চশমা
চশমাটা
আমার। আর আমাকেই পরতে দেবে না!
না,
আমি কাঁদব না। একটাও শব্দ যেন আমার মুখ দিয়ে বের না হয়। এক ফোঁটা জলও যেন আমার চোখ
থেকে বের না হয়। দাঁতে দাঁত চেপে আমি পড়ার টেবিলে বসে আছি।
ভোর
হয় নি তেমন। পাখির ডাক কানে আসছিল। জানলা দিয়ে রোদ আসে নি। মনে হচ্ছিল মেঘলা আকাশ।
হুড়মুড় করে বাবা আমাকে বিছানা থেকে তুলে দিল। তুলে দিয়েই বলতে লাগল কেন ভোরে ওঠা
স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো, কেন আমাদের দেশের মুনিঋষিরা প্রাচীনকালে ভোরভোর উঠতেন,
উঠতেন সেই সময় যাকে ব্রাহ্মমুহূর্ত বলে। তারপর
সূর্যপ্রণাম করেই পাঠারম্ভ।
এই
পাঠারম্ভের ব্যাপারটাই বাবানের কাছে প্রধান। কাল রাতে আইপিএল তো দেখতেই দিল না।
একটা বিদঘুটে সাইক্লিক অরডারের অঙ্ক হাতে ধরিয়ে দিয়ে পুলিশের মতো সামনে দাঁড়িয়ে
রইল। পুলিশের মতো এইজন্যে বলছি যে, আমার যখন অঙ্ক করতে ইচ্ছে করে না আর বাবান ওই
লাভ-ক্ষতির কেনাবেচার জটিল কোনো অঙ্ক করতে দেয়, আমি তালে তালে থাকি, বাবান একটু
আড়ালে গেলেই আগে কোথাও কষা আছে দেখে টুকে দিই। বাবানও জানে ব্যাপারটা। তাই,
পুলিশের মতো, হাতে সময় থাকলে, দাঁড়িয়ে থাকে।
তো
সেই কাল রাতে অঙ্কটি করতে পারি নি। বাবান ছাড়ার পাত্র না। ভোরবেলাই সেই কারণে ঘুম
থেকে তুলে দিয়েছে। আমি জানতাম, এখুনি, নিজেই খাতা খুলে ওই অঙ্কটিই করতে দেবে। তা
দিক। ওইরকম বাবান করেই। ছেলেবেলা থেকেই। কিন্তু ঘুম ভাঙার আগে আমি একটা স্বপ্ন
দেখছিলাম। ঘুম ভাঙতেই কেমন এক গন্ধ আমার চারপাশে। কোনো ফুলের গন্ধ না। সেন্ট কি
পারফিউমের গন্ধ যেমন হয় তাও না। তবে আমি নিশ্চিত ওই গন্ধের সঙ্গে কিছু একটা আছে যা
আমার ভালো লাগে। স্বপ্নে যে আনন্দ ছিল বাবান তা চটকে দিল। এ কথা বাবানকে বলাও যায়
না। বললেই আরম্ভ করে দেবে, কি স্বপ্ন দেখেছিলে ভালো করে মনে কর। পুরোটা আমাকে বল,
যতটা মনে পড়ছে বল। স্বপ্নের পেছনে মনের সত্যি থাকে। এইসব।
বলা
যায় নাকি সব কিছু ? সবাইকে ? বড় হচ্ছি না ? আর আশ্চর্য, ছোট থেকে ‘বড় হতে হবে’ ‘বড়
হতে হবে’ শুনে আসছি। মনে নেই ? ‘দুধটা খেয়ে নাও, শরীরে শক্তি হবে কি করে ? বড় হতে
হবে না ?’ এইরকম কত কথা।
বড়
যে হচ্ছি আমার চেয়ে বেশি কে আর টের পাচ্ছে ? বড় হচ্ছি বলেই তো সাতসকালে চশমা নিয়ে
এই কাণ্ড। ডাকতার কাকু বলেছে ওই চশমা
সবসময় চোখে রাখতে। বাবানের বেজায় আপত্তি। জানে না কিছু না, বলবে, সবসময় চোখে চশমা,
তা আবার মাইনাস পাওয়ারের, চোখের নাকি আরো ক্ষতি হবে। আসল ব্যাপারটা খানিকটা বাবান
জানে আর আমিও জানি। আরে ভাই, আশ্চর্য সুন্দর ওই চশমা। ফ্রেমটি আমার ঠোঁটের মতো
গোলাপি। গ্লাস নয়, ফাইবার। মামা যেবার জাহাজ নিয়ে এল, (বছরে একবার আসে তো, খুব খরচ
করে, একেবারে দুহাত খুলে), বাবুবাজারে আমাকে একটা ঝাঁচকচকে চশমার দোকানে নিয়ে গিয়ে
বলল, বাছ নীলাই। যা তোর পছন্দ হবে কিনে দেব।
এমন
মামা সত্যিই হয় না। তার ওপর, সেবার নাইনে উঠেছি, আর অন্যদিকে, মামারও বিয়ের ঠিক
