গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৭

মৌসুমী ঘোষ দাস

  বিন্দুর স্বপ্ন

            
 আজ এতদিন পর বিন্দুর ছেলেবেলাকার স্বপ্ন পূর্ণ হল! বিরাট মঞ্চে বসে, প্রেক্ষাগৃহ ভর্তি শ্রোতামণ্ডলীর সামনে চোখ বুজে আবিষ্ট হয়ে একটার পর একটা রবিঠাকুরের গান গেয়ে চলেছে। গাওয়া শেষ হতে চোখ খুলে দেখে মুগ্ধ শ্রোতাগণ উঠে দাঁড়িয়ে করতালির মাধ্যমে তাকে অভিবাদন জানাচ্ছে। আনন্দে, আবেগে আপ্লুত বিন্দুর চোখে জল এসে গেল! এই দিনটির স্বপ্নই তো এতকাল দেখে এসেছে!

                    বিন্দুদের বাড়িতে বাবার খবর শোনার  জন্য একটা ছোট রেডিও ছিল। সেই রেডিওতে প্রতি রবিবার দুপুরে অনুরোধের আসর হত। কিশোরী বিন্দু রেডিওতে কান লাগিয়ে একটার পর একটা গান শুনতো আর গলায় তুলতো। ছোট থেকেই এত নিখুঁত সুর লাগাতো যে সবাই অবাক হয়ে বলতো মেয়েটাকে গান শেখান দেব বাবু।
কিন্তু বিন্দুর রাশভারী বাবা মনে করতেন, একটা নির্দিষ্ট বয়সের আগে লেখাপড়া ছাড়া অন্য কিছু করা মানেই উচ্ছন্নে যাওয়া। গান শিখলে শিখতে হবে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর। উচ্চমাধ্যমিকের পর বাবার ঠিক করে দেওয়া পাড়ার এক দিদিমনির কাছে ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে সারেগামা শিখতে গেল বিন্দু। কিন্তু সেকেন্ড ইয়ার পড়তে পড়তেই বিয়ে হয়ে গেল তিমিরের সাথে। গান শেখার সমাপ্তি ঘটল।
স্বামীটিও পিতার সমগোত্রীয়। মেয়েরা গান শেখে বিয়ে হওয়ার জন্য। বিয়েই যখন হয়ে গেছে, তখন আবার গান শেখার কি প্রয়োজন? এখন মন দিয়ে সংসার করবে। অবশ্য বাড়িতে পূজা পার্বণে বা আত্মীয় স্বজনদের সামনে দু একটা খালি গলায় গান গাইবার পারমিশন দিয়েছে তিমির। কারণ, তাতে বাইরের লোকের সামনে স্বামীর মান বাড়ে! তবে তিমিরের আত্মীয়দের সামনে কোনোদিনই গান গাইবার প্রবৃত্তি হয়নি বিন্দুর। কেবল একলা ঘরেই গলা ছেড়ে গান গাইত সে।
তারপর মেয়েকে গানের স্কুলে নিয়ে যেতে যেতে শুনে শুনে সব গান গলায় তুলে ফেলেছিল। নিজের শেখার ইচ্ছা প্রকাশ করাতে তিমির স্পষ্ট জানিয়েছিল, “এই বয়সে আদিখ্যেতা করার জন্য এক্সট্রা খরচ করতে পারবে না! বিন্দু রোজগার করলে পয়সার মর্ম কিছুটা বুঝতে পারতো”  কিছুদিন আগে বাবা মারা যাওয়ার সময় কিছু টাকা বিন্দুর নামে ব্যাংকে রেখে গিয়েছিলেন। সেই টাকার ইন্টারেস্টটা এখন মাসে মাসে নিজের হাতখরচ বাবদ তোলে বিন্দু। সে টাকা দিয়েই কিছুদিন হল গান শিখছে গুরুজির কাছে। তাতেও তিমিরের গা জ্বলে। বাইরের লোকজনের সামনে বিন্দুকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, “এতদিন সংসার করে এখন এই বয়সে বাড়ির বউ কেমন বাহির মুখি হয়ে উঠেছে দেখুন। এইজন্যই মেয়েছেলেদের হাতে টাকা দিতে নেই! বাপটা তো গেল! মেয়ের বারোটা বাজিয়ে গেল!
