গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

সাঈদা মিমি

মহাপ্রস্থানগড় ও যন্ত্রদানব

 
মমিনা দেখতে চায় না। তারমানে এই নয় যে সে উপেক্ষা করছে। না চাইলেও চোখে পড়ে। কারওয়ান বাজারের যে দিকটায় একটি পাঁচতারা হোটেল আছে তার উল্টোদিকের আবছায়া গলি থেকে মেয়েটাকে ভাড়া করলো তিন চারজন। এখানে জোরাজুরির কিছু নেই, দুইপক্ষই সম্মত। তারপর ওরা একটা সিএনজি নিয়ে চলে গেল। মমিনার তখন ব্যস্ততা অন্য জায়গায়। জোবেদ আলির কাছে যাওয়ার তাড়া, মতামত দরকার। সংবাদটা দেয়ার পর থেকেই থমকে আছে জোবেদ আলি। মমিনার চোখের সামনে কিছু দৃশ্য ভেসে ওঠে। একটা ঘর, রঙচঙে ময়লা চাদর, ঘোলাটে বাথরুমে বহুব্যবহৃত তোয়ালে, একটা পানির বোতল, দুইটা গ্লাস এইসব। সে অবাক হয়, এখন এইসব ভাবনা আসবে কেন! তখনই ফোনটা আসে। জোবেদ আলি বলছে, ফেলে দাও। আমার সংসার আছে, তোমারও.... কি যে বিস্ফোরণ হয় মাথায়! রেলক্রসিংয়ে একটানা টিং টিং টিং টিং শব্দ, লোকাল ট্রেন আসছে...
পরিচালক বলে উঠলো, কাট। নিলীমা ক্ষিপ্ত হয়, ডামির ছিটকে পড়ার দৃশ্য নেবে না? মাজহার ভেটো দিল, এইসব দৃশ্য পুরনো হয়ে গেছে। ছিটকে পড়া রক্ত দেখাব, ভালগারিজম আনা যাবে না। দর্শককে বোঝাতে রক্তের ছাপই যথেষ্ট। নিলীমা বিরক্ত হতে থাকে। বোঝা যায়, এই বিরক্তিটা তার নিজের ওপর নিজেরই। মমিনাকে মরতে হবে কেন? সেন্টিমেন্টাল রাবিশ। কেউ প্রেমিকের মাধ্যমে গর্ভবতী হলেই মরবে? ট্রেন তার পথে যাক, মমিনা মমিনার। মাজহারকে একটু বিচলিত মনে হয়, কিন্তু আপনিই তো এরকম বলেছিলেন! এখন পাল্টাতে বলছি। এরকম আজাইরা মুভি আমি বানাবো বলে লগ্নি করিনি! মাজহার খানিকটা চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে থাকে। কাহিনি বদলাতে হবে, অনেকগুলি সিকোয়েন্স। প্রায় পঞ্চাশ ভাগ শ্যূটিং হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। বাজেট ফেইল করবে!
সে পঞ্চপাণ্ডবের সহচর হয়েছে। যোশিমঠ থেকে বদ্রীনাথ, তারপর মানাগ্রাম। শুরুটা হয়েছিল গাড়োয়ান থেকে। সেই গাড়োয়ান, যাকে ঘিরে আছে গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী, মন্দাকিনী, অলকানন্দা; মর্ত্যভূমির স্বর্গ। পশ্চিমে হিমালয়ের ইশারা। হরিদ্বার পার হয়ে যোশিমঠ, দীর্ঘ হাঁটাপথ। তার সময়জ্ঞান ছিল না। দিন, মাস কিংবা বছর। অন্ধকার আর আলো বুঝতো। কখনও কখনও খিদে, তৃষ্ণা। কোথায় যোশিমঠ? স্বর্গারোহনের পথ? দেবপ্রয়াগ, রুদ্রপ্রয়াগ, কর্ণপ্রয়াগ, নন্দপ্রয়াগ পার হওয়ার পর এক সুতন্বী বাতাস এসে বললো, আর বেশি দূরের পথ নয়....পঞ্চপাণ্ডব এখনও শিবিকায় অবস্থান করছেন, তাদের পত্নী সুন্দরী গৌরি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত থাকায় এখনও শয্যা ছেড়ে উঠতে সক্ষম হননি।