গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ২০ মার্চ, ২০১৭

দেবাশিস কোনার

বৃত্ত

চড়াইভাষ

মেজমায়ের পায়ের তলায় পরে কাতরাচ্ছে হারামজাদাটা । হারামজাদা বলে হারামজাদা ! যদি তার ওপরে কিছু থাকে , তাহলে ওকে সেটাই বলা উচিত ।কিন্তু সেটা কি আর বলা যায় বেনিমাধবকে ? হাজারহোক সে হল গে আমার ভগ্নিপতি । কে এই বেনিমাধব ? আর ওই বেটা কি করে আমার ভগ্নিপতি হল ? সে ইতিহাস বিলক্ষণ বলব । না বললে যে কাহিনী বুনতে পারা যাবে না । সেই ঘটনা বলবার আগে একটু মুখপাত বর্ননা করে ফেলি । আভাষ আর কি ! আমি নাম দিয়েছি চড়াইভাষ ।চড়াই পাখি ক্ষুদ্র । তার অভাষ।
    বেনি এক অদ্ভুত মানুষ । আমাদের পাশের গাঁয়ে বাস । ছেলেবেলায় বাবা মাকে হারিয়ে এক ভাসমান জীবন । নিজে রাঁধে নিজে খায় সময় পেলে হরিনাম গায় । হ্যা, আমি একফোঁটা মিথ্যে বলছিনা । কি করবে ছেলেটা । বিস্তর সময় ওর হাতে ।গা-গঞ্জে সকলে মিলে খোল কত্তাল বাজিয়ে হরিনাম গাইবার নিয়ম আছে । তো বেনি সেই সব করে বেড়াত । হেন নেশার বস্তু নেই যে , ওই বেটা করে নি । এখনও করে । আর করে বলেই মেজ মা আজ ওকে হাতে নাতে ধরেছে ।
       আমার মেজ জ্যাঠমশাইয়ের ওই একটিই কন্যা । নীলিমা আমার বোন । শোনা কথা যে বিয়ের পরেও নাকি আমার মেজমা এবং মেজবাবার বহুদিন কোনও সন্তান হয় নি । অনেক সাধ্যি সাধনা করে তবেই নাকি এই নীলিমার জন্ম । কিন্তু সে খোঁড়া । কেউ নীলিমাকে বিয়ে করতে চায় নি । শেষে এই অখোদ্যে অবোদ্যে বেনিমাধব । নীলিমা আর বেণীমাধব এখন আমাদের শরিক । তাই আমার ওদের ওপর প্রচন্ড হিংসা ।
     

