গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৬

নিবেদিতা পুণ্যি

ভক্ত
                  
                                                   (১)

          দরজা খুলতেই, ছায়াটি একপাশে সরে গেলো। ব্যাপারটি তাকে চমকে দিলেও; ভেবে নিলো ঘুম হয়তো লেগে আছে চোখে, তাই চোখ বা মনের ভুল। পা বাড়ালো সমীর ধানমন্ডী লেকের দিকে। এত ভোরে বাসার অন্য সবাই ঘুমিয়েই থাকে! প্রতিদিন নিয়ম করে ভোর বেলা হাঁটতে বের হয় সমীর। ধানমন্ডী আবাসিক এলাকার ফুটপাথ ধরে লম্বা লম্বা পা ফেলে সামনে এগোয় সে। শরীরে কোলেষ্টেরলের মাত্রা বেশী হলেও; শরীর এখনও বুড়িয়ে যায়নি, ত্বক ও বেশ টান-টান! বুকের প্রশস্থ ছাতিটা এখনও টগবগে তারুণ্যের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে। কিছুদূর যেতেই নিত্যদিনকার হাঁটার সঙ্গীদের সাথে এক এক করে দেখা হতে লাগলো। কারো সাথেই খুব একটা মেশার আগ্রহ দেখায় না সমীর। দিনকে দিন জীবনটাকে দ্বায়িত্ব কর্তব্যের ছকে বেঁধে ফেলছে। বৈষয়িকতায় ডুবে গিয়ে ব্যাহত হচ্ছে তার কাব্য-স্বত্বা।কবিতা লেখা তো বন্ধ হয়েছে ৯ থেকে ১০ বছর আগেই! তার লিখা বেশ কয়েকটি গল্পের পান্ডুলিপিও খোয়া গেছে। একবার এক পাঠিকা তাকে অবাক করে দিয়েছিলো তার লিখা একটি গল্পের প্রসংগ তুলে।অথচ সেই গল্পটি যে সাময়িকীতে ছাপা হয়েছিলো; সে-টির কপিও আজ তার কাছে নেই।আসলে স্ত্রী ডোনার উন্নাসিকতা তার জীবনটাকে এক রকম এলোমেলো করে দিয়েছে। সে নিজে যা হওয়ার কথা; তা না হয়ে বৈষয়িকতার হিসেবে তার জীবন সেজেছে বেশ ভিন্ন ছাঁচে! নিজে সাহিত্য চর্চা ছেড়ে ডোনাকে সু্যোগ করে দিয়েছে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান করার, কাব্য-চর্চার, আর সেই সুবাদে ডোনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বাড়িতে সাহিত্য সাংস্কৃতিক আড্ডা; যা সমীরের একেবারেই পছন্দ নয়! ইথিওপিয়ায় থাকাকালীন সংখ্যায় গুটিকতক বাংগালী পরিবারের মাঝে ডোনার রূপপ্রিয়তাই যে ডোনার প্রতি তাদের পক্ষপাতিত্ব আর পুরুষদের মাত্রাতিরিক্ত আগ্রহ আর স্তুতি; সে বিষয়ে সমীর নিশ্চিত। তাই নিজের সাহিত্য চর্চা বাদ দিয়ে এগিয়ে দিয়েছে ডোনাকে তার কাব্য-গ্রন্থ প্রকাশে। আর এই কাব্য-গ্রন্থ প্রকাশের সুযোগে জুটেছে আরো কিছু প্রকাশক আর পাঠকের ফোনালাপ আর ঢাকাস্থ বাসাতে আনাগোনা; যা সমীরের পছন্দ না। সে ডোনাকে নিজের করে পেতে চায় বেশি, অন্য সবার চেয়ে ডোনাকে বেশি ভালোবাসে।এত করেও, এত ভালোবেসেও নারীর মন পাওয়া যায় না! ডোনার পাথর মুখটা মনে পড়তেই মাথাটা চন করে ধরে উঠলো। আহ! শব্দ করে কাঁচা-পাকা ঘন চুলের অরণ্যে দুহাতের আঙ্গুলগুলো ঢুকিয়ে খামচে ধরলো এক রাশ চুল।হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো আরও! এবার ঠোঁটের উপরকার সাদা-কালো ঘাস গোঁফের গোড়ায় ঘাম শিশির জমতে লাগলো; বিন্দু বিন্দু পুতি দানার মত করে।

                                                        (২)