হয়ে গেছে। বাবানই, বলতে গেলে, ঘটক। তখন, বিশাল দোকান, আমি পড়লাম মুশকিলে। যেদিকে
তাকাই সেদিকেই চশমার ফ্রেম। আমি শাহরুখ, সলমান, এমনকি, ধনি কি দাদার (মানে, সৌরভ
গাঙ্গুলীর) চশমা খুঁজছি। আর বারবার চোখ চলে যাচ্ছে লেডিস চশমার দিকে। দোকানদারকাকু
একবার বলেই ফেলল, তোমাকে দেখতে যদিও খানিক খানিক মেয়েদের মতো, তবে তুমি তো গার্ল
নও, তুমি তো বয়। তুমি এই বাঁ দিকের ফ্রেমগুলোই দেখো। কি লজ্জা! কি লজ্জা! তখন, ওই
চশমা হল। দোকানদারকাকু মামাকে আরো একটা কথা বলল, কে আপনার ? ছেলে ?
মামা
বলল, ভাগনা, একমাত্র ভাগনা, নাইনে উঠেছে, চোখটা গেছে।
নাইনে
? মাথায় তো বেশ উঁচু। নাকটাও উঁচু কিন্তু।
আমি
জানতাম, আমার নাক একটু চাপা।
বাবান
সমানে বকেই চলেছে। অঙ্ক তো হচ্ছিল না। আমি একটু উঠে, পাশের ঘরে যেখানে ড্রেসিং
টেবিল, তার সামনে দাঁড়িয়েছি। বাবান ছাদের ফুলের টবে জল দেবে বলে তখন। চশমা খুলে,
ডান দিক দিয়ে একবার, একবার বাঁ দিক দিয়ে, আমার মুখ কেমন দেখাতে পারে, চশমা পরেও
সেভাবে, চশমাটি কপালের ওপর তুলে দিয়েও,
যদি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি তাহলে, যদি এমনভাবে তাকাই মনে হবে গভীরভাবে কিছু
ভাবছি, কিসে কেমন দেখায় ---- পরখ করছিলাম। সেই মুহূর্তেই বাবান। কখন ছাদ থেকে নেমে
এসেছে। বলল, চশমাটা দাও।
আমি
বললাম, কেন ?
দাও
বলছি না ?
কিন্তু
কেন ?
তুমি
আজ চশমা পরে স্কুলে যাবে না।
কেন
? আমি দূরের জিনিশ দেখতে পাই না। আমি ব্ল্যাক বোর্ড দেখতে পাই না।
ফাস্ট
বেনচে বসবে।
ফাস্ট
বেনচে ধীমান-দেবজিৎরা বসতে দেয় না।
দেবে
কেন ? তুমি তো আর
আমি
জানি, বাবানের কথার শেষটুকু হত (ওদের মতো টপার নও ...)। সে তো আমি কোনোদিনই নই।
আমি নিশ্চিত, হতেও পারব না। আর তাই আমার কোনো দুঃখও নেই। কিন্তু এসবের সাথে চশমা
না পরে স্কুলে যাবার কি সম্পর্ক বুঝতে পারছি না। আমি বললাম, না বাবান, চশমা পরে
যাব।
না।
আজ
আমাকে স্কুলে যেতে হবে। ফটো তোলা হবে। ক্লাশ টেনের সবাই, ছেলেমেয়ে সবাই, ফটো
তুলবে। যামিনী বলেছে আমার সাথে আলাদা করে ফটো তুলবে --- ওর আর আমার। সেঁজুতি ক্লিক
করবে। যামিনী বলেছে তিন-চারটে ফটো তুলবে আমার সাথে। আমার এই চশমাটি ওর খুব পছন্দ।
একবার, যেন কেউ দেখতে না পায় সেভাবেই, এই চশমাটি ঠোঁটের কাছে নিয়েছিল। আমি দেখে
ফেলেছি। তবে চুমু খেয়েছিল কিনা বুঝতে পারি নি। কারণ, কোনো শব্দই হয় নি।
বাবান
গায়ে হাত দেয় না ঠিকই, কিন্তু এমন জিদ করে আমার কান্না পেয়ে যায়। এইসব সময়, মাকেও
বলে দেখেছি, মাও কিছু করতে পারে না। শেষ অব্দি বাবানের কথাই শুনতে হয়। কাঁদলেও শোনে
না। আর এখন আমি বড় হয়ে যাচ্ছি না ? কাঁদলে, কান্নার শব্দ পেলেই, টুটান দরজা ঠেলে
ঢুকে পড়ে। টুটান আমার খুড়তুতো ভাই। ক্লাস
থ্রি বললেই সবাই বুঝতে পারবে কত বয়েস, তবে কেমন যেন অস্বাভাবিক পাকা। বলবে, কাঁদিস
না, দাদান, জেঠুর কথা শুনে নে। বড়দের কথা শুনতে হয়। পিত্তি জ্বলে যায়।
স্টাইল
হচ্ছে! বাবান আবার বলল।
স্টাইল!
