গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৭

জয়িতা ভট্টাচার্য

মা 
 
আমিনা রাত ভালোবাসে। দুধের ছানাটা ঘুমিয়ে গেলে পা টিপে টিপে বেরিয়ে আসে।তাও কি নিস্তার আ়ছে !দালান কো়ঠায় মরদ শুয়ে আঁচলে টান পড়ে শক্ত কেজো হাত ঘোরে আনাচ কানাচ। কঠিন লিঙ্গ প্রবেশ করে শায়া সড়িয়ে।কাঠ হয়ে থাকে আমিনা।পাশের ঘরে বুড়ো শউড়,উ়ঠোনে বাঁধা বলদ।আর পারেনা আমিনা।ছ,ছটা বাচ্ছা বিয়োনো শরীর।দুটো মরেছে সাপে কেটে আর জলে ডুবে। শরীর ঘেঁটে ঘুমিয়ে পড়ে আজগর। ঠিকে মিস্তিরি। আমিনা রাত ভালোবাসে।গাছ আর পুকুর ঘেরা বাদা়য় ঘুরে বেড়ায়। পা়য়ের ওপর সাপ চলে যায়, অন্ধকারে জাগে তার শরীর একা। কাপড় আল্গা করে,আদর করে নিজেকে। শির্ শির্ হাওয়া দেয়। পুকুর ঘাটে বসে থাকে আনমনে।যেন নিশির ডাক.........
ভোরের আজান শুরু হতে না হতে দিন শুরু হয় আমিনার। আসলে তো রাত।মন ঘুমিয়ে থাকে সারাদিন। কোলের ছেলেটাকে বুকের দুধ দিয়ে উঠে পড়ে হাড় জির্ জিরে, আধপেটা খাওয়া শরীরে চিমসে যাওয়া স্তন।কতটুকুই বা দু়ধ আছে তাই টানাটানি করে চোষে নবাব। হাসি পায় আমিনার।শউর হারামি আর নাম পেলোনা ছোটা রে আদর করে নাম রেখেছে নবাব।  কুয়োতলায় বসে এঁটো বাসন মাজে,শশুরের লুঙ্গি,বরের জা়ঙ্গিয়া,একরাশ মুতের কাঁথা কাচে আমিনা আর জসিমুদ্দিনের সাথে বক্ বক করতে থাকে তার আব্বা বিয়ের সময় সাথে দিয়েছিলো।খাসা বলদ। সব শোনে আর ঘার নাড়ে এই একজন বোঝে তার ব্যাথা। 
শউর তার ছাতা সারায় শহরে।কাঁসি করে বেড়ে দেয় পান্তা ভাত নুন পেঁয়াজ উঠোনের লঙ্কা গাছের কচি একটা। বর মুিড় পেঁয়াজ খেয়ে বেড়িয়ে যায়।আমিনা জানে কন্দক্পুরের সাজিদা বিবির ঘরে দুপুর কাটায় আজগর্ প্রমাদ গোনে কবে বিয়া করে আনে! ওর গতর আছে। দুপুরে আজগর মাংস খায় ওখানে।সে কাজের শেষে ,গুষ্টির আপদগুলোকে খাওয়ায়।পরে থাকলে দুটি বাসি ভাত খায়।এখন বাজার খারাপ।আয় -প়য় নেই আজগরের।
ক্ষিদের চোটে তারস্বরে চেঁচায় ওরা।রাগের চোটে 'ঘা বসিয়ে দিয়ে শান্তি। ওদের কান্না থামে ,তার চোখে বন্যা নামে। বাপের ঘর গাজীপুর। যায়না অভিমানে ১০বছর। বুড়ো বয়সে আব্বু তৃতীয় বার মেহ্ নাজ্ , তারই বান্ধবীকে বিয়ে করার পর থেকে। আম্মি মরে গেছিলো তার বয়স দশ,তার ছোটো আম্মি খারাপ নয়,১০ ক্লাস অবধি পড়িয়েছে একগন্ডা ছেলের মাঝেও। 
প্রথম রাতে আজগর যখন তার ১৫ বছরের শরীলটা ক্ষত বিক্ষত করে দিচ্ছিলো,বিছানাটা রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছিলো দাঁতে দাঁত চেপে নারী জনম সার্থক হলো তার এমন ভেবেছিলো।
নির্জন দুপুরে ,ছায়া ছায়া, রাবেয়া আর ছোট্ট সাবি তার ঔরস।তাকে ছেড়ে থাকতে পারেনা যে......তাই অপেক্ষা করে রাতের। রাত হলে যদি আসে !
