গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।
রবিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০১৬
সুবীর কুমার রায়
এক্সপ্রেস ট্রেনটা প্রবল গতিতে
ছুটে চলেছে। দুটি লোয়ার, একটি মিডল্ ও একটি আপার বার্থ নিয়ে একই কিউবিকল্-এ সংরক্ষিত আসন দখল করে, চার জন পূণ্যার্থী যুবক নিজেদের মধ্যে উচ্চৈঃস্বরে গল্পে ব্যস্ত। বড় লোকের সন্তান, সম্ভবত চার বন্ধু। তাদের কথাবার্তা থেকেই জানা যায় যে তাদের পরিবারের সাথে অনেক রাজনৈতিক
নেতা, এমনকী কিছু এম.এল.এ. বা এম.পি. ও পরিচিত। এদের মুখের ভাষায় কোন লাগাম নেই,
এদের
প্রতিটি বাক্যই বিশ শতাংশ অভিধান বহির্ভুত শব্দের
বিশেষণে অলঙ্কৃত। অপর দু’টি মিডল্ ও আপার বার্থ একজন অশীতিপর বৃদ্ধ ও তাঁর পঁচাত্তর
বছরের বৃদ্ধা স্ত্রীর। দুজনেরই হৃদয়টি উদার হলেও, হৃদযন্ত্রটি মাঝেমাঝেই শারীরিক
নিয়ন্ত্রন হারিয়ে তাঁদের অসুবিধা ও অসুস্থতার কারণ হয়ে
দাঁড়ায়।
প্রথম আলাপেই তাঁরা যারপরনাই
মুগ্ধ, ভীত ও আতঙ্কিত। বৃদ্ধটি একটু
বিনয়ের সাথেই ওদের একজনকে অনুরোধ করেন যে তাঁরা অত্যন্ত অসুস্থ,
বয়েসও অনেক
হয়েছে, তাই তারা যদি তাদের নীচের বার্থ দুটো
রাতে ওনাদের দু’জনকে ছেড়ে দেন, তাহলে ওনাদের খুব সুবিধা হয়। কথা শেষ
হওয়ার সাথে সাথে বড় বড় চুল, কানে দুল পরা যুবকটি মুখ বিকৃত করে বলে ওঠে “উম্ উম্ উম্, দাদুর আজ দিদিমাকে পাশে নিয়ে শোয়ার সাধ হয়েছে রে।
কিন্তু দুটো সিঙ্গল বার্থ নিয়ে তো তোমার
কিছু লাভ হবে না দাদুভাই, তুমি বরং টি.টি.ই. কে ডেকে একটা ডবল্ বেড বার্থের ব্যবস্থা করে দিতে
বলো”।
রাগে লজ্জায় বৃদ্ধের মুখ লাল
হয়ে উঠলো, বৃদ্ধা লজ্জায় শাড়ির আঁচলে মুখ ঢাকলেন। বাকি তিনজন যুবক উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলে প্রথম যুবকটি বললো “দ্যাখ, দ্যাখ, দাদু লজ্জা
পাচ্ছে। আরে দাদু তোমার মতো বয়স আমাদেরও তো একদিন ছিলো না কী”? বাকি তিন যুবক এরকম একটি রসালো রসিকতায় একে অপরের
গায়ে হেসে গড়িয়ে পড়লো। আশপাশের কোন যাত্রীকে কিন্তু প্রতিবাদ করতে দেখা গেল না,
বরং তাদের
মুচকি মুচকি হাসি বুঝিয়ে দিল, যে তারা এই
জাতীয় রসিকতা খুব উপভোগ করছে।
বেশ রাতের দিকে গাড়ি থামলে,
পাশের সাইড লোয়ার বার্থে একটি যুবতী এসে তার জায়গা দখল করে শোয়ার
আয়োজন করতেই, সেই প্রথম যুবকটি আবার শুরু
করলো “কি দিদি এত রাতে আর কষ্ট করে কি হবে,
তুমি বরং আমার পাশে চলে এস, ভাগাভাগি করে পাশাপাশি শুয়ে রাতটা
কাটিয়ে দেই। মাইরি বলছি, আমাকে তোমার খারাপ লাগবে না”। যুবকটি এবার বেশ জোরেই গান ধরলো— হাম তুম এক কামরা মে বন্দি হো,
আউর চাবি
খো যায়। অপর একজন মুখের ভিতর দুটি আঙুল পুরে
অদ্ভুত দক্ষতায় তীব্র একটা শিস দিয়ে দিল।
রাতদুপুরের চিৎকারে অনেকেরই ঘুম
