গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৭

উত্তম বিশ্বাস

তিন তালাক এবং একটি তাজমহলের গল্প
                        
রুবিনার পেট উঁচু দেখলি কাশেম? ফারুক কি বলে; তালাক দেবে না? তিনমাস অনেক টাইম। এখনও ঝদি না ছাড়ে এই আছোলা বাখারি ভাজব ওই কুজোর পিঠির ওপর।---রস মাঠে করে ছাড়ব লুচ্চার ব্যাটার!
মোচড়ানো বলিষ্ঠ নগ্ন উরুর ওপর বাশের বাখারি রেখে ধারালো দা
দিয়ে বাটাম তৈরি করতে বসেছে সফিউদ্দিন। রুবিনা ঘরে থাকলে এমন দৃশ্য দেখে সে কতবারই না বিড়ি দেশলাই দিতে উঠোনে নামত। ঘর উঠোন আজ একদম ফাঁকা ফাঁকা! কাশেম কানের বাড় থেকে আধপোড়া বিড়ি পেড়ে টিপে-ডলে, সফির ঠোঁটে ঠোঁট রেখে আগুন ঘষতে ঘষতে বলল, ‘সবে তিন মাস, তার ওপর হিজাব; মেয়েছেলের পেট, বুঝা যায়!
 তবে বমির আওয়াজ কানে আসে মাঝেমদ্দি!সফির দাউঁচু হতেই কাশেমের কথা থেমে যায়। ফারুকের দ্বারা এ কাজ অসম্ভব। পেচ্ছাপ করতে গেলেও যাকে একজন ধরে দাঁড়াতে, হয় সে কি না---! কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারে না সফিউদ্দিন। হাজার প্রশ্ন তার বুকের মাঝে শেকুলকাটার মত খোঁচা দিয়ে ওঠে; সব ফোটা যায় না,‘বারেক মিঞা কনে? সে এখন গদিতি বসে না?’  
কালে ভদ্রে বসে। তুই কি ভাবিস, তালাক এত সস্তা? সবাই কি তোর মত মাথামোটা? কোন আক্কেলে রুবির মত বৌ পেয়েও তুই তাল্লাক দিলি? নামেই তোর বিবিকে নিকা করেছে ফারুক। বারেক মিঞা কোন সাধে ফারুকের মত এক মাজাভাঙা ল্যাংড়া কর্মচারীকে এমন একটা কারখানার ক্যাশিয়ারের গদিতে বসালে সেটা ভাবতে হবে তো! আজকাল পাঁজায় ধুঁয়া ওড়ছে খুব। কুলিরা আগুনমুখো করে মরছে রোজ, আর ওদিকে বারেক বাবু রোজ আতর,ফুলফুলে পাঞ্জাবী পাজামা পরে আহ!--- মজা কারে কয়!
  
ওই মাদার---আমি ----!মুখ থেকে আগুন খসে পড়ে সফিউদ্দিনের। সে চুল্লীর ধোঁয়ার মত ফুঁসতে থাকে।   
তুইও একটা নাতখোর বুঝলি!--- খাচ্ছিলি জমি ভুঁই চষে; পাঁচখান ইটের লোভে এমন ফুটফুটে মাসুম বৌটাকে শালার আগুনের বয়লারে পুরে দিলি!সফি কামানমুখে চিৎকার করে ওঠে,----কাশেম-----!!