আমিনা ফুঁপিয়ে কাঁদে।বাদার নিস্ত ব্ধতা টুকরো টুকরো গোঙানিতে ভরে ওঠে।খুব মার খেয়েছে আজ স্বামি শ্বশুড়ের কাছে।এখান ওখান রক্তাক্ত। ঠোঁট ফেটে রক্ত বেড়োচ্ছে। ফজল মিঞার সাধ হয়েছে হজ করার। লাখ টাকার ব্যাপার। যাবার আগে সারা গেরাম ভুরিভোজ। কোথা পাবে সে। এই এক চিলতে ঘর জমিন তার বেটা গুলোর আশ্রয়।সেটা বন্ধক দিয়ে উনি যাবেন হজ। মাতব্বর হবেন ওর পেটের ছাওলদের পথে বসিয়ে। অমন বেহেস্তের মুখে ঝাঁটা। সেই নিয়ে ঝগড়া মারধোর  সন্ধ্যায় বৃষ্টি হয়েছে। কাদা জল ভিজে পাতা কিছু চেয়ে দেখেনা আমিনা। চলতে থাকে।চলতেই থাকে।রাত বাড়ে। ভাঙা ভাঙা দুটি কবর। আমিনা আছড়ে পরে তার ওপর।অসহায় কান্নার শব্দে বনানী যেন কেঁপে ওঠে।তার রাবেয়া তার সাবি আছে ওখানে। মিষ্টি মিষ্টি দুটি মেয়ে।আল্লাহ্ ওদের ছিনিয়ে নিয়েছে মায়ের কোল থেকে।এবার কি বাকীগুলো অনাহারে মরবে পথে পড়ে পড়ে !!
একবার আব্বু এমন মেরেছিলো।ছোটোবেলায় সরকারি ইস্কুলে সরস্বতী পূজো। আমিনা বন্দনা নন্দিতা ললিতার সা়থে কিসব বলে ফুল দিয়ে অন্জলি দিয়ে খিচুড়ি প্রসাদ খেয়ে বাড়ি আসতে কি মার খেয়েছিলো। সারা গায়ে ব্যা়থা আর জ্বর। আম্মি কি কান্না সাচ্চা মুসলমানের বেটি কিনা হিঁদুর দেবতা ভোগ খেলো ! আমিনা ধর্ম বো়়ঝেনা।সে বো়ঝে ১০ মাস পেটে ধরে মানুষ করে শরীর ছেনে বেড়োনো বাচ্চাগুলোর ক়থা
সাপে কাটা নীল হয়ে যাওয়া তার রাবে়য়া, এখানে শুয়ে।জল ছেঁচে তোলা তার সাবি, আদরের সাবি,বোনের পাশে শুয়ে।তার কি শুলে চলবে?ও়়খানে যে তার পানে চেয়ে আছে পেটের শত্তুরগুলো। চোখের পানি মোছে আমিনা। তৈরী হ়য় নতুন লড়াইয়ের
আমার সঙ্গে যখন আমিনার পরিচয় হয়,সে রাতের কথা ভুলবোনা। প্রায় সন্ধ্যা বেজে গেছ্ে।আমার অফিসের সবাই চলে গেছে শুধু দারোয়ান কাম পিয়ন সুজয় রয়েছে।এমন সময় একটি রোগা জীর্ণ শাড়ি পরিহিত মেয়ে,কোলে দুহাতে দুটি শিশু নিয়ে এসে দাঁড়ালো যেন দাঁড়াবার শক্তিটুকুও তার নেই।