জন্মদিনে একটা ক্যামেরামোবাইল কিনে দিতে বললাম। কত করে বললাম। ক্লাসের কত ছেলে
নিয়ে আসে। প্রিতম আনন্দের তো আবার ইনটারনেট আছে। তা কিছুতেই দিল না। বলল,
ইনজিনিয়ারিঙে চান্স পাও, তখন দেখা যাবে।
বললাম,
বাবান! আজকের দিনটা চশমাটি পরে যেতে দাও। কাকুতির মতো করেই বললাম।
না।
বাবানের গলার স্বর আরও গম্ভীর।
এই
অঙ্কটা যদি নামিয়ে দিতে পারি ?
না।
আমি
আর সামলাতে পারলাম না। বুকের মধ্যে থেকে কি একটা উথলে উঠতে চাইছে। বাবান এত
নিষ্ঠুর কেন ? সম্বিতদার কথা মনে এল হঠাৎ । সম্বিতদার বাড়ি পরের রাস্তায়।
ইনজিনিয়ারিঙ পাশ করেছে তিন বছর হল। চাকরি পায় নি। হোমিওপ্যাথি দোকান আছে সম্বিতদার
বাবার। সন্ধেবেলা সেখানেই বসে। সম্বিতদার
বাবাও খুব রাগী। এত রাগী যে খদ্দেররা নাকি ওদের দোকানে যেতে চায় না। সম্বিতদা বলে
হিটলার, নিজের বাবাকে।
বাবানকে
আমি হিটলার বলতে পারব না। বাবান খুব ভালোও। কাল রাতে যদি আইপিএল না থাকত, আর যদি
সাইক্লিক অরডারটি ঠিকঠাক নেমে যেত, তাহলে হয়ত আজ আমার চশমাবিভ্রাট হতই না। ব্যস।
আমি আর কিছুতেই সামলাতে পারলাম না। বাচ্চা ছেলের মতো কেঁদেই ফেললাম। দরজার দিকে
একবার চোখ গেল। দরজাটা খোলাই। বাবান তখনও বলছে, যতই কাঁদো, চশমা ছাড়াই আজ তোমাকে
স্কুলে যেতে হবে।
তখুনি
মোবাইল ফোনটি রিঙটোন শোনাল, এ পথে আমি যে গেছি বারবার। বাবানের পছন্দের রিঙটোন।
কতদিন বলেছি, রিঙটোনটা বদলাও। একটা ভালো হিন্দি গান নাও, শান কিংবা রহমানের। বাবান
ধমক দিতে ওস্তাদ, মোবাইল কে ইউস করে ?
আমি। আমার চয়েসে নাক গলিও না। সত্যিই তো। কতদিন বলেছি। মা শিখতেই চাইল না। তাহলে
আর এই সন্যিসীমারকা রিঙটোন শুনতে হত না।
বাবান
ইস্তিরি করছিল। বলল, নীলাই, ধরো।
আমি
কাঁদতে কাঁদতেই বললাম, অঙ্ক করছি।
বাবান
ঘাটাল না। ইস্তিরি রেখে মোবাইল তুলে নিল, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, (এই নিন, নাতির
সাথে কথা বলুন) বলেই আমার হাতে ফোনটি ধরিয়ে দিল।
চালাক
বলে চালাক! ভাবল, দাদুর সাথে কথা বলতে গেলেই আমার কান্না থেমে যাবে। আমিও জোরে
কেঁদে উঠলুম। ওপ্রান্ত থেকে দাদু অস্থির হয়ে উঠল, কি হল, দাদুভাই ?