ভেঙ্গে গেল। দু-চারজন পুরুষ তাদের নিজ নিজ বার্থ থেকেই বিরক্তি
প্রকাশ করলে সঙ্গের মেয়েরা বললো এটা ওদের ব্যক্তিগত
ব্যাপার, তাই ঝামেলায় না জড়িয়ে তাদের চুপ করে থাকাই উচিৎ। গভীর রাতে এরকম একটা অবস্থায় যুবতীটিকে সাহায্য করার
লোক খুঁজে না পাওয়া গেলেও, চরিত্র নিয়ে সমালোচনা করার লোকের
অভাব হ’ল না। ফলে এত রাতে মেয়েটার একা
আসা উচিৎ হয় নি, হাত কাটা ব্লাউজ পরা উচিৎ হয় নি, মুখে ঠোঁটে এত রঙ মাখলে এই অবস্থাই হয়, ইত্যাদি নানা আলোচনার ঝড় বয়ে গেল।
হয়তো কোনরকম
প্রতিবাদ না হওয়ায়, যুবকদের মেয়েটিকে
বিব্রত করার উৎসাহ আরও বৃদ্ধি পেল। একটি যুবক উঠে গিয়ে তার হাত ধরে জোর করে
টেনে এনে তাদের পাশে বসাবার চেষ্টা করলো। মেয়েটির অনুনয় বিনয়, সাহায্য প্রার্থনা, প্রতিবাদ, কোনটাই যখন কোন কাজে লাগলো না, তখন সে আত্মরক্ষার্থে
ছেলেটির গালে একটা বিরাশি সিক্কার চড় কষিয়ে
দিয়ে তার হাতে এক মরণ কামড় বসিয়ে দিল। আহত যুবকটি ভ্যাবাচাকা খেয়ে নিজের ক্ষতস্থান
চেপে ধরে বসে পড়লো।
এ হেন গর্হিত কাজ যে একজন
মহিলার পক্ষে অত্যন্ত অনুচিৎ কাজ, এবং সে নিজে ঐ যুবকটির জায়গায় থাকলে
কি করতো, এই আলোচনায় যখন ট্রেনের কামরা উত্তপ্ত হয়ে উঠলো,
তখন আহত
যুবকটি লজ্জার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে
বন্ধুদের নিয়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। নিজেকে কোনমতে তাদের হাত থেকে মুক্ত করে,
ফুল্লরা
মাসির কাছ থেকে শেখা শেষ অস্ত্রটি সে প্রয়োগ করলো। মেয়েটি তার পরনের শাড়িটি
কোমরের ওপর তুলে ধরলো। রাগে, হতাশায়, চারজন যুবক তার ওপর চড়াও হয়ে
তাকে মেঝেয় ফেলে কিল চড় লাথি ঘুঁসি মেরে আধমরা করে ফেললো। একজন আবার এই অবস্থাতেও
তার বাবা দেশের কত বড় একজন নেতা, তাদের সাথে চিটিংবাজি করার ফল কী হতে পারে,
জানাতে ভুললো না।
পুলিশ এলো। কি ঘটেছিল তা
যুবকরাই ফলাও করে বুঝিয়ে দিল। সে যে জোর করে টাকা আদায় করতে অনেকের ওপরেই অত্যাচার
করেছে, তাও জানাতে ভুললো না। বাকি সমস্ত
যাত্রী দর্শক হিসাবে থাকাটাই পছন্দ করে নিল। পুলিশ রক্তাক্ত আধমরা মহিলাটিকে তুলে
নিয়ে যাবার সময় বললো, “হায় রাম, এতো হিজড়া আছে। এ শালারা কোন কামে লাগে
না, শুধু জ্বালাতন করে মারে। চল্ একবার, আজ তোকে ট্রেনে উঠে ঝামেলা করার উচিৎ শিক্ষা দেব”। একজন নিরীহ মানুষ, শুধুমাত্র হিজড়ে হয়ে জন্মাবার
অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে গেল। জ্ঞান
হারাবার আগে তার শুধু একটা কথাই মনে উদয় হ’ল, “হিজড়ে হয়ে জন্মাবার অপরাধে বাবা-মায়ের স্নেহ ভালোবাসা থেকে চিরকাল বঞ্চিত
