গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১৬

৫ম বর্ষ ৭ম সংখ্যা।। ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

এই সংখ্যায় ৯ট গল্প । লিখেছেন অসিত চট্টোপাধ্যায়, ব্রতী মুখোপাধ্যায়, সুবীর কুমার রায়, সাঈদা মিমি, তাপসকিরণ রায়, শেখর কর, রুখসানা কাজল, আবু রাসেদ পলাশ, পলাশকুমার পাল ।

          সূচিপত্রে লেখকের নামে ক্লিক করে পড়ুন

অসিত বরন চট্টোপাধ্যায়

রুখা মাটিতে সোঁদা গন্ধ
                    [ প্রথম পর্ব ]

এ এক পলাশের দেশ। বিস্তির্ণ ধূ ধূ মাঠ। সবুজের লেশ বলতে ন্যাড়া পলাশের কিছু বিবর্ণ আধশুখনো ঝরা পাতা। পলাশের অভাব নেই। পেট ভর্তি থাকলেই পলাশ ফোটে। পাশে মহাকাল উল্টানো বাটির মত ন্যাড়া পাহাড়। নামটি ভারী সুন্দর। গৌরাঙ্গী। গৌরাঙ্গী নাম কেন হয়েছিল কে জানে। কেননা পাহাড়ে উঠতে গিয়ে দেখেছিলাম, মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের হাড়, করোটি, দু একটা পুর্ণ নরকঙ্কাল। বাতাসে চাপা গন্ধ। হাওয়ায় দীর্ঘশ্বাস।
পাহাড়ের কোল বেয়ে তিরতির করে বয়ে গেছে মুরাড্ডি নদী। আমি আদর করে নাম দিয়েছিলাম কাজলী নদী। যৌবনচ্ছল কাজলী বয়ে যেত আপনমনে। যে যায়গাটার কথা বলছি,সে যায়গায় খুব একটা কেউ আসতো না। গা ছমছমে পরিবেশ। দু একটা চিল শকুন ছাড়া অন্য পাখীরও দেখা মিলতো না। একটা আধিভৌতিক পরিবেশ।
এ হেন রুখা শুখা ভৌতিক পরিবেশে আমাকে পাঠানো হলো প্রোজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। কারণটা হল চঞ্চলা কাজলীকে বাঁধতে হবে অর্থাৎ কাজলীর বুকে বাঁধ দিতে হবে। অগত্যা রওয়ানা দিলাম জীপগাড়ীতে চড়ে। কিছু ইঞ্জিনীয়ারিং ইনস্ট্রুমেন্টস  নিয়ে ওখানে পৌছে চক্ষু চড়কগাছ। এ কোথায় পৌঁছালাম! ধূ ধূ মাঠ ইতি উতি পলাশের জঙ্গল।এক দেড় কিলোমিটার ব্যাসার্ধে কোন জনবসতি নেই। সকাল দশটায় গা ছমছম করা পরিবেশ। কিন্তু উপায় নেই। চাকরী রক্ষার দায় বড় দায়।
প্রাথমিক কাজ ছিল সার্ভে করা। দুজন রাখাল ছেলেকে দৈনিক মজুরীর কড়ারে সঙ্গে নিলাম যন্ত্রপাতি ধরা আর বওয়ার জন্য। ওরা প্রথমেই ভয় খাওয়ালো,
----বাবু যায়গাট ভাল লহে। যে কোন সময় যা কিছু ঘটে যাতে পারে। ইখানে দিনের বেলিও ভুত বাহিরায়।
ওদের কথা শুনে হাসলাম। বললাম
----যা তবে ঘরের খুঁধিতে ঢুকিন থাক ভুতের ডরে।
এসব কথার মধ্যেই আমি থিওডোলাইট বসিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছি। কাজ করা পাঁচ মিনিটও হয়নি হঠাৎ দেখি ফুট তিরিশেক দুরে একটা বোমা ব্লাস্ট হলো। আচমকা এই ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেলাম। ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া। ড্রাইভার বিজনকে বললাম, 'প্যাক আপ, চল ফিরে যাই।' তড়িঘড়ি সবকিছু নিয়ে সোজা হে'ড অফিস। ভাগ্যিস ঐ বোমায় স্প্লিন্টার ছিল না,থাকলে কি হত ভেবে শিউরে উঠলাম।
[ দ্বিতীয় পর্ব ]
অফিসের বড়সাহেবকে বলতেই উনি বলে বসলেন 
----প্রোজেক্ট তো শুরু করতেই হবে। ভয় পেলে তো চলবে না। যদি রিভলবারের লাইসেন্স চান ডি এম কে লিখে ব্যাবস্থা করতে পারি।
বললাম,
----সে কি? আমি কি যুদ্ধ করবো নাকি?
 
---- যদি কিছু হয় তাহলে পুলিশে খবর দেবেন।
----বেঁচে থাকলে তো দেবো।
---- তা বললে হবে না।
ভাবলাম ছুটি নিয়ে বসে থাকবো। তাও সম্ভব না। কেননা আর্ণড লিভ প্রায় শেষের মুখে। বাড়ীতে গেলাম। কাউকে কিচ্ছু বলিনি। পরদিন সন্ধ্যায় মামাদাদুর বাড়ী গিয়ে নানা গল্পের মাঝে দাদুকে এই ঘটনা খুলে বললাম। দাদু পেশায় এডভোকেট।
  সব শুনে বললেন,
----তুই তিনদিন পরে আয়। তারপর বলে দেব কি করতে হবে।
তিনদিন পর দাদুর কাছে গেলাম। দেখি দাদুর কাছে বসে আছে গাঁট্টাগোঁট্টা এক লোক। নাম দুগাই। দাদু আমাকে বললেন, 
----এই দেখে রাখ। এর নাম দুগাই বাউরী। এদের যে সর্দার তার নাম ভোলা চার আর বীরু চার। ওরা ওই যায়গার মালিক। তুই কাল থেকে যেতে পারিস তবে শর্ত একটাই, তা হলো ওই হলুদ রঙা ১০২১ জীপ ছাড়া যাবিনা,দ্বিতীয়ত কোন রকম পুলিশের কাছে এদের নিয়ে কিছু বলবি না,তৃতীয়ত প্রতিদিন সন্ধ্যে হওয়ার আগেই মাঠ ছাড়তে হবে।
দুগাই বলে উঠলো,
----ঠাকুরবাবা আপনি লিভঃয়ে যাবেন আর কুছু হবেক নাই। হামি আপনার থোবড়াটা দেখিন লিলি। আর কেউ কিছু কইরবেক নাই। কেউ কিছু ব'ল্ল্যে হামকে বলিন দিবেন। উয়াকে তুলিন লিব। আজ হামি তাহিলে চল্লি।
দাদুকে 'পন্নাম ঠাকুর' বলেই দুগাই চলে গেলো। দাদুর কাছে, পরে জানতে পারলাম ওরা দুস্কৃতীর দল। ডাকাতি ওদের পেশা। অত্যন্ত হিংস্র ওরা। ওদের লিডার ভোলা ও বীরু চার। জাতিতে ময়রা। ঐ তল্লাটে ওরাই একছত্র অধিপতি। ওরা ভালো কাজও করে খারাপ কাজও করে। ডাকাতির টাকা দিয়ে যেমন গরীবদের জন্য স্কুল তৈরি
  করে দেয়,গরীব মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা দেয়, তেমনি প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিকেশ করা ওদের বাঁ হাতের খেল। দলের কেউ বেইমানি করলে তাকে চিরতরের জন্য স্তব্ধ করতে দুমিনিটও সময় লাগে না।
যেহেতু আমি সার্ভে করার সময় থিওডোলাইট নিয়ে কাজ করছিলাম, সে সময় ওরা ভেবেছিল আমি পুলিশের চর, দুরবীন নিয়ে ওদের গতিবিধি লক্ষ্য করছি,তাই বোমাবাজী।
ভোলা ও বীরু ওরা দুই ভাই। ভোলা ডাকাত হলেও কিছু নীতি মেনে চলত। অত্যাচারী সুদখোর জমিদার বাড়ি বেছে বেছে ডাকাতি করতো। ভুলেও স্ত্রীজাতির গায়ে হাত দিত না। বৃদ্ধ ও শিশুদের উপর কোন অত্যাচার করত না। পার্শ্ববর্তী  তিন চারটে গ্রামে ছোটদের জন্য স্কুল বাড়ী তৈরী করে দিয়েছিল।
দুঃস্থ পরিবারকেও সাহায্য করত নিঃশর্তে।