          রাসেল স্কয়ার পার হয়ে ধানমন্ডী লেকের পাড়ে এসে থামলো সমীর। ইতিমধ্যে এখানে বেশ লোকের সমাগম হয়েছে। সমীরের ভালো লাগলো এই ভেবে যে, দিনকে দিন স্বাস্থ্য সচেতন বাংগালীর সংখ্যা বাড়ছে।প্যান্টের পকেটে রাখা খনিজ জলের বোতলটি বের করে কয়লার ইঞ্জিনের মুখে ঢক-ঢক করে ঢেলে দিতেই উত্তপ্ত কয়লার ঝাঁঝালো তাপ শুষে নিলো সেই জল, আর ছড়িয়ে পড়লো তার ধারা- রক্ত ধমণী; শিরা উপশিরার গতিপথ ধরে; তাকে নিয়ে যেতে ভালো লাগাময় এক তৃপ্তিকর রাজ্যে।সমীর এমন একটা জায়গায় বসেছে; যেখানে লোকজন কেউ এসে বসছে না, তবে লেকের বাতাসটাও স্বাস্থ্যকর মনে হলো না সমীরের।কেমন অবসাদ বোধ করছে যেন সে! এভাবে যে কতক্ষন বসে আছে; সমীরের তা খেয়াল নেই।নিজের লেখা একটা পুরোন কবিতা মনে করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো সমীর, শুধু মনে পড়লো কবিতাটি ডোনাকে নিয়ে লিখা, সমীরের এক সময়কার খুব প্রিয় একটি কবিতা যা খুব পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিলো আর সেই সাথে বন্ধু মহল আর নাটক মহলেও পেয়েছিলো সমীর জনপ্রিয়তা। সমীরের প্রিয় বান্ধবী তখন ডোনা। বেইলী রোড এর আশ-পাশ ছাড়াও ঢাকা শহরের এমন কোনও সুন্দর স্পট নেই; যেখানে তারা দুজন ঘুরে না বেড়িয়েছে। খুব পরিপাটি আর সুন্দর করে সাজতো ডোনা। সমীরের এই ভেবে খুব ভালো লাগতো যে; সাজের সময়টা ডোনা তার কথা ভেবে ভেবেই সেজেছে।আর খুব শান্ত ডোনার এই বাকসল্পতা তার সৌন্দর্যে এনে দিতো বাড়তি যোগ। স্মৃতির এলবামের পাতা উলটে ডোনার সেই জোছনা মুখটা মনে করার চেষ্টা করলো। প্রিয় বান্ধবী”- বিষন্ন সুরে বিড় বিড় করে আবৃত্তি করতে লাগলো সমীর।পায়ে হেঁটে বাড়ি ফেরার যেন আজ শক্তি পাচ্ছে না! হাতের ইশারায় একটা অটোরিক্সা থামালো। আজ আর এখন হেঁটে বাড়ি না ফিরে কাঁচা বাজারে যাবে। সেই নতুন সংসার শুরুর মত করে বাজার করবে সে। ছোট মাছ, ধনে পাতা, কাঁচা মরিচ, শাক, বগুড়ার নালিতা আলু, চিংড়ি মাছ আর লতা নিলো বাজারের চটের ব্যাগে। আঁখ কেটে টুকরো করে নেটের ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলো বিক্রেতা। ডোনার খুব পছন্দ এই আঁখ। ডাব কিনতে গিয়ে থমকে গেলো সমীর। লুনা তো বাসায় নেই, না জানি কেমন আছে মেয়েটা! মালয়েশিয়ায় মাস-কমিউনিকেশনে লুনার সাথে তার আরও তিন বান্ধবী চান্স পেয়েছে। ব্যাবসায়ী পিতার সুযোগ্যা কন্যা লুনা। দুহাতে খরচ করার স্বভাব পেয়েছে লুনা; সমীর ও বাঁধা দেয় না। বিদেশে জন্ম নেয়া আর বড় হওয়া লুনা; একটু বিলাসী তো হবেই! ছোট মেয়ে নায়নার কথা মনে আসতেই মৃদু হাসলো সমীর, নায়না দেখতে অবিকল ডোনার মত; আর উচ্ছলতাটা পেয়েছে বাবার। নায়নার জন্য দুটো পাকা কদবেল কিনে ব্যাগে পুরে নিলো সমীর। মেয়েটি তার বড় আহ্লাদী গোছের। সমীর ঘরে ঢুকতেই দুবেনী দুলিয়ে সমীরের হাত থেকে বাজারের ব্যাগগুলো দ্রুত টেনে নামিয়ে রেখেই বাবাকে টেনে এনে সোফায় বসাবে আর গলা জড়িয়ে বাবাকে আদর দিয়ে চুলগুলো সরিয়ে সরিয়ে চুলের ফাঁকে ফুঁ দিতে থাকবে আর বলবে,
বাবা তুমি কত্ত কষ্ট করো! আমাদের ছেড়ে এখনো তোমাকে দূর দেশে থাকতে হচ্ছে!”
এই তো মা, আর কটা বছর মাত্র! তোর লেভেল পড়া শেষ হলেই একবারে চলে আসবো তোদের কাছে, আর যাবো না ইথিওপিয়ায়।    

