গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

মঙ্গলবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৬

সঙ্গীতময় দাস

আলোপোকা




         এটা আসলে কোন গল্প নয়, ঘটনার বিবরণ মনিষীরা বলে গেছেন গল্প লিখতে গেলে চরিত্র গুলোর বুকের দরজা খুলে দেখে নিতে হবে। তার মানে রকম কোন মানুষের সুখ, দুঃখ, আবেগের সাথে পরিচিতি থাকতে হবে। কিন্তু অকপটে স্বীকার করছি, এখানে যার কথা বলব, তার সুখ দুঃখের কথা জানা, আমার মত মধ্যবিত্ত ভীরু ছাপোষার পক্ষে অসম্ভব। সেটা পারতেন যিনি তিনি আর এক মনিষী। ৯০ বছর বয়েসে এক আজীবন সংগ্রামী ইতিহাসকে পিছনে ফেলে তিনি কিছুদিন আগে চলে গেছেন। তাই এখানে যেটা নিবেদন করব, তা আদৌ কোন গল্প নয়, ঘটনার ধারা বিবরণী বলতে পারেন। আমি একজন খেপ খেলা হিসাবরক্ষক। কয়েক জন ব্যাবসায়ীর অর্থনৈতিক ময়লা সাফ করতে, সপ্তাহে একদিন/ দু দিন করে আমায় তাঁদের অফিসে হাজিরা দিতে হয়। তাঁরা আমার প্রতিপালক, অতএব তাঁদের প্রতি অবিচল শ্রদ্ধা রেখে, তাঁদের যাবতীয় দুর্গন্ধযুক্ত আদান প্রদানকে, আমায় দু হাতে সাবান মাখিয়ে পরিষ্কার করতে হয়। রকম দলিত শ্রেণীর কাজ করার জন্য আমার বিশেষ আক্ষেপও নেই। বরং দেখি, লোকে আমাকে বেশ সম্মানজনক চোখই দেখে। এভাবেই আমি এক দোতলা বাড়ির ছাদ থেকে পৃথিবীটাকে দেখি। দোতলা বাড়ির ছাদের একটা সুবিধা আছে মাটির কাছাকাছি থাকা যায় মোটামুটি সবকিছু উপর উপর দেখা যায়, কিন্তু কাদা লাগে না। দোতলা বাড়ির মানানসই একটি দু-চাকার মোটরসাইকেলও আছে, যাকে বাইক বললে গাড়ীর কাছাকাছি বোঝায়। তাতে চড়ে আমি সারা কলকাতা চষে বেড়াই।

         গড়িয়াহাটের মোড়ে একটা অফিসে আমি সপ্তাহে একদিন যাই। গড়িয়াহাটের ফ্লাই-ওভারের নীচে বাইক পার্ক করার জায়গাও আছে। পার্কিং স্লটের এক কোনে, পুলিস চৌকিটার পেছনে, সারা বছরই কিছু মানুষের মত জীব বাস করে। এরা যেন রাস্তারই একটা অঙ্গ। রাস্তার কুকুর-বিড়াল, গাড়ী-ফেশটুন এবং এই সব জীবদের বাদ দিলে, রাস্তা ঠিক স্বয়ং সম্পূর্ন হয় না। এক মেঘলা দিনে, সবে বাইকটা রেখে বেরোতে যাব। ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। অগত্যা, মোটর সাইকেলের বাক্স থেকে বর্ষাতিটা বের করে, গায়ে চাপাতে চাপাতে, লাগালাম এক দৌড়। কাজ শেষ করতে করতে সূর্্যেের আলোও শেষ হয়ে গেল এলাতে এলাতে বাইকের কাছে এসে, মাথায় হাত। বাক্সটা খোলা। চাবি!!! পকেটে হাত দিয়ে দেখি চাবি নেই। বাক্সের ভিতরে গাড়ীর কাগজ ছিল, তাও নেই। বাইকটা চুরি হয়ে যায় নি, আমার পিতৃপুরুষের ভাগ্য বলতে হবে।  গলার মধ্যে পুরো উদ্বেগটা ঢেলে দিয়ে, চেঁচিয়ে ডাকলাম স্লটের চৌকিদারকে।