পাশের বালিগাড়া গ্রামের স্কুল পন্ডিত বংশী বাবুর ছেলে ভোলা আর বীরু। শোনা যায় বংশী বাবু নাকি খুবই গরীব ছিলেন। অভাবী সংসার হলেও আপ্রান চেষ্টা করে যেতেন দুই ছেলেকে মানুষ করতে। কোন এক জমিদারের কাছে টাকা শোধ না করতে পারার কারণে মিথ্যা চোর অপবাদ দিয়ে লেঠেল দিয়ে ওনাকে প্রকাশ্য রাস্তায় দিবালোকে হত্যা করআ হয়। সেই ঘটনা আর পাঁচজনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছিল ছোট্ট ভোলা আর বীরু।
সেদিন থেকেই ভোলা আর বীরুর জীবন অন্য খাতে বইতে শুরু করে। পলাশ রঙা রক্তের বদলা নেওয়ার শপথ নেয় ভোলা। অকাল বসন্তে পলাশের নেশা তীব্রতর হয়।
একদিকে কষ্ট করে পড়াশুনা চালিয়ে যায় মেধাবী ছাত্র ভোলা, অন্যদিকে বুকে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে দাউ দাউ করে। সেকেন্ড ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাশ করে মা সরস্বতীর সঙ্গে আড়ি হয়ে যায়।
[ তৃতীয় পর্ব ]
দুগাইয়ের আশ্বাস আর দাদুর উপর ভরসা করে বাক্স বেডিং নিয়ে আবারও রওয়ানা দিলাম। জীপ থেকে নেমে পাশের গ্রাম মুরাড্ডিতে বাড়ীর খোঁজ করলাম। কেউ বাড়ী ভাড়া দিতে চায় না। অগত্যা পরিতক্ত  এক কৃষি খামারের কোয়ার্টারে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলাম। প্রোজেক্ট এরিয়ার কাছাকাছি। কোয়ার্টার পরিস্কার করতে গিয়ে বেরুলো বেশ কয়েকটি বিষধর সাপ আর কাঁকড়া বিছে। আগাছা পরিস্কার করিয়ে কার্বলিক এসিড ছড়িয়ে দুদিন পর বাড়িতে ঢুকলাম।
এ দুদিন আমাদের বাসস্থান ছিল ছাদবিহীন নির্নিয়মান হাসপাতাল কোয়ার্টার। ফিল্ড হস্টেল তৈরী না হওয়া পর্যন্ত কৃষি খামারের কোয়ার্টারে থাকতে হয়েছিল।
সার্ভের কাজ শেষে মাটি পরীক্ষার কাজও শেষ। লে আউট দেওয়ার পরেই শুরু হল কাজ।
মিঃ চৌধুরী ও মিঃ মল্লিক দুই বড় ঠিকাদার কিছু স্থানীয় এবং বেশ কিছু শ্রমিক এনেছিলেন সুদুর মুর্শিদাবাদ থেকে।
প্রথম দিনেই বিপত্তি। পুজো হলো, নারকেল ফাটানো হলো, কিন্তু কে প্রথম মাটি কোপাবে তাই নিয়ে বচসা। কেউই প্রথম মাটি কোপাতে রাজী নয়, এ যায়গাটা নাকি ভুতুড়ে। যে প্রথম কোপাবে সে নাকি তিন দিনের মধ্যেই রক্তবমি করে মরবে।পলাশে রঙ ধরবে অকালে। কেউ রাজী না হওয়াতে, অগত্যা আমাকেই গাঁইতি ধরতে হলো। পাশে একজন ফুট কাটলো,
---- ই ইঞ্জিনারটা বাভন বঠে,পৈতা আছে কাঁধে,ইয়ার কিছু নাই হবেক।
আমি গাঁইতি নিয়ে মাটিতে কোপ মারতে শুরু করলাম। বার পাঁচেক কোপ মারতেই দেখি এক মাথার খুলি। সবাই চমকে উঠে পালাবার চেষ্টা করছিল। বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওদের বললাম 
----"তোরা ওইপাশে মাটি খুঁড়তে শুরু কর। ওদিকে মাটিটাও নরম আছে।"
ওরা জনা পঞ্চাশ মিলে মাটি খোঁড়া শুরু করল। ঘন্টা দুই পরে আবারও বিপত্তি। গুনে গুনে দেখলাম এগারোটা মাথার খুলি থরেথরে সাজানো। ওরা তো ভয় পেয়েইছিল। আমিও বাদ ছিলাম না।
ওই বারোটা খুলির সৎকার করে আবারও পরদিন ফিরে পূজা করা হলো। এমন কি দুটো পাঁঠাবলিও হলো।
সবাই পাঁঠার ঝোল আর ভাত খেয়ে তার পরদিন আবার কাজ শুরু হলো। না আর খুলি পাওয়া যায়নি। কিন্তু কার খুলি, কেন খুলি এর জবাব পাওয়া যায় নি। পলাশে রঙ ধরতে গিয়েও ধরল না। পলাশ গাছে কচি পাতা গজালো।
[ চতুর্থ পর্ব ]
ভোলা চারকে নিয়ে অনেক কিংবদন্তি আছে। ভোলা প্রখর বুদ্ধিমান, তার চেহারা কেমন তা কেউ জানতো না। কেউ জানলেও বলত না। এমনকি পুলিশ ফাঁড়িতেও কোন ছবি ছিল না। তার জন্য পুলিশ বহু চেষ্টা করেও ওকে ধরতে পারেনি। শোনা যায় ভোলা একবার নিজের চেহারার বিবরণ ও তার অপকর্মের কাহিনী  শোনাতে তদানীন্তন ডি সি (ডেপুটি কমিশনার)  ও পদস্থ পুলিশ অফিসারের সঙ্গে বৈঠক করেছিল। বৈঠক শেষে পেপার ওয়েটের তলায় একটা চিরকুট ছেড়ে  এসেছিল।  চিরকুটে নাকি লেখা ছিল " All of you are fools. I was at here."
দুঃসাহস দেখাতে গিয়েই প্রথম ভুলটা করে ফেলেছিল ভোলা। পলাশের বৃতির চেহারা আর গড়ন দেখে ফেললো পুলিশ মহল। তাও কিনা আঠারো বছর বাদে। পাশাপাশি গ্রাম যশপুর,ভেটি,মুরাড্ডি,রামচন্দ্রপুর মানপুর সব যায়গাতে চলতে লাগলো তল্লাশী। কিন্তু কোথায় ভোলা। গ্রামের লোকের মুখে কুলুপ। তাই সোর্স হিসেবে পুলিশ ইয়াসিনকে ঠিক করল,যে কিনা আসানসোলের বড় দুস্কৃতীকারী। সেও সুবিধা ও সুযোগ  পেয়ে ভোলার সাম্রাজ্যে পা রাখলো।  এহেন সময়ে ভোলার মা মারা গেলেন। বালিগাড়া গ্রামে রব শোনা গেল ভোলা মায়ের পারলৌকিক কাজ করতে গ্রামে আসবে। পুলিশের সোর্স পুলিশকে কনফার্ম করলো। বালিগাড়া গ্রামের বাড়িতে একদিকে মাইকে মন্ত্রোচ্চারণ হচ্ছে,অন্যদিকে গোটা বাড়ী ঘিরে রেখেছে অজস্র পুলিশ। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। মন্ত্রোচ্চারণ  শেষে দুপুর দেড়টায় ঘরের ভেতর পুলিশ  ঢুকে দেখে ভোলা নেই। চিরুনি তল্লাশি করে পুলিশ কিচ্ছু পায়নি। নারী ছদ্মবেশে ভোলা ততক্ষনে পগারপার। তিনদিন বাড়ি ঘেরাও করেও পুলিশ তার টিকি দেখতে না পেয়ে অধোমুখে ব্যারাকে ফিরে গেল। ঠিক পাঁচ দিনের মাথায় এক রাখাল ছেলে গৌরাঙ্গী পাহাড় থেকে নেমে এসে বলল
---- পাহাড়ের উপরে একটা মানুষের মাথা দেখলাম। মুখে দাড়ি আছে।
পরে জানা গেলো ওটা ইয়াসিনের কাটা মুন্ডু। পুলিশ  মরিয়া হয়ে উঠলো ভোলাকে ধরার জন্য।
বীরু অর্থাৎ ভোলার ভাই, ভোলার বিপরীত চরিত্রের। বীরু অত্যাচারী, চুরি, ডাকাতি,ধর্ষনে সিদ্ধহস্ত। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে থাকতো দিনের বেশির ভাগ সময়। প্রতিরাত্রে নিত্য নুতন শয্যাসঙ্গিনী নিয়ে মেতে উঠত। কোন মেয়ে অবাধ্য হলেই চরম শাস্তি দিতো। এই একটা বিষয়ে গ্রামের মানুষ বীরুর উপর তিতিবিরক্ত হয়ে পড়েছিল।  কিন্তু যেহেতু ওর দাদার নাম ভোলা, তাই কেউ প্রতিবাদ করার সাহস করেনি। এর জন্য গ্রামের লোকেদের গোপন ক্ষোভটা গিয়ে পড়ে ভোলা চারের উপর। দুগাই ভোলাকে বলে,
---- দেখ খুড়া বীরু ভাইপোর উপর গাঁয়ের লোক বহুত বিরক্ত। উ যে অন্যায় কামগুলা ক'রছে সেটা তো ঠিক লহে। তুঁই তো বলিনছিলি বিটি ছা মা বহিনের মতন। উয়াদের গায়ে কেউ হাত দিলে হাতট কাটিন লিব। লোক ভা'বছে তোর পশ্রয়ে উয়ার এত বাড়বাড়ন্ত। উ যা খুশি ক'রত্যে পারে,আর তোর জন্যে কেউ কিছু ব'লতে পারছ্যে নাই। শেষমেশ
  তরেই উপর লোকের রাগ হবেক।
----হম
---- উয়াকে একটুয়েক বকিন দে ন। অন্তত
  বিটিছায়ের উপর অত্যাচারট কমাক ন ভালা।
---- উ শুধরিবেক নাই কাকা।
ভোলা প্রতিদিন সকালবেলা স্নান সেরে কালীপুজো করতো তারপর মুখে কিছু দিত। যেখানেই থাকুক না কেন কালীর ফটো পুজা বন্ধ হয়নি। এমনি একদিন মানপুর গ্রামে এক সাগরেদের বাড়ীতে  সকালবেলায় কালীপুজায় বসেছিল। এমন সময় পুলিশ ঘিরে ফেললো সারাবাড়িটা। পুজা অসমাপ্ত রেখে পাঁচিল ডিঙিয়ে পালাতে চেষ্টা করল। কিন্তু বিধাতা অলক্ষে হয়তো হেসেছিলেন। ঝাঁকে ঝাঁকে  গুলি ছুটে এল তার শরীরে। প্রথম গুলিটা লাগলো পায়ে,তবু খোঁড়াতে খোঁড়াতে দৌড়ে ঢুকে গেলো বাঁশঝোপে। কিন্তু শেষরক্ষা হলনা। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল ভোলা।
ফাল্গুনের
  কৃষ্ণচুড়া সকালে একটা পলাশ টুপ করে খসে পড়ল।
[ পঞ্চম পর্ব ]
পূর্ণ উদ্দমে বাঁধ তৈরীর কাজ শুরু হল। ঠিকেদারের ক্যাম্প,শ্রমিকদের থাকার ধাওড়াতে ভরে গেল মাঠের একাংশ। তখনও জে সি পি মেশিনের চল হয়নি।সব কাজই ম্যানুয়ালি করতে হত। ট্রাক, ড্রাইভার, খালাসি, মুর্শিদাবাদের বহু শ্রমিক,ও স্থানীয় শ্রমিকে ছয়লাপ। মাঠ নদী লোকে লোকারণ্য। বাঙ্ময় হয়ে উঠলো নির্জন মাঠ, মৌন গৌরাঙ্গী আর আমার লজ্জাবতী কাজলী নদি। এ যেন কাজলীর বিয়ের উৎসব। ভেটির পাহাড় থেকে গৌরাঙ্গী পাহাড়ের দুরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার।এই এক কিলোমিটার দুরত্ব বাঁধ দিতে হবে। একপাশে তৈরী হবে স্পীলওয়ে।  দুই পাহাড়ের মধ্যিখানে বয়ে যাচ্ছে লজ্জাবতী কিশোরী কাজলী। কলকল, ছলাৎ ছলাৎ। চঞ্চলা কিশোরী একদিন যৌবনবতী হবে। বর্ষায় ঘুঁঙুরের টুপটাপ শব্দে নেচে উঠবে। খেয়ালী কাজলীকে তো ছেড়ে দিতে হবে মাঝে মধ্যে সাগর পিয়াসী স্রোতবতীকে। তাই স্পীলওয়েতে দরজা বসাতে হবে। তারজন্যই বিশাল কর্মকান্ড। রঙ ধরবে পলাশে। সবুজ হবে অহল্যাভূমি, শস্যবতী হবে আদিগন্ত মাঠ। মৌন মূক গৌরাঙ্গীর বুকে গড়ে উঠবে নিত্য নুতন রিসর্ট। মুছে যাবে কঙ্কালের ইতিহাস।
এই স্বপ্ন মেদুরতাই উৎসাহ যুগিয়ে যাচ্ছিল বিশাল কর্মকান্ডের প্রাথমিক নির্মান পর্বে।
বারোঘর তেরো উঠানের মত শ্রমিকদের ধাওড়া গুলো ভারী অদ্ভুত। অনেকটা তাঁবুর মত। কিন্তু ত্রিপল কাপড় দিয়ে নয়। তিনদিকে ছিটেবেড়ার দেওয়ালে খড় দিয়ে ঢাকা উপরে পাতলা খড়ের ছাওনি। সামনে ছোট্ট ছয় বাই আটের গোবর নিকানো উঠান। এক একটা পঁচিশ  জনের দলের জন্য নয়টি ধাওড়া। তার মধ্যে একটা রান্নাঘর।
স্থানীয় শ্রমিকদের কাজের নির্দিষ্ট সময় থাকলেও মুর্শিদাবাদের শ্রমিকের কোন বাঁধা ধরা সময় ছিল না। রাত হোক বা দিন যে কোন সময় তাদের কাজে লাগানো হত। তবে আট ঘন্টার বেশী নয়।
দেখতাম তারা অবসর সময়ে গম্ভীরা বা ভাওইয়া গাইত। ভারী সুন্দর লাগতো ঐ গান শুনতে। বেঁচে থাকার অন্যতম রসদ ছিল ঐ গান।
বেশ কিছুদিন কেটে গেল। খনন কার্য প্রায় শেষের দিকে। সিমেন্ট, ছড়, বালি পাথর সবকিছু মজুত হতে লাগল আস্তে আস্তে। মাঠে স্তুপাকৃত বালি আর চিপ্স,বোল্ডার ইত্যাদি। দিন কয়েক পরেই দ্বিতীয় পর্বের কাজ শুরু হবে।
এমনসময় একদিন সন্ধ্যের গোড়ায় গোড়ায় হঠাৎ দেখি সবাই ভূত ভূত চিৎকার করতে করতে দৌড়ে পালাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
 
