গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

সুবীর কুমার রায়

 আঁধারে আলো


রাত সাড়ে আটটার পর সুমনার সত্যিই চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ালো। এত রাত তো অনিল কোনদিন করে না। তখনও মোবাইল ফোনের প্রচলন সাধারণ মানুষের মধ্যে শুরুই হয় নি, তাই কোন কারণে ফিরতে দেরি হলে, যেভাবেই হোক বাড়িতে একটা খবর দেওয়া অনিলের বরাবরের অভ্যাস। রাত যে খুব একটা হয়েছে তা নয়, কিন্তু আজ কোন খবর না দিয়ে এত রাত করায়, চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিন বছরের বাচ্চাকে নিয়ে একা সে কিভাবে ও কোথায় খোঁজখবর করবে ভেবে পায় না। আরও কিছু সময় ভাবনা চিন্তাতেই কেটে গেল। এবার আশপাশের পরিচিত বাড়িতে গিয়ে সাহায্য চাওয়া ছাড়া আর উপায় রইলো না।
তার কাছে বিপদের কথা শুনে সকলেই একই কথা বললেন— “কান্নাকাটি করার কি আছে, এখন তো সবে দশটা বাজে, কোন কারণে আটকে গেছে। অফিসের কাজে হতে পারে, রাস্তাঘাটে জ্যাম হতে পারে, এত ভেঙ্গে পড়লে চলে? যাও বাড়ি যাও, চিন্তা করো না একটু পরে ঠিক চলে আসবে”।  সুমনা ছেলের হাত ধরে বাসায় ফিরে গেলে প্রতিবেশী নবীনবাবু,  অমলবাবুকে বললেন “যত্ত সব ন্যাকামি, দশটার মধ্যে স্বামী বাড়ি ফেরে নি বলে চোখের জলে বন্যা বইয়ে দিয়ে গেল। আমরা যেন আর চাকরি বাকরি করি নি। একবারে রোমিও জুলিয়েট মাইরি”। অমলবাবু শুধু বললেন, “এসব আজকালকার ছেলে মেয়েদের ন্যাকামো, বাইরের লোকের কাছে রোমিও-জুলিয়েট, ঘরের মধ্য সাপ-নেউল”।
ধীরে ধীরে একসময় ঘড়ির ছোট কাঁটাটা এগারোটার ঘরে গিয়ে পৌঁছলো। না, কোন সন্দেহ নেই, কিছু একটা বিপদ নিশ্চই হয়েছে। ঘুমন্ত ছেলেকে কোলে নিয়ে সুমনা একটু দুরে অনিমেষবাবুর বাড়ি গিয়ে সব বলে অনিলের অফিসের ফোন নম্বর দিয়ে একটু খোঁজ নিতে অনুরোধ করলো। অনিমেষবাবু যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে কেউ ফোন তুললো না। অনিলের অফিসের কারো ব্যক্তিগত ফোন আছে কী না, সুমনার জানা নেই। থাকলেও সুমনার ফোন নম্বর তো দুরের কথা, পুরো নামটা পর্যন্ত কারো জানা নেই। অনিলের মুখে প্রদীপবাবু, অসিত, তন্ময়, মুরারীদা, ইত্যাদি কয়েকজনের নাম শুনেছে মাত্র। সুমনার কাছ থেকে ফোন নম্বর নিয়ে অনিমেষবাবু সুমনার ভাইকে ফোন করে সুমনাকে লাইনটা দিলে, সুমনা কাঁদতে কাঁদতে সব কথা বলে অফিসের ফোন নম্বরটা দিলো। কিছুক্ষণ পরে সেই ভাই আবার ফোন করে জানায় যে অনিলের অফিসের কেউ ফোন তুলছে না। রাতও অনেক হয়েছে কাজেই সুমনা যেন বাড়ি ফিরে যায়, কোন কারণে রাতে ফিরে না আসলে, কাল সকালে সে অনিলের অফিসের সাথে যোগাযোগ করে যা করার করবে। যোগাযোগের আর কোন উপায় না দেখে বাধ্য হয়ে সুমনা বাসায় ফিরে আসে।
