গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৬

নীহার চক্রবর্তী

মেলবন্ধন

স্কুটি কেনার শখ অনিন্দিতার অনেকদিনের । কেনার অবস্থায় যে ওর স্বামী সুমন্ত্র নেই,তাও নয় । কিন্তু বারবার এড়িয়ে যায় । 
এও বলে,''তুমি বাড়ির বৌ । চেনা মানুষরা দেখলে খারাপ বলবে । তাই আর কি । আর একটা গয়না কেন,সেও ভালো ।''
 
আসলে সুমন্ত্র ওর বিধবা মাকে খুব ভয় পায় । তারই মনের কথা অনিন্দিতাকে বলে । সে খুব বোঝে অনিন্দিতা ।
কিন্তু কদিন আগে অনিন্দিতা আবার স্কুটি কেনার কথা বলতেই সুমন্ত্র বেশ রেগে উঠে বলল,''কতবার বলেছি তোমায় ? আর কতবার বলবো,শুনি ? অসম্ভব । এ বাড়িতে এসব চলবে না ।''
সুমন্ত্রর কথা শুনে অনিন্দিতা এতটুকু রাগ করলো না । রাগ করলেও রাগ চেপে গেলো মনে হয় ।
 
স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করলো সুমন্ত্রকে,''কোথায় আমি সেফ বল তো ? সেখানেই না হয় চালাবো । তবে মনে হয় তখন আর তোমার টাকা লাগবে না ।''
একথা বলেই অনিন্দিতা হাসতে হাসতে সুমন্ত্রর পাশ থেকে উঠে গেলো । আর তা দেখে সুমন্ত্র চমকাতেই থাকলো । সে অনেকক্ষণ চমকাল ।

তারপর থেকে সুমন্ত্র খুব অবাক হতে থাকলো অনিন্দিতার ব্যবহারে । সারাদিন মিষ্টি-মিষ্টি কথা মুখে । সুমন্ত্রকে আদরে-আদরে ভরিয়ে দিলো । না চাইতে জলের মতো যখন-তখন ওকে বিছানায় নিয়ে উঠে গেলো । শুধু তাই নয় ।সুমন্ত্রদের কালচারের প্রশংসা করতে থাকলো খুব ।
দুদিন পরে অনিন্দিতা টোল পড়া গালে হেসে বলল সুমন্ত্রকে,''মাস দুই হল বাড়ি যাইনি । কদিনের জন্য একটু বেরিয়ে আসি ?''
 
সুমন্ত্র স্মিত হেসে উত্তর দিলো,''একশোবার । কে না করেছে তোমাকে ? আর অফিসেও আমার তেমন কাজের চাপ নেই এখন । চল,আমিই কাল দিয়ে আসি তোমাকে ।''
শুনে অনিন্দিতা মহা খুশীর ভাব দেখাল । আনন্দে সুমন্ত্রকে বুকে জড়িয়ে ধরল । আবার হাত ধরে শোবার ঘরেও নিয়ে গেলো ওকে ।
সুমন্ত্রর ফুর্তি তখন দেখে কে । একেবারে আনন্দে আটখানা নয়,ষোলখানা ।

হাসতে হাসতে সুমন্ত্র অনিন্দিতাকে ওর বাপের বাড়িতে দিয়ে এলো । সেখানেও সুমন্ত্র অনেক যত্ন-আত্তি পেলো । জামাইকে অনেকদিন পরে পেয়ে অনিন্দিতার বাবা-মা খুব খুশী । অনিন্দিতার বোন অস্মিতা তো আনন্দে মাতোয়ারা । সুমন্ত্রর পকেট খসাল বেশ । তারপর সুম্নত্র আনন্দ-সাগরে ভাসতে ভাসতে নিজের বাড়িতে ফিরে এলো ।
ফেরার আগে সুমন্ত্র বলে এলো অনিন্দিতাকে,''আমি নিতে আসবো । কয়েকদিন আনন্দ করে যাও ।''
শুনে খুব খুশী-খুশী ভাব দেখাল অনিন্দিতা ।
এর দুদিন পর অনিন্দিতা ফোন করলো সুমন্ত্রকে ।
হেসে-হেসে বলল ওকে,''একটা দারুণ খবর আছে গো ।''
খুব আগ্রহের সঙ্গে সুমন্ত্র সুসংবাদটা জানতে চাইলো । তখন অনিন্দিতা বলল,''তুমি যা পারোনি,আমি তা করে দেখালাম । সম্পূর্ণ বাবার টাকায় । আমি স্কুটি কিনেছি । এখন বল কোথায় চালাবো ? এখানে,না তোমাদের ওখানে ?''
শুনে চমকে গেলো সুমন্ত্র । অনেকক্ষণ কোন কথাই বলতে পারলো না ।
শেষে নেশ গম্ভীর-গলায় বলল অনন্দিতাকে,''ওটা তোমাদের ওখানেই থাক । এখানে অসম্ভব ।''
সাথে-সাথে অনিন্দিতা সপাটে ব্যাট চালানোর মতো উত্তর দিলো,''তাহলে অন্তত একবছর স্কুটির শখ মিটিয়ে ফিরছি । খুশী তো ?''
অনিন্দিতার কথা শুনে সুমন্ত্র সঙ্গে-সঙ্গে ফোন কেটে দিলো । অনিন্দিতা তখন বোন অস্মিতার গায়ে হেসে লুটিয়ে পড়লো ।