                                                          (৩)

         সকাল ৯টার দিকে নিজ ফ্ল্যাটে ফিরলো। অটোরিক্সা থেকে নামতেই সে দেখলো একজন মহিলা হঠাত করে ঘুরে দাঁড়ালো, তারপর মুখটা আঁচল চাপা দিয়ে দৌঁড়ে অনেকদূর চলে গেলো, আর পাশের গলিতে মোড় নিয়ে হারিয়ে গেলো। নাহ সমীরের তেমন অবাক লাগলো না। শুধু একবার মনে হলো; মহিলাটিকে বোধ হয় সে চিনে!
ঘরে ফিরে নায়নার হাতে কদবেল দুটো তুলে দিলো। আর পাথর মুখো ডোনা বাজারের ব্যাগ থেকে সব্জী, মাছ নামাতে নামাতে বেশ কঠিন স্বরে বল্লঃ ছোট মাছ কেন আবার? কে কুটবে এসব? তুমি না যা ঝামেলা করতে পারো!” অথচ এই ডোনা-ই মহিলা সমিতির মঞ্চ-নাটক দেখতে দেখতে সমীরের কাঁধে মাথাটা গুঁজে উষ্ণ স্বরে বলেছিলো, “হোষ্টেলে থেকে কতই তো বাইরের খাওয়া খেলে, এবার তোমার সংসারে ঢুকে তোমাকে রান্না করে খাওয়ানোর সু্যোগটা দাও আমাকে! আমি বোধ করি খারাপ রাঁধি না!” একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসে সমীরের চার পাশটা ধূমায়িত করে তুল্ল।চোখ বুজে ডোনার গাওয়া- “ফুলের কানে ভ্রমর এসে, চুপি চুপি বলে যায়গানটি মনে করে ডুবে থাকতে চাইলো স্মৃতির রঙ্গীন বজরার দুলুনীতে।
                                                            (৪)
          এক সপ্তাহ হলো ধানমন্ডীর এই নতুন ফ্ল্যাটে তারা উঠেছে। এখনও গোছগাছ পুরোপুরি শেষ হয়নি। প্রতিদিন-ই কোন না কোন জিনিষ কিনতে বাইরে যেতে হচ্ছে রিয়াকে। বড় ছেলেটা তার বাবার সাথেই রয়ে গেছে ইথিওপিয়ায়, এক মাস পর তালাতের সঙ্গে আসবে।রিয়া তার ছোট ছেলে আর এক মেয়ে সাথে করে ফ্ল্যাট বুঝে নিতে আগে চলে এসেছে। নতুন ফ্ল্যাটে তার শ্বশুড়বাড়ির লোকজনও সাথে আছে। দেবরটা নিজের সংসার আর অফিস নিয়েই ব্যস্ত খুব; তাই আসবাব থেকে শুরু করে নতুন ফ্ল্যাট সাজানোর যাবতীয় কেনা-কাটা সব ননদদেরকে সাথে নিয়েই করতে হচ্ছে রিয়াকে।এই ফ্ল্যাটে ওঠার পর থেকেই সব কাজের ফাঁকেও মনে পড়ছে ডোনার কথা, সমীরের কথা, আর সমীর রিয়াকে ঘিরে ডোনার ভুল বুঝাবুঝির কথা।
                                                              (৫)

          ডোনার অনুপস্থিতিতে সমীর যখন পাগলপ্রায় আর সেই যুগলের বিচ্ছেদের কারন যখন রিয়ার প্রতি সমীরের শ্রদ্ধা তখন স্বাভাবিকভাবেই রিয়া এগিয়ে এসেছে এর সমাধানে। রিয়াকে সমীর প্রথম দেখে স্যাটেলাইট চ্যানেলের নিউজ কালেক্টর হিসেবে যখন রিয়ার উপস্থিতিতে এক জমজমাট ঈদ পূনর্মিলনী অনুষ্ঠান হয়; তখন। খুব সাদা মাটা বন্ধুসুলভ কথা হয় রিয়া, সমীর আর ডোনার। কিন্তু সমস্যাটা বাঁধে তার কয়েক মাস পর যখন সমীর বৈশাখী মেলায় একা এসে রিয়ার পরিচালিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করে এবং রিয়ার গান সরাসরি সমীর মোবাইল অন করে

