় না । কারন আমিও যে বাবু। একটা মুখোস চাই, একটা ছদ্মবেশ। দৌড়ে গিয়ে অসুরকে বললাম “কি করছেন মশাই। পুলিস কেসে জড়িয়ে যাবেন যে। যান যান। যা হবার তো হয়েই গেছে, বাড়ি গিয়ে তাড়াতাড়ি ধুয়ে ফেলুন। দাগ পড়ে গেলে আর উঠবে না”।
দাগ পড়ার ভয় আমারও আছে । তাই যেন একজন পুজো কমিটির মেম্বার, সেই রকম ভাব নিয়ে মেয়েটাকে বললাম “ অত হুড়মুড় করার কি ছিল। এক বাটি খেয়ে লাইনে দাঁড়াবি আবার ? চল অফিস ঘরে ... দু বাটিই খাস”। মমতাকে (আসল নাম জানি না। আমার মমতার পোষ্য, তাই নাম দিলাম মমতা) নিয়ে বাইরে এলাম। টিউবয়েলের জলে ঠোটের কোনের রক্তটা মুছিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম “ কিছু খাস নি আজ?” “না রে বাবু। পুজোর সময় কোথাও ভিখারিদের বসতে দেয় না । ভিক্ষা না পেলে খাব কি?”“চল আজ তোকে খাওয়াব, যা খেতে চাইবি। আমি আর তুই খাব” বেদুইনে নিয়ে গেলাম। মটল কষা দিয়ে ফ্রাইড রাইস খেলাম দুজনে, তারপর থাম্পস-আপ... অনেকেই দেখছে আড়-চোখে। ভাবছে বোধ-হয় কাজের লোকটাকে পুজোর সময় জামাও কিনে দেয় নি, বেদুইনে খাওয়াচ্ছে ঢং করে!! কিংবা...।।
এ সব নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করল না। নিজেই অবাক হয়ে গেলাম নিজের পরিবর্তনে। মমতাকে দেখছি। একমনে মাংসের হাড় চিবোচ্ছে। একটা হাড় পেলে কুকুর যেমন...মমতা তাকাল আমার দিকে। ঠোটটা ফুলে উঠেছে । হলদে দাঁত গুলো বার করে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল মমতা। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই হাসির উজ্বলতা যত মেকি আলোর পস্রবনকে প্লাবনে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। মেকি হাসির হুল্লোড়কে চিরকালের জন্য যেন বোবা করে দিল। ছুড়ে দিল আসল খুশির ঠিকানা। ঠিক সেই সময় বেজে উঠল সন্ধি পুজোয় ঢাকের নিনাদ, লক্ষী পুজো শেষ। অফিস খুলেছে । বাইক রাখার জায়গাটা ফাঁকা ফাঁকা। চৌকিদারও নেই। ছেঁড়াখোঁড়া চাটাই, অ্যালমুনিয়ামের হাঁড়ি, ময়লা মানুষগুলোয় নেই। উশখুশ করছি জানার জন্য। ফুচকাওয়ালাটা বসেছে। ওর কাছ থেকে অনেকদিন ফুচকা খেয়েছি আমি আর মমতা পাশাপাশি। জিজ্ঞ্যাসা করলাম মমতার কথা। সে বলল “ আপনি জানেন না? পুজোর সময় সব পরিষ্কার করে ফেলে। নেতাদের বড় বড় পুজো । আমাকেও বসতে দেয় নি এখানে”।
মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। আমতা আমতা করে জিজ্ঞাসা করলাম “ কবে ফিরবে এরা” একগাল হেসে ফুচকাওয়ালা বলল “ কি করে জানব বলুন। এই পুজোর মাসটা গেলে কেউ না কেউ তো আসবে। যে আগে দখল নেবে। মারামারি, খেস্তা খেস্তি হবে”। “এরা সব নেড়ি কুত্তার মত বাবু । কখন কোন পাড়ায় থাকে কোন ঠিক নেই। ঐ মেয়েটার কথা ভুলে যান। আপনি তো অনেক খাইয়েছেন। ব্যাগে কাগজ ছিল বলেই দিয়েছিল। টাকা থাকলে ঝেড়ে ফাঁক করে দিত”। মনটা বিকল হয়ে গেল। হয়ত ঠিক। টাকা থাকলে পেতাম না। কিন্তু টাকা তো দিতে চেয়েছিলাম। বুঝি না, এখনও বুঝি না মনুষ্য চরিত্র। হয়ত কোন মমতা আসবে। আমার মমতাকে আর দেখব না। আমার মমতা এখন দোতলা / তিনতলা ছাড়িয়ে আনেক উঁচুতে চলে যাবে লিফটে চড়ে। যেখান থেকে এদের মনে হয় এরা সব রাস্তারই অঙ্গ।
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)