আমি
আরও জোরে কাঁদছি তখন। স্পিকার অন করে দিলাম। এবার তো দাদুর গলা বাবানও শুনতে পাবে।
ঠিক। দাদুর গলা, কি হল, দাদুভাই ? সকালবেলাই দাদুভাইকে কাঁদাচ্ছে। সুভাষকে নিয়ে আর
পারা যায় না। এই নে, গোপা, দেখ তো। দুদিনের জন্যে এলি, তাও কত দিন পরে ...
দাদু
থামবে না। থামবে না যতক্ষণ গোপা, মানে আমার মা, মোবাইলটা হাত থেকে না নেয়। দাদুর
মাথাটা গোল, আর পুরোটাই টাক। আমি একবার বলেছিলাম, বিশাল একটা মারবেল। মারবেলের কথা
হঠাৎ মনে এল কেন এখন আবার! সত্তর বছর বয়েস হবে। একটাই মেয়ে। তাই মাঝেমধ্যে মেয়েকে
নিজের কাছে নিয়ে যাওয়া চাই। তার
জামাই, মানে শ্রীযুক্ত সুভাষচন্দ্র দাস,
মানে আমার বাবান, কোনোদিন আপত্তি করে নি। বাবানের কি ? কাকিমা-ই তো খাওয়ার
ব্যবস্থা করে দেয়। খাওয়ার ব্যবস্থা অবশ্য নিচের তলায়। মা জানিয়ে দিল, সামনের শনিবার, আসতে পারে।
দিন
চারেক আগে মামা এসে মাকে নিয়ে গেছে। তাতে একটা লাভ হয়েছিল এই যে যামিনী রোজ ফোন
করতে পারত। ফোনে ওর গলা কেমন ঘ্যাসঘ্যাসে লাগে। মা থাকলে আমি বারণ করে দি। মা
একবার আমাকে ধরেছিল, কে রে মেয়েটা ? তুই চুল কাটবি কি না, সেকথা ও বলার কে ?
যামিনীও
পারে। আমার আগেই মা সেদিন ফোনটা ধরেছিল আর যামিনী বলছিল, তোর মাথার চুল বড় হয়ে
গেছে। ছেঁটে নিস রোববার।
কিন্তু
আমার নাটক জমল না। কান্না থামল নিজের থেকেই। বাবানের দাড়ি কামানো হয়ে গেছে। অঙ্কটি
এরই মধ্যে, কেমন করে কে জানে, মিলে গেল। বাবান শুনল। দেখল খাতাটা, তবে তো পারো না
এমন নয়।
চশমার
কথা আর একবার বলব ভাবছি, কি জানি আমার মুখের দিকে তাকালেই বাবান অনেক কিছু
মুহূর্তেই বুঝে নেয় (ভাগ্যিস, সব কিছুই বুঝতে পারে না), গম্ভীরভাবে বলে উঠল,
লাইব্রেরি নিয়ে দশটা সেনটেন্স লিখে দাও। আমি স্নান সেরে আসছি। দেখো, কায়দা করবে
না। ভুলভাল যেন না হয়। যেটা জানো না, লিখতে যাবে না।
বলেই
চলে গেল। এইসময় আমি খবরের কাগজে চোখ বোলাই। বাবানের স্নানপুজো সারতে আধ ঘণ্টা
চল্লিশ মিনিট লাগে। কাগজ থাকে কাকুর পড়ার টেবিলে। কাকু বাংলার মাসটার, ইংরেজি কাগজ
পড়ে। আমি ভালো বুঝতে পারি না। তবে খেলার পাতা আর বিজ্ঞাপনগুলো খুব টানে।
লাইব্রেরি
? যামিনীর সাথে স্কুলের লাইব্রেরিতেই তো, আলাপ নয়, ভাব হয়েছিল, প্রথমবার। যামিনীর
মা গল্পের বইএর পোকা। মার জন্যে বই নিতে এসেছিল। দেবু দত্ত, ইতিহাসের স্যার, আমাকে