পাশের মাদুরে খালেদা ধড়মড়িয়ে জেগে ওঠে। এমন মাগিমুখো খপ ধরানে ব্যাটাছেলে নিয়ে তার শরীরটা নিমপাতার মত ভাজাভাজা হয়ে আছে। সে সরে এসে গায়ে গুঁতো দিয়ে জাগিয়ে দ্যায় সফিক,‘কই শোনচ,---আজ আবার খপে ধরেছে নাকি!সফি উঠে বসে। ঘামসিক্ত শরীরে একবার খালেদার দিকে তাকায়। খালেদার চোখদুটিতে কোথাও যেন তন্দ্রা জড়ানো সৌন্দর্যের লেশমাত্র নেই; একরাশ বিরক্তি আর শানিত প্রশ্ন নিয়ে সেও যেন চেয়ে আছে সফির দিকে, “আজ কিরাম উত্তুরে ঝামট মারছে দেখেছো!রাত জেগে প্রেমালাপে অভ্যস্ত নয় সফি। এটা তার কাছে বড়ই বিড়ম্বনার! তবু নারীর অসুখের কথা তপ্তকড়াই খইয়ের মত বিকশিত হয়! খালেদা আপন তাগিদে বলতেই থাকে, ‘সামনেই ঝড়ের মাস, ঘরখানার ঝা অবস্থা, এইবার একখান জোর ঝামট মারলি এর তলায় আর মাথা রাখা যাবে না কিন্তু! উঠোনের ইটগুলো তো পড়ে থেকে থেকে ছ্যাতা ধরে গেল। এখন যে কখানা আছে, চোরের ঘায় তাও হয়ত আর দুদিন পরে থাকবে না। ইটকখানা দিয়ে বড় ঘরখানা খড়া কল্লি হয় না?’ খালেদা স্পর্শ সুখ প্রার্থনায় চেয়ে থাকে সফির দিকে। কিন্তু সফি বিড়ির আগুনটাকেই যেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রাধান্য দিতে থাকে,‘না। ইট ঝ্যামন আছে ত্যামন থাক। ঘর করবার জন্যি ওই ইট আমি এনে রাখিনি।
তবে কোন কাজে লাগাবার জন্যি?’ বলি সোহাগের কব্বরখোলা গাঁথার জন্যি?’   
মুহূর্তের মধ্যে সফির চোখমুখ বারুদ হয়ে উঠল। খালেদা আরও ভীষণরকম বাজখাই! শরীরের খিদে গড়াতে থাকে অন্য খাতে,‘বিয়ের আগে ওই ইট কখানা পুঁজি করে তুমার বাপ আমার বাপকে ঠকিয়েছে।
য্যামন ইটের গাদি দেখে এ বাড়িতে এয়েচো, তেমনই ইটের গাদিটা দেখেই না হয় বাকি জীবনটা কাটিয়ে দ্যাও।
শ্বশুর ছাত্তার মিঞাও মাঝে মাঝে মেয়ের বাড়িতে এসে জামাইকে বোঝানোর চেষ্টা করে ,‘দ্যাখ জামাই বাবাজী, মানষীর কাছে ঘা’গুতো তো তুমি কম খেলে না! তাছাড়া আমি একজন মুরুব্বি মানুষ। আমার ঘরের মেয়ে গ্রামের আর পাঁচটা মেয়ের মত বেইজ্জতি নিয়ে বাচতি পারে না। ঘর না হয় পড়ে মরুক, আগে বাড়িটার সামনে অন্তত একটা পাঁচিল দ্যাও। ছালা চট টাঙিয়ে আর কতই বা রাস্তার মানুষের নজর এড়ানো যায়? তোমার কথা নাহয় বাদই দিলাম, গ্রামে আমারও তো একটা মান ইজ্জত আছে না কী?’
সফিউদ্দিন বিনয়ের সাথে জবাব দেয়, ‘এই মুহূর্তে আমি ঘরে হাত দিতি পারব না। আমার হাত-গাট শূন্য। এবার ফলনও ভাল না।---তাছাড়া যেটুকু ফসলী জমি সবই ভাঁটার দখলে---!
ঘর থেকে খালেদা মুখে মটরভাজা নিয়ে বলে ওঠে,‘আগে শুনতাম তালুক মুলুক আছে। দশটা পাঁচটা ভাঁটা আছে। কই,এসে পন্তি নিজের বলতে কাঠাখানেক ভাগাড়ে জমি ছাড়া আর কিছুই তো চোখে পড়ে না। নিত্য দেখি পরের ক্ষেত চষে ঘরে ফেরেন। বলি দেওলে হয়েচ কার জন্যি সে আর জানতি বাকি নেই। আমরা তো আর অত রূপুসী না, তাই জ্যান্ত থাকতিও ভাতারের সুহাগ কাকে বলে আজও টের পালাম না!

কারণে অকারণে সংসারে এখন আনাজের চেয়ে আগুনের আধিক্যই বেশি! রোজ রোজ এই অশান্তি ভালো লাগে না সাত্তার মিঞার। মেয়ের সামনে এখন দাঁড়াতেও তার লজ্জা করে। সংসারে আর পাঁচটা কষ্টের সাথে যখন মনের কষ্টটাও যুক্ত হয়, তখন স্বাভাবিক ভাবেই ঘরের মেয়েরা পুরুষের প্রতি কাঁসর ঝাঁঝি হয়ে ওঠে! কনকনে শীতে যখন  হাতপা কালিয়ে আসার মত অবস্থা! এমন দিনগুলোতেও খালেদা একা! তার ওপর মেঝেয় একলা মাদুর পাতলে উদলো আকাশের সপসপে শিশিরে বিছেন কাঁথা ভিজে একসা হয়ে ওঠে। এত কষ্ট আর খালেদার সয্য হয় না। বিশেষত সে দ্বিতীয় পক্ষের।---অন্যের উল্টেপাল্টে রেখে যাওয়া সংসার । আর যাই হোক, খচখচানি তো একটু বেশিরকমই থাকেই। ক্রমেই অশান্তি পাকিয়ে উঠছে দেখে সাত্তার মিঞা একদিন বলেই ফ্যালে, ‘ঠিক আছে বাবাজী, আমি নাহয় কবস্তা মাটি কিনে পেইঠ্যে দেব খন!