তলে তলে কত জলে

 আমি আগেই বলেছি ওই বেটা বেনির ওপর আমি এবং আমার শরিক অন্য ভাই বোনদের ভীষণ রাগ । রাগের কারন আর কিছুই না , বেটা ভ্যাগাবন্ড । দুদিন আগেও এদিক সেদিক ঘুরে হরিনাম গেয়ে বেড়াত । সে কিনা আমাদের ভাগিদার ? বেটাকে বিপদে ফেলার জন্য আমরা তক্কে তক্কে থাকতাম । এত টুকু খুঁত পেলেই টুক করে এসে মেজমাকে নালিশ করতাম ।
       আমাদের একটা বিরাট দীঘি আছে । বাড়ির কাছেই । সেখানে গাছপালা প্রচুর । বাগান যেমন হয় ।সেখানে গেলে মনটা কেমন যেন উদাস উদাস হয়ে যায় । হিংসা,বিদ্বেষ,লড়াই,ঝগড়া , মারামারি,কাটাকাটি - এসব মনেই থাকে না । আমরা অবসর পেলেই সেখানে যাই । কোনও কাজ না থাকলেও যাই । গিয়ে চারদিকটা ঘুরে বেড়াই । মনে মনে গুন গুন করে গান গাই । গাছের ভিড়ের ভিতর থেকে নীল আকাশটাকে প্রাণ ভরে দেখি । সবুজ পাতার ফাঁক গলে আসা রোদের ছটা দেখি । দেখতে যে কি ভাল লাগে , তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না । মোট কথা আমাদের বাড়ির সকলে সময় পেলেই একবার না একবার সেখানে দৌড়ে যায় । তো আমিও গেলাম । গিয়ে দেখি সে এক মহা কান্ড । মেজমা ঘামটি মেরে একটা চারা তাল গাছের নিচে বসে কি যেন লক্ষ্য করছেন । আমাকে দেখতে পেয়ে ইশারায় চুপ করতে বললেন । আমি স্পিকটি নট হয়ে মেজমার দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখি কি , সে এক মহাকান্ড । বাঁশবাগানে একদল যুবক বসে কলকে ধরিয়ে গঞ্জিকা সেবন করছে । আর আমার ভগ্নিপতি বেনি সেই দলের মধ্যমনি ।
              আমাদের ভাইরা মিলে বেটাকে পাকড়াও করে নিয়ে এলাম বাড়িতে ।বিচার হবে তার।খুব মজার ব্যাপার । বেটা শয়তান একটা । শশুরবাড়ির ভাত খেয়ে আবার নেশা করা । ছা , নির্লজ্জ্ব , বেহায়া কোথাকারআদতে বেনি আমার একসময়ের ঘনিষ্ট বন্ধু । সেই প্রাইমারি স্কুলের ক্লাশ ওয়ান টুর সময়ের । তারপর ও পিছিয়ে পড়তে পড়তে কবে যে আমার বন্ধু থেকে শত্রু হয়ে গেল তা নিজেই জানি না । আমার যে একটু আধটু দরদ হচ্ছে না, তা নয় । তার ওপরে ওই বোন নীলিমাকে নিয়ে হয়েছে মুশকিল । সে একেবারে পরম পতিব্রতা নারী । স্বামী শত অপরাধ করলেও সে ওর পক্ষে । বিচার চলাকালীন সে এসে বলল , মা , ওকে ছেড়ে দাও !
      ব্যাস ! বিচারের দফারফা ! একটা দারুন সুযোগ মাঠে মারা গেল ।আমিও বুঝলাম মেজমার এসব লোক দেখানো কীর্তন । এসবের মধ্যে আমি আর থাকবো না । ফালতু ঝুটঝামেলা না করে শান্তিপূর্ণ সহবস্থান করাটাই শ্রেয় ।
    
