গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৬

মৃন্ময় চক্রবর্তী

গল্প বলে কানাই সর্দার


কানাই সর্দার গল্প বলে। তার মাথায় সাদা কোঁকড়া চুল গালে দুচার খানা সাদা দাড়ি উত্তুরে হাওয়ায় নড়ে তিরতির।
পচাই খেয়ে চোখদুটো লাল হলেই তার কাছে গল্প বের হয় দুদ্দাড়। সাদা নেংটির মত একফালি ধুতিখানা জড়িয়ে বাবলাতলায় বসেই বিড়ি চায় আধখানা। না তার গোটা চাওয়া নেই কোনোকালেই।
মাঠে শীতের ধান কাটা হচ্ছে। কামিনদের মাথা উঠছে নামছে। আর হরেক পাখি চক্কর খাচ্ছে মাথার উপর।

-তা বুজলে বাবু সেসব কতকালের কতা।
তার মুখ থেকে বিড়ি আর পচাইয়ের মিশ্র গন্ধ ছিটকে বেরিয়ে আসে। দুটো কথা বলেই বুড়ো খক খক করে কাশে আর কফ ফেলে।
-হ্যাঁ আমি তকন বিশ বছরের জোয়ান। ঠিক এই তোমার মত বাবু। কি সেসব দিন বাপুরে। শালো নরেশ জোদ্দার পালাল কলকাতা।
বাবলাগাছের পিছনদিয়ে তিরতির বয়ে যাচ্ছে সুতিয়ার নালা। জল নেই খুব একটা। জলজ ঘাসগুলো জল ফুঁড়ে মাথা তুলেছে। ঘাসের ডগায় দোলখাচ্ছে নানারঙের ফড়িং ।
-আমাদের ভাগচাষী ক্ষেতমজুর মাহিন্দরদের কী রোয়াব তকন। সে দেকার মত। এই যে জমি দেকচো এসব জোর করে দকল নে ফিসারি করে রেকেছিল নস্কররা। ফের সব দকল হয়ে গেল। আসলে যার জমি সে ফিরে নিল।
মাঠে চাষীরা বড় বড় ধানের বোঝা বাঁধছে। মেয়েরা মাথায় নিয়ে চলে যাচ্ছে সেসব ধান। খালের ওধারের জমিগুলোয় ধান ভাল হয়নি। ঘূর্ণি হাওয়ায় ঘাড় ভেঙে পড়ে আছে।
-তা বুঝলে বাবু কাত্তিক ওরাং ছিল আমাদের নেতা। সে যকন চাষীদের মাঝখানে দাঁড়াত, যেন হাজার হাতির বল । নস্কররা গুন্ডা পাঠাল গাঁয়ে। কিন্তু গুন্ডারা চাষীদের হাতে মার খেয়ে শ্যালের মত লুকোলো অই বাদাড়ে।
চাষীদের ভয় পেয়ে গেল সরকার, মিলিটারি আইন জারি করে দিল। তারপর পুলিশ, তারপর ছি আর পি এলো। গাঁয়ে গাঁয়ে কংসের মত সে কী অত্যেচার,ধানচাল এক করে দেয়, মা বোনের কাপড় ধরে টানে, হাঁস ছাগল ধরে নিয়ে যায়। জোয়ান চাষী পেলেই ধরে এনে চালিয়ে দেয় গুলি,সব ভিনদেশি কসাই....
তবু চাষীদের দমানো গেলনা!
কানাই থামল। বিড়ি শেষ হয়ে গেছে। আগুন না হলে বুড়ো গল্প বলতে পারেনা। কলজে ঠান্ডা হয়ে যায়। জড়িয়ে যায় স্মৃতি ।
উত্তুরে হাওয়া ছুঁচ পরাচ্ছে সুতোয়। বুড়ো ধুতির একটা গিঁট খুলে আরেকটু পেঁচিয়ে নিল বুক। তারপর আয়েশ করে ধরাল একটা বিড়ি। বাকি আধখানা।
-কাত্তিককে ওরা ধরে ফেলল একদিন। শোর খেদা জান বাবু? ওই অমন করে। কমিটি তাকে বলেছেল সরি থাকতি, সে শোনেনি। গাঁ ছেড়ে সে যাবেনা, কাউরে বেপদে ফেলি সে যাবেনা। গোঁয়ার ছেলে কিনা!
তো বাবু সেই থেকে তার আর হদিস হলনা...
তার মুখ থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে অদ্ভুত সমান্তরাল রেখা হয়ে ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে।
-তবে বাবু আমি দেকেচি তাকে। সে বেঁচে আচে, হ্যাঁ বেঁচে আচে!
তার কথায় জোর বাজে। ফিসফিস করে হাওয়ায় -হ্যাঁ হ্যাঁ, আছে আছে!
একটা দলছুট গাঙচিল চক্কর মারছে মাথার উপর। সূর্যটা হলুদ কমলালেবু হয়ে শূণ্যে ঝুলছে নিরুত্তাপ।
-তকন এই বিলে সারারাত মাছ মারতুম বাবু। কি করব ভাত জোটেনা ঠিকমতো, তাই মাছ ধরে গেরস্তর বাড়িতে বেচতুম। হাটের দিনে হাটে যেতুম।
তা একরাতে দেখি। নিঝঝুম রাত বুজলে বাবু।আকাশের চাঁদটুকু ছাড়া কোতাও এট্টা শ্যাল পজ্জন্তি নেই। এমনধারা রাত। হুই মাঠের দিকি একদল মড়া...হ্যাঁ বাবু!
আমি সারারাত মাছ ধরি তো ভয়টয় নেই কোনোকালে, তো করলুম কি পাঁকালের মত জলার হোগলা ঠেলে সামনে চলে গেলুম। দেকি, চাঁদের আলোয় একদম পস্ট বাবু, কতগুলো মড়া, গায়ে একদানা মাংস নেই শুদু হাড়,একটা গাড়ি থেনে আমাদের কাত্তিককে নামিয়ে এনে মাঠের মদ্যি ছেড়ে দিল। কী বলব বাবু দেকি কাত্তিকের শরীলটায় যেন শয়ে শয়ে জোনাকপোকা জ্বলচে...
আমি ডেকে উঠতে গেলুম,কাত্তিইইক...! কিন্তু আমার গলাটা কে যেন চেপে ধরে শব্দ বের হতি দিলনা।
খানিকপর সবকিচু মিলিয়ে গেল মাঠের ভেতর। হুই বাসকঝোপের আঁধারে!
-তারপর...
-তারপর আর কি বাবু। গাঁয়ে এসে সবাইকে বললুম কিন্তু কেউ বিশ্বেস করলনা। ওরা ভাবল আমি স্বপন দেকেচি। ওরা ঘুমোয়ে থাকে তাই স্বপন দেকে,আমি তো জেগি থাকি সারারাত...
ওরা বুজলনা এটা স্বপন নয়...
কাত্তিক এই মাঠের মদ্যি কোতাও আচে, খুঁজলি ঠিক পাওয়া যাবে, ঠিক। ওকে মারা অত সোজা নয় বাবু বুজলে, উঁহু অত সহজ নয়...
বুড়ো বিড়িতে সজোরে টান দিতেই লাল সূর্যটা দপ করে জ্বলে উঠেই আরো পশ্চিমে হেলে গেল,আর তারপরেই শনশন ঘিরতে লাগল ধারালো অন্ধকার!