ইঁদুরের গর্তে আলতো আঁচড় লাগলেই যেমনটি হয়, ঠিক তেমনিভাবে উঠোনের পাশে দেওয়া কবরটা আজ কার অদৃশ্য আঘাতে যেন ঝুপ ঝুপ করে ধসে গেল। তার সাধের রুবিনা হাঁটুসমান ঝোপঝাড়ের মধ্যে অসহায় ভাবে শুয়ে আছে। বিমুঢ়ের মত অনেকক্ষণ কবরটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সফি। আজ কে যেন তার গায়ে কেবলই বিদের কাঠি ঠেসে ধরছে। উঠোনের আর একপাশে এখনও ইটগুলো গাদি দেওয়া আছে; অথচ সে এই দু বছরের মধ্যে তার কবরের ওপরে দুখানা ইটের গাঁথনি তুলে উঠতে পারে নি। সফিউদ্দিন তার জলঝাপসা মুখখানি দুহাতে চেপে ধরে রুদ্ধকণ্ঠে বলে উঠল,‘এই অক্ষমকে তুমি ক্ষমা কর রুবি!
কী জানি কোন ভাবের উদয় হয়েছিল ওর মনে,---সেদিন রাত্রে শোবার সময়, কাছাকাছি গিয়ে সফি খালেদার গায়ে ধাক্কা দিয়ে বলল,--‘এই তোর বাপরে বলিস, মাটি মজুর কিছুই দেওয়া লাগবে না। ওই ইট আমি রুবিনার নামে মসজিদে দান করব। তা না হলে ওর আত্মা শান্তি পাবে না!
এই ছোট্ট কথাটায় খালেদার নারীর আত্মসম্মানে কতটা আঘাত করেছিল,একমাত্র সেই জানে। তাই সেও পালটা আঘাত দিতে কমে ছাড়ল না। সঙ্গে সঙ্গে সফি ক্ষিপ্র বাঘের মত লাফিয়ে উঠে শুয়ে থাকা খালেদার চুলের মুঠি ধরে একদমে কোন এক পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মত নির্মম শব্দ উচ্চারণ করতে চাইছিল। কাঙালের সংসারে সাক্ষী লাগে না; একমাত্র আল্লাতলা শুনলেই সর্বনাশ! শুধু খালেদা কেন, কথা মুসলমান সমাজের সব মেয়েরাই জানে যে! সঙ্গে সঙ্গে খালেদাও খ্যাপা বাঘিনীর মত দুহাতে সফিউদ্দিনের টুটি টিপে ধরে বলল,‘খবরদার! আর একটিবার ওই শব্দ উচ্চারণ করলে এক্কেবারে টুটি টিপে মেরে ফ্যালাব! হারামির জাত! মেয়েলোকের গতর আমড়ার আঁটি তাই না! ইচ্ছে হলিই ছুঁড়ে ফ্যালান যায়!সংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ বলে কথা! থালা বাসনের শব্দ পেলেও গাঁ গ্রামের উঠোনে এখনও একশো মানুষ জড়ো হয়ে যায়, সে রাত হোক আর দিনই হোক। তখন প্রতিটি কথার চুলচেরা বিশ্লেষণ আর জবাবদিহি করা লাগে জনে জনে। খালেদা মরুঝড়ের মত তেড়ে আসে উঠোনে,‘যাও তো বাপু! যে যার ঘরে গিয়ে শরিয়ৎ ভাজ গিয়ে। আমি সফিকে এস্তোমা দিচ্ছিলাম,---আমি!--- কেন, আমি মেয়েমানুষ বলে বিশ্বাস হচ্ছে না? তুমরা কি শুনেছো এইবার বল দেখি,--- মেয়ে মানুষ হয়ে এতখানি আশকারা কনথে পাচ্ছি---এই তো? আমি আবারও বলছি, সুমসার করতি আইচি একেনে! বললাম তো, ত্যালানি মারতি না! মদ্দামানুষ বলে ধর্ম অধর্মের সব দায় দায়িত্ব তুমাদের তাই তো! কারণ নেই অকারণ নেই; ঘাট অপরাধ দ্যাখা দেখির বালাই নেই, পানথে চুন খসার আগেই কথায় কথায় তাল্লাক! মাগনা পেয়েচো নাকি!!--- কাঠি খুলে ছেড়ে দোব একদম!পাড়াপড়শীরা যে যার মত কেন্নোর মাথায় টুকি দিয়ে ঘরমুখো হয়,‘বাব্বা! জাঁদরেল মেয়েলোক একখান জুটিয়েছে সফি! মুখে যেন ক্ষুরের ধার, কে যাবে ওর সামনে! এমন আজরাইল পারলে আজই ঝেন আস্ত একখান কুরান লিখে ফ্যালে! দুখানা ইটের জন্যি সমাজ শরীয়তের একদম দফারফা করে ছাড়লে গো! কে বলে খালেদা মুরুব্বির মেয়ে? ভাবখানা দ্যাখ! খিষ্টানেরও এককাটি বাড়া!   

