গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ২০ মার্চ, ২০১৭

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

এই প্রবাস

(১) 

লাহা বাড়ির পাশ দিয়ে যেতেই  হল্লাটা কানে এলো মালিনীর। আর কয়েক পা এগোলেই ‘স্নেহ কুটির’কে বাঁয়ে রেখে ডান দিকে ঘুরে গেছে রাস্তাটা। পাঁচ-ছটা বাড়ির পরেই একটা তেমাথা মোড়, মোড়ের মাথায় সীতারামের দোকান, সীতারাম নট্ট কোম্পানী। নামেই নট্ট কোম্পানী, এখন শুধু থিয়েটারের ড্রেস ভাড়া পাওয়া যায় আর সন্ধ্যেবেলা দোকানে ছেলে ছোকরাদের আড্ডা বসে। জোর আড্ডা বসে বিশেষ বিশেষ সময়ে। যেমন দোলের আগে, পুজোর সময়, দেওয়ালি আর পিকনিকের আগে। সীতারামের দোকানটা পেরিয়েই বাঁদিকে বাঁকের মুখে মালিনীর বাড়ি। সীতারামের দোকানের পাশে এই পাড়ার সবচেয়ে ধনী পরিবারের বাড়ি ‘রাধাকুঞ্জ’,  ওদিক  থেকেই হল্লাটা আসছে মনে হল। এখানকার বাড়িগুলোর সব এমনিই নাম। ‘ইন্দু-কিরণ’,’বনলতা’, স্নেহকুটির’ এমনি সব আরও কত কি। অবাঙ্গালী পরিবেশে যতটা বাঙ্গালীয়ানা বজায় রাখা যায় আর কি! পূর্বপুরুষেরা কবে জীবিকার তাগিদে এখানে এসেছিলেন, মিলমিশ হয়ে অনেক কিছুতেই শুধু বাড়িগুলোর নামেই রয়ে গেছে বাঙ্গালীয়ানা। ‘রাধাকুঞ্জর’ সামনে আসতেই জোর হল্লার আওয়াজ কানে এলো। মালিনী বুঝল, আজ খুব জোর দুর্গাপুজোর মিটিং শুরু হয়েছে, কাল ভোরে মহালয়া।
প্রভাদির বাড়ি থেকে ফিরছিল মালিনী। পরশু স্কুলে একটা মিটিং আছে। প্রভাদি এখানকার মেয়ে ইস্কুলের হেড দিদিমনি। বছরখানেক হল মালিনী ঐ স্কুলে দিদিমনি হয়ে ঢুকেছে। আগামীকাল  বাড়িতে একটু পুজোপাঠের ব্যাপার আছে, হয়ত সময় করে উঠতে পারবে না, তাই আজ বিকেলেই ঘুরে এল। ফিরতে দেরী হয়ে গেল। খুব যে দেরি ঠিক তাও নয়। কিন্তু বিহার-বাংলার  এই মফস্বলী  জায়গায় তাড়াতাড়ি সন্ধ্যে নেমে আসে।এখনও পুজো শেষ হলনা, এর মধ্যেই  সন্ধ্যে ছটা বাজতে না বাজতেই অন্ধকার। আজ আবার আকাশ একটু মেঘলা হয়ে আছে।  আকাশের দিকে একবার মুখ তুলে চাইল মালিনী, তারপর পা চালিয়ে রাস্তাটুকু পার হয়ে মোড়ের মাথায় এসে পড়ল।
দূর থেকেই বুঝতে পারল সীতারামের দোকানের এক চিলতে বারান্দায় আজ তিল ধারণের জায়গা নেই। কে নেই ওখানে? বাপি,ঋষি,তনু, লাল্টু,বাদল, দুলু, বাটু,সীতেশ,হীরালাল এমনকি টুটুল মানে ইব্রাহিম পর্য্যন্ত! সীতারামের দোকানের আগে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা।  কা’দের যেন বাড়ি করার কথা ছিল, শেষমেশ আর হয়ে ওঠেনি। একটা প্রকান্ড বড় শিউলি গাছ আছে,অজস্র ফুল ফুটে আছে। শিউলির গন্ধে সারা রাস্তাটা ম’ম করছে। রাস্তা দিয়ে যাবার সময় গন্ধটা নাকে এসে লাগল মালিনীর। তার ভাল লাগছিল। বাঁদিকের বাঁকের মুখে এবার এসে পড়ল মালিনী। বাঁদিকের প্রথম বাড়িটাই মালিনীদের। মালিনীর বাবা ছিলেন এ তল্লাটের সবচেয়ে নামকরা ডাক্তার, আজ দুবছর হল মারা গেছেন। দাদা মারা যাওয়াও হয়ে গেল প্রায় সাত/আট বছর।  দাদা মারা গিয়েছিল মহালয়ার দিন। আগামীকাল তার মৃত্যুবার্ষিকী।
ফাঁকা জায়গায় শিউলি ফুলের গন্ধের জন্যই হোক কিংবা দাদার কথা ভাবার জন্যই হোক অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল মালিনী। ডানদিকে তাকাতেই দেখল সাইকেলে হেলান দিয়ে শুভ দাঁড়িয়ে আছে। সেও সীতারামের দোকানের দিকেই যাচ্ছে, মালিনীকে দেখে দাঁড়িয়েছে। মালিনী কাছাকাছি আসতেই জিজ্ঞাসু মুখে তাকাল।
খুব মৃদুস্বরে যেন নিজের সঙ্গে কথা বলছে এভাবে মালিনী জিজ্ঞেস করল—কখন?
-বিকেলেই...তুমি এখন?
-প্রভাদির বাড়ি গিয়েছিলাম,একটু দরকার ছিল, আমি চলি...’ তাড়াতাড়ি পা চালাল মালিনী। সীতারামের দোকানের দিকে একবার মুখ তুলে চাইল, দেখল সবাইকে। মালিনীকে দেখতে পেয়ে বাটু আর টুটুল ছুটে এল—এবার কিন্তু তোমার আলাদা চাঁদা, মিলিদি।‘
--কেন?
--বারে, চাকরি করছ না!
--বেশ, তাহলে বিজয়াটা বাদ দিস্‌!
--ইস্‌...বাদ দিলেই হল! না বোলনা কিন্তু মিলিদি, এটা আমাদের প্রেস্টিজ...প্লিজ!’
--আচ্ছা যা, দেব’ বাঁ দিকে ঘুরে গেল সে। বাড়ির ফটকে হাত দিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখল,   আলোদি দাঁড়িয়ে, হাতে একটা কাগজ।