কিছু দরকারী কাগজপত্র গুছিয়ে নিচ্ছিলাম।ইসারায় ওদের বসতে বলে সুজয় কে চা কিছু খাবার আনতে বলি।আমার সংস্থা যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করে।তাদের সুবিধে ,সমস্যা ,ঝগড়া নানাবিধ ব্যাপার দেখতে হয়। ঘরে ফেরানোর ব্যবস্থা করি বিক্রী হয়ে আসা মে়য়েদের।কাজেই অবাক হইনি।ভাবলাম তেমনই কেউ হবে। প্রথমে সে বলেছিলো তার নাম অসীমা।কিন্তু এরা সাধারনত ভুল নাম বলে তাই একটু ধমক দিতে আসল নামটি বল্লো। পরে বলেছিলো যদি মুসলমান শুনে তাড়িয়ে দি তাই এই মিথ্যে বচন।সে রাতে আমাদের হোমে পাঠানো যুক্তি-যুক্ত মনে হলোনা।অ়ভিজ্ঞ চোখ বলছিলো এর ব্যাপারটা বোধহয় অন্য কেসগুলোর মতো নয়। গাড়িতে যেতে যেতে সংক্ষেপে কিছুটা শুনলাম। আমিনা ক়থা বলার অবস্থায় ছিলোনা। তাই পরদিন বাকীটা শুনব বল্লাম।
শুনলাম কন্দকপুর থেকে দুদিন আগে শিয়ালদা স্টেশনে এসে পৌঁছয়। মাঝরাতে অন্য ভিখারীদের তাড়া খেয়ে ফুটপাথের এক কোণে পড়েছিলো। সারাদিন এঁটো কাটা যা পেয়েছিলো শিশুগুলোকে খাইয়েছে। সেদিন রাতে ফিরতে পারেনি সে জানেনা কোণ ট্রেন তার পয়সাও নেই।আকুল সে রমনী ছেড়ে এসেছে কয়েকটি অবলা কে গ্রামে একা। তার অঝোর কান্না আমার চোখে জল আনে।সে রাতে হঠাত্ এক টহলধারী পুলিশ প্রথমে তাকে লাথি মেরে তুলে দেয় তারপর তার যাবতীয় পৌরুষ দিয়ে তাকে যথেচ্ছ ভোগ করে ফেলে রেখে চলে যা়য়। 
সারাদিন ওভাবে পড়ে থাকার পর কোনো দয়ালু নাগরিক আমার অফিসে পৌঁছে দিয়ে়ছে। নিজের শহর সম্পর্কে লজ্জা়য় অবনত হই। সেরাতে নিজের বাড়িতে রাখি।প্রশ্নের পর প্রশ্ন জাগে। কন্দকপুরের আমিনাকে কেন আসতে হয় নিরন্ন বেশে। তার স্বামি আছে।সন্তান তিনটি ফেলে এসে় সারা রাত সে কাঁদে। কেন??ঠিক করি সকালে শান্ত হলে সব কথা জানবো। হিসেবটা মিলছেনা। সে রাত আমার ঘুম হ়য়না। শহরের রাত,অন্ধকার পাপে পূর্ণ পৈশাচিক রাত। কত নারীর সর্বনাশের রাত............