---কি ব্যাপার ওরা দৌড়ে পালাচ্ছে কেন?
ঠিকাদারের ম্যানেজার সিংজী বলে উঠলেন
----এ শালারা ভূতের ডরে পালাছে।সব বকবাস। ভুত বলে কিছু আছে নাকি। শালারা ডরপুক আছে।
আমি বললাম ----চলুন সিংজী একবার দেখে আসা যাক।
সিংজী প্রথমে দোনামনা করতে লাগলেন,
----আপনে যান স্যার, সব ফালতু আছে।
 
সিংজীকে বললাম ---- আরে চলেন না। দেখেই আসা যাক না ব্যাপারটা কি?
একরকম জোর করেই সিংজীকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি বেশ কয়েকজন সাহসী গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর উৎসুক হয়ে কি যেন দেখছে। আমাদের দেখেই যায়গা ছাড়লো। আমিও আর পাঁচজনের মত দেখে অবাক হলাম একটা সিঁদুর লেপা বটপাতা ধীরে ধীরে চলছে। এটা দেখেই সিংজী ধুতি সামটে দে দৌড়
 
---- আই বাপ এতো বঢ়িয়া ভূত আছে রে বাবা।
 
সিংজীর দৌড়ানো দেখে হেসে ফেললাম। ভাবলাম ধুতি না খুলে যায়। তাহলে আবার ফ্যসাদ। কে একজন বলে উঠল,
---- স্যার আবার জোড়া পাঁঠা বলি দিয়ে বিশাই চন্ডীর পূজা দিতে হবেক। পরশু শ'নবার আমাবস্যা,ঐ দিনটতে পূজা দিলে ভূত পেরেত আর উপদ্রব
  নাই করবেক। সবাই দেখি ওর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলে উঠলো,
----হঁ হঁ তাই হোক। পূজাটা হলে করতেই হবেক।
আমি যে চমকাইনি তা নয়। তবু সাহসে ভরকরে আমার স্টিল ছাতার বাঁটটা আচমকা গেঁথে দিলাম ঐ সিঁদুর লেপা পাতাটায়।  কয়েক সেকেন্ড পরেই ছাতাটা মাটি থেকে উঠাতেই দেখি ছাতার সঙ্গে পাতাটাও উঠে এসেছে। অত্যন্ত কম আলো। তবু পর্যবেক্ষন করে দেখলাম, পাতার বোঁটা একটা কালো সুতায় বাঁধা। কালক্ষেপ না করে ছেঁড়া সুতোকে ধরে একটা কাঠিতে গোটাতে গোটাতে চললাম সুতার অভিমুখে। শেষ প্রান্তের ধাওড়ার মুখে আসতেই দেখি অন্যপ্রান্তে মনোহর মাহাতো সুতো গোটাচ্ছে। আমাকে দেখেই চমকে উঠলো মনোহর।
---- স্যার আপনি।
---- হ্যাঁ আমি।তোমার ভূতটা ধরে এনেছি। এই দেখ ছাতায় গেঁথে রেখেছি।
 
---- সা স্যা স্যার। হামার কন দষ নাই।ঐ শালারা হামকে হুচকাঁয়ছে। বললেক একটা ভুতের ব্যাবস্থা কর তাহিলে পাঁঠা মাংসের যগাড়টা হঁয়ে যাবেক। হা দেখুন এখন শালারা পাছুয়াছে, দৌগিন পালাছ্যে।
আমি ওকে ধমকাবো কি হেসে বাঁচিনা ওর অবস্থা দেখে। বেচারা যে এভাবে ধরা পড়ে যাবে ভাবেনি। আমি বললাম,
---- হ্যাঁরে বাপ হামকে বললেই পারথিস,হামি ঠিকাদারকে বলিন জড়া পাঁঠা কেনে যাচাই মাংসের ব্যাবস্থা করথি।
---- একবার বলিন দিহেন ন সার। মাংস বহুত দিনলে নাই খাওয়া হয়।
এই গরীব গুর্বো মানুষগুলোর উপর মায়া হলো। শোষিত মানুষগুলো কি সহজ সরল। মুখে বলতে না পেরে ছলনার আশ্রয় নিয়েছে। কয়েকটুকরো পাঁঠার মাংসের জন্য। অথচ আমরা? প্রতিদিন প্রায় মুরগী নয়ত খাসির মাংস দিয়ে ঠিকাদারের ক্যাম্পে মধ্যাহ্ন ভোজন সারছি।
নিজের উপরই ঘেন্না ধরতে শুরু করল।
প্রথম যেদিন ঢালাই বা সিমেন্টের কাজ শুরু হবে তার আগের দিন জম্পেশ ভোজ হলো। সব শ্রমিকের নেমতন্ন। পাতা পেড়ে আদিগন্ত মাঠে বসিয়ে দেওয়া হল ওদের। খিচুড়ি, একটা পাঁচমিশালি তরকারী, চাটনি  আর খাসি মাংস। কি আনন্দটাই না ওরা পেল। অন্তত একটা দিন তো ওরা পেট পুরে খেলো। অন্যান্য দিন দেখতাম স্থানীয় শ্রমিকরা নিয়ে আসতো জামবাটিতে করে পান্তাভাত, শাকপাতা, নুন আর কাঁচা লংকা। ওদের বাচ্চা ছেলে মেয়েদের ঐ একই খাবার। সদ্য মা হওয়া  মেয়ে শ্রমিকরা বাচ্চাকে বুকের দুধ খাইয়ে পলাশ গাছের তলায় মাটির উপর কাঁথা পেতে শুইয়ে দিয়ে ঝুপি ঢাকা দিয়ে আসত। ঝুপি মানে বেতের উল্টানো শঙ্কুর মত। যা দিয়ে সাধারনত চেঙ,ল্যাঠা,মাগুর মাছ ধরা হয় তাকেই স্থানীয় ভাষায় বলে ঝুপি। অন্যদিকে মুর্শিদাবাদের শ্রমিকের বাঁধাধরা খাবার। প্রত্যেকের জন্য একবেলার বরাদ্দ পাঁচশ গ্রাম চালের ভাত, দেড়শো গ্রাম আলুসেদ্ধ,সপ্তাহে একদিন পঞ্চাশ গ্রাম কুচো মাছ, চারটে কাঁচা লংকা, সপ্তাহে  চার বান্ডিল বিড়ি ও একটা দিয়াশলাই। "সত্য সেলুলাস কি বিচিত্র এই দেশ।"

(শেষ অংশ পরের সংখ্যায় )


ব্রতী মুখোপাধ্যায়

 চশমা

চশমাটা আমার। আর আমাকেই পরতে দেবে না!
না, আমি কাঁদব না। একটাও শব্দ যেন আমার মুখ দিয়ে বের না হয়। এক ফোঁটা জলও যেন আমার চোখ থেকে বের না হয়। দাঁতে দাঁত চেপে আমি পড়ার টেবিলে বসে আছি।

ভোর হয় নি তেমন। পাখির ডাক কানে আসছিল। জানলা দিয়ে রোদ আসে নি। মনে হচ্ছিল মেঘলা আকাশ। হুড়মুড় করে বাবা আমাকে বিছানা থেকে তুলে দিল। তুলে দিয়েই বলতে লাগল কেন ভোরে ওঠা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো, কেন আমাদের দেশের মুনিঋষিরা প্রাচীনকালে ভোরভোর উঠতেন, উঠতেন সেই সময় যাকে ব্রাহ্মমুহূর্ত বলে। তারপর  সূর্যপ্রণাম করেই পাঠারম্ভ।

এই পাঠারম্ভের ব্যাপারটাই বাবানের কাছে প্রধান। কাল রাতে আইপিএল তো দেখতেই দিল না। একটা বিদঘুটে সাইক্লিক অরডারের অঙ্ক হাতে ধরিয়ে দিয়ে পুলিশের মতো সামনে দাঁড়িয়ে রইল। পুলিশের মতো এইজন্যে বলছি যে, আমার যখন অঙ্ক করতে ইচ্ছে করে না আর বাবান ওই লাভ-ক্ষতির কেনাবেচার জটিল কোনো অঙ্ক করতে দেয়, আমি তালে তালে থাকি, বাবান একটু আড়ালে গেলেই আগে কোথাও কষা আছে দেখে টুকে দিই। বাবানও জানে ব্যাপারটা। তাই, পুলিশের মতো, হাতে সময় থাকলে, দাঁড়িয়ে থাকে। 