শিব্রাম চক্রবর্তীর কোনো বই আছে কিনা খোঁজ নেয়ার জন্যে পাঠিয়েছিলেন। তখনই, মানে
সেদিনই, মানে আমাদের টিফিন পিরিয়ডে, লাইব্রেরির পাখা খারাপ হয়ে যাওয়ায় বেশ গরম
লাগছিল। চশমা খুলে আমি একটা টেবিলে
রেখেছিলাম।
যামিনী
বলল, চশমা খুললি কেন ? তোর চশমার ডিজাইনটা খুব সুন্দর, আর তোর মুখে মানিয়েছেও
ব্যাপক।
আমি
একটু সপ্রতিভ হবার চেষ্টা করছিলাম, যামিনী বলতে থাকল, তোর নাকটা স্লাইট ফ্ল্যাট,
কিন্তু ঠোঁটদুটো স্লাইট হেভি। তাই ক্লাস টেনেও তোকে বেশ কিউট লাগে।
আশ্চর্য,
রহস্যময় গন্ধ একটা ছড়িয়ে পড়ছে। বাতাসই হয়ত বয়ে এনেছে। কিংবা ছিল হয়ত আমার মধ্যেই
কোথাও। কিন্তু যামিনী যা বলছিল ভালোই লাগছিল শুনতে। দেখলাম, যামিনীর হাতে
প্লাসটিকের চুড়ি, চওড়া আর হলুদ রঙের, কানে ছোট ছোট রিং, গলায় কিছু নেই। চোখদুটো
শুভশ্রীর মতোই মিস্টি মিস্টি, তবে যখন সে হাসে কোয়েলের সাথে কোথাও মিল চোখে পড়ে।
গায়ের রঙ পাওলি দামের মতোই চাপা। যামিনী এভাবে কখনো কথা বলে নি। আমরা জানতাম, ভালো
ইংরেজি জানে বলে ওর খানিক ফুটুনি আছে। ইংরেজিতে
কথা বলতেও পারে। রবিঠাকুরের জন্মদিনে টানা পাঁচ মিনিট ইংরেজিতেই বলেছে। এহচ এস
স্কুলের ক্লাস টেন।
যামিনী
সেখানেই থামে নি। আমার দিকে একটুখানি এগিয়ে এসে কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে বলেছিল, ওয়ান
ওয়ার্ড মোর আমি বলতে পারি, ইফ আয়াম টু ডেসক্রাইব ইউ। বলেই থেমেছে, না থাক, ইউ লুক,
না থাক, ওয়ার্ড, ফোর লেটারড ওয়ার্ড, না থাক, বিগিনস উইথ এস।
লাইব্রেরির
প্যারাগ্রাফ কি আর গল্প হলেও সত্যি এইসব দিয়ে আরম্ভ করা যাবে ? বাবান আমার পিঠের
ছাল ছাড়িয়ে নেবে তাহলে। যা হোক, যে করেই হোক বাবানকে যাতে প্রসন্ন করা যাক, এমন
কিছুই বোধ হয় মনে মধ্যে ছিল, কারণ প্যারাগ্রাফ তাকে হয়ত খুশিই করেছে, দুটো একটা
শিলি মিসটেক লাল কালি দিয়ে মারকিং করে দিয়ে বলল, যাও, স্নান করে এসো। ভালো করে
সাবান দিয়ে স্নান করবে। তোমার পাশে যে বসবে তার যেন মনে না হয় যে তোমার গা থেকে
গন্ধ বের হচ্ছে।
সব
শুনতে রাজি আছি, বাবান। চশমাটা দাও। ঠিক আছে, একদিনের জন্যেই দাও। কাল থেকে না হয়
---
না।
আবার সেই গম্ভীর গলা। আর আগের চেয়ে জোরেও। তারপরই জিগগেস করল, আমার সঙ্গে
যাবে, না বাসে যাবে ?