পুকুর ঘাটে দেখা হয় সাবিত্রী,বেস্পতি,কমলা,ময়নাদের সাথে। ওরাও আসে একই ঘাটে,বাসন মাজে,স্নান করে পাড়ার নিষিদ্ধ সব হাসি মস্করা করে। আমিনার প্রি়য় বন্ধু সবিতা। ওরা সবাই একই রকম গরিব,নিরন্ন। কিন্তু ওরা ঘর বাড়ি বন্ধক রেখে তীর্থে যায়না।বড়ো ঠাকুরের পূজো করে, বিপত্তারিনীর ব্রত করে তবু ওদের দুর্দশা কাটেনা। আমিনা ওদের বলে মনের ব্যাথা। শ্বশুড় হজে গেছে সরকার থেকেও টাকা দেছে। মোল্লা পাড়া়য় ওদের ইজ্জত বেড়েছে। আরও গরিব হয়েছে ওরা সেদিন পূর্নিমা। আজগর ঘরে ফেরেনা।তার ফুফার ছেলে ফয়জল এসে খপর করে আজগর ফের বিহা করছে কন্দকপুরের মাগীটারে। আমিনা কাঁদেনা। নামেই মরদ। কখনো আদর করেছিলো মনে পরেনা।শুধু শরীলটাকে হাচর পাচর করে ছিবড়ে করতো। বড়ো ছাওল সবুজ আর পরেরটা নাজমা বড়ো হয়েছে অজানা আশংকায় কাঁদতে থাকে। বাকীগুলো অবোধ। ঘুমিয়ে পড়ে নিশ্চিন্তে। রাত আজ তাকে হাতছানি দেয়। বন বাদারে কালো কালো ছায়া প্রেতিনীর মত তার পিছে পিছে যায়। আমিনা চোখের জল শুকিয়ে গেছে। সাবি আর রাবেয়া কে ছুঁয়ে থাকে রাতভর ভোরবেলা ফিরে জসিমুদ্দীনকে খুব আদর করে খেতে দেয় পেটভর তারপর নিয়ে যায় তার খালার বাসায়। কদিনের জন্য দিয়ে আসে। আজগর তার নতুন বউ নিয়ে ফেরে।আমিনার ঘরে নিয়ে যায়। তার স্খান বারান্দায়। তিন তালাকের হূমকি দেয় আজগর।আমিনা গ্রামের মাজারে গিয়ে মানত করে।আজগর সামান্য টাকা দেয় তার দিন চলেনা। সবিতা বলে "তুই কলকেতায় কাজ ধর। বড়ো তিনটে ইস্কুল যায়, মিড্ ডে মিল পায়। শুধু রাত টা মুড়ি দিয়ে দেয়। ভেবে চিন্তে আমিনা কলকাতায় কাজে যাওয়াই ঠিক করে। কমলা বলে মোসলমান মেয়েছেলে কে কাজ দেবেনা হিঁদু ঘরের বউরা। বলে তুই বরং বলবি তোর নাম অসীমা।সবিতা পেলাস্টিকের শা়খা পলা কিনে দেয় বলে টেরেনে উঠে পরে নিবি। বেবাক হতবম্ব আমিনা তাই ঠিক করে।

সনজিদা আসার পর সংসারটা ধীরে ধীরে তার হয়ে গেল। রাতের ক্ষিদে সে ডাগর শরীল নতুন বিবিকে নিয়ে মেটায়.....আজগর.....তাদের সশব্দ যৌনতার আওয়াজ পায় আমিনা বারান্দায় কুঁকড়ে শুয়ে চোখ জ্বালা করে।জল নয় রক্ত পড়ে যেন চোখ দিয়ে।কলিজা ফাটে।ছানাদের কান ঢাকবে না নিজের।  পাগলের মতো ঘুরে ঘুরে বেড়ায় রাতভর।পেঁচা ডাকে,বাদুরের ডানার ঝাপটা লাগে, ভিজে পাতার ভেতর বিছে,বিষাক্ত পোকারা যাতায়াত করে। আমিনাকে স্পর্শ করেনা কিছু মন বিকল শরীর আধপেটা খে়য়ে খেয়ে অবশ।