প্লাবনের রাজকার্য

        আমার মেজবাবা নীলিমা আর বেনির বিয়েটা দিয়ে গিয়েছিলেন । বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই তিনি দেহ রাখেন । আমাদের পরিবার সহ এই এলাকার সকলেরই ধারণা , এই অপগন্ড জামাইয়ের কু- কীর্তি দেখেই তিনি নাকি হৃদয়তান্ত্রিক হাহাকারে দেহ রাখতে বাধ্য হয়েছেন । বেনির গুণের তো শেষ নেই । তিন ময়ের নেশা তো আছেই । তার ওপর জুয়ার নেশা । তলে তলে তার পিতৃ প্রদত্ত থুড়ি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সমস্ত সম্পত্তি ইতিমধ্যেই বিক্রি করে দিয়েছে বেনি । এখন আমাদের শরিকী সম্পত্তিতে হাত দিতে চায় । মেজমা যদ্দিন বেঁচে আছেন , তদ্দিন খুব একটা সুবিধা হবে না ।
        রসে বসে ভালই দিন কেটে যাচ্ছিল বেনির । নীলিমা সব কিছু দেখে শুনেও মুখ বুজে থাকছিল ।আমাদের দীঘির পাড়ে আর কখনও ভুলেও বেটা বেনি গাঁজার আড্ডা বসায় নি । তা না করলেও , সে যে নিয়মিত নেশা করে সেটা আমরা সকলেই অবগত । কিন্তু কিছুতেই বেটাকে বাগে আনা যাচ্ছে না । ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে সে বেশি আনন্দ পায় । শ্মশানযাত্রীদের দলে তার নামটি সকলের আগে উচ্চারিত হয় । এহেন যুবক আমাদের পরিবারের সদস্য - এটা ভাবতেই অনেকের গায়ে জ্বর আসে । আমারও যে আসে না , তা নয় !
     আকাশে ঘন মেঘের ঘনঘটা । আর আমার বোনের মুখে তার ছায়া । নীলিমা তার সুখ দুঃখের কথা আমাকেই জানায় । আর কোনো ভাই বোন তাকে পাত্তা দেয় না । সেও দেয় না । আমি ছাব্বিশ এ পা দিয়েছি । একটা চাকরি জুটলে জুটতেও পারে । কারন লেখা পরীক্ষায় পাশ করেছি । সামনে শুধু মৌখিক । নিজের ওপর বিশ্বাস আছে । ওই টুকু গাঁট পার হয়ে যাব । আমার মনটা ভীষণ বিষন্ন । প্রথমত চাকরিটা কোথায় হবে , সেটা জানি না । তারপর আমার আদরের বোনটির একটি অপদার্থ স্বামী জুটেছে । আমরা এখনও এক সংসারে আছি । কিন্তু কতদিন থাকতে পারব , তা জানি না । মেজজ্যাঠামশাই গত হবার পর পরই একটা আওয়াজ উঠেছিল পৃথক হবার । কিন্তু মেজমা রাজি হন নি । একে ওই উড়নদুরদে মানে বাউন্ডুলে জামাই । তারওপর তার স্বভাবচরিত্র মোটেই ভাল না । এই রকম সাত পাঁচ ভেবে মেজমা রাজি হন নি ।
        এই পরিবারে মেজমার কাছের মানুষ বলতে একমাত্র আমি । আর কারো সঙ্গে তার ভাব ভালোবাসা তেমন নেই । নেই বলাটা ভুল হবে । আছে , তবে সেটা সংসারের চৌহদ্দির বাইরে নয় । আমাদের বেনিমাধবের হাতে পারে রাজ্যটা যাতে একেবারে শ্মশান না হয়ে যায় সেকারনেই হয়তো সকলেই ভাগের বিষয়টা এই মুহূর্তে করতে চাইছে না ।

মধুপের কানাকানি

     আমাদের দেশে মেয়েদের কাছে স্বামী সবসময় দেবতা । আমার বোন নীলিমার আচরণের জন্যেই শুধু যে এমনটা বলছি , তা কিন্তু না । আসলে দু একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে এটাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঘটে থাকে । নীলিমা আমার থেকে বছর পাঁচেকের ছোট । আমি ওকে সেই কোন ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি ।ও চিরকালই শান্ত স্বভাবের । কিন্তু ওর গুণগুলো ঢাকা পড়ে যায় শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারনে । জন্ম থেকেই খোঁড়া । ওকে কেউ খোঁড়া বললে আমি ভীষণ রেগে যেতাম ।
         সেই নীলিমার জন্যই আমি , আমাদের অধিকারে ভাগ বসানো বেনিমাধবকে মেনে নিলাম । বেনিকে আমি আবার আমার বন্ধুর জায়গায় ফিরিয়ে আনলাম । তবুও সে কিন্তু আগের মতই রয়ে গেল । মেজমা তাকে একেবারেই সহ্য করতে পারে না । বেআক্কেলে ছেলে হিসাবে মহল্লায় বেনির নাম ছড়িয়ে পড়ল । খাওয়া পড়ার ভাবনা নেই তার । হরিনাম করে , মরা পোড়াতে যায় এখন আবার আর একটা কাজ জুটিয়েছে সে । গাঁয়ে অসুস্থ মানুষ জনকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য শহরে যাওয়ার কাজ ।
       মেজমা তো রেগে আগুন । এই অপদার্থ জামাই বাবাজী যে তার একমাত্র সন্তানটিকে কিছুতেই সুখে রখবেনা , তা তিনি বুঝে গেছেন । তবে হ্যা , সে কিন্তু নীলিমাকে কখনো আঘাত দিয়ে কথা বলে না । যতক্ষন বাড়িতে থাকে নীলিমাকে ছায়ার মত ঘিরে রাখে । কি করলে নীলিমার উপকার হবে , সেই কাজগুলি করতে চায় । এখন আমি,মেজমা এবং নীলিমা এই তিনজন নিয়ে একটি বৃত্ত তৈরি হয়েছে । আমাদের চিন্তা কেবল বেনিমাধবকে নিয়ে । ওকে কি করে সংসারী করা যায় ?