হয়েছি, স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাইনি, চাকরি বাকরি তো দুরের কথা, লোকের বাড়ি ঝি-এর কাজ করে পেট চালাবার সুযোগও পাইনি, আজ নিরপেক্ষ বিচার পেয়ে নিজেকে মুক্ত করতে পারবো তো? কাকে এসব বলবো, কেই বা আমার কথা শুনবে? অচ্ছুৎ হিজড়ে ছাড়া আমার তো আর কোন
দ্বিতীয় পরিচয় নেই”।
পুলিশ চলে গেল, ট্রেন ছেড়ে দিতে যুবকরা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়ার বৃত্ত তৈরি করলো।
নীহার চক্রবর্তী
ছাতিমপুর
হাইস্কুলে চারজন বাংলার শিক্ষক । রমেশবাবু,তরুণবাবু,নীলিমা দিদিমণি আর নতুন শিক্ষক তন্ময় । এরা চারজন বাংলাটাকে
চারভাগে করে নিয়েছে । রমেশবাবু খুব পুরনো শিক্ষক । তিনি কবিতাটা দারুণ পড়ান । এ
ব্যাপারে বেশ তার নাম আছে । তরুণবাবুকে ব্যাকরণে ওস্তাদ বলতে হয় । এলাকায় তার খুব
যশ এ ব্যাপারে । নীলিমাদিদি বরাবর গদ্য পড়ান । বেশ ভালোই ।
তন্ময় বলেছে,’’আমি নির্মিতিটা পড়াবো । কেমন ?’’
তন্ময় বলেছে,’’আমি নির্মিতিটা পড়াবো । কেমন ?’’
বাকি তিনজন তাতেই রাজী । এভাবেই বাংলা পড়ান চলছে ছাতিমপুর হাইস্কুলে ।
কিন্তু সব
নামকে ছাড়িয়ে গেছে তরুণবাবু । এলাকায় তার মুখে-মুখে নাম । অভিভাবকরাও জেনে গেছে তার ব্যাপারে । অন্য
দুই সিনিয়ার শিক্ষকের তার জন্য খুব ক্ষোভ ।
রমেশবাবু প্রায় মুখ-ভার করে বলে,’’আমি তো কম কষ্ট করি না । তাহলে ?’’
নীলিমাদিদিমণি তার স্কুলের সখীদের মধ্যে তার কষ্টের কথা জানায় । তন্ময় দু’বছর পড়াচ্ছে । তাই তার এখনো মুখ ফোটেনি তেমন ।
রমেশবাবু প্রায় মুখ-ভার করে বলে,’’আমি তো কম কষ্ট করি না । তাহলে ?’’
নীলিমাদিদিমণি তার স্কুলের সখীদের মধ্যে তার কষ্টের কথা জানায় । তন্ময় দু’বছর পড়াচ্ছে । তাই তার এখনো মুখ ফোটেনি তেমন ।
কিন্তু কেন
? কেন তরুণবাবুর এত নাম ? সে ব্যাপারটা নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন । শেষে স্কুলের
সংস্কৃতের প্রবীণ শিক্ষক চক্রপাণিবাবু এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিলেন হেসে-হেসে ।
তিনি হেড-স্যার সহ বেশ কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকার সামনে সেদিন বললেন,’’আসলে হয়েছেটা কি জানেন ? তরুণবাবু তার ছেলেমেয়েদের মাকে চিনতে শিখিয়েছেন । ভাষা মানেই তো আমাদের মা । ব্যাকরণ পড়িয়ে তিনি সেই মাকে চিনিয়ে দিয়ে অসাধারণ কাজটা করে চলেছেন দিনের পর দিন । আবার শুনেছি তিনি সময় পেলে অন্য বিষয়গুলোও ধরেন । আমার নাতী বলছিল সেদিন । তাহলে বলুন তো এবার,তরুণবাবু সবার পুজো পাবে,না অন্য কেউ ? এই হল ব্যাপার ।‘’
তিনি হেড-স্যার সহ বেশ কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকার সামনে সেদিন বললেন,’’আসলে হয়েছেটা কি জানেন ? তরুণবাবু তার ছেলেমেয়েদের মাকে চিনতে শিখিয়েছেন । ভাষা মানেই তো আমাদের মা । ব্যাকরণ পড়িয়ে তিনি সেই মাকে চিনিয়ে দিয়ে অসাধারণ কাজটা করে চলেছেন দিনের পর দিন । আবার শুনেছি তিনি সময় পেলে অন্য বিষয়গুলোও ধরেন । আমার নাতী বলছিল সেদিন । তাহলে বলুন তো এবার,তরুণবাবু সবার পুজো পাবে,না অন্য কেউ ? এই হল ব্যাপার ।‘’