সব কথা গল্প করে রাবেয়া কে। সাবিকে আদর করে। কন্দকপুরের নিশিরাত চাপা কান্না়য় গুমরে গুমরে ওঠে। আজ কমলা একমু়ঠো ভাত আর ডাল আলু ঘাটে এসে চুপিসারে ঢেলে দিয়ে যায় তার ভা়ঙা সানকিতে। ওদেরও তো ়ধম্মের ভয় আছে। কাল সবি তাকে একটুকরো মাছ দিয়েছিলো। একাদশীর চাঁদ ঢেকে যাচ্ছে মেঘে।আমিনা কাল কলকাতা যাবে কাজের খোঁজে। বুকটা দুর দুর করে।কখনো সে যায়নি বৈকুন্ঠপুরের কুপি নদীর ওপারে। রাতে তাকে যে ভাবে হোক ফিরতেই হবে রাবেয়া আর সাবির কাছে ওরা আম্মির জন্য জেগে থাকে কবরের নীচে। সবুজ আর নাজমা কে ফুফা বাড়ি পাঠিয়ে ছোটো দুটোকে ট্যাঁকে নিয়ে যাবে।  অজানা অচেনা শহরে কি অপেক্ষা করছে তার জন্য?আমিনা আর মার খাবেনা।আল্লার দোয়ায় সে কি মাথা তুলে দাঁড়াতে পাড়বে?পারবেকি সন্তানগুলোর মু়খে পেট ভরা খাবার যোগাতে?ভাবতেই থাকে আমিনা সারারাত।
আজ ২২ফাল্গুন রাতটা কাটাবো জেগে। কত রাতই তো কেটে গেলো এমন জেগে। অরিন্দম ইটালি চলে যাবার পর আমার আকাশ যে ওর সাথে। আজ আকাশের জন্মদিন। আমি লৌহ মানবী।অনূভুতিশূন্য নারী যে নিজের সন্তানকে নিজের কাছে রাখতে চায়নি ! কিন্তু, সত্যি কি চাইনি ?আমি যে মা। যৌনকর্মীদের নিয়ে আমার কাজটা যখন শুরু হয়, ত়খন থেকেই শাশুড়ি ক্রমশ আর সকলে আমাকেই বেশ্যা হিসেবে দেখতে লাগল।এমনকি অরিন্দম,বিদেশ থেকে MS করা আমার প্রেমিক স্বামিরও মনে হতে লাগল আমি কাদায় ডুবছি। কেন সমাজে আর কি দীনদুঃখী নেই। সারাদিন কালিঘাটের গলি,সোনাগাছি,বিড্ন স্ট্রীটে কাটানো বউ তার এ্যাশোসি়শনে পরিচয় দেবার মতো নয়। 
আজ আকাশের জন্মদিন। আকাশ জানেনা তার মা পায়েস রেঁধে়ছে। সংগঠনের অনাথআশ্রমের যৌনকর্মীদের সন্তানরা নতুন জামা পরেছে।কেক খেয়েছে।কিন্তু আমি সারাদিন উপবাস। মনে পড়ে তার বাবুই এর জন্য ঘুরে ঘুরে জামা কেনার কথা।মনে পরে রাত জেগে ন্যাপি পাল্টানোর কথা।রাত দেখছি আমি। চোখ ভিজিয়ে নামছে জলধারা। ১২ বাজলেই ফোন।স্কাইপে আসবে ছেলে দুটো আ়ধো বাংলায় কথা।হাসি।দুমিনিট।হাত বাড়িয়ে ওকে ছুঁতে চাই আদরে ভরিয়ে দিতে চাই অন্তর্জাল ছিঁড়ে ফেলে।
সেবার যৌনকর্মীদের আন্তর্জাতিক কনফরেন্সে যোগ দিতে জাপান যেতে হলো।ফিরে দেখলাম শূন্য সংসার আমার।তলে তলে অরিন্দম এতোটা এগিয়েছে বুঝিনি। কয়েকদিনের ম়ধ্যে ধরিয়ে দেওয়া হল ডিভোর্স পেপার। আর দেখিনি বাবুইকে।৫ বছরের বাবুই যেদিন কাঠগরায় দাঁড়ালো সমস্ত অসহায় যৌনকর্মী,ধর্ষিতা,নিরন্ন মেয়েদের চেয়ে একা মনে হল।ও বড়ো হোক।সুন্দর দেশে সুন্দর পরিবেশে,চোখের সামনে দৈনিক অশ্লিলতা বল্ধ হোক চাইলাম আমি। আজ আকাশের জন্মদিন।আমি মা।একা স্মৃতিটুকু নিয়ে।
"