এত টুকু আশা

      সেই দীঘির বাগানটা আমাদের কাছে যেন একটা স্বপ্নপুর । আজ আমি সেখানে গেলাম একটু বে টাইমে । আমি সাধারণত খুব সকালে অথবা বিকালে যাই সেখানে । কিন্তু কেন যেন আমি গেলাম ভর্তি দুপুরে ।গিয়ে দেখি সেখানে চুপচাপ বসে আছে নীলিমা । একেবারে অন্যরকম । আমি কত কি যে ভাবলাম ? ভাবলাম হয়তো ওর মন খারাপ । কখনও ওকে নিজের ছাড়া ভাবিনি । আজও তাই ভাবি । আমাদের ওই একটিই বোন । সাতভাই চম্পা ।
     ভর্তি দুপুর । কিন্তু এ এক অদ্ভুত পরিবেশ । এখানে রোদ প্রবেশ করে না । পাখির কলতানে নিঃশব্দ পরিবেশটা আরো যেন মধুময় হয়ে ওঠে । ওকে দেখে আমার কেন জানি মনে হল রামায়ণের সীতা অশোক বনে বনবাসে রয়েছে । ওর মানসিক কষ্টটা আমাকেও পীড়িত করে । অথচ এই সমস্যাটা খুব সহজেই এড়ানো যেত । বিয়ে না হলে কি একটা মেয়ে বাঁচতে পারে না ? আর এই যেটা হয়েছে নীলিমার সাথে , এটা তো বেঁচে মরার সমান ।
      আমার বুকটা ফেটে গেল দুঃখে ।জানোয়ারটা প্রতিদিন নেশা করে ঘরে ফেরে । কোথায় না কোথায় পরে থাকে ! কিন্তু খাবার সময়ে এসে ঠিক গিলে যাবে । আমি যেন অহল্যার ধ্যান ভাঙালাম । এক চিলতে রোদ এসে পড়েছে গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে ঠিক নীলিমার মুখে । পা টা যদি না পোলিয়তে আক্রান্ত হয়ে এমন লিকলিকে হত তাহলে আমার এই বোনটিকে কে না পচ্ছন্দ করত । কিন্তু যা হবার নয় , তা কি হয় ?
   