তো সেই কাল রাতে অঙ্কটি করতে পারি নি। বাবান ছাড়ার পাত্র না। ভোরবেলাই সেই কারণে ঘুম থেকে তুলে দিয়েছে। আমি জানতাম, এখুনি, নিজেই খাতা খুলে ওই অঙ্কটিই করতে দেবে। তা দিক। ওইরকম বাবান করেই। ছেলেবেলা থেকেই। কিন্তু ঘুম ভাঙার আগে আমি একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। ঘুম ভাঙতেই কেমন এক গন্ধ আমার চারপাশে। কোনো ফুলের গন্ধ না। সেন্ট কি পারফিউমের গন্ধ যেমন হয় তাও না। তবে আমি নিশ্চিত ওই গন্ধের সঙ্গে কিছু একটা আছে যা আমার ভালো লাগে। স্বপ্নে যে আনন্দ ছিল বাবান তা চটকে দিল। এ কথা বাবানকে বলাও যায় না। বললেই আরম্ভ করে দেবে, কি স্বপ্ন দেখেছিলে ভালো করে মনে কর। পুরোটা আমাকে বল, যতটা মনে পড়ছে বল। স্বপ্নের পেছনে মনের সত্যি থাকে। এইসব। 

বলা যায় নাকি সব কিছু ? সবাইকে ? বড় হচ্ছি না ? আর আশ্চর্য, ছোট থেকে ‘বড় হতে হবে’ ‘বড় হতে হবে’ শুনে আসছি। মনে নেই ? ‘দুধটা খেয়ে নাও, শরীরে শক্তি হবে কি করে ? বড় হতে হবে না ?’ এইরকম কত কথা।

বড় যে হচ্ছি আমার চেয়ে বেশি কে আর টের পাচ্ছে ? বড় হচ্ছি বলেই তো সাতসকালে চশমা নিয়ে এই  কাণ্ড। ডাকতার কাকু বলেছে ওই চশমা সবসময় চোখে রাখতে। বাবানের বেজায় আপত্তি। জানে না কিছু না, বলবে, সবসময় চোখে চশমা, তা আবার মাইনাস পাওয়ারের, চোখের নাকি আরো ক্ষতি হবে। আসল ব্যাপারটা খানিকটা বাবান জানে আর আমিও জানি। আরে ভাই, আশ্চর্য সুন্দর ওই চশমা। ফ্রেমটি আমার ঠোঁটের মতো গোলাপি। গ্লাস নয়, ফাইবার। মামা যেবার জাহাজ নিয়ে এল, (বছরে একবার আসে তো, খুব খরচ করে, একেবারে দুহাত খুলে), বাবুবাজারে আমাকে একটা ঝাঁচকচকে চশমার দোকানে নিয়ে গিয়ে বলল, বাছ নীলাই। যা তোর পছন্দ হবে কিনে দেব।

এমন মামা সত্যিই হয় না। তার ওপর, সেবার নাইনে উঠেছি, আর অন্যদিকে, মামারও বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে। বাবানই, বলতে গেলে, ঘটক। তখন, বিশাল দোকান, আমি পড়লাম মুশকিলে। যেদিকে তাকাই সেদিকেই চশমার ফ্রেম। আমি শাহরুখ, সলমান, এমনকি, ধনি কি দাদার (মানে, সৌরভ গাঙ্গুলীর) চশমা খুঁজছি। আর বারবার চোখ চলে যাচ্ছে লেডিস চশমার দিকে। দোকানদারকাকু একবার বলেই ফেলল, তোমাকে দেখতে যদিও খানিক খানিক মেয়েদের মতো, তবে তুমি তো গার্ল নও, তুমি তো বয়। তুমি এই বাঁ দিকের ফ্রেমগুলোই দেখো। কি লজ্জা! কি লজ্জা! তখন, ওই চশমা হল। দোকানদারকাকু মামাকে আরো একটা কথা বলল, কে আপনার ? ছেলে ?
মামা বলল, ভাগনা, একমাত্র ভাগনা, নাইনে উঠেছে, চোখটা গেছে।
নাইনে ? মাথায় তো বেশ উঁচু। নাকটাও উঁচু কিন্তু।
আমি জানতাম, আমার নাক একটু চাপা।

বাবান সমানে বকেই চলেছে। অঙ্ক তো হচ্ছিল না। আমি একটু উঠে, পাশের ঘরে যেখানে ড্রেসিং টেবিল, তার সামনে দাঁড়িয়েছি। বাবান ছাদের ফুলের টবে জল দেবে বলে তখন। চশমা খুলে, ডান দিক দিয়ে একবার, একবার বাঁ দিক দিয়ে, আমার মুখ কেমন দেখাতে পারে, চশমা পরেও সেভাবে, চশমাটি  কপালের ওপর তুলে দিয়েও, যদি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি তাহলে, যদি এমনভাবে তাকাই মনে হবে গভীরভাবে কিছু ভাবছি, কিসে কেমন দেখায় ---- পরখ করছিলাম। সেই মুহূর্তেই বাবান। কখন ছাদ থেকে নেমে এসেছে। বলল, চশমাটা দাও।
আমি বললাম, কেন ?
দাও বলছি না ?
কিন্তু কেন ?
তুমি আজ চশমা পরে স্কুলে যাবে না।
কেন ? আমি দূরের জিনিশ দেখতে পাই না। আমি ব্ল্যাক বোর্ড দেখতে পাই না।
ফাস্ট বেনচে বসবে।
ফাস্ট বেনচে ধীমান-দেবজিৎরা বসতে দেয় না।
দেবে কেন ? তুমি তো আর 
আমি জানি, বাবানের কথার শেষটুকু হত (ওদের মতো টপার নও ...)। সে তো আমি কোনোদিনই নই। আমি নিশ্চিত, হতেও পারব না। আর তাই আমার কোনো দুঃখও নেই। কিন্তু এসবের সাথে চশমা না পরে স্কুলে যাবার কি সম্পর্ক বুঝতে পারছি না। আমি বললাম, না বাবান, চশমা পরে যাব।
না।

আজ আমাকে স্কুলে যেতে হবে। ফটো তোলা হবে। ক্লাশ টেনের সবাই, ছেলেমেয়ে সবাই, ফটো তুলবে। যামিনী বলেছে আমার সাথে আলাদা করে ফটো তুলবে --- ওর আর আমার। সেঁজুতি ক্লিক করবে। যামিনী বলেছে তিন-চারটে ফটো তুলবে আমার সাথে। আমার এই চশমাটি ওর খুব পছন্দ। একবার, যেন কেউ দেখতে না পায় সেভাবেই, এই চশমাটি ঠোঁটের কাছে নিয়েছিল। আমি দেখে ফেলেছি। তবে চুমু খেয়েছিল কিনা বুঝতে পারি নি। কারণ, কোনো শব্দই হয় নি।

বাবান গায়ে হাত দেয় না ঠিকই, কিন্তু এমন জিদ করে আমার কান্না পেয়ে যায়। এইসব সময়, মাকেও বলে দেখেছি, মাও কিছু করতে পারে না। শেষ অব্দি বাবানের কথাই শুনতে হয়। কাঁদলেও শোনে না। আর এখন আমি বড় হয়ে যাচ্ছি না ? কাঁদলে, কান্নার শব্দ পেলেই, টুটান দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ে।  টুটান আমার খুড়তুতো ভাই। ক্লাস থ্রি বললেই সবাই বুঝতে পারবে কত বয়েস, তবে কেমন যেন অস্বাভাবিক পাকা। বলবে, কাঁদিস না, দাদান, জেঠুর কথা শুনে নে। বড়দের কথা শুনতে হয়। পিত্তি জ্বলে যায়।

স্টাইল হচ্ছে! বাবান আবার বলল।
স্টাইল! জন্মদিনে একটা ক্যামেরামোবাইল কিনে দিতে বললাম। কত করে বললাম। ক্লাসের কত ছেলে নিয়ে আসে। প্রিতম আনন্দের তো আবার ইনটারনেট আছে। তা কিছুতেই দিল না। বলল, ইনজিনিয়ারিঙে চান্স পাও, তখন দেখা যাবে।
বললাম, বাবান! আজকের দিনটা চশমাটি পরে যেতে দাও। কাকুতির মতো করেই বললাম।
না। বাবানের গলার স্বর আরও গম্ভীর।
এই অঙ্কটা যদি নামিয়ে দিতে পারি ?
না।

আমি আর সামলাতে পারলাম না। বুকের মধ্যে থেকে কি একটা উথলে উঠতে চাইছে। বাবান এত নিষ্ঠুর কেন ? সম্বিতদার কথা মনে এল হঠাৎ । সম্বিতদার বাড়ি পরের রাস্তায়। ইনজিনিয়ারিঙ পাশ করেছে তিন বছর হল। চাকরি পায় নি। হোমিওপ্যাথি দোকান আছে সম্বিতদার বাবার। সন্ধেবেলা সেখানেই বসে।  সম্বিতদার বাবাও খুব রাগী। এত রাগী যে খদ্দেররা নাকি ওদের দোকানে যেতে চায় না। সম্বিতদা বলে হিটলার, নিজের বাবাকে।

বাবানকে আমি হিটলার বলতে পারব না। বাবান খুব ভালোও। কাল রাতে যদি আইপিএল না থাকত, আর যদি সাইক্লিক অরডারটি ঠিকঠাক নেমে যেত, তাহলে হয়ত আজ আমার চশমাবিভ্রাট হতই না। ব্যস। আমি আর কিছুতেই সামলাতে পারলাম না। বাচ্চা ছেলের মতো কেঁদেই ফেললাম। দরজার দিকে একবার চোখ গেল। দরজাটা খোলাই। বাবান তখনও বলছে, যতই কাঁদো, চশমা ছাড়াই আজ তোমাকে স্কুলে যেতে হবে।