দিদি আমি যা়ই তবে" --আমিনার ডাকে চমকে তাকাই।এতো রাতে যাবি? বলি।জানি যাবেই। বলি ছেলে মেয়ে দুটো ঘুমিয়ে পড়েছে থাক। আমিনা চলে যায়। মা আমি জানি কেন ছুটে যায় রাতে।সাবি আর রাবেয়ার কাছে যাবে। আমিনা পাল্টেছে। কিন্তু আজ রাত শুধু আমার। ম্যাডাম নয় দিদি নয় আজ আমি শুধুই মা।বাবুই়য়ের মা। ফোন বাজ়ছে।দিনগুলো পাল্টে যাচ্ছে।রঙ বদলে নিচ্ছে রাত। আমিনা এক মনে টান দিচ্ছে চারকোলএ।একের পর এক রে়খায় ়রেখায় ফুটে উঠছে তার, নারীর অব্যক্ত বেদনার কথা,নির্যাতনের কথা। কখনো চারকোল কখনো কোলাজ।দিদি না থাকলে প্রকাশ পেতোনা তার সৃষ্টি। কলকাতা গিয়ে তাকে পরিচারিকার কাজ করতে দেয়নি দিদি।ক্রমশ তার জীবন কথা বলেছিলো সে। শ্বশুড় বোরখাহীন ঘরের বাইরে পা রাখা বউকে তাড়িয়ে দিলো। মসজিদে বিচার হলো তার।একতরফা বিচার। এরই ভেতর একদিন দিদির ফেলে দেওয়া কাগজের টুকরোতে আনমনে আঁকিবুকি কাটছিলো। ছোটোবেলা়য় ফিরে যাচ্ছিলো মন। সেই ফেলে দেওয়া কাগজ হাতে দিদি গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলো।সে রাতে আর কথা বলেনি।পরদিন তাকে ধরিয়ে দেওয়া হলো রঙ,ক্যানভাস ,চারকোল,কাগজ আর বলা হলো একের পর এক নিজেকে কাগজে ফুটিয়ে তোলা তার কাজ ়আজ থেকে। তার আঁকা নাকি বড়ো শিল্পীদের বরাবর। কত বিস্ময় জীবনে। তার হাত থেমে যায় হঠাত কবর থেকে উঠে আসে সেই দিনটা।মরীয়া সে দিনটাকে ভুলে যেতে। মাথা উঁচু করে বাঁচার মন্ত্র দিলো আসগর্।আর দিলো জেদ্।ভরা গ্রামবাসীর সামনে আসগর বল লো "তালাক",জলভরা চোখে কাতর তাকায় আমিনা,"তালাক" মানুষেরা সিনেমার শেষ দৃশ্য দেখতে এবার উন্মুখ।আমিনা নীরবে হাত জোড় করে আস্গর কে, সময় অনন্ত মনে হয়। শেষ বার স্পষ্ট উচ্চারণে বলে আস্গর "তালাক"যেন খেলায় জ়য় হয়েছে,মানুষগুলোর মুখে ফুটে ওঠে তীব্র জান্তব আনন্দ।জ্ঞান হারাতে হারাতে হঠাত্ মাথা তুলে দাঁড়ায় আমিনা। যেন এক অন্য আমিনা
আজ সবুজ আর নাজমা ইস্কুল পাশ করলো। ওরা চারজন।আসিফ আর রাজিয়া।ওরা থাকে গড়িয়াতে ছোট্ট একটি বাড়িতে।রাজিয়া মায়ের ধাত পেয়েছে।সবুজ আর রাজিয়া আর্ট কলেজে যাবে।ওরা মায়ের মত হতে চায়।আসিফ দিদির নেওটা।এখন ৭এ পড়ে। বোর্ডিং এ।নাজমা ভীষণ পড়ছে।ডাক্তার হয়ে গ্রামেপ্র্যাক্টিস করতে চায়।  কাঁচা পাকা চুল, চওড়া পাড় তাঁত শাড়িতে আমিনা আজ তার গ্রামে ইতিহাস। অনেক সংগর্ামের পর আজ এই হেমন্তের রাত এসেছে। লেখাপড়া,আদব কা়য়দা,গুরু হেমেন তরফদারের কাছে মাসের পর মাস শিক্ষালাভ সাথে নানা কাজ করে পেট চালানো। দিদি পাশে ছিলেন তাই দিনগুলো বছর হয়ে গেছে কবেই যেন সে হয়ে উঠেছে শিল্পী। চিত্রশিল্পী। আকাশ মেঘলা আজ।