এর
পরে কথা বলার ইচ্ছে কারো থাকে ? বললাম, আমি নিজেই যাব।
অফিস
যেতে বাবান প্রায়ই দেরি করে ফেলে। এই কথাটাও আমার মাথায় ছিল। কিছুদিন আগেও, বাবান
অফিস যেত যখন ইচ্ছে। তখন কি একটা কমিটির সদস্য ছিল। ওই কমিটির সদস্য হলেই সাত খুন
মাফ হয়ে যেত। এখন খুব কড়াকড়ি চলছে। বাবান বলে, এ কিছু দিনের জন্যে। এমন মাঝেমধ্যে
হয়। আবার আগে যেমন ছিল, হয়ে যাবে। নীলাই মাধ্যমিক দেবে। ব্যবস্থা একটা আমাকে করতেই
হবে। ওর দিক থেকে চোখ সরানো যাবে না।
স্কুলে
যাবার পথেই সম্বিতদাদের বাড়ি। সম্বিতদা বেলা দশটায় বাইরের বারান্দায় চায়ের কাপ
হাতে। বেশ গাবদাগোবদা চেহারা হয়েছে। খায় দায় ঘুমোয়। কাজকর্ম নেই। তবে গণিত জানে
তুখোড়। গণিতের সঙ্গে আমার আবার বনিবনা ভালো না। মাসটার একজন আছে। মানে টিউশন।
সপ্তাহে দুদিন। সায়েন্স গ্রুপ। গোয়ালই বলা যায়। তা তিনিও মাঝসাঝে খাবি খান। তখন ওই
সম্বিতদাই ভরসা। কিন্তু ইদানীঙ সম্বিতদাকে নিয়ে আমার একটা সমস্যা হচ্ছে। দেখা হলে
খুব সচ্ছন্দবোধ করছি না। তাই বারান্দায় দেখতে পেয়েই কেটে পড়তে চাইছিলাম।
সম্বিতদাই
ডাকল, শোন তো।
বললাম,
বাস ছেড়ে দেবে।
শোন
না একবার।
সামনে
গিয়ে দাঁড়াতেই প্রথমে বলল, ব্যাগের মধ্যে কি ঠেলেছিস রে! দেখে তো মনে হচ্ছে হসটেলে
যাচ্ছিস।
তারপরই
গলার স্বর হঠাৎ নিচে নেমে গেল, স্কুল থেকে ফিরে একবার আসবি।
কথাটি
শেষ হতেই আমি সেই গন্ধটি পেলাম। সম্বিতদার ঘরে আমি আগেও পেয়েছি। বললাম, আচ্ছা।
বার
তিনেক হয়েছে। একবার জ্যামিতির একটা এক্সট্রা নিয়ে গেছি। পরের দুবার নিজেই ডেকে
পাঠিয়েছে। আমাকে সোজা নিয়ে গেছে দোতলায়, নিজের ঘরে। প্রথমে, দুহাত ধরে সামনে,
একেবারে মুখোমুখি, দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমার চেয়ে মাথায় একটু উঁচু তো, আমার মাথার
চুলে নাক ঠেকিয়ে নিশ্বাস নিয়েছে। তারপর বলেছে, চশমাটা খোল। খোল, রাখ না ওই বিছানার
ওপর।
আমি
চশমাটা চোখ থেকে সরিয়ে বিছানার ওপর রাখতেই বলেছে, আমার দিকে চা, চেয়ে থাক। কত বড়
হলি দেখি।
আমার
মনে হচ্ছিল, বাড়ি চলে যাই। কিন্তু সম্বিতদা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই, দুহাত দিয়ে আমার
মুখটা তুলে ধরে আমার দুটো চোখে বারবার চুমু খেয়েছে। এই সময় তার ঘন ঘন নিশ্বাস
পড়ছিল। আমার কি খারাপ লাগছিল ? আমার কি ভালো লাগছিল ? কিন্তু কেমন যেন লাগছিল। আর
ব্যাপারটি আমি কাউকেই বলি নি।
বড়
হওয়ার কথা, স্কুলেও, ক্লাস টিচারের কাছ থেকে শুনতে হয়েছে, তুমি বেশ লম্বা নীলাই।
সেকেন্ড বেনচে যদি বসতে হয়, একেবারে কোণের দিকে বসবে। নাহলে তোমার পেছনের
স্টুডেন্টদের ব্ল্যাক বোর্ড দেখতে অসুবিধে হবে। তখন একটা সুবিধে এই হল যে দেয়ালে
পিঠ ঠেকিয়ে পেছনে খানিকটা দেখতে পারছি।
প্রিয়ঙ্কা, সেঁজুতিরা পাশের বেনচগুলোয় বসে। আমি যামিনীকে দেখতে পারতাম।
কিন্তু
যতদূর মনে পড়ছে, বড় হচ্ছি প্রথম শুনেছি মার মুখ থেকেই। তখন আমার ক্লাস সিক্স কি সেভেন। বাথরুমে
শাওয়ারের জল মাথায় ঢেলেই তোয়ালে হাতে সোজা শোয়ার ঘরে ছুটে যেতাম। সে একদিন খুব
ঠান্ডা পড়েছে। মাথায় জল ঢেলেই রোদের খোঁজ। মা বলল, দাঁড়া তো। ভালো করে দেখল আমাকে।
কি দেখল বুঝি নি। তারপর বলল, বড় হচ্ছ। স্নানের পর বাথরুম থেকে বেরনোর আগে তোয়ালে
জড়িয়ে নেবে। ন্যাংটো হয়ে বেরবে না।
পিকলু
আমার জন্যে সিট রাখে। ওকে আগের স্টপেজে, জোড়ামন্দিরে, উঠতে হয়। পাশে বসতেই জিগগেস
করল, তোর চশমা ?