সারা রাত জেগে কাটিয়ে ভোরবেলা অনিমেষবাবুর বাসার উদ্দেশ্যে আবার ছোটে সুমনা। পথে বাজারের ব্যাগ হাতে নবীনবাবুর দেখা। নবীন বাবু হাসিহাসি মুখে একটু ব্যঙ্গ করেই বললেন, “কি পতিদেবতাটি ফিরে এসেছে তো, তা কখন তিনি ফিরলেন”? এক ঝাঁক বিরক্তি নিয়ে সুমনা জানায় “না এখনও সে ফেরে নি”। মনে একটা আশা ছিল, রাতে  অনিল ফিরে না আসলেও ভাইটি যেকোন উপায়ে কোন একটা খবর জোগাড় করতে পারবেই। কিন্তু অনিমেষবাবুকে দেখেই সে বুঝতে পারে, যে এখনও কোন সন্ধান পাওয়া যায় নি। অনিমেষবাবু তাকে সান্তনা দিয়ে অফিস কাছারি খোলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলে স্ত্রীকে ডেকে বাচ্চাটা ও সুমনার জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করতে বললেন।
সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ অনিলের অফিসে ফোন করে খোঁজ নিতে যাওয়ার ঠিক আগে তাঁর টেলিফোন যন্ত্রটি সশব্দে বেজে ওঠে। অনিমেষবাবু ফোনটা তুলে কিছুক্ষণ চুপ করে ও প্রান্তের কথা শুনে, দু-চারবার সংক্ষিপ্ত হ্যাঁ বা না বলে, থমথমে মুখে ফোনটি রেখে ভিতরে চলে গেলেন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি পোষাক পরে তৈরি হয়ে ফিরে এসে খুব ঠান্ডা গলায় সুমনাকে বললেন চলো। বিষ্মিত সুমনা অনিলের অফিসে ফোন না করে এখন কোথায় যাবে জিজ্ঞাসা করায়, অনিমেষবাবু একটু সময় নিয়ে বললেন, “তোমার ভাই ফোন করেছিলেন, গতকাল তোমার স্বামী অফিসেই যায় নি। আচ্ছা তোমার কী মনে হয়, ও অফিস না গিয়ে আর কোথায় যেতে পারে? আগে কখনও এরকম ঘটনা ঘটেছে? আমি তোমার বাবার বয়সী, সত্যি করে বলতো ওর স্বভাব চরিত্র কেমন ছিল”?
সুমনার চিৎকার করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ায়, এই প্রসঙ্গে আলোচনা বন্ধ করে তিনি একটা রিক্সা নিয়ে সুমনা ও বাচ্চাটিকে নিয়ে লোকাল থানায় গেলেন। থানার অফিসারটি সব শুনে বললেন আপনি একটা মিসিং ডাইরি করতে পারেন, তবে আমার মনে হয় তার আগে হাসপাতাল, মর্গ, বা ওনার আত্মীয় স্বজন বা বন্ধু বান্ধবের বাড়িতে একটু খোঁজ নিয়ে দেখা উচিৎ। মর্গের কথা শুনে সুমনার প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হ’ল। 
বৃদ্ধ অনিমেষবাবু থানা থেকে বেড়িয়ে সুমনাকে নিয়ে ট্যাক্সি করে একে একে অনিলের অফিস, বিভিন্ন হাসপাতাল, ও মর্গে ঘুরেও কোন সংবাদ না পেয়ে ফিরে আসার সময় চাঁদপাল ঘাটে লঞ্চে উঠে প্রথম খবরটা শুনলেন। সকাল থেকে তিনি খবরের কাগজ ওল্টাবার অবকাশ পান নি। গতকাল সকালে অফিস টাইম-এ রামকৃষ্ণপুর লঞ্চ ঘাটে চাঁদপাল যাওয়ার একটি লঞ্চ জেটিতে এসে দাঁড়াবার সময় একটু জোরে ধাক্কা লাগে। জেটি থেকে তখন অফিস যাত্রীরা লঞ্চে ওঠার জন্য হুড়োহুড়ি করছে। আচমকা ধাক্কার জেরে কয়েকজন লঞ্চ ও জেটির মাঝখানে পড়ে যায়। অনেকেই সাঁতরে পাড়ে উঠে আসে, কিন্তু ঠিক কতজন জলে পড়ে গেছিলো বোঝা যায় নি। দীর্ঘক্ষণ তল্লাসি করেও কাউকে না পাওয়া যাওয়ায়, আশা করা যায় এই ঘটনায় কেউ হতাহত হয় নি।