ডোনাকে শোনায় আর রিয়ার গান ভিডিও করে নিয়ে যায় বাসায়। আসলে ডোনার প্রতি সমীরের স্বামীসুলভ দ্বায়িত্ব, প্রেম অভিভূত করতো রিয়াকে। কতটা ভালোবাসলে নিজের জনপ্রিয়তা জলাঞ্জলী দিয়ে সাদা মাটা প্রতিভার ডোনাকে সুযোগ দিয়ে সব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে! আর তা-ই করেছে সমীর তার স্ত্রী ডোনার জন্য। রিয়া চায়নি সমীরের মত এমন একটা কাব্য-প্রতিভা হারিয়ে যাক, মুছে যাক ডোনার জন্য তার স্বামী ও প্রেমিক সমীরের নিবেদিত প্রেমাত্মার সুন্দর নিবেদনের মূল্যায়ন। রিয়া চায়নি কোনভাবেই ডোনা আর সমীরের সংসার ভেঙ্গে যাক। চেয়েছে সমীরের মনে স্বান্তনা, সহানুভূতি আর নিঃসংগতা দূর করতে আর তাই রিয়াকে সমীরের দেয়া বাসার ল্যান্ডফোন নাম্বারে মাঝে মাঝে ফোন করে ডোনা ও বাচ্চাদের খবরাখবরসহ সমীরের শারিরীক অসুস্থতার সময় খোঁজ নিয়ে জানতে চাইতো পরিবারটা কেমন আছে। শুধু তা-ই নয় সমীরের কাছ থেকে ডোনার ঢাকার বাসার বাবার ফোন নাম্বার নিয়ে ডোনার ভুল ভাংগানোর জন্য ডোনাকে বুঝিয়েছে সমীর রিয়ার প্রতি অনুরক্ত নন, সমীর ডোনাকে অনেক বেশী ভালোবাসেন আর তাই ভুল বুঝাবুঝি ঝেড়ে ডোনা যেন সমীরের কাছে ফিরে আসে।একটা সুন্দর পারিবারিক জীবনের ভাংগন ঠেকাতে রিয়ার এ ভূমিকাকে সমীর তার ব্যক্তি জীবনে কাজে লাগিয়েছে ঠিক-ই কিন্তু রিয়াকে সমাজে বিপদে ফেলে সে এই কাজ করেছে। এটা তার ব্যক্তিগত জীবনকে সুন্দর সূরে বেঁধে দিলেও রিয়ার শিল্প স্বত্ত্বাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। সামাজিক অসন্মানের ভয়ে গুটিয়ে গেছে রিয়া। সামাজিক অনুষ্ঠান গুলোতে যাওয়া বন্ধ করেছে, শুধু সংসারের কাজে নিজেকে করে তুলেছে চরম ব্যস্ত। কারন, ডোনা যাতে অনায়াসে সমীরের কাছে ফিরে আসে, তার জন্য সমীর রিয়াকে সমাজের কাছে তুলে ধরেছে একজন দুশ্চরিত্রা নারী হিসেবে; একজন বেহায়া নির্লজ্জ মহিলা হিসেবে। আর তাতে সত্যি-ই কাজ হয়েছে। রিয়ার প্রতি ডোনার ঈর্ষার যে কারন তা ভেঙ্গে গেছে, ডোনা বুঝেছে সমীর আসলেই রিয়াকে ভালোবাসেনা, রিয়াকে ভালোবাসলে সমীর এভাবে সভা ডেকে রিয়ার বিষয়ে সমীর বলতো না যে, স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে সমীরের সাথে প্রেমালাপ করার সুযোগ নেয়ার চেষ্টা। রিয়ার স্বামী তালাত খুব বেশী ব্যস্ত বলে রিয়া নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে পার পেয়েছে। আর তালাত খুব ভালো করেই জানে যে, রিয়া এমন নয়। ডোনা তার স্বামীর ঘরে ফিরে এসেছে এটা শোনার পর রিয়া তার ব্যাপারে ছড়িয়ে দেয়া সব অপবাদ ভুলে গেছে এই খুশীতে যে তার সয়ে নেয়া অপবাদ, তার সহ্য কাজে লেগেছে একটি মহৎ কাজে। থেমে গেছে রিয়া আগ বাড়িয়ে পরোপকারের যে কোন ভূমিকা থেকে। কিন্তু থামেনি তার মনের অন্তর্নিহিত সুন্দর আবেগের নির্ঝরিণী। বাঁধহীন এ ঝর্ণা নিরবে বয়ে চলেছে মনের কোনে; ঝিরি-ঝিরি দেবদারু পাতার দুলে ওঠার মত দুলে দুলে।
                                                        