বাড়িতে কয়েকদিন চুপচাপ থাকার পর সুমন্ত্র ওর মাকে অনিন্দিতার স্কুটি কেবার ব্যাপারটা জানালো ।
মা চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করলো,''তোর টাকায় বুঝি ?''
সুমন্ত্র বলল,''আরে,না । ওর বাবার পয়সার অভাব আছে ? কিন্তু একটা সমস্যাও হয়েছে তার জন্য ।''
মা বলল,''স্কুটিটাই তো সমস্যা । আর কী,শুনি ?''
তখন সুমন্ত্র বলল মাকে,''অনিন্দিতা বলেছে একবছর আগে আর ফিরছে না । স্কুটির শখ মিটিয়ে নাকি আসবে । এ হয়,বল ?''
মা তো শুনে আকাশ থেকে মাটিতে পড়লো ।
বেশ বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠলো,''সে কখনো হয় ? আমাদের ঘরের বৌ না সে ? কি আর করা যাবে । ও স্কুটি নিয়েই ফিরুক । তবে একটু দেখে-শুনে চালাবে । তুইও সঙ্গে থাকিস একটু । স্কুটির জন্য বৌ বাপের বাড়িতে । এ মানা যায় নাকি তাই ?''
মার কথা শুনে সুমন্ত্র স্বস্তির শ্বাস ফেললো তখন ।
 
মাকে স্মিত হেসে বলল,''তাহলে আজকেই ফোন করছি আমি ওকে । বিকালের দিকে ওদের বাড়ি যাই ?''
মা তাতে রাজী হয়ে এক-মুখ হেসে বলল,''বেশ কদিন বৌমার মুখ দেখিনি । আজই যা তবে । কাল সকালেই ফিরিস ওকে নিয়ে । আর সঙ্গে স্কুটি । বৌমা আমাকে আবার চড়াবে তো ?''
মার কথা শুনে সুমন্ত্র প্রাণ-খোলা হেসে উঠে বলে,''সে আমি বলে দেখবো ।''

সুমন্ত্র তার কিছু পরেই অনিন্দিতাকে ফোন করলো । অনিন্দিতা সুমন্ত্র আর ওর মার মনোভাবে খুব খুশী ।
কিন্তু বলল,’’আমি স্কুটিটা বোনকে দিয়ে দিলাম । ও আমার দুদিনের শখ । পারলে তুমি আমাকে নিজের টাকায় কিনে দিও পরে । আমার অত তাড়াহুড়ো নেই ।‘’
শুনে বেশ হতাশ সুমন্ত্র ।
হতাশার সুরে অনিন্দিতাকে বলল,’’তুমি তাহলে দিয়েই দিলে ? এ কেমন কথা ? ধুর...’’
সুমন্ত্রর কথা শুনে অনন্দিতা বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে উত্তর দিলো,’’এখনো তুমি আমার বাপের টাকায় ফুর্তি করতে চাও ? লজ্জা লাগে না ? বলছি তো পারলে পরে তুমি কিনে দিও । এখনোই না ।‘’
অনিন্দিতার কথা শুনে হেসে ফেললো সুমন্ত্র ।
বলল,’’বেশ করেছো । আমিই কিনে দেবো । মা যখন তোমার স্কুটিতে চড়তে চেয়েছে,তখন আর বেশী দেরী করছি না । আমি বিকালে আসছি । কাল সকালে স্কুটির শো-রুম ঘুরে তোমাকে নিয়ে বাড়ি ফিরবো ।‘’
তবে সুমন্ত্রর কথায় অনিন্দিতা তেমন আর উৎসাহ দেখাল না । তা বুঝে সুমন্ত্র নিজেও অবাক ।
জিজ্ঞেস করলো অনিন্দিতাকে,’’তাহলে থাক ?’’
অনিন্দিতা হাসতে হাসতে বলল তখন,’’বন্ধনটাই আসল গো । মেলের গতি না হলেও আমার চলবে । ওকে ?’’
সুমন্ত্র সহাস্যে বলে উঠলো,’’তাহলে আর কি । ওকেই ।‘’