তখুনি মোবাইল ফোনটি রিঙটোন শোনাল, এ পথে আমি যে গেছি বারবার। বাবানের পছন্দের রিঙটোন। কতদিন বলেছি, রিঙটোনটা বদলাও। একটা ভালো হিন্দি গান নাও, শান কিংবা রহমানের। বাবান ধমক  দিতে ওস্তাদ, মোবাইল কে ইউস করে ? আমি। আমার চয়েসে নাক গলিও না। সত্যিই তো। কতদিন বলেছি। মা শিখতেই চাইল না। তাহলে আর এই সন্যিসীমারকা রিঙটোন শুনতে হত না।     
বাবান ইস্তিরি করছিল। বলল, নীলাই, ধরো।
আমি কাঁদতে কাঁদতেই বললাম, অঙ্ক করছি।
বাবান ঘাটাল না। ইস্তিরি রেখে মোবাইল তুলে নিল, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, (এই নিন, নাতির সাথে কথা বলুন) বলেই আমার হাতে ফোনটি ধরিয়ে দিল।
চালাক বলে চালাক! ভাবল, দাদুর সাথে কথা বলতে গেলেই আমার কান্না থেমে যাবে। আমিও জোরে কেঁদে উঠলুম। ওপ্রান্ত থেকে দাদু অস্থির হয়ে উঠল, কি হল, দাদুভাই ?
আমি আরও জোরে কাঁদছি তখন। স্পিকার অন করে দিলাম। এবার তো দাদুর গলা বাবানও শুনতে পাবে। ঠিক। দাদুর গলা, কি হল, দাদুভাই ? সকালবেলাই দাদুভাইকে কাঁদাচ্ছে। সুভাষকে নিয়ে আর পারা যায় না। এই নে, গোপা, দেখ তো। দুদিনের জন্যে এলি, তাও কত দিন পরে ...
দাদু থামবে না। থামবে না যতক্ষণ গোপা, মানে আমার মা, মোবাইলটা হাত থেকে না নেয়। দাদুর মাথাটা গোল, আর পুরোটাই টাক। আমি একবার বলেছিলাম, বিশাল একটা মারবেল। মারবেলের কথা হঠাৎ মনে এল কেন এখন আবার! সত্তর বছর বয়েস হবে। একটাই মেয়ে। তাই মাঝেমধ্যে মেয়েকে নিজের কাছে  নিয়ে যাওয়া চাই। তার জামাই,  মানে শ্রীযুক্ত সুভাষচন্দ্র দাস, মানে আমার বাবান, কোনোদিন আপত্তি করে নি। বাবানের কি ? কাকিমা-ই তো খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। খাওয়ার ব্যবস্থা অবশ্য নিচের তলায়।  মা জানিয়ে দিল, সামনের শনিবার, আসতে পারে।

দিন চারেক আগে মামা এসে মাকে নিয়ে গেছে। তাতে একটা লাভ হয়েছিল এই যে যামিনী রোজ ফোন করতে পারত। ফোনে ওর গলা কেমন ঘ্যাসঘ্যাসে লাগে। মা থাকলে আমি বারণ করে দি। মা একবার আমাকে ধরেছিল, কে রে মেয়েটা ? তুই চুল কাটবি কি না, সেকথা ও বলার কে ?
যামিনীও পারে। আমার আগেই মা সেদিন ফোনটা ধরেছিল আর যামিনী বলছিল, তোর মাথার চুল বড় হয়ে গেছে। ছেঁটে নিস রোববার।

কিন্তু আমার নাটক জমল না। কান্না থামল নিজের থেকেই। বাবানের দাড়ি কামানো হয়ে গেছে। অঙ্কটি এরই মধ্যে, কেমন করে কে জানে, মিলে গেল। বাবান শুনল। দেখল খাতাটা, তবে তো পারো না এমন নয়।

চশমার কথা আর একবার বলব ভাবছি, কি জানি আমার মুখের দিকে তাকালেই বাবান অনেক কিছু মুহূর্তেই বুঝে নেয় (ভাগ্যিস, সব কিছুই বুঝতে পারে না), গম্ভীরভাবে বলে উঠল, লাইব্রেরি নিয়ে দশটা সেনটেন্স লিখে দাও। আমি স্নান সেরে আসছি। দেখো, কায়দা করবে না। ভুলভাল যেন না হয়। যেটা জানো না, লিখতে যাবে না।

বলেই চলে গেল। এইসময় আমি খবরের কাগজে চোখ বোলাই। বাবানের স্নানপুজো সারতে আধ ঘণ্টা চল্লিশ মিনিট লাগে। কাগজ থাকে কাকুর পড়ার টেবিলে। কাকু বাংলার মাসটার, ইংরেজি কাগজ পড়ে। আমি ভালো বুঝতে পারি না। তবে খেলার পাতা আর বিজ্ঞাপনগুলো খুব টানে।

লাইব্রেরি ? যামিনীর সাথে স্কুলের লাইব্রেরিতেই তো, আলাপ নয়, ভাব হয়েছিল, প্রথমবার। যামিনীর মা গল্পের বইএর পোকা। মার জন্যে বই নিতে এসেছিল। দেবু দত্ত, ইতিহাসের স্যার, আমাকে শিব্রাম চক্রবর্তীর কোনো বই আছে কিনা খোঁজ নেয়ার জন্যে পাঠিয়েছিলেন। তখনই, মানে সেদিনই, মানে আমাদের টিফিন পিরিয়ডে, লাইব্রেরির পাখা খারাপ হয়ে যাওয়ায় বেশ গরম লাগছিল। চশমা খুলে আমি  একটা টেবিলে রেখেছিলাম।
যামিনী বলল, চশমা খুললি কেন ? তোর চশমার ডিজাইনটা খুব সুন্দর, আর তোর মুখে মানিয়েছেও ব্যাপক।
আমি একটু সপ্রতিভ হবার চেষ্টা করছিলাম, যামিনী বলতে থাকল, তোর নাকটা স্লাইট ফ্ল্যাট, কিন্তু ঠোঁটদুটো স্লাইট হেভি। তাই ক্লাস টেনেও তোকে বেশ কিউট লাগে।
আশ্চর্য, রহস্যময় গন্ধ একটা ছড়িয়ে পড়ছে। বাতাসই হয়ত বয়ে এনেছে। কিংবা ছিল হয়ত আমার মধ্যেই কোথাও। কিন্তু যামিনী যা বলছিল ভালোই লাগছিল শুনতে। দেখলাম, যামিনীর হাতে প্লাসটিকের চুড়ি, চওড়া আর হলুদ রঙের, কানে ছোট ছোট রিং, গলায় কিছু নেই। চোখদুটো শুভশ্রীর মতোই মিস্টি মিস্টি, তবে যখন সে হাসে কোয়েলের সাথে কোথাও মিল চোখে পড়ে। গায়ের রঙ পাওলি দামের মতোই চাপা। যামিনী এভাবে কখনো কথা বলে নি। আমরা জানতাম, ভালো ইংরেজি জানে বলে ওর খানিক ফুটুনি  আছে। ইংরেজিতে কথা বলতেও পারে। রবিঠাকুরের জন্মদিনে টানা পাঁচ মিনিট ইংরেজিতেই বলেছে। এহচ এস স্কুলের ক্লাস টেন।
যামিনী সেখানেই থামে নি। আমার দিকে একটুখানি এগিয়ে এসে কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে বলেছিল, ওয়ান ওয়ার্ড মোর আমি বলতে পারি, ইফ আয়াম টু ডেসক্রাইব ইউ। বলেই থেমেছে, না থাক, ইউ লুক, না থাক, ওয়ার্ড, ফোর লেটারড ওয়ার্ড, না থাক, বিগিনস উইথ এস।

লাইব্রেরির প্যারাগ্রাফ কি আর গল্প হলেও সত্যি এইসব দিয়ে আরম্ভ করা যাবে ? বাবান আমার পিঠের ছাল ছাড়িয়ে নেবে তাহলে। যা হোক, যে করেই হোক বাবানকে যাতে প্রসন্ন করা যাক, এমন কিছুই বোধ হয় মনে মধ্যে ছিল, কারণ প্যারাগ্রাফ তাকে হয়ত খুশিই করেছে, দুটো একটা শিলি মিসটেক লাল কালি দিয়ে মারকিং করে দিয়ে বলল, যাও, স্নান করে এসো। ভালো করে সাবান দিয়ে স্নান করবে। তোমার পাশে যে বসবে তার যেন মনে না হয় যে তোমার গা থেকে গন্ধ বের হচ্ছে।
সব শুনতে রাজি আছি, বাবান। চশমাটা দাও। ঠিক আছে, একদিনের জন্যেই দাও। কাল থেকে না হয় ---
না। আবার সেই গম্ভীর গলা। আর আগের চেয়ে জোরেও। তারপরই জিগগেস করল, আমার সঙ্গে যাবে,  না বাসে যাবে ?

এর পরে কথা বলার ইচ্ছে কারো থাকে ? বললাম, আমি নিজেই যাব।
অফিস যেতে বাবান প্রায়ই দেরি করে ফেলে। এই কথাটাও আমার মাথায় ছিল। কিছুদিন আগেও, বাবান অফিস যেত যখন ইচ্ছে। তখন কি একটা কমিটির সদস্য ছিল। ওই কমিটির সদস্য হলেই সাত খুন মাফ হয়ে যেত। এখন খুব কড়াকড়ি চলছে। বাবান বলে, এ কিছু দিনের জন্যে। এমন মাঝেমধ্যে হয়। আবার আগে যেমন ছিল, হয়ে যাবে। নীলাই মাধ্যমিক দেবে। ব্যবস্থা একটা আমাকে করতেই হবে। ওর দিক থেকে চোখ সরানো যাবে না।

স্কুলে যাবার পথেই সম্বিতদাদের বাড়ি। সম্বিতদা বেলা দশটায় বাইরের বারান্দায় চায়ের কাপ হাতে। বেশ গাবদাগোবদা চেহারা হয়েছে। খায় দায় ঘুমোয়। কাজকর্ম নেই। তবে গণিত জানে তুখোড়। গণিতের সঙ্গে আমার আবার বনিবনা ভালো না। মাসটার একজন আছে। মানে টিউশন। সপ্তাহে দুদিন। সায়েন্স গ্রুপ। গোয়ালই বলা যায়। তা তিনিও মাঝসাঝে খাবি খান। তখন ওই সম্বিতদাই ভরসা। কিন্তু ইদানীঙ সম্বিতদাকে নিয়ে আমার একটা সমস্যা হচ্ছে। দেখা হলে খুব সচ্ছন্দবোধ করছি না। তাই বারান্দায় দেখতে পেয়েই কেটে পড়তে চাইছিলাম।
সম্বিতদাই ডাকল, শোন তো।
বললাম, বাস ছেড়ে দেবে।
শোন না একবার।
সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই প্রথমে বলল, ব্যাগের মধ্যে কি ঠেলেছিস রে! দেখে তো মনে হচ্ছে হসটেলে যাচ্ছিস।
তারপরই গলার স্বর হঠাৎ নিচে নেমে গেল, স্কুল থেকে ফিরে একবার আসবি।
কথাটি শেষ হতেই আমি সেই গন্ধটি পেলাম। সম্বিতদার ঘরে আমি আগেও পেয়েছি। বললাম, আচ্ছা।
বার তিনেক হয়েছে। একবার জ্যামিতির একটা এক্সট্রা নিয়ে গেছি। পরের দুবার নিজেই ডেকে পাঠিয়েছে। আমাকে সোজা নিয়ে গেছে দোতলায়, নিজের ঘরে। প্রথমে, দুহাত ধরে সামনে, একেবারে মুখোমুখি, দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমার চেয়ে মাথায় একটু উঁচু তো, আমার মাথার চুলে নাক ঠেকিয়ে নিশ্বাস নিয়েছে। তারপর বলেছে, চশমাটা খোল। খোল, রাখ না ওই বিছানার ওপর। 
আমি চশমাটা চোখ থেকে সরিয়ে বিছানার ওপর রাখতেই বলেছে, আমার দিকে চা, চেয়ে থাক। কত বড় হলি দেখি।
আমার মনে হচ্ছিল, বাড়ি চলে যাই। কিন্তু সম্বিতদা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই, দুহাত দিয়ে আমার মুখটা তুলে ধরে আমার দুটো চোখে বারবার চুমু খেয়েছে। এই সময় তার ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছিল। আমার কি খারাপ লাগছিল ? আমার কি ভালো লাগছিল ? কিন্তু কেমন যেন লাগছিল। আর ব্যাপারটি আমি কাউকেই বলি নি। 