একথা বলে তিনি আবার এক-মুখ অমলিন হাসি হেসে উঠলেন । বাকি সবাই শুধু মুখ চাওয়াচায়ি করতে থাকলো তখন ।
তারপর থেকে
বাকি তিনজনও ব্যাকরণ পড়াতে শুরু করেছে জোরকদমে ।
কিন্তু তরুণবাবু ক্লাসে গেলে ছেলেমেয়েরা খুব হতাশার সুরে প্রায় বলছে তাকে,’’কিছুই বুঝিনি । আপনি ধরুন তো,স্যার ।‘’
একথা শুনে তরুণবাবু খুব লজ্জা পায় ।
তারপর অস্ফুট-স্বরে বলে,’’দে তো দেখি ।‘’
কিন্তু তরুণবাবু ক্লাসে গেলে ছেলেমেয়েরা খুব হতাশার সুরে প্রায় বলছে তাকে,’’কিছুই বুঝিনি । আপনি ধরুন তো,স্যার ।‘’
একথা শুনে তরুণবাবু খুব লজ্জা পায় ।
তারপর অস্ফুট-স্বরে বলে,’’দে তো দেখি ।‘’
সুনীতি দেবনাথ
সোমনাথদার
বাড়ি যাবে বলে বেরিয়েছিল মৃণাল। সাইকেলটা যণ্ত্রণা দিচ্ছে, যাওয়া হবে না। এটা সারাই করতে দিতে হচ্ছে। কাল অফিস আছে, এতোটা ঠ্যাঙানো যাবে না পায়ে। সোমনাথদা শেষ শয্যায়, মনটা খচখচ করছে। বৌদি সেদিন ফোনে জানালেন সোমনাথদা বারে বারে ওর নাম নিচ্ছেন।
মৃণাল ভেবে
নিলো সাইকেল মন্টুর গ্যারেজে দিয়ে আজই যাবে পায়ে হেঁটে। হোক না পাঁচ মাইল দূর। ও
কিছু না। সোমনাথদার সঙ্গে পায়ে হেঁটে দূর দূরান্তে পার্টির কাজে যাবার অভিজ্ঞতা তো
পুরোনো হয়নি এখনো। এইতো ক'মাস আগেও গেছে। সোমনাথদার বাড়ি তো সকাল বিকেল কতদিন
গেছে।
আজ কিন্তু
সিদ্ধান্ত নেবার পর থমকাতে হলো। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি যেন পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে
সজোরে পা দুটিকে টানতে লাগলো। একটা মুখ যেন সমস্ত চেতনাকে দুমড়ে মোচড়ে রক্তক্ষরণে
অবশ করে দিচ্ছিল। মুখটি সুমনার। যাক সেসব। এক্ষুণি রওনা না হলে অসুবিধা হবে।
সোমনাথ
দত্ত পার্টির হোমরাচোমরা নেতা। বয়স তার থেকে বছর ছয়েক বেশি। তবু বন্ধুর মত।
সোমনাথদার জন্যই মৃণাল পার্টি সদস্য হয়। তবে ওসবে ওর তেমন ইন্টারেস্ট না থাকায় আজো
সাধারণ সদস্য থেকে পদোন্নতি হয়নি। সে চায়ও না। ওসব পার্টির কথাবার্তা, মতাদর্শ আর
বাস্তব জীবন তার কাছে একেবারে ভিন্ন মনে হয়। মাটির সঙ্গে কোন মিল নেই। কেমন যেন
আমদানি করা বিদেশি মালের মত! চমক আছে ভিত্তি নেই।
অথচ সোমনাথদা পার্টি অন্ত প্রাণ। পার্টি পার্টি করে সোমনাথ সংসার জীবন সবকিছুকে হেলাফেলা করেই আজ এই অবস্থায়। প্রথমে ডায়াবেটিস, তারপর দুটি কিডনি গেলো। ডায়ালিসিস করে করে বছর খানেক গেছে। টাকার ফুলঝুরি হলো, বৌদির গয়না একটা একটা করে শেষ হলো। বোন সুমনার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল ভাগ্যিস!