আনি
নি।
কেন
? আজ তো ফটো তোলা হবে।
জানি।
সবচেয়ে
সুন্দর ফটো কার হবে বল তো ?
কার
?
যামিনীর।
ওকে যা দেখতে না --- ফাটাফাটি।
আমার
চেয়ে সুন্দর ?
তুই
তো ছেলে।
না।
ওকে কি আমার চেয়ে সুন্দর দেখতে ? তুই এই কোশচেনটার আনসার দে।
তোর
চেয়ে প্রিতম আনন্দ কিন্তু লম্বা। ফরসাও।
এবার
আমি আর কিছু বলব না বলে ঠিক করে নি। কিন্তু পিকলু আবার বলে, ওর নাম কোনটা রে ?
প্রিতম না আনন্দ ? দুটোই তো নাম মনে হয়।
আনন্দ
ওদের টাইটেল। ওরা পানজবি। চুলকাটা পানজাবি। বাবুবাজারে হিরো বাইকের একটা শোরুম আছে
দেখেছিস ? ওটা ওদের।
ঘ্যাম
পয়সা বল ?
পয়সা
? ওরা হেভি রিচ।
পিকলু
একটু সময় চুপ করে থাকে। আমার মন এমনিতেই বিগড়ে আছে। চশমা ছাড়া ফটো উটবে। বেকার।
বাবানের জন্যেই।
পিকলু
চুপ করে থাকতে পারে না। ক্লাসেও। টিচারদের ধমক খায়। মারও খায়। মুখ খোলে আবার, প্রিতম
তোকে দেখিয়েছিল ?
কি
?
জিগগেস
করলাম ঠিকই, কিন্তু আমি জানতাম পিকলু কি বলতে চাইছিল।
কিন্তু
পিকলুই প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল। কারণ, রাখো মা কালী স্টপেজে একজন বুড়ো মানুষ বাসে
উঠেছে যার মাথায় যদিও চুল নেই পেল্লাই গোঁফ রয়েছে দুই গাল জুড়ে। পিকলু তাই দেখে,
তার দিকে তাকিয়েই, প্রায় শব্দ করে হেসে উঠছিল আর কি। আমি বললাম, হাসিস না, পিকলু।
তুই
দেখছি বড়দের মতো কথা বলছিস, বলেই পিকলু আমার গলায় ফু দিয়ে দিল।
লোকটিকে
দেখে আমার দাদুর কথা মনে পড়ল। দাদুর মাথাও ফাঁকা, তবে বড় হওয়া বলতে দাদু অন্যরকম
বোঝে। বলে, তোমার চোখ হল সবচাইতে বড় ব্যাপার --- মানে, তুমি কি দেখতে পাচ্ছ, কতদূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছ, যত বয়েস হবে ততই
বাড়বে তোমার দেখার ক্ষমতা, যা যা তুমি দেখবে বা তোমার দৃষ্টির আওতায় আসবে তোমাকে
দেখতে হবে তার কোনটি ভালো আর কোনটি তোমার পক্ষে হানিকর, কি তোমাকে আনন্দ দিতে
পারে, কি তোমার দুঃখের কারণ হবে। অবশ্য, দাদু এইভাবেই বলে নি কখনো, তবে তার কথা
সাজিয়ে নিলে এইরকমই দাঁড়াবে।
পিকলু
আবার কনুই দিয়ে গুঁতোল, বল না, দেখিয়েছিল ?
আমি
আবার বললাম, কি ?
পিকলু
ব্যাগটা সরিয়ে, হঠাৎই দুই আঙুলে আমার প্যান্টের ওপরে শুঙ্কুটা টিপে ধরল, এইসব।
আমি
রীতিমতো চমকে উঠলাম। আমাদের ক্লাসে দু-একটা ছেলে এইরকম করে জানি। পেছনের বেনচেই
বসে তারা। শুনেছি, আরো অনেক কিছুই করে। কিন্তু পিকলু তো সামনের দিকে বসে। আর এইসব
নিয়ে আমাকে ও আগে কোনোদিন কিছুই বলে নি। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ভেবেই পাচ্ছে
না আমি চমকে উঠলাম কেন। বললাম, মোবাইল ফোনে ওইসব ক্লিপিংসের কথা বলছিস ?
পিকলু
বলল, হ্যাঁ। পুরোটা দেখিয়েছিল ?
না,
একটুখানি দেখেছিলাম, তারপরে স্যার ক্লাসে চলে এসেছিল।
কতদূর
দেখেছিলি ? জামাপ্যান্ট খুলে ফেলেছিল ?
হ্যাঁ।
তারপর
?