ক্লান্ত আমিনা তাকিয়ে দেখে মেঘের চলন মনের ক্যানভাসে তুলে নিতে থাকে রেখাগুলো। প্রথম প্রদর্শনি তেই সে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেল্লো তাবড় চিত্রশিল্পীদের।১০০০০ টাকার ছবি বিক্রী ! আজও সে আনন্দ,সে রোমাঞ্চ তাকে আবেগরুদ্ধ করে দে়য়। আশাতীত সে প্রাপ্তি।
তারপর দিনরাত এক করে জীবনকে বাজি রেখে আমিনা চার সন্তানকে মানুষ করে এক সফল শিল্পী।
দিদি,তার জীবনের ধ্রুবতারা, তার অক্লান্ত পরিশ্রম ছাড়া আজ সে কোণ ভাগাড়ে পড়ে থাকত ভেবে শিউরে ওঠে। কিন্তু চল্লিশের কোঠা পেড়িয়ে এসে এই প্রবল ঝড়ের মুখে পড়বে কে জানতো ? জীবনে কতটুকু অসহায় মে়য়েদের সাহায্য করতে পাড়লাম জানিনা।তবে আমার রাত শেষ প্রহরে।আমার জীবনের সবচে়য়ে বড়ো সা়ফল্য বোধহয় আমিনা। যৌনকর্মীদের সন্তানরা ়অনেকে আজ প্রতিষ্ঠিত হয়ে মা কে নিয়ে গেছে নরক ়থেকে।যৌনপল্লীগুলোতে মাস্তানরাজ কিছুটা হলেও কম। কিছু মেয়ে বিয়ে করে সুখের মুখ নিয়ে আসে ,আমি এদের সবার মা। আকাশ আজকাল প্রায় দেশে আসে।মাকে নিয়ে ভারি গর্ব তার।তবে মায়ের চোখ এড়ায়না। নাজমার প্রতি তার মুগ্ধতা দেখতে পাই।পাশ ফিরে শুই।জীবনের শেষ প্রহরের দিকে আমি। আমিনার জীবনে কি নতুন বাঁক নেবে?ওষুধের আবেশে চোখ বুজি আমি। একবছর আগের কথা। মুম্বাই শহরের ঝলমলে এক রাত।মুম্বাই বার্ষিক চিত্রপ্রদর্শনী তে বাংলা থেকে আমিনা গেছে মাত্র চারজনের একজন হয়ে।তার কয়েকটি ছবি সংগ়ঠকরা বেশ চড়া দামে বিক্রী করেছেন শিল্প পতি সংগ্রাহকদের কাছে। এসেছেন বিদেশী চিত্রশিল্পীরাও। দ্যনিয়েল সচ্ভিকো তার মধ্যে একজন। সপ্রতি়ভ আমিনা তার কাজ বিশেষ মনোযোগ নিয়ে দেখছেন তার নজর এড়ায়েনি। ভিক্টর মূলত মিশ্র মাধ্যমের কাজ নিয়ে এসেছেন। বিমূর্ত ছবি। অদ্ভুত আকর্ষনী়য় কাজ। আমিনার কোলাজ শিল্পী হিসেবে জনপ্রি়য়তা,নারী তার অন্তর্লীন বেদনা ফুটি়য়ে তোলে সে কখন চারকোলেও। পরস্পরের প্রতি মুগ়্ধতা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে অজান্তেই।তারপর মাস়ছয়েক আগে কলকাতায় সীমা গ্যালারীতেও। তারপর তার বাড়ি।তার পূর্ব জীবনের কথা একে একে আমিনা চেপে রাখা এতদিনের যন্ত্রনা একাকীত্ব উজার করে ়ফেলে ়ভিক্টরকে। যার স্ত্রী শিশু কন্যা হাইও়য়েতে গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত ৮বছর আগের এক রাতে। ভিক্টর তার গ্রামে যেতে চা়য় সে সাবি আর রাবেয়ার কাছে যাবেই। আমিনার বুক কাঁপে।