নিম্ন রুচির তিমিরের কথাগুলো শুনতে বিষের মত লাগে! কোনোদিন হাতখরচ চেয়ে পায়নি স্বামীর কাছে। বলে, খাচ্ছো দাচ্ছো, কোন জিনিসটার অভাব আছে যে আবার হাত খরচ লাগবে? যেন দুবেলা খাওয়ার পরিবর্তে বাড়ির একখানা বাদী সে। তার নিজের কোন ইচ্ছে থাকতে নেই। যা হাতে তুলে দেবে তাই পরতে হবে। বাজার করে এনে যা বলে দেবে সেটাই রান্না করতে হবে।
তা বিন্দু এখন একটু সাহস করেই ইন্টারেস্টের টাকা দিয়ে মেয়ের সাথে গুরুজির কাছে গান শেখে। রান্নাবান্না, ঘরের কাজ সেরে যে সময়টুকু পায় গান করে তখন। তাই আজ প্রেক্ষাগৃহ ভর্তি এত লোকের করতালিতে বিন্দু আবেগে আপ্লুত। চোখ ভরা জল নিয়ে সে সকলের অভিবাদন গ্রহণ করছে।
-“কি ব্যাপার! তখন থেকে ডেকেই চলেছি, কোন সাড়া দিচ্ছো না যে! সারাদিন কেবল গান, খাওয়া, ঘুম এই নিয়েই আছো, আর আমি খেটে মরছি। যে সংসারের মেয়েছেলে কেবল খায় আর ঘুমায় সে সংসার তো রসাতলে যাবেই। বিকেল পাঁচটা বেজে গেল,এখনো এক কাপ চা পেলাম না!
হঠাৎ বিন্দুর ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। কোথায় মঞ্চ? আর কোথায়ই বা প্রেক্ষাগৃহ ভর্তি লোক? সামনে তিমির দাঁত মুখ খিঁচিয়ে দাঁড়িয়ে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বিকেল সওয়া পাঁচটা বাজে। ধড়মড় করে উঠে বসলো। আজ রবিবার। তার মধ্যে সকাল থেকে খাটুনিটা খুব হয়েছে। তারপর খাওয়া দাওয়া সেরে বিছানায় একটু গা এলিয়ে দিতেই কি মরণ ঘুম যে পেয়ে বসেছিল। এত বেলা হয়ে গেল তবু টেরটি পায় নি। লজ্জিত হয়ে উঠে খোলা চুলটা ঘাড়ের কাছে হাত খোঁপা করে নিচে নেমে এল।
নিচেই সব ঘর। শুধু দোতলায় একটি মাত্র ছোট ঘর। সেই ঘরে বিন্দুর অবসর কাটে সঙ্গীত চর্চায়। আর দুপুরে মাঝে মধ্যে একটু বিশ্রাম নেয়। নিচে রান্নাঘরে এসে চা বসাল বিন্দু।                                                                                              দুটো কপোত কপোতী রান্নাঘরের জানলার কাছে আদরে মেতেছে। আনমনে তাদের দেখতে দেখতে প্রার্থনা করলো পরের জন্মে যেন এমন পাখি অথবা কোন পতঙ্গ হয়ে জন্মায়। এই ঘৃণ্য মনুষ্য জন্ম আর চায় না সে। কিছুই ভাল লাগছে না। অত সুন্দর একটা স্বপ্নের পর তিমিরের অমন কটু কথা মনটা তেতো করে দিল।
আচ্ছা, একদিন কি তিমির নিজে চা করতে পারে না? তাতে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হবে? বিন্দু চাকরি করে না বলে কি বাড়িতে শুয়ে বসে থাকে? নাকি সারাদিন গান করে? চারবেলা ভালমন্দ বানিয়ে মুখের কাছে কে ধরে তবে? তিমির তো নড়েও না। যেখানে বসে থাকে সেখানেই খাবারটা এগিয়ে দিতে হয়। জলটাও গড়িয়ে খায় না। আবার খাওয়া হয়ে গেলে এঁটো বাসনটা এনে যথাস্থানে রাখে না। বিন্দুকেই তুলে আনতে হয়। জলের বোতলটাও যে নিয়ে খায় না,সে কেন এভাবে কথা শোনায়?