আবার
সুমনার কথা মনে এলো। হ্যাঁ সুমনাকে ভালোবেসে ফেলেছিলো মৃণাল। মনে হতো সুমনাও তাকে
ভালোবাসে। কেউ কারও কাছে মন খুলেনি কোনদিন, কোনদিন বলা হয়নি মনের অন্দরে ভালোবাসার অনুরণনের কথা।
মৃণাল তখনো বেকার, চাকরির জন্য দৌড়োদৌড়ি করে হয়রান। সুমনা বি.এ. পাশ করে ঘরে বসা। মৃণাল তখন ছুটে ছুটে আসতো সোমনাথের কাছে
কাজে অকাজে। উদ্দেশ্য অন্য। বৌদি সব বুঝে গিয়েছিলেন। মৃণালকে অসময়ে দেখলে মুচকি হাসতেন। মেয়েরা বুঝি এসব ব্যাপার ছেলেদের চেয়ে বুঝায় পারঙ্গম
বেশি। সুমনা মুখে কুলুপ এঁটে ছিল এ বিষয়ে । অতিরিক্ত সপ্রতিভ দেখালেও সে যেন সহজ
সাবলীলভাবে নানা বিষয়ে কথা বললেও এ বিষয়ে চুপ থাকতো। কোন কিছু হয়নি যেন।
এ ধরনের
একটা হচপচ্ পিরিয়ডে মৃণাল একদিন দুপুরবেলা পাশের গাঁ থেকে ফেরার পথে ওদের বাড়ি
গেলো। মধ্য শরতের আকাশে সাদা মেঘের হুলুস্থুল, বাতাস কেমন আনমনা শীতল। সকালের শিশির শুকিয়ে গেছে।
ওদের বাড়ির সামনেকার শিউলিফুলের গাছ থেকে এখনো অসময়ে হালকা বাতাসে দু'চারটে
শিউলি ঝরছে। নরম একটা মিস্টি গন্ধ আলতোভাবে নাক ছুঁয়ে গেলো।
মৃণাল
সাইকেলটা রোজকার মত গেটের বাইরে স্ট্যাণ্ড করিয়ে ভেতরে ঢুকলো। সে জানে এই
গণ্ডগ্রামে চুরির কোন ভয় নেই। ঢুকেই সামনে শিউলিতলায় স্ট্যাচুর মত সুমনা। মৃণাল
একটুখানি থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করলো — ইয়ে, সোমনাথদা আছেন?
স্পষ্ট গলার জবাব —
না, নেই । তুমি কি শুধু দাদার কাছে আসো ?
স্পষ্ট গলার জবাব —
না, নেই । তুমি কি শুধু দাদার কাছে আসো ?
না -আ -হ্যাঁ। এ কেমন জবাব?
মানে?
কিছু না, একটা কথা ছিলো।
মৃণাল
ততোক্ষণে ধাতস্হ হয়েছে। সুমনার মুখের দিকে কিছু আগ্রহ অনেকটা কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে চমকে গেলো। করুণ মুখখানি নিচু করে মাটির দিকে
সুমনা তাকিয়ে আছে। বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে মাটি খুঁড়ছে। অসহায় একটা অস্তিত্ব যেন তার।
মৃণালের ইচ্ছে করছিল সুমনার হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। পারলো না। খুব নরম.
গলায় মায়া
মাখিয়ে বললো — বলো!
জবাব এলো ম্রিয়মান গলায় — আমার বিয়ে ঠিক হচ্ছে। বীরভূমে এক বিরাট ধনী পরিবারে। এককালে ওরা জমিদার ছিলো। পাত্র দোজবরে। হোক না, টাকা তো আছে। সুখে সংসার করবো।
কি হলো চুপ
যে? কিছু বলবে না? মৃণালের প্রথমে মনে হচ্ছিল পায়ের তলার মাটি সরে
যাচ্ছে, শরীর কাঁপছে। তারপর সুমনার মুখে টাকা আছে, সুখে সংসার করবে এসব শুনে শক্ত হয়ে গেলো। সুমনা কি ব্যঙ্গ
করলো তাকে? ওতো বেকার, দরিদ্র পরিবার ওর। এই মুহূর্তে বিয়ে সে যেমন ভাবতে
পারে না, তার পরিবারও এ অবস্থায় কক্ষণো রাজি হবে না। সুমনা তাকে কেন
ব্যঙ্গ করলো? সুমনের সঙ্গে তো তার সম্পর্ক তেমন গড়ে ওঠেনি যে এই
মুহূর্তে বিয়ে হতে হবে! নিজেকে সামলে মৃণাল ম্লানভাবে বলতে পারলো— বেশ তো! খুশি হলাম! সুখে থেকো! নেমন্তন্ন করবে তো?