আপনি কি রকম লোক মশাই? চাবি ছেড়ে চলে গেছেন? আমার কি দশখানা চোখ, যে সব
গাড়ির উপর নজর রাখব? “বাইকের কাগজগুলোও পাচ্ছি নাশুনে ওনার মেজাজ আরো সপ্তমে চড়ল।
         দাঁড়ান দাঁড়ান , বাইক ছোঁবেন না। অনেক লাফরা আছে। আগে পুলিস ডাকি। কাগজপত্র নেই। বেনামী গাড়ি, পুলিসের হাতে তুলে দিতে হবে।----আমার মাথাটা ঘুরে গেল। পুলিসের হাতে গেলে এখন মাসের কারাগারবাস হবে আমার বাইকের। গাড়ি গেলে খাব কি! এমন সময় ষোড়শী দর্শন। মাথার রুক্ষ চুলে তেলের আভা আছে। হাতে পায়ে ময়লার কালো ছোপগুলো এখনও চেপে বসে নি। মুখের লাবণ্য এখনও মরুভূমিতে শুষে নেয় নি। মোটের উপর রাস্তার
বাচ্চাদের মত এখনও ঘিয়ে ভাজা হয়নি। কেমন মানুষ গো তুমি। হুড়মুড় করে চলে গেলে? এই নাও চাবি চাবি পেয়ে বুকের ধিকপুকুনি কমল। কিন্তু ফাইলটা ! ওটা না পেলে বাইক যে থানায় জমা যাবেআমার আকুতি ঝরে পড়ে। এই নাও। খাতাটা পড়ে গিয়েছিল, বৃষ্টির জামা বার করতে গিয়ে। হুশ নাই না কি”– ঝংকারেও আমার কানে মধু ঝরে পরল যেন। ভগবানকে একরাশ ধন্যবাদ দিলাম। দেও পাঁচ টাকা দেও তোবলে হাত পাতল মেয়েটা।
আমি তার হাতে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিলাম। ভগবানকে পুজো দিলেও এর চেয়ে বেশি লাগত। এবার আমার অবাক হবার পালা। মেয়েটা বলল – “না পাঁচ টাকাই দেও” “কেন রে! আমি তো খুশি হয়েই দিচ্ছি তোকে। নে হাত পাত না। তুমি জানো না বাবু, পঞ্চাশ টাকা পেলে মাগীটা বলবে এত কমে এই গতর বেচেছিস ন্যাকামো মারার জায়গা পাও নি। দে বাকি টাকা দে খুব মারবে বাবু তুমি আমাকে পাঁচ টাকাই দেও  
        আমার মুখ দিয়ে কথা বেরোল না। জিজ্ঞাসা করা হল না কোন মারবে। আমি নীরবে পাঁচ টাকা দিয়ে চলে এলাম। ভালবাসা নয় মমতা বলতে পারেন। প্রতি সপ্তাহে  বাইক রাখার সময় চোখ খুঁজত মেয়েটাকে। কি করে জানি বুঝে গেল আমার মনের ভাবাবেগ। রাস্তার কুকুরের পিঠ চাপরে বিস্কুট দিলে তারাও গায়ে উঠে আদর খায়। তাই আমার যাবার দিনে মেয়েটাই অপেক্ষা করত আমার জন্য। আমি যে বাইকটা রেখে খাবারের প্যাকেট টা তুলে দিতাম ওর হাতে। ভাবেই একটা ধূসর অভিজ্ঞতা হল মানুষ কুকুরের বাচ্চাগুলোর সম্পর্কে। একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, “হ্যা রে তোর মা বুঝি খুব মারে?” মা!!! মা কে ? মাগিটা তো আমায় বড় করেছে বেচবে বলে। একদিন আমি যখন ছোট। ওর লোকটা আমার মাকে লাগিয়ে দিল। আমার মা টা ওর লোকটার সাথে চলে গেল। ওর কোলে তখন একটা খানকি। আমার বাপ আর মাগিটা মিলে আমাকে দিয়ে ভিক্ষা করাত। এখন ভাল বাবু পেলে বেচে দেবে আমাকে একরাশ ঘৃণা ঝড়ে পড়ছে চিখ বেয়ে। তুমি কিনবে?”- অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন
         ভাগ্যিস ভগবান আমাকে প্রচুর টাকা দেয় নি। মেয়ের উচ্চশিক্ষার খাতে জমাতে জমাতেই আমি ফতুর। তাই এই রকম লোভনীয় প্রস্তাবে সায় দেওয়া হয়ে ওঠে নি। পারভারসান বঞ্চিত মধ্যবিত্তদের ভীরু স্বপ্নের মধ্যে লুকিয়ে বাসা বাঁধে। কিন্তু সাহসে কুলোয় না। তাই অনেকেই বেশ নীতির দোহাই দিয়ে সান্তনা খোঁজে। যাই হোক, মমতা আর কৃতজ্ঞতার দোআঁশলা অনুভূতির দোহাই দিয়ে আমি যখনই যেতাম কিছু খাবার নিয়ে যেতাম। মেয়েটা মোনালিসা হাসি হেসে খাবার গুলো নিয়ে আমার বাইকের উপর বসত। তারিয়ে তারিয়ে খেত। পারভারসানকে আপাত্য স্নেহে পরিণত করে, আমিও বাৎসল্য রসে আপ্লুত হতাম। এভাবেই পূজো মানে দুর্গাপুজো, বাঙ্গালীর সবচেয়ে বড় উৎসব দরজায় কড়া নাড়ল। মহালয়ার আগে একবার গিয়েছিলাম, মেয়েটাকে দেখি নি। তারপর আর রাস্তা মাড়ানো হয় নি। অষ্টমীর দিন। বালিগঞ্জ আলোর মাদকতায় মসগুল হয়ে আছে। প্যান্ডেল প্যান্ডেলে ঘুরে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ একটা গোলমালে আকৃষ্ট হয়ে পতঙ্গের মত পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম। রং চটা ময়লা শালোয়ার কামিজ পড়া মা-দুর্গা ধু-লুন্ঠিত। পেশীবহুল অসুর তখনো হাত তুলে দাড়িয়ে আছে। তার সোনার পাঞ্জাবী অষ্টমীর বারোয়ারি ভোগের কল্যাণে মায়ের ভোগে গেছে। মাইকে তখনও ডাক হচ্ছেঅষ্টমীর ভোগ নিতে যারা যারা ইচ্ছুক তারা আমাদের কার্যালয়ে এসে ভোগ সংগ্রহ করুণ। কি ব্যাপার! কানে যা উড়ে এল তা থেকে আসল  তথ্য ছেঁকে নিলে যা দাড়ায় তা হল এই যে, মেয়েটা মায়ের ভোগ প্রসাদ নিয়ে এক ছুটে বেরোতে গিয়ে ধাক্কা মেরেছে। এবং সোনলি পাঞ্জাবি ভোগে মাখামাখি। তা সে বাবু সেই পাঞ্জাবীর শোকে উতলা হয়ে, ভিখিরী মেয়েটাকে উত্তম-মধ্যম দিয়েছে। মেয়েটা রক্ত আর অশ্রুতে হোলি খেলে মুখ তুলে তাকাল। আরে তো আমারই সেই মমতা সেই আদর মাখানো স্ট্রে। কিন্তু যতই হোক, আয় আয় ... চুক... চুক... করে ডাকা যায়, কিন্তু কোলে তোলা যায় না কারন আমিও যে বাবু। একটা মুখোস চাই, একটা ছদ্মবেশ। দৌড়ে গিয়ে অসুরকে বললামকি করছেন মশাই। পুলিস কেসে জড়িয়ে যাবেন যে। যান যান। যা হবার তো হয়েই গেছে, বাড়ি গিয়ে তাড়াতাড়ি ধুয়ে ফেলুন। দাগ পড়ে গেলে আর উঠবে না