কেমন মা সে। কিভাবে যেন আর বাদা়য় যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো।সৃষ্টির মধ্যে ডুবে যেতে যেতে অনুভব করছিলো ওরা তো কবরে নেই সাবি আর রাবে়য়া তারই মননে রয়েছে জেগে। ওদের সে জীবিত করে চলেছে নিয়ত তার সৃষ্টিশীলতার মধ্যে দিয়ে।বহূ বছর পর পা দেয় সেই গ্রামে। তার কোনো ছেলেমেয়েই আর যেতে রাজি হয়না সেখানে। দিন পাল্টেছে। রাস্তা ঘাট ,আলো, তার কানে বাজে বহূদিন পর "তালাক,তালাক,তালাক" নিজেকে সামলে নিতে শিখেছে আজ আমিনা। ভিক্টরকে নিয়ে মাথা উঁচু করে
গাড়ি থেকে নেমে সোজা চলে যায় সেই বাদার দিকে। ওখানটা আজ়ও জংলা। সন়্ধ্যে হয়ে আসে।দুজনের চো়খে়ই জল। আমিনা বাঁধ ভা়ঙে।জড়িয়ে ধরে মাথা রা়খে ভিক্টরের বুকে। রাত বাড়ে। একসময় ফিরে আসে ওরা।কিন্তু এক নতুন বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে।
ফিরে আসে এরই মাঝে আর একটি শূণ্যমন রাত বাগবাজারের পুরোনো গলির মধ্যে বাড়িটা।আজ রাতভর ভীর থিক থিক করছে। সমাজের ঘৃণ্য মানুষগুলির অন্তর আজ কি অপূর্ব বেদনায় নীরব। ব়ৃদ্ধা ,পরিজন পরিত্যক্ত রা ,মিডিয়ার লোক সবাই এসেছে জীর্ণ প্রাচীন বাড়িটার সামনে। একটি সাদা গাড়ি এসে ়দাঁড়ায়। গাড়ি ়থেকে যিনি নামেন সম্ভ্রমে প়থ করে দেয় সবাই।শ্ল়থ গতিতে ধীরে ়ধীরে প্রবেশ করেন বাড়িতে।এই বাড়ির,আরও অনেক যত্নে গড়ে তোলা বাড়ির কত্রী আজ দেহ রেখেছেন। একটু পড়ে একটি সুন্দরী অল্পবয়সী ডাক্তারকে দেখা যায় রোদনভরা মুখে এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আসতে। মালা আর অনন্ত শ্রদ্ধা সঙ্গী করে তিনি শেষ যাত্রায়।দেহ দান করেছেন তিনি চক্ষুদানও। তিনি যে সকলের মা। সুদর্শন এক যুবক মেয়েটির হাত ধরে পরস্পরের আবেগ দমন করে। 
রাত প্রায় ৯টা। অফিসে শেষ ফাইলটি তুলে নেয় আমিনা। কাল কেস আ়়ছে কোর্ট এ। উদ্ধার আশ্রমে ধর্ষিতা মেয়েটিকে নিয়ে এসেছে। স্বামী টি তালাক দিতে চায়।আমিনা লড়াই জিতবেই। আইনের পথে রায় হবে ধর্মের প্রাচীন লিখন আর কোনো মেয়ের জীবন যেন ধ্বংস না করতে পারে। রাতে সামান্য আহার।আকাশ নাজমা ভালো আ়়ছে আমেরিকা়য়। কথা হবে।তারপর কথা হবে সারা রাত। একা শিড়দারা সোজা এক নারী ফুটি়য়ে তুলবে আরক্ত বেদনাগুলি ক্যানভাসে। রাত জাগে প্রৌঢ়া। মনে পরে এক জীবনে অনেক জীবনের কথা।ইয়র্কশায়রে শান্ত সমাহিত শুয়ে আছে ভিক্টর।তার ভালোবাসা। তার আমৃত্যুর সাথী সকল ব্যথার ব্যথী। পুব দিক হাল্কা আলোয় ভরে উঠছে। তুলিতে শেষ টানটুকু দিয়ে একটু চোখ বোজে আমিনা ।