তারপরই
তো স্যার ক্লাসে চলে এল।
খুব
ফরসা বল ?
স্কুলে
ঢুকতেই সবাই আমাকে ছেঁকে ধরল, জিগগেস করতে লাগল সে কেন চশমা পরে আসে নি। যামিনীকে
দেখতে পেলাম না। কেউ একজন বলল, আগেই ফটো তোলা হবে। দেবজিৎ বলল, আজ যামিনীর ঝাড়
হচ্ছে।
কেন
? ওর দিকে না তাকিয়েই বললাম।
যা
সেজে এসেছে না, মনে হচ্ছে পারলার থেকে এসেছে।
সেজে
এসেছে তো কি হয়েছে ? ফটো তোলা হবে ---
নীলাই,
কথা বলিস না। চশমাই পরে আসিস নি।
হেডমাসটারের
রুমের কাছে একটা ছোট ভিড়।
ধীমান
বলল, দুপক্ষেরই বাড়াবাড়ি।
কি
হয়েছে ?
ধীমান
কোনো উত্তর দিল না। ভালো ছাত্রদের এই এক সমস্যা, আমার মতো কাউকে, মানে যারা আর কি
পরীক্ষায় বেশি নমবর পায় না তাদের, হিশেবের মধ্যেই ধরে না। সামনেই ছিল আদৃতা, বলল,
যামিনী যেরম সেজেছে, তেমনি হেড স্যারও হেভি দিয়েছে।
আমি
আর পারলাম না, বললাম, তুইও তো খুব সাজগোজ করেছিস। তাতে অসুবিধে কোথায় ?
তখুনি
কোত্থেকে সেঁজুতি ছুটে এল। হাতে একটা ক্যামেরা। দামিই হবে। বলল, কে কে ফটো তুলবি
দাঁড়িয়ে পড়। ধীমানরা সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল, ঝাউগাছটাকে পেছনে রেখে।
রেডি
? স্মাইল! ওয়ান ট্বু থ্রি, একটু জড়াজড়ি করে দাঁড়া। ফাইন।
দেবজিৎ
বলল, ডিজিটাল ক্যামেরা ? ডিজিটাল ?
সেঁজুতি
আমার হাত ধরে টান দিল, আমার সঙ্গে আয়, পেছন পেছন।
একটু
এগিয়েই গেল ও। প্রায় ছুটেই। পিকলু, ক্লাস টেনের ক্লাসরুম থেকেই দেখতে পেয়ে,
চেঁচিয়ে উঠল, সেঁজুতি, কোথায় যাচ্ছিস ?
সেঁজুতি
কোনো জবাব দিল না।
স্কুলের
দালান চার দিক দিয়েই একরকম ঘেরা। পশ্চিমেই একটা বড় দরজা। দক্ষিণ দিকে সাত আটটা গাছ
কিভাবে আর কতদিন ধরে মাথায় বেড়েছে, ডালপালা ছড়িয়েছে, কেউ তার খবর রাখে না। তার
মধ্যেই, একজোড়া মহুয়া গাছ পাশাপাশি। একটু দূরে বেশ উঁচু পাকুড়। আরও চার পাঁচটা গাছ
ছায়া ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, কি তাদের নাম
আমার জানা নেই। সেখানেই যামিনী একা একা।
আসামান্য সেজেছে সে। কোথায় লাগে শুভশ্রী কি কোয়েল!
যামিনী
লক্ষ করল আমার চোখে চশমা নেই। কিছু বলল না। সেঁজুতি বলল, চটপট কর। ঘাম মুছে নে। নে
দাঁড়া। ক্লোজ হ রে বাবা! আরও। ধুর! তোদের
দ্বারা কিচ্ছু হবে না। দেরি করিস না।
সেঁজুতি
পরপর পাঁচ-ছটা ফটো তুলে নিল, বলল, একসাথে যাবি না কিন্তু। ঝাড় হবে। আমাকে আগে
কাটতে দে।
সেঁজুতি
চলে গেল। আমার ঠোঁটের কাছে এল, ভোরবেলা আমি তোর স্বপ্ন দেখেছি। যা দেখেছি আবছাআবছা
মনে আছে। তবে তা মুখ ফুটে বলতে পারব না।
আমি
কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না। আশ্চর্য! পরিচিত গন্ধটা কোথা থেকে যে আসছে।
এদিকে
আয়, যামিনী ডাকল। পাকুড় গাছের পেছনটায়। তারপর আমাকে আর একটুও সময় না দিয়ে নিজের
ঠোঁটদুটো নিয়ে এল আমার ঠোঁটের কাছে।