এত বছর তো তিমিরের অনুগত হয়েই কাটালো। তিমিরের ইচ্ছের বিরুদ্ধে একটি কাজও করেনি। নিজের সব ইচ্ছে দমন করেছে তিমিরের একতরফা জেদের কাছে। কিন্তু কি পেয়েছে? একদিনের জন্যও কি তিমির বিন্দুর একটিমাত্র প্রশংসা করেছে? একটিও না। কেবল খুঁত ধরেছে। বাকি জীবনটাও কি এভাবে কাটতে হবে বিন্দুকে? কেন?
না! আর না। অনেক বয়স হল। এবার একটু নিজের মত বাঁচতে হবে। যতটা সম্ভব সংসারের জন্য করবো। কিন্তু নিজের ইচ্ছেকে জলাঞ্জলি দিয়ে আর নয়” - মনে মনে বলল বিন্দু। চা করে ডাইনিং টেবিলে চাটা রেখে তিমিরকে ডাকলো। তিমির সামনের ঘরে সোফায় বসে পেপার পড়ছিল। সেখান থেকেই বলল, “চোখের মাথা খেয়েছো নাকি? দেখছো না পেপার পড়ছি। এখানে দিয়ে যাও
বিন্দু চা টা টেবিলে রেখেই ধীর পায়ে এগিয়ে গেল তিমিরের ঘরে। খুব শান্ত ও দৃঢ় কণ্ঠে চোখে চোখ রেখে বলল, “আজ থেকে চা, জলখাবার, লাঞ্চ, ডিনার সব ডাইনিং টেবিলেই সারতে হবে। অন্য ঘরে এগিয়ে দিতে পারবো না। আর আমি যখন রেওয়াজ করবো তখন তোমার খাবারটা নিজে নিয়ে খাবে। টেবিলে গোছানো থাকবে সব।
আর শোন,আমি সারাদিন খাওয়া,ঘুম আর গান করে কাটালে চারবেলা সময় মত তোমার মুখে খাবারটা জুটতো না।  তোমার আত্মীয় স্বজনদের ঠিকমত আদর যত্নও হত না। রান্না ছাড়াও সংসারে অনেক কাজ থাকে। সব কাজ সেরে সবার মন জুগিয়ে তারপর নিজের জন্য একটু সময় বের করে গান করি। তাতেও তোমার আপত্তি? এখন থেকে আর নয়। যতটা সম্ভব করবো, তবে নিজের ইচ্ছে বা একান্ত সময়টুকু বিসর্জন দিয়ে নয়। তুমি লোকের কাছে আমার নিন্দে করবে তো? যত খুশি কোরো। এবার থেকে আমি আর পরোয়া করবো না। এই বলে বিন্দু শান্ত পায়ে সেই ঘর ত্যাগ করলো। তিমির চিৎকার করে অনেক কথা বলতে লাগল। কিন্তু বিন্দুর কানে সেসব কিছুই পৌঁছাল না। কেবল গুরুজির একটা কথাই কানে বাজছে এখন, “বেটি, তুই তো একটা কোহিনূর! তোর মধ্যে অনেক সম্ভাবনা আছে! ঘষে মেজে আরও ঝকঝকে হয়ে উঠতে হবে তোকে। শুধু সেইটা করে যা”! হ্যাঁ,বিন্দু এখন থেকে সেটাই মন দিয়ে করবে।