বড় হওয়ার কথা, স্কুলেও, ক্লাস টিচারের কাছ থেকে শুনতে হয়েছে, তুমি বেশ লম্বা নীলাই। সেকেন্ড বেনচে যদি বসতে হয়, একেবারে কোণের দিকে বসবে। নাহলে তোমার পেছনের স্টুডেন্টদের ব্ল্যাক বোর্ড দেখতে অসুবিধে হবে। তখন একটা সুবিধে এই হল যে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পেছনে খানিকটা দেখতে  পারছি। প্রিয়ঙ্কা, সেঁজুতিরা পাশের বেনচগুলোয় বসে। আমি যামিনীকে দেখতে পারতাম।
কিন্তু যতদূর মনে পড়ছে, বড় হচ্ছি প্রথম শুনেছি মার মুখ থেকেই।  তখন আমার ক্লাস সিক্স কি সেভেন। বাথরুমে শাওয়ারের জল মাথায় ঢেলেই তোয়ালে হাতে সোজা শোয়ার ঘরে ছুটে যেতাম। সে একদিন খুব ঠান্ডা পড়েছে। মাথায় জল ঢেলেই রোদের খোঁজ। মা বলল, দাঁড়া তো। ভালো করে দেখল আমাকে। কি দেখল বুঝি নি। তারপর বলল, বড় হচ্ছ। স্নানের পর বাথরুম থেকে বেরনোর আগে তোয়ালে জড়িয়ে নেবে। ন্যাংটো হয়ে বেরবে না।

পিকলু আমার জন্যে সিট রাখে। ওকে আগের স্টপেজে, জোড়ামন্দিরে, উঠতে হয়। পাশে বসতেই জিগগেস করল, তোর চশমা ?
আনি নি।
কেন ? আজ তো ফটো তোলা হবে।
জানি।
সবচেয়ে সুন্দর ফটো কার হবে বল তো ?
কার ?
যামিনীর। ওকে যা দেখতে না --- ফাটাফাটি।
আমার চেয়ে সুন্দর ?
তুই তো ছেলে।
না। ওকে কি আমার চেয়ে সুন্দর দেখতে ? তুই এই কোশচেনটার আনসার দে।
তোর চেয়ে প্রিতম আনন্দ কিন্তু লম্বা। ফরসাও।
এবার আমি আর কিছু বলব না বলে ঠিক করে নি। কিন্তু পিকলু আবার বলে, ওর নাম কোনটা রে ? প্রিতম না আনন্দ ? দুটোই তো নাম মনে হয়।
আনন্দ ওদের টাইটেল। ওরা পানজবি। চুলকাটা পানজাবি। বাবুবাজারে হিরো বাইকের একটা শোরুম আছে দেখেছিস ? ওটা ওদের।
ঘ্যাম পয়সা বল ?
পয়সা ? ওরা হেভি রিচ।
পিকলু একটু সময় চুপ করে থাকে। আমার মন এমনিতেই বিগড়ে আছে। চশমা ছাড়া ফটো উটবে। বেকার। বাবানের জন্যেই।
পিকলু চুপ করে থাকতে পারে না। ক্লাসেও। টিচারদের ধমক খায়। মারও খায়। মুখ খোলে আবার, প্রিতম তোকে দেখিয়েছিল ?
কি ?
জিগগেস করলাম ঠিকই, কিন্তু আমি জানতাম পিকলু কি বলতে চাইছিল।
কিন্তু পিকলুই প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল। কারণ, রাখো মা কালী স্টপেজে একজন বুড়ো মানুষ বাসে উঠেছে যার মাথায় যদিও চুল নেই পেল্লাই গোঁফ রয়েছে দুই গাল জুড়ে। পিকলু তাই দেখে, তার দিকে তাকিয়েই, প্রায় শব্দ করে হেসে উঠছিল আর কি। আমি বললাম, হাসিস না, পিকলু।
তুই দেখছি বড়দের মতো কথা বলছিস, বলেই পিকলু আমার গলায় ফু দিয়ে দিল।

লোকটিকে দেখে আমার দাদুর কথা মনে পড়ল। দাদুর মাথাও ফাঁকা, তবে বড় হওয়া বলতে দাদু অন্যরকম বোঝে। বলে, তোমার চোখ হল সবচাইতে বড় ব্যাপার --- মানে, তুমি কি দেখতে পাচ্ছ,  কতদূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছ, যত বয়েস হবে ততই বাড়বে তোমার দেখার ক্ষমতা, যা যা তুমি দেখবে বা তোমার দৃষ্টির আওতায় আসবে তোমাকে দেখতে হবে তার কোনটি ভালো আর কোনটি তোমার পক্ষে হানিকর, কি তোমাকে আনন্দ দিতে পারে, কি তোমার দুঃখের কারণ হবে। অবশ্য, দাদু এইভাবেই বলে নি কখনো, তবে তার কথা সাজিয়ে নিলে এইরকমই দাঁড়াবে।

পিকলু আবার কনুই দিয়ে গুঁতোল, বল না, দেখিয়েছিল ?
আমি আবার বললাম, কি ?
পিকলু ব্যাগটা সরিয়ে, হঠাৎই দুই আঙুলে আমার প্যান্টের ওপরে শুঙ্কুটা টিপে ধরল, এইসব।
আমি রীতিমতো চমকে উঠলাম। আমাদের ক্লাসে দু-একটা ছেলে এইরকম করে জানি। পেছনের বেনচেই বসে তারা। শুনেছি, আরো অনেক কিছুই করে। কিন্তু পিকলু তো সামনের দিকে বসে। আর এইসব নিয়ে আমাকে ও আগে কোনোদিন কিছুই বলে নি। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ভেবেই পাচ্ছে না আমি চমকে উঠলাম কেন। বললাম, মোবাইল ফোনে ওইসব ক্লিপিংসের কথা বলছিস ?
পিকলু বলল, হ্যাঁ। পুরোটা দেখিয়েছিল ?
না, একটুখানি দেখেছিলাম, তারপরে স্যার ক্লাসে চলে এসেছিল।
কতদূর দেখেছিলি ? জামাপ্যান্ট খুলে ফেলেছিল ?
হ্যাঁ।
তারপর ?
তারপরই তো স্যার ক্লাসে চলে এল।
খুব ফরসা বল ?

স্কুলে ঢুকতেই সবাই আমাকে ছেঁকে ধরল, জিগগেস করতে লাগল সে কেন চশমা পরে আসে নি। যামিনীকে দেখতে পেলাম না। কেউ একজন বলল, আগেই ফটো তোলা হবে। দেবজিৎ বলল, আজ যামিনীর ঝাড় হচ্ছে।
কেন ? ওর দিকে না তাকিয়েই বললাম।
যা সেজে এসেছে না, মনে হচ্ছে পারলার থেকে এসেছে।
সেজে এসেছে তো কি হয়েছে ? ফটো তোলা হবে ---
নীলাই, কথা বলিস না। চশমাই পরে আসিস নি।
হেডমাসটারের রুমের কাছে একটা ছোট ভিড়।
ধীমান বলল, দুপক্ষেরই বাড়াবাড়ি।
কি হয়েছে ?
ধীমান কোনো উত্তর দিল না। ভালো ছাত্রদের এই এক সমস্যা, আমার মতো কাউকে, মানে যারা আর কি পরীক্ষায় বেশি নমবর পায় না তাদের, হিশেবের মধ্যেই ধরে না। সামনেই ছিল আদৃতা, বলল, যামিনী যেরম সেজেছে, তেমনি হেড স্যারও হেভি দিয়েছে।
আমি আর পারলাম না, বললাম, তুইও তো খুব সাজগোজ করেছিস। তাতে অসুবিধে কোথায় ?
তখুনি কোত্থেকে সেঁজুতি ছুটে এল। হাতে একটা ক্যামেরা। দামিই হবে। বলল, কে কে ফটো তুলবি দাঁড়িয়ে পড়। ধীমানরা সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল, ঝাউগাছটাকে পেছনে রেখে।
রেডি ? স্মাইল! ওয়ান ট্বু থ্রি, একটু জড়াজড়ি করে দাঁড়া। ফাইন।
দেবজিৎ বলল, ডিজিটাল ক্যামেরা ? ডিজিটাল ?

সেঁজুতি আমার হাত ধরে টান দিল, আমার সঙ্গে আয়, পেছন পেছন।
একটু এগিয়েই গেল ও। প্রায় ছুটেই। পিকলু, ক্লাস টেনের ক্লাসরুম থেকেই দেখতে পেয়ে, চেঁচিয়ে উঠল,  সেঁজুতি, কোথায় যাচ্ছিস ?
সেঁজুতি কোনো জবাব দিল না।
স্কুলের দালান চার দিক দিয়েই একরকম ঘেরা। পশ্চিমেই একটা বড় দরজা। দক্ষিণ দিকে সাত আটটা গাছ কিভাবে আর কতদিন ধরে মাথায় বেড়েছে, ডালপালা ছড়িয়েছে, কেউ তার খবর রাখে না। তার মধ্যেই, একজোড়া মহুয়া গাছ পাশাপাশি। একটু দূরে বেশ উঁচু পাকুড়। আরও চার পাঁচটা গাছ ছায়া ছড়িয়ে  দাঁড়িয়ে রয়েছে, কি তাদের নাম আমার জানা নেই।  সেখানেই যামিনী একা একা। আসামান্য সেজেছে সে। কোথায় লাগে শুভশ্রী কি কোয়েল!
যামিনী লক্ষ করল আমার চোখে চশমা নেই। কিছু বলল না। সেঁজুতি বলল, চটপট কর। ঘাম মুছে নে। নে দাঁড়া। ক্লোজ হ রে বাবা!  আরও। ধুর! তোদের দ্বারা কিচ্ছু হবে না। দেরি করিস না।
সেঁজুতি পরপর পাঁচ-ছটা ফটো তুলে নিল, বলল, একসাথে যাবি না কিন্তু। ঝাড় হবে। আমাকে আগে কাটতে দে।