                                                        (৬)

          খুব ভোরে প্রাতঃ ভ্রমন শেষে রিয়া গিয়েছিলো ডোনার বাবার বাসার ঠিকানায় ফ্ল্যাটটা খুঁজ়ে বের করে ডোনার কাছে সব খুলে বুঝিয়ে বলে আসতে। কিন্তু রিয়া তা পারলো না। অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু বেশী ক্লান্ত থাকায় সমীর সেদিনের প্রাতঃভ্রমনে বেরুতে দেরী করে ফেলেছিলো বিধায় দরজা খুলতেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে রিয়া দৌড়ে আড়াল হয়েছে পার্শ্ববর্তি গ্যারেজটার

দিকে। ভাগ্যিস নায়না সেদিন রিয়াকে তার নানার বাসার ঠিকানাটা ফোনে বলে দিয়েছিলো! নইলে আজীবন এই দূর্নামী হওয়ার কষ্টটা তাকে কুড়ে কুড়েই খেতে থাকতো যা সমীর বা ডোনাকে কখনো স্পর্শ করতো না। খুব কাছে থাকা তালাত কিংবা রিয়ার সন্তানেরা মায়ের দুঃখ দূর করতে চাইলেও পারতো না।
                                                           (৭)

          কলিংবেলের শব্দ শুনতেই কি-হোলে চোখ রাখলো ডোনা। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা রিয়াকে চিনতে পেরেই দরজার কাছ থেকে সরে গেলো ডোনা। বার কয়েক কলিংবেল টিপে সাড়া না পেয়ে রিয়া ফিরে গেলো তার নিজের ফ্ল্যাটে। আর যাবার আগে উপহারগুলো রেখে এলো ওই ফ্ল্যাটের  দরজার বাইরে। গেইটের বাইরে রিয়াকে মিলিয়ে যেতে দেখেই ডোনা জানলার ভারী পর্দাটা একটানে সরিয়ে দিয়ে সমীরকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাংগালো। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো সমীর।ডোনা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বল্লঃ আমার সাথে চালাকি, তাই না? আমার সামনে বলা হয় রিয়া খুব খারাপ, রিয়াকে তুমি একেবারেই পছন্দ করো না, হেন, তেন! আবার রিয়াকে বাসায় আসার ঠিকানাও দেয়া হয়, তাই না? তুমি একটা!...তুমি একটাকেঁদে ফেল্লো ডোনা নিজেকে আর সামলাতে না পেরে।
সমীর অবাক হয়ে গেলো ডোনার কথাগুলো শুনে। কোথায় পেলে তুমি রিয়া ভাবীকে? উনি তো ইথিওপিয়ায়! কি আশ্চর্য্য! আমি উনাকে ঠিকানা দিতে যাবো কেন?”
কেন তা তুমি-ই জানো! আমি কি মিথ্যা বলছি? তুমি ঠিকানা না দিলে আজ রিয়া ভাবী এ বাসায় কি করে এলো, বলো?” কেঁদে কেঁদেই কথাগুলো বল্ল ডোনা।
তা আমি কি জানি? না জেনে শুনে আমাকে কেন দোষারোপ করছো, বলো তো ডোনা?”
বাইরে আবার কলিংবেলটা বেজে ওঠলো, সমীর যেতে উদ্যোত হতেই ডোনা হাত দিয়ে সমীরকে ধরে যেতে বাধা দিলো, “না তুমি যাবে না! কেউ দরজা খুলবে না! এহ, কি আদিখ্যেতা! প্রিয়তমের খোঁজ পেয়ে উনি বাসায় চলে এসেছেন! তুমি নিশ্চই আসার আগে রিয়া ভাবীকে জানিয়ে এসেছিলে যে, এ মাসে তুমি ঢাকার বাসায় থাকবে, আর সেই সাথে বাসাটার ঠিকানাটাও দিয়ে এসেছো। নইলে রিয়া ভাবী জানলো কী করে যে তুমি এখন এ বাসায়, ইথিওপিয়ায় নও!”
কেউ দরজা খুল্লো না। নায়না শুধু ফ্যাল-ফ্যাল করে চেয়ে থেকে বাবা মায়ের ঝগড়া দেখলো।
                                                     (৮)