দেবপ্রয়াগে সে অলকানন্দা, ভাগিরথী আর গঙ্গার ত্রিধারায় ডুবতে বসেছিল। না..., দেহত্যাগ করে নয়... বলতে বলতে তার অন্তরে দেবদত্ত এক শক্তি ভর করেছিল। আমিও সশরীরে স্বর্গে যেতে চাই। তারপর, ত্রিবেণীর ঘূর্ণি তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। মন্দাকিনীর পর দুটো পথ। একটা কেদারনাথের দিকে গেছে, আরেকটি বদ্রিনাথ। সে বদ্রিনাথ যাবে কিন্তু এখন একটু বিশ্রাম দরকার। ফুলে ওঠা ক্ষতবিক্ষত পা দুটো টেনে সে যোশিমঠের এক ধর্মশালায় দাঁড় করালো নিজেকে। এখন অন্ধকারের শৈশব। হঠাৎ অনেক দিন, মাস বা বছর পরে সে প্রচণ্ড খিদে ও পিপাসা অনুভব করলো।
ট্রেন অসবে কিন্তু মমিনা আত্মহত্যা করবে না। কারণ, সে জোবেদ আলিকে ভালোবাসে! হতে পারে, জোবেদ আলি এই বাচ্চাকে স্বীকৃতি দিতে পারেনি... তবুও। আহা, জোবেদ আলির কি দোষ? তার তো স্ত্রী সন্তান আছে! কিংবা মমিনার কথাই ধরা যাক, সেও তো বিবাহিতা! তারও সন্তান আছে। এই অবস্থায় আত্মহত্যা করা যায় কি? ঘোর অন্যায়, সন্তানদের প্রতি অন্যায়। মমিনা এবং জোবেদ আলি তো ভুলেই গিয়েছিলো,জীবন কি? তারা রোজ মরে বেঁচে ছিলো। মাঝখানে এই ঝামেলাটা দূর্ঘটনাবশত হয়ে গেছে। মমিনা পারবে না, জোবেদ আলিকে রেখে পালাতে পারবে না সে।এই পর্যন্ত ভাবার পর মাজহার ক্ষান্ত দেয়। এই টিপিক্যাল স্টোরি চলবে কি? এর চেয়ে ভালো হতো যদি সে নাচে গানে ভরপুর একটা মারদাঙ্গা ছবি বানাতো। যদিও মাজহার মূলধারার বাইরে বসে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে। তবে আর্ট ফিল্ম নয়। কিছু গান কিংবা মারামারি থাকে। পাবলিক সেটাকে বলে জীবনবাদী ছবি। কিন্তু এই ভূতগ্রস্ত ধনী নারী নিলীমা এরকম ওল্ড ধারার মুভিতে টাকা ঢেলে বসে আছে। ব্যাকগ্রাউণ্ডে লালনগীতি থাকতে পারে। প্রয়োজনে নগ্নতা আসতে পারে। মাজহার নিলীমাকে এই দূর্বল চিত্রনাট্যের কথা বলে তাকে একটু বানিজ্যিক হওয়ার পরামর্শ দেয়। অগ্নিদৃষ্টি হেনে বের হয়ে আসে নিলীমা। এই ধনাঢ্য শতপদী নারীর আচরণ বুঝতে পারে না মাজহার। সঙ্গত কারনেই সে নিজের ওপর ফেটে পড়ে।৪রুধিরা ধর্মশালার নির্জনে পশু চামড়ার কম্বল জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। বদ্রীনাথের দূরত্ব তো কম নয়! খুব ভোরে তাকে হাঁটা শুরু করতে হবে, ভোরের আরতি শেষ করেই। পাণ্ডুকেশ্বরে একবার বিশ্রাম নেবে সে, তারপর বিষ্ণুপ্রয়াগে। খিদে পেলে মাধুকরী করবে, গত কয়েকবছর যেরকম করেছে। শীত আসতে ঢের দেরী কিন্তু হিমালয়ের যত কাছে সে আসছে তার অস্থি পাঁজরে কাঁপুনি দিচ্ছে। তবে সেসব নিয়ে সে মোটেই ভাবিত নয়, তার ভাবনাজুড়ে কেবলই চাররাত্রিতে দেখা একটা স্বপ্ন। একবার অন্বেষের কথা মনে পড়েছিল। সেটার কোন তীব্রতা ছিল না; সেই মনে পড়ায়। অন্বেষ কে? কোন গোত্রের? কিছুই জানে না রুধিরা। তবে দুজনের মধ্যে তীব্র সখ্যতা তৈরি হয়েছিল বৈ কি! যে যার পছন্দকেই গুরুত্ব দেয় তাদের গোত্রে। সুতরাং রুধিরা আর অণ্বেষের কোন সমস্যা ছিল না। নৃত্য-ভোগ-গীত-আনন্দ নিয়ে তারা বেশ ছিল। তাদের পুরোহিতের নির্দেশ ছিল, সন্তান জন্ম দাও; গোত্র বাড়াও। বিয়ে নামক একটা বন্ধন নাকি তৈরি হয়েছে! এবং এই সংক্রান্ত আরও ভয়ংকর তথ্য তারা পেলেও বিশ্বাস করেনি।