সুমনা হঠাৎ হু হু কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ' তোমরা সবাই এক, দাদার চেলা তুমি, দাদার মতই পাষাণ ' বলে ছুটে ঘরে ঢুকে পড়লো। আর মৃণালের অবস্থা তখন ন যযৌ ন তস্থৌ! মিনিট পাঁচেক এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে টলতে টলতে সে বেরিয়ে সাইকেল ঠেলে ফিরতে লাগলো। চালানোর মত অবস্থা তার ছিলো না। সুমনার শেষ কথাগুলো তার মস্তিষ্কে, বাতাসে, আকাশে অনুরণন তুলতে লাগলো কেবলই।
তারপর অনেকদিন পার হয়ে গেছে। সুমনার বিয়ে হয়ে গেছে। যেদিন শেষ দেখা সেদিনই পাকা কথার জন্য সোমনাথ গিয়েছিলেন। পরে জেনেছে মৃণাল। সে আর সোমনাথের বাসায় যায়নি। সোমনাথের সঙ্গে সম্পর্কও তার ছিলো না। এতোদিন পর এভাবে আসতে হলো। বেলা ঢলে পড়েছে। দেরি হয়ে গেছে।
সদর দরজায় কড়া নাড়লো সে! সেই নিস্তব্ধতায় কড়ার শব্দ বড় কড়া শোনালো। কিন্তু কেউ সাড়া দিলো না। আবারো আরো জোরে কড়া নাড়লো। এবার মৃদু পায়ের শব্দ শোনা গেলো। দরজা খুললো। থতমত হয়ে মৃণাল দেখলো থান পরা এক নারী দাঁড়িয়ে। ভাঙ্গাচুরা শরীরের সেই নারী প্রায় রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, বড়ো দেরি করে এলে তুমি!
কে বৌদি?
পেছনে সাদা থান পরা এমনি আরেকজন প্রশ্নটা করেছিলেন। সামনে এগিয়ে আসার পর মৃণালের চিনতে দেরি হলো না কে। সে মাথা নিচু করে ফিরে আসতে লাগলো, তার কানে দু'জন সাদা থান পরা নারীর কথা অনুরণনের পর অণুরণন তুলে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে আকাশে ছড়িয়ে সারাটা আকাশ ঢেকে ফেললো।
রুখসানা কাজল
নিজেই থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর দেখছি। এটা আমি পারি। বাপি হচ্ছে হাতুড়ে ডাক্তার।
আসলে ওষুধের ব্যবসায়ী। কি করে কেন যেন সবাই ডাক্তার বলত কে জানে। ব্যাপক পসার ।
তাতে কি আমার মা কখনো বাপির ওষুধ খেতো না। কিছু হলেই রমানাথ কাকুর কাছে চলে যেত।
লেজ ধরে আমরাও।তারপর চৌ আমি ভাইয়া আর মা রমানাথকাকু আর কাকিমা –হিরণ্ময় সময় ছিল
আমাদের।
কালিপূজোর মেলা ছিল আমাদের শহরের প্রাণ । সবাই ঘুরছে ,
কিনছে , খাচ্ছে , খেলছে , দেখছে আমার জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। গত
বছরের মেলার রঙ্গিন হাঁড়ি , মা পুতুল, ঘোড়া
নীলগরু কাগজের কুমির মা আমার বিছানার পাশে
রেখে দিয়েছে। জিলিপি এনেও খাইয়েছে। কিন্তু আমি খ্যানখ্যান করে কাঁদছি ,
এগুলো পুরনো এগুলো পুরনো!সবাই বুঝি সব কিনে ফেললো। মাও ঘুরে এসেছে মেলা। একগাদা কাঠের খুন্তি চামচ, মসলা রাখার খোপ খোপ প্লেট, বাটি কিনে হেসে হেসে দেখাচ্ছে ফুপিকে
। জ্বরের মাতালে কখনো দেখছি কখনো চোখ বন্ধ
করে শুনছি। অন্ধকূপের মোটর সাইকেল চালানো