সেঁজুতি চলে গেল। আমার ঠোঁটের কাছে এল, ভোরবেলা আমি তোর স্বপ্ন দেখেছি। যা দেখেছি আবছাআবছা মনে আছে। তবে তা মুখ ফুটে বলতে পারব না।
আমি কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না। আশ্চর্য! পরিচিত গন্ধটা কোথা থেকে যে আসছে।
এদিকে আয়, যামিনী ডাকল। পাকুড় গাছের পেছনটায়। তারপর আমাকে আর একটুও সময় না দিয়ে নিজের ঠোঁটদুটো নিয়ে এল আমার ঠোঁটের কাছে।




সুবীর কুমার রায়

 গ্রাম দেখার হ্যাপা

ছোটবেলা থেকে গ্রামেই মানুষ বলা যায়। আজ যে অঞ্চলে বসবাস করি, জীবনের প্রায় পঞ্চাশটা বছর সেখানেই বসবাস করলেও, মিলি, সেন্টি, ডেকা, হেক্টোর মতো সেটারও সৌন্দর্যের, উন্নতির, পরিচিতির, ওজন বেড়ে বেড়ে ক্রমে পুরো গ্রাম থেকে, আধা গ্রাম, আধা শহর, পুরো শহরের, মর্যাদা ছাড়িয়ে এখন মেগা সিটির সম্মানে ভুষিত এক শহরের আকার ধারণ করেছে। কিন্তু দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়ার মতো সেভাবে গ্রামের সৌন্দর্য কোন দিনই লক্ষ্য করা হয় নি। আলোর পাশে অন্ধকার না থাকলে, প্রকৃত অন্ধকারের রূপ চেনাও যায় না। তাই কোন গ্রামের সৌন্দর্য, নির্মল বিশুদ্ধ হাওয়া, সততা, টাটকা সবজী, পুকুরের মাছ, বাড়ির গরুর দুধ, কাঞ্চন, স্বর্ণ চাপা, বকুল, মালতী লতা, প্রজাপতির কথা শুনলে আজ আফসোস হয়, কেন সেদিন চোখ বুজে থাকলাম, কেন সেদিন বুক ভরে নিশ্বাস নিলাম না। তাই আজও সময়, সুযোগ পেলেই ছুটে যাই কাছেপিঠের কোন গ্রামে। মন খারাপ হয়ে যায়, যখন দেখি সেইসব গ্রামেও আধুনিকতার ছোঁয়া  লেগে গ্রাম্য সৌন্দর্য হারিয়েছে। ঠিক যেমন কোন সুন্দরী নারী আধুনিক বিউটি পার্লারের সৌজন্যে নিজের স্বাভাবিক সৌন্দর্য হারিয়ে কৃত্রিম চাকচিক্যের অধিকারী হয়।

তখন আমি নতুন চাকরী পেয়ে কলকাতার ডালহৌসি অঞ্চলে একটা আকাশচুম্বি বাড়িতে কর্মরত। একদিন গ্রাম নিয়ে আলোচনার সময়, আমার তিন সহকর্মী স্বপন, বলাই ও মনোজ, হঠাৎ কোন একটা প্রত্যন্ত গ্রাম, তাদের ভাষায় ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুর, দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলো। আমি কাছেপিঠেই আমার দেখা একটা গ্রামের কথা উল্লেখ করতেই ওরা রাজী হয়ে গেল। এই জায়গাটা আমার বাড়ি থেকে বেশ কয়েকটা রেলওয়ে স্টেশন পরে অবস্থিত। এর আগেও আমরা কয়েকজন ঐ স্টেশনে গিয়ে মাঠের আল ধরে, সাঁকো পেরিয়ে পায়ে হেঁটে অনেক ঘুরেছি। পরদিন শনিবার অফিস ছুটির পরে আমার পছন্দ করা গ্রাম দেখতে যাওয়া পাকা হয়ে গেল।

শনিবার অফিস ছুটির পরে, আমরা চারজন আমাদের বাড়িতে এসে চা জলখাবার খেয়ে, রোদের তেজ একটু কমলে, ট্রেনে চেপে নির্দিষ্ট স্টেশনে এসে হাজির হলাম। আজ কিন্তু ওদের নিয়ে অন্য দিকে এগলাম। এই এলাকা আমার পরিচিত নয়। আল ধরে, পায়ে চলার মাটির রাস্তা দিয়ে সোজা এগিয়ে যাওয়া, আবার আন্দাজে আন্দাজে, প্রয়োজনে স্থানীয় লোককে জিজ্ঞাসা করে করে, স্টেশনে ফিরে আসা। রেল লাইনের ওপর দিয়ে বেশ খানিকটা পথ হেঁটে, একটা সরু বাঁশের সাঁকোর কাছে এসে হাজির হলাম। ইংরাজী এক্স (X) অক্ষরের মতো কিছু দুরে দুরে তিনটে বাঁশের খুঁটির ওপর দুটো বাঁশ, রেল লাইনের পাশের সরু ঝিলের এপার থেকে ওপার পর্যন্ত ফেলা। খুঁটির একটু ওপর দিকে রিকেট রোগগ্রস্থ একটা খুব সরু বাঁশ এপার থেকে ওপার পর্যন্ত বাঁধা, সম্ভবত পথচারীদের ঐ বাঁশ ধরে নিরাপদে পারাপার হওয়ার সুবিধার্থে।

স্বপন যখন সাঁকোর মাঝামাঝি, তখন ওপার থেকে স্থানীয় একজন, ট্রেন ধরার তাড়ায় কী সুন্দর ঐ সরু বাঁশের ওপর দিয়ে ওকে পাশ কাটিয়ে এপারে চলে এল। বলাই যখন বহু প্রস্তুতি নিয়ে পার হওয়ার জন্য সাঁকোর ওপর কয়েক পা মাত্র এগিয়েছে, ঠিক তখনই ওপারে এক বৃদ্ধা গরু নিয়ে সাঁকোর কাছে এসে উপস্থিত। গরুর গলার দড়ি তাঁর হাতে জড়ানো। মনোজ ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠলো, এই মরেছে, এ আবার গরু নিয়ে আগের লোকটার মতো সাঁকো পার হবে নাকি? এই বলাই সাবধান, গরু সাঁকো পার হবে। বলাই ভয় পেয়ে প্রায় মিনতি করে বলে উঠলো, ও মাসী একটু দাঁড়াও, আমি আগে পার হয়ে নি তারপরে তুমি তোমার গরুকে সাঁকো পার করাও। ব্যাস্, বলাইয়ের আদরেরে মাসী রেগে গিয়ে চিৎকার শুরু করে দিল— “তোমরা কিরকম নেকাপড়া জানা মানুষ বাপু? গরু কখনও  তোমাদের মতো সাঁকো পার হতে পারে? আমাদের সঙ্গে গরুর একমাত্র পার্থক্যটি অবগত হয়ে, আমরা একে একে সাঁকোর ওপারে গিয়ে হাজির হলাম।  

একটু এগিয়েই আমার দুই সঙ্গীর ভীষণ জল পিপাসা পেল। তারা আমায় একটু ঠান্ডা জলের ব্যবস্থা করতে বললো। তাদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, তারা যেন আমার জমিদারিতে অতিথি হিসাবে এসে উপস্থিত হয়েছে, এবং আমার                                                 
দায়িত্ব এই অতিথি নারায়ণদের সেবা করা। সামানেই একটা পাকা বাড়ি দেখে দরজায় টোকা দিলাম। এক ভদ্রমহিলা দরজা খুলতে আমরা খাবার জল চাইলাম। ভদ্রমহিলা ভিতর থেকে এক ঘটি জল ও একটা গ্লাশ নিয়ে এসে আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন আমরা কোথা থেকে আসছি এবং কার বাড়ি যাব। আমরা জল খেয়ে ঠান্ডা হয়ে জানালাম, আমরা এখানে কারো বাড়িতে আসি নি, আমরা গ্রাম দেখতে এসেছি।

বেশ খানিকটা পথ এঁকেবেঁকে ছোট ছোট বাড়ির পাশ দিয়ে গিয়ে, আমরা একটা খালের ধারে এসে পৌঁছলাম। খালের ওপর সমান্তরাল ভাবে দুটো রেল লাইনের মতো মোটা লোহার রড পাতা, তার ওপর রেল লাইনের কাঠের স্লীপার পাতা। পাকাপোক্ত ব্রীজ হলে কী হবে, ব্রীজের বেশ কয়েকটা স্লীপার কিন্তু চোখে পড়লো না। ব্রীজটার ঠিক আগে,  ডানদিকে খালটার একবারে পাশে একটা ছোট্ট মাঠের মতো জমি। তিন-চারটে বাচ্চা ছেলে সেখানে খেলা করছে। আমরা মাঠটার একপাশে গিয়ে বসলাম। আমাদের একজন সঙ্গীর বোধহয় গ্রাম্য পরিবেশ ও সুন্দর আবহাওয়ায়, হঠাৎ মুড়ি খাওয়ার ইচ্ছা জেগে উঠলো। কাছেপিঠে কোথাও কোন দোকানও চোখে পড়ে নি। অগত্যা বাচ্চাগুলোকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, সামনেই একটা দোকানে মুড়ি, চানাচুর পাওয়া যায়। পাশে তেলেভাজার দোকানও আছেএ তো মেঘ না চাইতেই জল। বাচ্চাগুলোকে একটু বলতেই, ওরা এনে দিতে রাজী হল। আমরাও মুড়ি, চানাচুর, বাদাম ভাজা ও চপের জন্য পয়সা দিয়ে, এবং তাদের লজেন্স ও বিস্কুট কিনে খাওয়ার পয়সা দিয়ে, শুকনো মাঠের মাঝখানে উঠে গিয়ে বসে, গুলতানি শুরু করলাম।

বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যা নামবে নামবে করছে, বাচ্চাগুলোর পাত্তা নেই। এমন সময় একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক একহাতে একটা জ্বলন্ত হারিকেন, অপর হাতে মাছ ধরার নাইলন জাল নিয়ে এসে হাজির হলেন। এখনও হারিকেন জ্বালার মতো অন্ধকার নামেনি। ভদ্রলোক ব্রীজের এপারে হারিকেনটা রেখে, জাল হাতে ব্রীজ পেরিয়ে খালের জলের কাছে নামলেন মাছ ধরতে। খালের এপারে আমরা, ঠিক ওপারেই ভদ্রলোক জল ও স্থলের সংযোগ স্থলে দাঁড়িয়ে খ্যাপলা জাল ছুড়ে মাছ ধরছেন। আমরা একবার জিজ্ঞাসা করলাম— “দাদা কী মাছ পেলেন? উত্তরে তিনি শুধু বললেন, মাছ কোথায়? সামান্য কিছু চিংড়ি পড়েছে। আমরা আবার নিজেরা গল্পে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ মনে হল ভদ্রলোক কিছু বলছেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে মনে হল তিনি ঝুঁকে পড়ে নিজের মনে কিছু বলতে বলতে, তাঁর পা থেকে জালটা খোলার চেষ্টা করছেন। হয়তো কোনভাবে তাঁর পায়ে জালটা জড়িয়ে গিয়ে থাকবে। আমরা আবার গল্পে মত্ত হলাম। কিন্তু ভদ্রলোকের কথায় এত য্ন্ত্রণা ও আর্তনাদের সুর কেন? তাঁর দিকে তাকিয়ে  তাঁর কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, তিনি ঝুঁকে পড়ে তাঁর হাঁটুর নীচে জালের দড়িটা বাঁধবার চেষ্টা করছেন ও তীব্র যন্ত্রণার সুরে একভাবে বলে যাচ্ছেন, ও মা গো, জাত সাপে কেটেছে গো। ও মা গো, জাত সাপে কেটেছে গোআমাদের আড্ডা দেওয়া মাথায় উঠলো, তাঁকে খালের এপারে চলে আসতে বলে খালের ব্রীজটার কাছে এগিয়ে গেলাম।