          প্রায় এক ঘন্টা বাক-বিতন্ডার এক ফাঁকে নায়না-ই খুট করে দরজা খুল্ল ভয়ে ভয়ে। আশে-পাশে তাকিয়ে দেখলো পরিস্থিতি। দরজা খুলে বাইরে দাঁড়াতেই চোখে পড়লো সাদা বড়


খামটি। খামের মুখ বন্ধ করা। উপরে সুন্দর হস্তাক্ষরে লিখা- “প্রিয় কবি, লেখক, আবৃত্তিকার ও প্রিয় ব্যক্তিত্ত্ব জনাব সমীর চৌধুরীকে উপহার- মিসেস মমতাজ হক (রিয়া)
প্যাকেটটা হাতে নিয়ে দুবেনী দুলিয়ে লাফাতে লাফাতে নায়না ঢুকে গেলো তার বাবা মায়ের ঝগড়ার মাঝ খানে। বাবা, ও বাবা! দেখ! দেখ! তোমাকে কে যেন গিফট দিয়ে গেছে!” প্যাকেটটা ছোঁ মেরে লুফে নিলো ডোনা। ত্রস্ত হাতে এক টানে ছিঁড়ে ফেল্ল খামের পার্শ্ব-কিনার, আর সাথে সাথে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটি ভি.ডি.ও ক্যাসেট, একটি অডিও ক্যাসেট, আর তিনটি সাময়িকী। খামের ভেতর উঁকি দিয়ে নায়না পেলো আরেকটা ছোট্ট খাম। খাম অবমুক্ত করতেই সে খাম থেকে বেরুলো বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সমীরের একক ছবি, দলীয় ছবি, কিছু শুকনো ফুল আর ছোট্ট একটি কাগজে লিখা, “ভক্ত, শুধুই ভক্ত আপনার গুনের, ব্যাক্তিত্বের; অন্য আর কিছু নয়!- আপনার গুনমুগ্ধ- রিয়া
ভি.ডি.ও অন করে ওরা তিনজন দেখলো- সমীরের এন.টি.ভি তে করা আবৃত্তি, ইথিওপিয়ার বাঙ্গালীদের আয়োজনে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রাখা সমীরের বক্তব্য ও আবৃত্তি। অডিও ক্যাসেটে সমীরের প্রান-খোলা হাসি, আর সেই সাময়িকী গুলো; যাতে সমীরের কবিতা, ছোট গল্প ও প্রবন্ধ রয়েছে, যার একটিও সমীরের সংগ্রহে ছিলো না। ডোনার অনাগ্রহের কারনেই সমীরের কোন কিছু সংগ্রহে রাখেনি, আর ব্যাবসায়ে ও সামাজিকতায় অতি ব্যস্ত সমীরের-ও সম্ভব হয়নি খুঁজে পেতে নিজের সব সংগ্রহে রাখা।
জিনিষগুলো এক এক করে নেড়ে চেড়ে দেখতে লাগলো সমীর। অদ্ভূত এক আবেগে তার সারা গা কাঁপছে। মনে পড়তে লাগলো রিয়ার সাথে সমীরের টেলিফোনে আলাপচারিতায় রিয়ার সারল্যমাখা কথা, আবেগ প্রকাশ, সমীরের পরিবারের কল্যাণ চেয়ে উপদেশ দেয়া ইত্যাদি। মনে পড়তে লাগলো ডোনা আর তার দুটো মেয়ে বিহীন সংসারে তার একাকীত্ব জীবনের হাহাকার। মাঝে মাঝে ডোনার প্রতি মনের দ্রোহ এত খারাপ দিকে রূপ নিতো; যে মনে হতো আত্মহত্যাই শ্রেয়! রিয়ার হঠাত হঠাত আসা ফোন সমীরের ভালো লাগতো, মনে হতো পৃথিবীতে অন্ততঃ কেউ আছে যে ভালোবাসার বিনিময় চায় না। আজও রিয়া তা-ই প্রমাণ করে গেলো। রিয়াকে টেলিফোনে শুনানো সেই গানটা মনে মনে ভাঁজতে লাগলো সমীর-
আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি তোমাকে দিলাম.”