লোকটা আমার মাথার ভেতর ঘুরছে। গান বাজছে , এক হৃদয়হীনার কাছে
হৃদয়ের দাম কি আছে
---
মাথা ধুইয়ে মা বলছে,
এই ত জ্বর কমেছে। কাল সিওর যেতে পারবে মেলায়। আমি সারারাত ঘুমের ভেতর মেলায়
ঘুরি। সার্কাস পুতুলখেলা, নাগরদোলা আমার ভাল লাগে না। বিশাল জায়গা নিয়ে যাত্রা
প্যান্ডেল। অনেকেই চোরা পথে যাত্রা দেখে। একবার দিনের বেলায় আমরাও ঢুকেছিলাম । খা
খা করছে প্যান্ডেল । মাথার উপর ঝুটি বাঁধা
সামান্য কতগুলো মেয়ে বসে বসে গল্প করছে। কতগুলো ছেলে তেল মাখছে গায়ে। জেফরুল
আমাদের দলে বড়। ও বল্ল এরাই রাতে পরি হয়ে যায়। আর অই যে চুলওয়ালা ছেলেটা ও বিবেক
হয়। এমনিতে ঘোষের দোকানে মিষ্টি কাটে। আমি কোনদিন যাত্রা দেখিনি। একটু রাত হলেই
ঘুমিয়ে যাই। তখন কে বয়ে আনে! মা তাই আমাদের রেখে দলবেঁধে চলে যায়
সিঁদুর নিও না কেড়ে, জোশ, আলেয়া দেখতে।
পরদিন বিকেলে আমাদের পাকা উঠোনে সেই যাত্রাপালার গল্প হত। সবিতা কাকিমা বলত
চুলগুলো নকল আমি হলপ করে বলতে পারি। পারভিন আন্টি বলে উঠত, নারে সবিতা আসল চুল।
ইসস ওরকম চুল যদিআমার হত! মা কায়দা করে নিজের হাঁটু পর্যন্ত চুল
আলগোছে ছড়িয়ে দিয়ে বলত, চুল হচ্ছে বংশগত। আলেয়ার শাড়ি দেখছ ভাবি! রমলা পিসি উস্কে দেয়, মার চোখ চকচক
করে উঠে,কোথায় পাওয়া যাবে বলত!এরমধ্যে আজান ভেসে আসত। সবিতা কাকিমা রমলা পিসি উঠে পড়ত। আর কিছু পরেই শোনা যেত
শাঁখের দমবন্ধ সুর। ঝলক ঝলক
ঘন্টা ধ্বনি।আমাদের ঘরে ধূপ ধুনো আগরবাতির গন্ধ।
মা আমার চায়নিজ কাট্ উলুঝুলু চুল ভাল
করে আঁচড়ে দিয়ে জামা বাছাই করছে। আমার কত যে জামা। সব লাল কমলা। মার সাথে বেরুলেই
কেউ কেউ আফসোস করে, এহে এই মেয়ে বিয়ে দিতে কত টাকা যে
লাগবে। ছোটমেয়েটাই কালো কুচ্ছিত হলো! ব্যাড লাক বউমা! মা রেগে মেগে তাদের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিতো কিছুদিন ।
জামার পকেটে কিছু টাকা লুকিয়ে দিয়ে
দেয় মা। তোমার যেটা খুশি তাই কিনো কেমন! বাপির হাত ফস্কে আমি উপুড় হয়ে বসে পড়ি মাটির হাঁড়িপাতিল
পুতুল গরুর দোকানে। বাপি বাপি সব নেবো স—ব। নাও নাও ওরে ও অখিল
এইসব কিন্তু আমার ছোটকন্যার। দোকানকাকু লাল
গামছায় মুখ মুছে বলত, সব তোমার
মা জননী। তুমি দুই হাত ভরি নিয়ি যাও ত দিখি।
আমি চোখের জল চশমার কাঁচে ঢেকে দোয়েল
চত্বর চষে ফেলছি। অই লাল,
হলুদ, সবুজ, কালো রঙের
সরলফুলতোলা মাটির হাঁড়ি পাতিল, লালগরুর কালো লেজ,পেটের সাথে
জড়ানো বাছুর, নীল গরুর কালো চোখ আর কাগজের কুমিরের
ঘুচঘুচ চলা আমার যে চাই। আমি মানুষ হতে চাই। হিন্দু কি মুসলিম, খৃষ্টান বা ইহুদী কিচ্ছু না কিচ্ছু
না।
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)