অহল্যার ঘুম ভাঙা

    আকাশে প্রবল মেঘ এখন । বুঝি বৃষ্টি নামতে আর দেরি নেই । চারদিকে সাজো সাজো রব । ঝড়ের পূর্বাভাষ । পাখিরা চঞ্চল হয়ে উঠল হটাৎ করে ।  এটা কি অসময়ের বৃষ্টি ? অসময়ের কেন হতে যাবে ? কতদিন বৃষ্টি হয় নি একটানা । একটু হোক না , ক্ষতি কি ? ধরিত্রী শীতল হোক ! কিন্তু নীলিমা যে উদাস হয়ে বসে আছে । আমি আর দেরি করলাম না । ওর কাঁধে হাত রাখলাম । আমাকে দেখে এক টুকরো কাষ্ঠ হাসি হাসল ।তারপর সচকিত হয়ে বলল, "এ মা ! আমি বসে আছি । মেজদা , তুই বোস !
    আমাদের এই দীঘির পারে কাঠের গুড়ি কেটে একটি বসবার জায়গা করা আছে । যেটা করেছিলেন আমার মেজজ্যাঠামশাই ।তো আমার সোহাগী বোন , সেই আসন খানি আমাকে ছেড়ে দিতে চায় । অথচ ওর দাঁড়াবার ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত নেই । এই হল গে সম্মান । আমি আহা হা হা করে ওকে নিরস্ত করলাম । বললাম , তুই কি পাগলী ? তারপর বসলাম ওর পায়ের কাছে ঘাসের ওপর ।
       আমি  বসব নীলিমার পায়ের কাছে আর ও তা মানবে ? মোটেই না । হিঁচড়ে সে নেমে এসে আমার পাশে ঘাসে এসে বসল । ঝড় বৃষ্টিটা একটু থমকে গেছে । মনে হয় আজ আর হবে না । অথবা অন্য কোথাও হয়ে গেল । আমি ভাবছি আমার এই অসহায় বোনটির ভাগ্যের পরিহাসের কথা । গতকালই পালিত হল আন্তর্জাতিক নারী দিবস । অথচ তাদের হাল কি নাই খারাপ । বিশেষ করে নীলিমাকে শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারনে নারীর পক্ষে যা চরম অপমানকর , সেটাই সহ্য করতে হয় ।
           আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম , তুই কি চাস ?
     কি চাই মানে ? যেন আমি অদ্ভুত কোনো কথা জিজ্ঞাসা করেছি ।
     আমি আরো স্পষ্ট করে বললাম , বেনি সম্পর্কে তুই ঠিক কি ভাবছিস ?
      কি ভাবছি মানে ? ও আমার স্বামী । স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক জন্ম জন্মান্তরের ।
     দ্যাখ , আমার না তোর এই সব কথাবার্তা একদম ভাল লাগে না ।তুই কি সোজা কথা বলতে পারিস না ?
      আমি তো সোজা কথাই বলছি ।
      আমি বললাম, তুই আগে কিন্তু এমন ছিলিস না ।
     বিয়ের পর নারী পুরুষ সকলেই বদলে যায় । আমি সাধারণ এক প্রতিবন্ধী মেয়ে , বদলাব না ?
   আমি বুঝলাম এভাবে নীলিমার সাথে কথা বলে কোনো লাভ নেই । গাছে একটা বউ কথা কও পাখি ডেকে উঠল । আমাদের নীলিমা আগে এত সব কথা জানত না ।বউয়ের মুখে যেন কথা ফুটেছে । আবার আকাশে মেঘের গর্জন শুরু হয়েছে । ঝড় বৃষ্টি না হয়ে থামবে না দেখছি ।
  