                  দাগ পড়ার ভয় আমারও আছে তাই যেন একজন পুজো কমিটির মেম্বার, সেই রকম ভাব নিয়ে  মেয়েটাকে বললামঅত হুড়মুড় করার কি ছিল। এক বাটি খেয়ে লাইনে দাঁড়াবি আবার ? চল অফিস ঘরে ... দু বাটিই খাস মমতাকে (আসল নাম জানি না। আমার মমতার পোষ্য, তাই নাম দিলাম মমতা) নিয়ে বাইরে এলাম। টিউবয়েলের জলে ঠোটের কোনের রক্তটা মুছিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলামকিছু খাস নি আজ?” “না রে বাবু। পুজোর সময় কোথাও ভিখারিদের বসতে দেয় না ভিক্ষা না পেলে খাব কি?”“চল আজ তোকে খাওয়াব, যা খেতে চাইবি। আমি আর তুই খাববেদুইনে নিয়ে গেলাম। মটল কষা দিয়ে ফ্রাইড রাইস খেলাম দুজনে, তারপর থাম্পস-আপ... অনেকেই দেখছে আড়-চোখে। ভাবছে বোধ-হয় কাজের লোকটাকে পুজোর সময় জামাও কিনে দেয় নি, বেদুইনে খাওয়াচ্ছে ঢং করে!! কিংবা...।।
         এ সব নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করল না। নিজেই অবাক হয়ে গেলাম নিজের পরিবর্তনে। মমতাকে দেখছি। একমনে মাংসের হাড় চিবোচ্ছে। একটা হাড় পেলে কুকুর যেমন...মমতা তাকাল আমার দিকে। ঠোটটা ফুলে উঠেছে হলদে দাঁত গুলো বার করে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল মমতা। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই হাসির উজ্বলতা যত মেকি আলোর পস্রবনকে প্লাবনে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। মেকি হাসির হুল্লোড়কে চিরকালের জন্য যেন বোবা করে দিল। ছুড়ে দিল আসল খুশির ঠিকানা। ঠিক সেই সময় বেজে উঠল সন্ধি পুজোয় ঢাকের নিনাদ, লক্ষী পুজো শেষ। অফিস খুলেছে বাইক রাখার জায়গাটা ফাঁকা ফাঁকা। চৌকিদারও নেই। ছেঁড়াখোঁড়া চাটাই, অ্যালমুনিয়ামের হাঁড়ি, ময়লা মানুষগুলোয় নেই। উশখুশ করছি জানার জন্য। ফুচকাওয়ালাটা বসেছে। ওর কাছ থেকে অনেকদিন ফুচকা খেয়েছি আমি আর মমতা পাশাপাশি। জিজ্ঞ্যাসা করলাম মমতার কথা। সে বললআপনি জানেন না? পুজোর সময় সব পরিষ্কার করে ফেলে। নেতাদের বড় বড় পুজো আমাকেও বসতে দেয় নি এখানে

         মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল। আমতা আমতা করে জিজ্ঞাসা করলামকবে ফিরবে এরা একগাল হেসে ফুচকাওয়ালা বললকি করে জানব বলুন। এই পুজোর মাসটা গেলে কেউ না কেউ তো আসবে। যে আগে দখল নেবে। মারামারি, খেস্তা খেস্তি হবে এরা সব নেড়ি কুত্তার মত বাবু কখন কোন পাড়ায় থাকে কোন ঠিক নেই। মেয়েটার কথা ভুলে যান। আপনি তো অনেক খাইয়েছেন। ব্যাগে কাগজ ছিল বলেই দিয়েছিল। টাকা থাকলে ঝেড়ে ফাঁক করে দিত মনটা বিকল হয়ে গেল। হয়ত ঠিক। টাকা থাকলে পেতাম না। কিন্তু টাকা তো দিতে চেয়েছিলাম। বুঝি না, এখনও বুঝি না মনুষ্য চরিত্র। হয়ত কোন মমতা আসবে। আমার মমতাকে আর দেখব না। আমার মমতা এখন দোতলা / তিনতলা ছাড়িয়ে আনেক উঁচুতে চলে যাবে লিফটে চড়ে। যেখান থেকে এদের মনে হয় এরা সব রাস্তারই অঙ্গ।