ভদ্রলোক জাল হাতে খোঁড়াতে খোঁড়াতে, কাতরাতে কাতরাতে, এপারে হারিকেনটার কাছে এসে বসে পড়লেন। যন্ত্রণা ও মৃত্যুভয়ে তিনি কাঁদতে শুরু করেছেন। তাঁর পায়ে এখনও জালের দড়ি বাঁধা, পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের পাশে সাপে কাটার দাগ, এবং ক্ষতস্থান থেকে খুব অল্প রক্ত বেরচ্ছে। শুনেছিলাম বিষাক্ত সাপে কামড়ালে ক্ষতস্থান থেকে যে রক্তপাত হয়, তা নাকি ছানা কাটা দুধের মতো হয়ে যায়। এই ভদ্রলোকের ক্ষতস্থান থেকে যে রক্তপাত হয়েছে, তা কিরকম ছানা কাটা মতো। হাঁটুর নীচে জালের নাইলন দড়িটা বাঁধা। ওখানে দড়ি বাঁধলে রক্ত চলাচলের কোন অসুবিধা হয় না, তার ওপর ভদ্রলোক যেরকম ঘাবড়ে গিয়ে লাফঝাঁপ করেছেন, তাতে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাও অনেক বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমি ঊরুতে পরপর তিনটে রুমাল শক্ত করে বেঁধে দিয়ে জালের দড়িটা খুলে দিলাম। কিন্তু তারপর? এবার কী করবো? াচ্চাগুলোও তো এখনও ফিরে আসে নি, অথচ ভদ্রলোকের বাড়িতে তো একটা খবর দেওয়া প্রয়োজন। ভদ্রলোককে তাঁর বাড়ি কোথায় জিজ্ঞাসা করলে ভয়ে না শারীরিক অসুস্থতায় জানিনা, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে  থাকছেন। এর মধ্যে একটু দুরে একজনকে দেখতে পেয়ে, চিৎকার করে তাকে ডেকে আনা হল। আগুন্তুক সাপে কাটা ভদ্রলোকটিকে দেখে চিনতে পারলেন। আমরা তাকে যত শীঘ্র সম্ভব এই ভদ্রলোকের বাড়িতে একটা খবর দিতে বললামলোকটি এতটুকু সময় নষ্ট না করে, ছুটে চলে গেলেন

অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সঙ্গে দুজন লোক নিয়ে ছুটতে ছুটতে যিনি এসে উপস্থিত হলেন, তাঁকে দেখে চিনতে পারলাম। হ্যাঁ, তিনি সেই ভদ্রমহিলা, যিনি আমাদের তৃষ্ণার জল দিয়ে পিপাসা মিটিয়ে ছিলেন। ভদ্রমহিলা এসে ভয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলেন। তাঁর কথায় জানতে পারলাম, উনি এই ভদ্রলোকের স্ত্রী। তাঁকে বললাম, ভদ্রলোককে যত শীঘ্র সম্ভব কোন হাসপাতালে নিয়ে যেতে, এবং হাসপাতালের ডাক্তারের নির্দেশ ছাড়া কারো কথায় পায়ের বাঁধন না খুলতে। সময় নষ্ট না করে, তাঁর সঙ্গী দুজন পাঁজাকোলা করে ভদ্রলোককে নিয়ে ছুটলেন। পিছন পিছন ভদ্রমহিলাও হারিকেন ও জালটা হাতে নিয়ে দৌড় শুরু করলেন।

আমরা ছোট মাঠটায় এসে বসতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, মাঠে অনেক গর্ত। সেগুলো গরু বাঁধার খুঁটির গর্ত, না সাপের গর্ত জানি না। আমরা গর্তের ওপর চটি পেতে বসে, আশপাশের গর্তের ওপর বাকী চটি চাপা দিয়ে দিলাম। অন্ধকার নেমে আসছে। এখানে থাকাও বিপজ্জনক। তাছাড়া অনেকটা পথ হেঁটে স্টেশনে যেতে হবে। কিন্তু বাচ্চাগুলোর জন্য চিন্তা হচ্ছে। ওরা এখনও ফেরে নি। ওরা না ফিরলে আমরা যেতেও পারছি না।

হঠাৎ একটা লোক এসে হাজির। তিনি এসেই বলতে শুরু করলেন—“সাপে কেটেছে তো? জাত সাপে কাটলে কেউ ওরকম চিৎকার করে? ও আর বাঁচবে বলে মনে করো না। ওর কী আর এ জগতে শত্রু নেই? সে তো জানতে পারলেই বাণ মারবে। সেই বাণের বিষ পিঁপড়েতে যদি খেয়ে নেয়, তাহলে ওঝার বাবারও ক্ষমতা নেই ওকে বাঁচায়লোকটা আরও কত কথা যে বলে গেলেন তার ইয়ত্তা নেই। বুঝলাম ইনি একটি কুসংস্কারের জাহাজ। কুসংস্কারসাগর বললেও ভুল বলা হবে না। ইতিমধ্যে বাচ্চাগুলো ঠোঙা হাতে ফিরে এসেছে। মুড়ি, তেলেভাজা খাবার ইচ্ছা আর নেই। বাচ্চাগুলোকে ওগুলো খেয়ে নিতে বলে, লোকটাকে বললাম, “আমরা এখানে নতুন, অন্ধকার নেমে এসেছে তাই আপনি যদি আমাদের একটু স্টেশনে পৌঁছে দেন, তাহলে খুব ভাল হয়। তিনি আমাদের স্টেশনে পৌঁছে দিতে রাজী হলেন।

আমরা তার সাথে যেদিক থেকে এসেছি সেদিকে না গিয়ে, একবার উল্টো দিক দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। একবারে সরু পায়ে হাঁটার পথ, দুপাশে ঝোপঝাড়। তাঁকে সামনে এগিয়ে দিয়ে, আমরা লাইন দিয়ে তার পিছন পিছন হাঁটছি। উদ্দেশ্য মহৎ, যা কিছু ঝড়ঝাপটা, তাঁর ওপর দিয়েই যাক। অতিরিক্ত সতর্কতা হিসাবে মার্চ-পাষ্ট করার মতো করে পা ঠুকে ঠুকে হাঁটছি। খুব অল্প সময়ের মধ্যে স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। এবার কিন্তু সাঁকোও পার হতে হল না, রেলের ঝিলও চোখে পড়লো নাআসলে আমরা যাবার সময় স্টেশনে নেমে, অর্ধবৃত্তাকারে চক্কর দিয়ে আবার স্টেশনে ফিরে এলাম।
স্টেশন প্ল্যাটফর্মে ঢুকে দেখি ঐ ভদ্রমহিলা ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন, সঙ্গে দুজন লোক। ভদ্রলোককে একটা স্ট্রেচারে শোয়ানো আছে। ক্ষতস্থানটা কিরকম নীলচে কালো রঙ হয়ে গোদের মতো ফুলে গেছে। আমাদের রুমালের বাঁধন খোলা হয় নি। আমরা ভদ্রমহিলাকে সান্তনা দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কোন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জানা গেল উলুবেড়িয়া হাসপাতাল। ট্রেন এসে গেলে তাঁরা চলে গেলেন। আমরাও উল্টো দিকের ট্রেনে ফিরে আসলাম।

পরদিন রবিবার। সোমবার অফিস গিয়ে সঙ্গীদের বললাম, আমাদের সামনে ঘটনাটা ঘটেছে, াজেই আমাদের একটা দায়িত্ব থেকেই যায়। ওরা বললো আমার বাড়ি থেকে যেহেতু ভদ্রলোকের বাড়ি খুব বেশী দুরত্ব নয়, তাই আমি অফিস থেকে দুপুরে বেড়িয়ে তাঁর বাড়ি গিয়ে যেন একটু খোঁজ নেই। আমি এ প্রস্তাবে রাজী হলাম না। কারণ ভদ্রলোক যদি মারা গিয়ে থাকেন, যা কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকের এলাকা দেখে আসলাম, বিশ্বাস নেই, আমরা ঐ গ্রামে গেলাম, তাঁর বাড়িতে কড়া নেড়ে জল খেয়ে আসলাম, আর আমাদের সামনেই ঘটনাটা ঘটলো। আমরা তাঁর সেবা করার নাম করে  বাণ মেরেছি বলে ধারণা হয়ে থাকলে যথেষ্ট বিপদের সম্ভাবনা আছে।

শেষ পর্যন্ত উলুবেড়িয়া হাসপাতালে ফোন করলাম। প্রথমে এক ভদ্রলোক ফোনটা ধরে কথা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা নামিয়ে রাখলেন। কিছুক্ষণ পরে আবার ফোন করতে এক ভদ্রমহিলা ধরলেন। আমি প্রথমেই বললাম, দয়া করে ফোনটা কাটবেন না, আমার একটা ব্যাপার জানার ছিল। তাঁকে মোটামুটি ভদ্রলোক কোথা থেকে গেছেন, কখন গেছেন ইত্যাদি বলার পর তিনি বললেন, পেশেন্টের নাম কী, কত নম্বর বেড? আমি সমস্ত ঘটনা জানিয়ে বললাম আমি কিছুই জানি না, তবে আমার একটা দায়িত্ব থেকেই যায়, তাই তিনি কেমন আছেন জানতে চাইছি। ভদ্রমহিলা আমাক ফোনটা ধরে থাকতে বললেন।

বেশ কিছুক্ষণ পরে তিনি জানালেন যে, ভদ্রলোককে অবজার্ভেশনে রাখা হয়েছিল। এখন চিকিৎসা চলছে তবে তিনি এখন সম্পূর্ণ বিপদ মুক্ত। কথাটা শুনে খুশী ও নিশ্চিন্ত হলেও, সাহস করে তাঁকে কিন্তু দেখতে যেতে পারি নি।