‘এত দেরী হল তোমার, আমি কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি দিদি’...কাতর গলা শোনা গেল আলোর। আলো এবাড়ির আয়া, নার্স, রাঁধুনী, পাহাদারনি এককথায় সব। দাদা আর বাবার  মৃত্যু মা’কে একেবারে শয্যাশায়ী করে রেখেছে প্রায় এক বছর হতে চলল। সারাদিন স্কুলে থাকে মালিনী, আলো তার ডান হাত। বাড়ির সব কাজে তো বটেই!
-কেন , কি হয়েছে আলোদি’—ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল মালিনী।
--তোমাকে বলতে ভুলে গেছি দিদি, মায়ের রাত্রে খাবার আগের ওষুধ টা শেষ হয়ে গেছে। রাগ কোর না দিদি, তুমি বাইরে বেরোবার আগে বলতে এসে দেখি, তুমি বেরিয়ে গেছ।  সকালে যদি বলে রাখতাম... ইস্‌’ আপশোষের স্বর আলোর।
--দেখি, কাগজটা দাও। টাকা এনেছ?
-হ্যাঁ, এই যে নাও। দোকানে ছেলেদের কাউকে বল না দিদি,ওরা কেউ ঠিক এনে দেবে।‘
--দেখি...’ আবার পা বাড়ায় মালিনী। ফটক খুলে বাইরে এসে দোকানের কাছাকাছি দাঁড়ায় কিন্তু ঠিক কাকে ডাকবে বুঝতে পারছিল না। ওরা নিজেদের মধ্যে এতো হই-হল্লার মধ্যে রয়েছে, ওদের ডাকতেই খারাপ লাগছিল মালিনীর। নিজেই ওষুধের দোকানে চলে যাবে কিনা ভাবছিল, হঠাৎ ঋষি এদিকে তাকিয়ে তনুকে কানে কানে কিছু যেন বলতেই তনু চীৎকার করে উঠল--   কি রে, কি হয়েছে, কিছু বলবি?’
তনুই ডেকে বলল টুটূলকে, ‘এই দেখ তো কি হয়েছে, মিলি কিছু বলছে যেন!’
ছু্টে এল টুটুল। মিলি কুন্ঠিত স্বরে টুটুলের হাতে কাগজটা দিয়ে বলল—আমার একটা কাজ করে দিবি রে?’
--অমন করছ কেন, কি করতে হবে, বলো না?
-তোরা এতো নানা কাজে ব্যস্ত আছিস, আর আমি মাঝ থেকে তোদের...’ কুন্ঠিতভাবে কাজটুকু জানাল মালিনী।
--ছাড়ো তো, দাও আমাকে। তুমি ভিতরে যাও,আমি দিয়ে আসব’ বলল টুটুল।
দোকানের কাছে আসতেই শুভ জিজ্ঞেস করল- কি হয়েছে রে, সিরিয়াস কিছু?’
--কি জানি, ঠিক বুঝলাম না, একটা ওষুধ আনতে দিল। দুলুকে ইশারা করল টুটুল—তোর সাইকেলটা নিয়ে গেলাম।
-কালকেই তো মহালয়া, নারে?’ শুভকে জিজ্ঞাসা করল ঋষি। জবাবে মাথা নাড়ল শুভ।
--এবার থেকে আমাদের এই মিটিং টা অন্য জায়গায় করতে হবে,বুঝলি? কেন যে মনে থাকে না!’ মৃদুস্বরে বলল ঋষি। প্রতিবারই ওদের মনে হয় কথাটা, কিন্তু কেন জানা নেই হয়ে ওঠে না। তারুণ্যের কি এটাই স্বভাব! অথচ, রণেনের মৃত্যু তো ওদের মনে না থাকার কথা নয়। মালিনীদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে শুভ।
টুটুল মালিনীদের বাড়ির বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিছু কথা বলছে মালিনীর সঙ্গে। হাতের প্যাকেট মত কিছু একটা টুটুলের হাত থেকে আলো নিয়ে দুজনে ভিতরে গেল। টুটুল ফিরে আসছে। এসে দেখল বাপিদার হাতে অনেকগুলো চায়ের ভাঁড় আর দুলু সকলকে চা ঢেলে দিচ্ছে।  দুলুর কাছ থেকে চা চেয়ে নিয়ে গরম চায়ে একটা চুমুক দিল টুটুল। 

(পরের অংশ আগাম সংখ্যায় )