গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৬

৬ষ্ঠ বর্ষ ৫ম সংখ্যা ।। ১৬ই ডিসেম্বর ২০১৬

এই সংখ্যায় ১০টি গল্প, লিখেছেন – অনুপম দাশশর্মা, বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়, তুষ্টি ভট্টাচার্য, রুখসানা কাজল, মৌ দাশগুপ্তা, নীহার চক্রবর্তী, সুবীর কুমার রায়, অভিলাষা, মনজিৎ কুমার দাস উত্তম বিশ্বাস
       
       সূচিপত্রে লেখকের নামে ক্লিক করে পড়ুন

অনুপম দাশশর্মা

ভাঁওতা নেই এমন ভুতের গপ্পে কিন্তু......

  
ঠাকুর্দা ছিলেন অবিভক্ত ভারতের আর অধুনা বাংলাদেশের বরিশাল জেলার কীর্তিপাশা অঞ্চলের অধিবাসী ও কবিরাজ বৈদ্য। তৎকালীন সরকার কর্তৃক শংসাপত্রও এখনো রয়েছে বাড়িতে। দেশভাগের পর কলিকাতায় সপরিবারে চলে আসার পরেও তাঁর কবিরাজী চিকিৎসা বহাল ছিল। আমার বাড়ি এলাকায় "কবিরাজ বাড়ি" নামেই বহুল পরিচিত। তো, আমার পিতৃদেবের মুখে ঠাকুর্দার অনেক জীবন-গল্প শুনেছিলাম। . শুনেছিলাম দূরের গ্রামে কোন রোগীর চিকিৎসা করে হেঁটে ফেরার পথে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতায় পড়ার কথা। বাবা বলেছিলেন তাঁর বাবা সেই সন্ধের সময় দুজন সহকারীকে সঙ্গে নিয়ে যখন মেঠো পথে হাঁটতে হাঁটতে ফিরছেন, তখন যেন স্পষ্ট দেখছেন আর একটু এগোলেই বাড়ী এসে যাবে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে রান্নাঘরে জ্বলছে কেরোসিনের কুপি। উনি হাঁটছেন পা চালিয়ে অথচ যেন কিছুতেই বাড়ীর কাছে আসা যাচ্ছে না। কিন্তু সেই দেখা যাচ্ছে কুপির টিমটিমে আলো। এভাবে আর একটু এগোতেই হঠাৎ হুড়মুড় করে পথ যেন নীচে নেমে গেল। আচমকা চারপাশ দিয়ে হৈ হৈ মানুষের চীৎকার। দশ বারোজন লোক মশাল বাগিয়ে আলো ফেলতেই তারা দেখল পুকুরে ফাঁদ পাতা জায়গায় আটকে পড়েছে তিনজন। একজন মুখ বাড়িয়ে বলে উঠল, আরে কবিরাজ মশাই ! আপনি এখানে... . ধরাধরি করে তিনজনকে ওপরে তোলা হল। জানা গেল ঠাকুর্দা নিজের বাড়ী ছেড়ে পেরিয়ে পাশের গ্রামের শেষে চলে এসেছেন। আর সেই পুকুরে ফাঁদ পাতা হয়েছিল মাছধরাদের ধরা হবে তাই। রাতে ঠাকুর্দার ধুম জ্বর। . পরদিন সকালে একটু সামলে উঠে ঠাকুর্দা ফিরেছেন তাঁর বাসায়। বাবাকে বলেছিলাম তাহলে কি করে এমন ব্যাপারটি ঘটেছিল। বাবা অম্লান মুখে জানিয়েছিলেন তাঁর চিকিৎসক বাবা আলোভুতের কব্জায় পড়েছিল। . এমন আরেকটি ঘটনা। . কলকাতায় ঠাকুরদা এসে প্রথমে একটি দ্বিতল বাড়ী লিজ নিয়েছিলেন। সেই সময়ের কলকাতায় প্রায়সব বাড়ীর প্রধান ফটকের বাইরে চওড়া রক থাকতো। গরমকালে ঠাকুর্দা তার বাড়ীর বাইরের রকে মশারী খাটিয়ে দিব্য নিদ্রা যেতেন। তো, তেমন এক তপ্ত রাতে ঠাকুর্দা যখন দারুণ ঘুমে বিভোর হঠাৎই খসখস শব্দে ওঁনার ঘুম ভেঙ্গে যায়। বিরক্তি ভরা ঘুম মাখানো চোখ মেলতেই দ্যাখেন.... একটা আবছা মূর্তি সাদা কাপড়ে দাড়িয়ে মশারী দু'হাতে তুলে ধরেছে। আর সেই মূর্তিমানের গলা থেকে উপরে মাথা নেই। ঠাকুর্দা এক ঝটকায় উঠে বসে নিজের কাঁধ থেকে পৈতেটা তর্জনীতে তুলে সামনে উঁচু করতেই সেই মূর্তি বেমালুম গায়েব। . জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি বাবাকে, এই ভুতের কি বংশ পরিচয়? বলেছিলেন তাহার শুভনাম "স্কন্ধকাটা ভুত" !


বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

নীল গোলাপ

         কর্পোরেট দুনিয়ায় এই অল্পদিনেই শঙ্খশুভ্র সান্যাল একটি পরিচিত নাম কীভাবে সমস্ত অ্যাডভার্স সিচুয়েশন ওভারকাম করতে হয় কীভাবে ড্যামেজ কন্ট্রোল করে আবার ঝকঝকে পূনর্বিন্যসের মোড়কে সবকিছু নতুনভাবে মুড়ে দিতে হয় এইসব প্যাকেজিং তার মুখস্ত মার্কেটিং আজ হাতের নাগালে একটি বোতামের স্পর্শে খুলে যাচ্ছে বাজার মানুষকে অলস করে দাও শারীরিক এবং মানসিক দিক থেকে সে যেন বাজার বাজার যেতে না পারে বাজারকে পৌঁছে দাও তার বাড়ির দরজায় আর ভাবনার মধ্যে যৌক্তিক বিন্যাসগুলো এলোমেলো করে দাও যাতে সে নিজে কিছু ভাবতে না পারে মার্কেট তাকে যা বোঝাবে এর বাইরে সে যেতে পারবে না শঙ্খশুভ্র এই দর্শনকে প্রসারিত করেছে তার জিও হকার নামে একটি কর্পোরেট সংস্থার মাধ্যমে প্রেমকেও প্যাকেজিং এর আওতায় ফেলা যায় কী না এই নিয়ে এখন গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে সে তার তীব্র বিশ্বাস পৃথিবীর কোন বিষয়ই বাণিজ্যিক পরিষেবার বাইরে নয় সীমা নামের মেয়েটি আসবে বিকেল পাঁচটায় ওকে সেভাবেই বলা আছে সীমার মনস্তত্ত্ব , ভালো লাগার পরিধি , পছন্দ এবং তাকে খুশি করার উপাদান সবকিছুই ডাটাব্যাঙ্ক থেকে দেখে নিয়েছে শঙ্খ সেইমতো প্রোগ্রামিং করা আছে ল্যাপটপে সমস্ত প্যারামিটার টু জেড ফলো করলে সীমা প্রেমে পড়বেই এবং সে শঙ্খ ছাড়া অন্য পুরুষের কথা জীবনে ভাবতেও পারবে না সীমা যথাসময়েই এল কম্পিউটার নির্দেশিত সংলাপ আবেগের তারতম্য অনুসারে ঠিক মেপে বুঝেই বলে চলল শঙ্খ পছন্দের গান শোনাল , খাবার এল সীমা খুব খুশি বলল- তাহলে চল আমি তোমাকে প্রেম দেখাই , শঙ্খ প্রেমের মুর্ত রূপ দেখল - হাই শাঙ্খো ,আই আম প্লিজড , লাভ ইউ এন্ডলেস বলে আকাশের দিকে হাত বাড়াল দিগন্তপ্রসারী শঙ্খশুভ্র বুঝল কম্পিউটার কাজ করছে পরদিন রনিতা , তারপর অসীমা , পামেলা , রুমেলা ......

যাকে যেরকম সময় দেওয়া ছিল এল কারো সাথে কারো দেখা হওয়ার কথা নয় ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু বলে শঙ্খ এক একজন নারীর সাথে কাটাতে লাগল সকাল বিকাল সন্ধ্যে, রাত অদ্ভুত সুন্দর প্রোগ্রামিং কী অপূর্ব ! প্রেমও এবার যন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে তিনদিন পর বিকেলে একটি শপিং মলের সামনে এসে দাঁড়াল শঙ্খ তিনফুট দূরে ওই যে ফুচকা খাচ্ছে ওই মেয়েটা হ্যাঁ ওই তো সীমা কিন্তু ওর তো আজ দিল্লী যাওয়ার কথা সেরকমই তো বলেছিল সেদিন পাশের ছেলেটি তার মুখে একটা ফুচকা গুঁজে দিতে দিতে কি বলছে ফিসফিস করে - কাল সন্ধ্যায় এসো কিন্তু সারারাত মস্তি হবে ... ছিঃ, কোন মরালিটি নেই একরাশ মনখারাপ নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায় একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁয় কিছু খাওয়ার ইচ্ছে হল তার এসব জায়গায় সে কখনও আসেনি প্রথম পা রাখল রুমেলাকে দেখে সে চমকে উঠল পর্দা ঢাকা কেবিনের আলোছায়ায় কার ঠোঁটের আলিঙ্গনে ধরা দিচ্ছে সে লোকটাকে নয় রুমেলার দিকেই অপলক চেয়ে আছে শঙ্খ বিরক্তি নিয়ে সে বেরিয়ে আসে এরপর কোথায় যাবে সে ? মনটা দুমড়ে মুচড়ে চৌচির হয়ে গেছে সারারাত ঘুম এলনা ভোর হতেই সে বেরিয়ে পড়ল বনপথ পেরিয়ে নির্জনতার দিকে জঙ্গলের পর জঙ্গল নদীপথও সে পেরিয়ে এল পায়ে হেঁটে দেখল এক যুবতীকে জ্যোৎস্না ঠিকরে বেরুচ্ছে তার গা থেকে একজন যুবক ধরে আছে তার হাত তুমি নীল গোলাপ দেখেছ অরুন্ধতী ? অরুন্ধতী মেয়েটি বলল- কিছুই তো দেখা হয়নি আমার - সত্যিকারের ভালোবাসো নীল গোলাপ ফোটায় দেখবে ? - কীকরে দেখব আমার তো চোখ নেই ছেলেটি তার গালের উপর হাত রাখল এবার বিন্দু বিন্দু নীল জল - এই রঙ নীল গোলাপ হয়ে ফুটে উঠছে আমার শরীরে , দেখো মেয়েটি আবার মাথা নাড়লআমি দেখতে পাচ্ছি না ছেলেটি বললতুমি কেঁদো , না আমার দুটো চোখ দুজনে ভাগ করে নেব কথাগুলোর কম্পন শঙ্খকে তোলপাড় করল সে বুঝতে পারল এই শব্দগুলো কম্পিউটারে প্রোগ্রামিং করা নয় বুকের সেই জায়গা থেকে উঠে আসছে যেখানে সত্যিই নীল গোলাপ ফোটে