অন্বেষের বীজ অঙ্কুরিত হল না। রুধিরা মা হতে পারলো না এবং অন্বেষ চলে গেল একদিন। এতে কিছু যায় আসে না তাদের। দেহ আর যৌবন থাকলে আরও অনেকেই আসবে তাকে অঙ্কুরিত করতে। সেই রাতেই বিশাল এক স্বর্ণপুরুষকে স্বপ্ন দেখলো রুধিরা, তার রূপ, প্রভা, ব্যাক্তিত্ব্যে ছিল হীরের ধার। রুধিরা কে পথনির্দেশ দেয়া হয়েছে। বদ্রীনাথে যেতে হবে তাকে, সেখান থেকে হিমালয়। শুরুতে এড়িয়ে গিয়েছিল রুধিরা কিন্তু পরপর চার রাত একই স্বপ্ন দেখার পর পুরোহিতের কাছে যায় সে। তিনি চিন্তিত ছিলেন কিছুক্ষণ, তারপর রুধিরাকে বের হয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। সেই থেকে শুরু। বিশ্বকর্মার মন্দিরে পৌঁছুনো পর্যন্ত স্বস্তি নেই।রুধিরা ভাবে, বিশ্বকর্মার মন্দিরে পূজো দেয়ার আগে সে স্নান করবে তপ্তকুণ্ডে। এর পরপরই স্নান করতে হবে নারদকুণ্ড ও সূর্যকুণ্ডের উষ্ণ প্রস্রবনে; সেটাই নাকি রীতি! স্বপ্নে দেবনর সেরকমই বলে দিয়েছেন। তারপর তুলসি পাতা দিয়ে স্নান করতে হবে বদ্রীনারায়নে। বিক্ষিপ্ত সব ভাবনা শেষে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে ঘুম ভাঙলো তার। কেউ তার ওপর পাহাড়ি দানবের মতন মন্থনলীলা চালাচ্ছে। রুধিরার কষ্ট হচেছ। এই আনন্দকর্মে জোর করে যন্ত্রণা দেয়ার প্রয়োজন কি! তাকে বললেই তো হতো! সে সম্ভবত উহ জাতীয় একটা শব্দ করেছিল, অন্ধকারে কেউ তার মুখ চেপে ধরলো। দূর্বল শরীরে প্রতিরোধের একটা ভাষা তৈরি হয়েছিল রুধিরার, কয়েকটি হাত তার কণ্ঠনালীর দিকে এগিয়ে এলো। রুধিরা জানতেও পারলো না, কি অপরাধে তাকে মরতে হচ্ছে! দেহ থেকে বিযুক্ত একটা আত্মা ছুটছে। পার্থিব কাজ অসমাপ্ত রেখে যাওয়া যায় না, অবশিষ্ট রজনীর মধ্যে তাকে একটা দেহ পেতে হবে।
নিলীমা অপরাধবোধে আক্রান্ত। প্রবল, অসীম, ভয়াবহ এসব বলে এর পরিমান নির্ণয় করা সম্ভব নয়। যে সবে রক্তপিণ্ড হয়ে জমাট বাধছিলো, তাকে নিষ্ঠুরের মত সরিয়ে দেয় সে অথবা সরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। জোবেদ আলি কোনভাবেই দায়িত্ব নিতে চাইছিলো না। সেটা কি সম্ভব ছিলো আদৌ? এই মূহুর্তে সংসার ত্যাগ করা কারও পক্ষে সম্ভব ছিল কি? নিলীমার জন্য বিষয়টা ছিল আরও কঠিন। বরং এটা বলাই ভালো, জোবেদ আলি শেষ সম্ভাবনার কথাও ভেবেছিলো। আহা, বাচ্চাটা তবু বাঁচুক! নিলীমা একেবারেই ঝুঁকি নিতে পারেনি। সন্তানের মুখচ্ছবি সবকিছুই বলে দেবে এই আতঙ্ক তাকে রাতের পর রাত ঘুমাতে দেয়নি। তাছাড়া শফিক অতিরিক্ত সন্দেহবাতিকগ্রস্ত। তার একটি ছেলেও রয়েছে এবং সে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। মূলত চৌদ্দ বছর বয়সে দ্বিগুন বয়স ব্যবধানের শফিকের সাথে বিয়ে হওয়ার পর থেকেই অসুখী ছিল নিলীমা। ভেবেছিল এভাবেই মরে মরে বাঁচতে হবে বাকি জীবন। এমন ভাবনার কোন এক এপ্রিলে জোবেদ আলির সাথে তার পরিচয় হয় ভাগ্নির বিয়ের অনুষ্ঠানে।