থানায় মিসিং ডায়েরি করার পর থেকে আজ দুই দিনে গঙ্গার বিভিন্ন ঘাটে চারটি ভেসে আসা মৃতদেহ সনাক্ত করার জন্য সুমনাকে ডেকে পাঠানো হলেও, একটা দেহও অনিলের নয়। কোন দেহই অনিলের না হওয়ায়, সুমনা মনে মনে খুশি হলেও সে বুঝতে পারে অনিলের ফিরে আসার সম্ভাবনা ক্রমশঃ ক্ষীণ হয়ে আসছে।
চতুর্থ দিনে অফিস থেকে অনিলের কিছু বন্ধু সুমনার সাথে দেখা করতে আসে। নানাভাবে সান্তনা দিয়ে তারা জানায় যে তাদের ধারণা, ঘটনার দিন অনিল হয়তো গঙ্গায় তলিয়ে গেছে। এতক্ষণে সুমনার কাছ থেকে জানা যায় যে অনিল সাঁতার জানতো না, আর তাই তার স্বামী রোজ হাওড়ার রামকৃষ্ণপুর লঞ্চ ঘাট থেকে চাঁদপাল ঘাটে লঞ্চে পারাপার করায় সে খুব ভয় পেত।
এবার অনিলের সহকর্মীরা জানায় যে তারা অনিলের অফিসের ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। অনিলের যখন কোথাও কোন খোঁজ পাওয়া গেল না, তখন ধরে নেওয়া যেতে পারে যে সেদিনের লঞ্চ ঘাটের সেই দুর্ঘটনায় অনিল গঙ্গার জলে তলিয়ে গেছে। তারা ঐ লঞ্চ ঘাটে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জেনেছে যে আকস্মিক জেটির সাথে লঞ্চের ধাক্কায়, সেদিন বেশ কয়েকজন জলে পড়ে যায়। অনেকেই সাঁতরে জেটিতে উঠে আসলেও সবাই উঠতে সক্ষম হয়েছিল কী না, জোর করে বলা আদৌ সম্ভব নয়, কারণ ঠিক কতজন জলে পড়ে গেছিল সঠিক জানা যায় নি। তাছাড়া লঞ্চ ও জেটির মাঝের অংশটিতে পড়ে গেলে পারে উঠে আসাও বেশ কষ্টকর, লঞ্চের ইঞ্জিন চালু থাকলে তো আরও কষ্টকর। এরপর অনিল ফিরে না এলে সুমনার কী কী অসুবিধা হতে পারে বুঝিয়ে বলে তারা অদ্ভুত একটা প্রস্তাব দেয়।
তারা জানায় যে কোন মানুষ হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে থানায় মিসিং ডায়েরি করার পর মৃতদেহ উদ্ধার করা গেলে, মৃতের ঘনিষ্ঠ লোকেদের দিয়ে শবদেহ শনাক্ত করা হয়। মৃতের ঘনিষ্ঠ লোকেরা শবদেহ শনাক্ত করলে নিয়ম মাফিক সেই ব্যক্তিকে মৃত ঘোষণা করা হয়, এবং পোস্টমর্টেম করে মৃতদেহ তার নিকট আত্মীয়দের হাতে সৎকার করার জন্য তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু মৃতদেহ উদ্ধার করা না গেলে, সাত বছর তার ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করা হয়। সাত বছর অতিক্রান্ত না হলে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা যায় না, এটাই রীতি। এক্ষেত্রে অনিলের মৃতদেহ উদ্ধার করা না গেলে তাকে আইনত মৃত বলে ঘোষণা করা যাবে না। আর আগামী সাত বছর নিরুদ্দেশ অনিলের প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুয়িটি, ইত্যাদি কোন কিছুর টাকাই অফিস সুমনাকে ফেরৎ দিতে পারবে না, এমনকী অনিলের চাকরিটাও সুমনাকে দেওয়া অফিসের পক্ষে আইনত সম্ভব হবে না। সাত বছর পর অফিসের পক্ষে সুমনাকে মৃত অনিলের চাকরিটা দেওয়া সম্ভব হবে কী না, বা আদৌ দেবে কী না, আজ এখানে দাঁড়িয়ে সেটা জোর গলায় বলা খুবই শক্ত। এই সাতটা বছর সে তার শিশু সন্তানকে নিয়ে দারুণ অর্থাভাবে কিভাবে কাটাবে? তাই তারা মনে করে অনিলের দুর্ঘটনার কথাটা যখন অফিস ও পুলিশ জানেই, তখন এরপর গঙ্গায় কোন মৃতদেহ উদ্ধার হলে, সুমনা যেন তাকে তার মৃত স্বামী বলে শনাক্ত করে। এক্ষেত্রে স্ত্রী হিসাবে তার শনাক্তকরণই গ্রাহ্য হিসাবে বিবেচিত হবে। এরপর সুমনার পক্ষে অনিলের চাকরিটি বা তার প্রাপ্য সমস্ত টাকা পয়সা ফেরৎ পাওয়ায় আর কোন বাধা থাকবে না।
সমস্ত কথা চুপ করে শুনে সুমনা তাদের জানায়, যে সে তার ভাইয়ের সাথে কথা বলে কয়েক দিনের মধ্যে তার সিদ্ধান্ত জানাবে। এই ব্যাপারটা যত শীঘ্র সম্ভব সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে অনিলের সহকর্মীরা চলে যাওয়ার আগে শুধু বলে যায়, যে বেশি দেরি হলে ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে পারে।
অনিলের সহকর্মীদের সমস্ত কথা ও বিপদের গভীরতার কথা চিন্তা করে সুমনা তার ভাইয়ের অমত থাকা সত্ত্বেও, তাদের পরামর্শটা মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করার ঠিক পরের দিনই খবর আসে, যে নাজিরগঞ্জের কাছে গঙ্গায় একটি মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। দুই ভাইবোনে মৃতদেহ ও তার পোষাক দেখে বুঝতে পারে, যে শবদেহটা আর যারই হোক অনিলের নয়। আরও অনেকেই সুমনাদের মতো শবদেহ দেখে শনাক্ত না করে ফিরে যায়। মৃতদেহটা তার স্বামীর বলে শনাক্ত করার আগে, সুমনা তার ভাইয়ের অনুরোধ ও পীড়াপীড়িতে চুপ করে থাকতে একপ্রকার বাধ্য হয়।
দিন তিনেক পরে সালকিয়ার কাছে গঙ্গায় একটি শবদেহ উদ্ধারের সংবাদ পেয়ে দুই ভাইবোনে আবার যায়। বেশ কয়েকটা দিন পার হয়ে যাওয়ায় সুমনা তার ভাইকে দৃঢ় কন্ঠে বলে, যে সুযোগ থাকলে আজ সে মৃতদেহটিকে অনিলের বলে শনাক্ত করবেই। ভাইও কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে, আগের সেই মনের জোর ও পাপবোধ বোধহয় এখন আর তারও নেই।
একে একে বেশ কয়েকজন মৃতদেহ দেখে শনাক্ত না করে ফিরে গেল। সুমনা ইচ্ছা করেই একটু সময় নিলো, অন্যের শবদেহ নিজের স্বামীর বলে দাবি করার মধ্যে একটা ঝুঁকি তো আছেই। জায়গাটা ফাঁকা হলে সুমনা তার ভাইকে নিয়ে মৃতদেহটা দেখেই ডুকরে কেঁদে উঠে আছড়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। মৃতদেহের দুটি চোখের জায়গাতেই বড় দুটো গর্ত, হয়তো মাছ তার চোখ দুটো খুবলে খেয়ে নিয়েছে। গোটা শরীর ও মুখ পচে, ফুলে, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। শুধু পরনের জামাকাপড় তাকে অনিল বলে চিনতে সাহায্য করছে।
হ্যাঁ, সহকর্মীরা তাদের কথা রেখেছিল। তাদের ঐকান্তিক ও আন্তরিক চেষ্টায় সুমনা অনিলের চাকরিটি পায়, অনিলের প্রাপ্য সমস্ত টাকা অফিস থেকে ফেরৎ পায়। ছোট্ট ছেলেটাকে ভালো স্কুলে ভর্তি করে।