প্রকাশ্যে অর্ধেক আকাশ

       আমি কিছু বোঝাবার আগেই প্রবল ঝড় শুরু হয়ে গেল । সাথে বিদ্যুতের ঝলকানি আর এলোপাথাড়ি বৃষ্টির ফোঁটা । আকাশটাই কি এমন করে নীলিমার মনের তোলপাড়ের কথা জানান দিচ্ছে ? আমরা কোনোক্রমে দীঘির পাড়ে আমাদেরই বানানো একটি কুঁড়ে ঘরে আশ্রয় নিলাম । এই ঘরটি বানানো হয়েছে আমাদের স্বার্থে । এখানে কৃষি যন্ত্রপাতি , মাছের খাবার , মাছ ধরবার জাল , বিছানা- পত্র , ইত্যাদি ইত্যাদি রাখা থাকে । এই ঘরের চাবি একটি গোপন স্থানে রাখা থাকে । আমি সেটা জানি ।তাই এই প্রবল বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে আমি সেই ঘরটি খুলে ফেললাম ।
     এই বৃষ্টিতে ভিজে মাটি , তাই নীলিমা হাটতে পারলো না ।আমি তাকে পাঁজাকোলা করে ওই ঘরে আনলাম । বাইরে প্রবল ঝড়ো হাওয়ার শব্দ । ভিতরে নীরবতা । আমি নীলিমার ওপর বিরক্ত ।তাই সেই প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করল ।বলল, মেজদা জানিস ওর নিজের যা কিছু ছিল সবই বিক্রি করে দিয়েছে ।সে  খবর তো বহুদিন ধরেই পাচ্ছিলাম আমরা । তবু আমি চুপ করে থাকলাম । কারন নীলিমা মুখে কখনও কিছু বলে না । আজ মুখ খুলেছে যখন , তখন ও বলুক !
       নীলিমা বলল , দেখ মেজদা , ও ঠিক একদিন ভাল হয়ে যাবে । ওই আকাশের নীল শূন্যের মত ওর মনটা পরিষ্কার । আমাকে ও কখনো আঘাত দিয়ে কথা বলেনি । ও হয়তো নেশাভাঙ করে , কিন্তু আমাকে ভালোবাসে ।তুমি দেখ , ও ঠিক বদলে যাবে । আমি ওকে বদলে দেব !
    আমি মনে মনে বললাম , তাই যেন হয় । কিন্তু যে ছেলে বাউন্ডুলে  আর যে নেশা করে , সে কি করে সংসারী হবে ? নীলিমা যা চায় , আমি তাকে কি করে অগ্রাহ্য করি ? আমি চুপ করে ওর বলা কথা গুলো বোঝাবার চেষ্টা করে গেলাম ।
    জানিনা বাইরে এখন কি হচ্ছে ? আমার মনের মধ্যে একটা প্রবল আলোড়ন চলছে । আমি দোটানায় । বউ কথা কও পাখিটা কি আমাদের বাগানেই আছে ? না কি তার বাসাটা এই প্রবল ঝরে ভেঙে গেল ? আমি জানি যত ঝড় বৃষ্টিই হোক , ওরা ঠিক আবার গড়ে তুলবে ওদের বাসা । ওরা এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম বেঁচে আছে । ওদের এই লড়াইটাই তো আসল বেঁচে থাকার লড়াই ।
     নীলিমা আবেগঘন কন্ঠে স্বপ্ন বুনতে থাকে । সে বলে , ও ভাল গান গাইতে পারে । যে কোনো গান একবার শুনলেই ওর মুখস্ত হয়ে যায় । আমাকে কতবার শুনিয়েছে । জান , মেজদা ওর গলাটা না একেবারে হেমন্তের মত । বাইরে ঝড়টা থেমে গেল । বৃষ্টির তোরটাও কমেছে । আমার বনের আশার বাণী আমার মনের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে । পৃথিবীতে অনেক কিছুই তো বদলায় । প্রকৃতি এক এক ঋতুতে এক এক রূপ ধারণ করে । আর নীলিমার সামান্য এই চাওয়াটুকু পূরণ হবে না । নিশ্চয়ই হবে ।
   এসময়ে বাইরে কারো পায়ের শব্দ । আমি মুখ বাড়িয়ে দেখি মূর্তিমান বেণীমাধব । কিছু বলব না বলব না করেও বলে ফেললাম , তুমি এত অমানুষ কেন ? আমার বোনটা তোমাকে কত ভালোবাসে বুঝতে পারো না ?
   সে বেটা আমার কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠল , আমিও কি কম ভালোবাসি ?
  তারপর নীলিমাকে কোলে তুলে নিয়ে বলে উঠল , মেজদা , তাড়াতাড়ি চলে এসো ! বৃষ্টিটা ধরেছে !