মাজহার স্বিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, উম্মাদ ঘরাণার মহিলা নিলীমার মুভি সে নির্মাণ করবে না। হ্যাঁ, করলে অনেকগুলি টাকা সে পেতো কিন্তু নিজেই উম্মাদ হয়ে যেত। প্রতিটা দৃশ্যে মহিলা ঘাপলা করবে। আকারে ইঙ্গিতে সে বহুবার বোঝাতে চেষ্টা করেছে নিলীমাকে, লাভ হয়নি। মুনাফা ছাড়া ফিল্ম মাজহারও বানায়, পুষিয়ে নেয় পরবর্তী দুটো ছবি দিয়ে। কিন্তু এটা কেমন গল্প? খাপছাড়া চিত্রনাট্য, বেঢপ ইমোশন, সমন্বয়হীনমাজহারের মনে পড়ে, ফিদা হুসেনের গজগামিণীতে কাজ করে মাধুরী কেন বলেছিল সে আর এরকম ছবিতে নেই! সে তো গেল অভিনেত্রীর এক্সপ্রেশন, নির্মাতার তৃপ্তি বলে একটা কথা আছে! মাজহার কাজ করে তৃপ্ত নয়। নিলীমা আইনগত ব্যবস্থা নিলে নিক। সিদ্ধান্তটা নেয়ার পর অনেকদিনের আটকে রাখা দমটা ছাড়ে মাজহার। বয় কে ডেকে খাসির কালাভূনা আর খিচুরির অর্ডার দেয় সে।
দীর্ঘ মহাপ্রয়াণ পথ। সম্মুখে নির্বিকারচিত্তে যুধিষ্ঠির। আসলে, বড় কৌশলে সে নিজের অস্থিরতা গোপন রেখেছে। স্ত্রী দ্রৌপদী বুদ্ধিমতী মহিলা, আরও রয়েছে চারটে অবুঝ ভাই। পরমাশ্চর্য, এখনও সে ভাইদের একরত্তি আর নাদান মনে করে! অবশ্য জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কর্ণ বেঁচে থাকলে চেপে রাখা কষ্টের বোঝা তাকে বইতে হতো না। দলটা থেমে গেছে। অন্তঃসলিলা সরস্বতীর উৎসস্থলে গভীর খাদ। দ্রৌপদী বলে উঠলো, কিভাবে এগোব প্রভু? যুধিষ্ঠির ভীমের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন্। পাশের পাহাড়শ্রেণীতে লাথি মারলো সে। পাথর ভেঙে সরস্বতী নদীর ওপর একটা সেতু তৈরি হয়ে গেলো।কেশবপ্রয়াগের দিকে পাঁচজনের দলটা চলছে। যুধিষ্ঠির পেছন দিকে তাকালেন, অনেকটা সময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। একটা কুকুরও আছে তাদের সাথে। সেই বদ্রীনারায়ণ থেকে পিছু পিছু আসছে। বাদামী সাদার মিশ্রনে লোমশ একটা খোঁড়া কুকুর। কুকুরটা নিকট অতীতের কথা স্মরণে অক্ষম কিন্তু যুধিষ্ঠির জানেন, মহাপ্রভু তাকে সমস্তই জ্ঞাত করিয়েছেন। বাদামী এবং সাদা কুকুরটি, তাকে আমি রুধিরা নামে ডাকতে পারি কি?
হিমালয়ের যমদুয়ার ক্রমশ দৃশ্যমান হচ্ছে। রুধিরা এটা দেখতে পায়, আরও অনেককিছুই সে এখন দেখে যা সাধারণ মানুষেরা দেখতে পায় না। চুড়ান্ত পর্বের আগে নিয়তি অনেক কিছুই গুটিয়ে ফেলেছে। যুধিষ্ঠিরি এখন একা। অবশ্য রুধিরাকে যদি হিসেবে ফেলা হয় তাহলে এভাবে বলতে হবে, একজন জাতিস্মর স্বর্গারোহনের শেষধাপে অপেক্ষমান।