অনেকদিন একটানা উত্তুরে ঝাপটের পর, মাঝরাতে আকাশে কুয়াশা চাদর গাঁয়ে চাঁদ উঠেছে। ঊঠোনের নতুন পাঁচিলটার ওপর খালেদার খয়াটে হাসির মত জ্যোস্নার ঘোলা ঠিকরে পড়েছে। মোটা মোটা শিশিরের দানা ধীর অথচ মন্থর লয়ে টুপ টুপিয়ে ঝরে পড়ছে শুকনো পাতার ওপর। নতুন ঘরের উত্তর-দক্ষিণে দুটি বড় বড় ও জানালার ফাঁক দিয়ে কম্পিত চাঁদের কনকনে শীতল জোয়ার বইছে। ঠিক যেন রুবিনার স্বপ্নে আঁকা শয়ন কক্ষ। উঠোনের পাশে লম্বা একফালি গর্তে এখনও ঝরা পাতা আর বিষন্ন বেদনার মত ঘুটঘুটে অন্ধকার! আর সেই অন্ধকারে কে যেন আজ অশরীরী ছায়ার মত,--- মায়ার মত মচমচ শব্দ তুলে উঠে বসছে!--- ক্রমশ এগিয়ে আসছে তারই শোবার ঘরের দিকে! সফির চোখে আজ আর ঘুম নেই। বুকে বালিশ চাপা দিয়ে, খোলা জানালার কাছে আকাশের দিকে চেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। পাশে খালেদা গভীর নিদ্রা সুখে মগ্ন; দীর্ঘ লড়াই শেষে সংসারী হিসাবে নতুন ঘরে মাথা দেওয়ার সুখ। একসময় সফিউদ্দিন নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরে এল। ওখানে কে যেন তার জন্যে অপেক্ষা করছে।
নতুন ঘরে ঘুম এসতেচ না মিঞা?’    
না। ঘরখান বড্ড খা খা করে! 
কেন, বউ আছে তো। খালেদার পাশেও শোও না?” 
চেষ্টা করি, পারি নে! শরীলটা ঝেদি শুধুমাত্র ভাতের হাঁড়ি হত, তাইলে ত কোন কথাই ছিল না! কিন্তু মনের সব ক্ষিদে কি আর সবজায়গায় মেটে!
হিহিহিহি---! মেয়েমানুষের গায়ে গোন্দ পাও বুঝি? তবে চান্দে চান্দে বিবি পাল্টাও ক্যান? শুধুমাত্র সংসারের এঁটো বাসন মাজা, আর খেজমতি করার জন্যি মেয়েলক পোষ বুঝি?’
এমন করে ক্যান বল রুবি!
  
শেষমেশ তুমিও বেইমানি করলে তাহলে? খালেদার জন্যি ঘর বাঁধলে? ওই ইটকখান আমার গতর পুড়ানো খেজমতি করে আনা, আর তুমি আমার অসেক্ষেতে, বলা নেই কওয়া নেই--- অমনি খালেদার দিয়ে দিলে? ত্যাকন ঝাল জিরে ভাল করে বাটতে শিখিনি,----সেই কচি-ডবগা কালে আমার আনলে! আর এনেই, বছর না পেরোতিই একেবারে এনে দেড়গ্যে দিলে বয়লারের মুখে! চিমনির মুখের উড়ন্ত আগুনের ওপর বস্তা চাপা দিলেই কী আগুনকে আটকানো যায় মিঞা? আগে জানতাম, জগতের সব পুরুষই মেয়েমানুষের রূপে বুঁদ হতে পারলে কত না জানি দেহমনে আরাম পায়! --- আমার সে ধারনা ভুল। দেখলাম, তুমি তার ঠিক উলটোটা। যখন চুল্লির মুখের আগুনের মত দ্রুত গড়িয়ে নামল আমার গতরের গড়ন। তুমি তখন কলে-কৌশলে আমাকে ঝামা করে তোলার জন্যি অস্থির হয়ে উঠলে। তুমি এত ভীতু! আসক্তি না থাকলে সংসার হয় মিঞা? বিহারী কুলিদের সাথে একই ঝুপড়ির নীচে সাপের মত থাকতে থাকতে তুমিও দেখলাম, বেমালুম বারুদ হয়ে উঠলে! স্বপ্ন দ্যাখালে আয়েসি পিত্থিবীর।--- কুলি ব্যারাক ছ্যেড়গে নিরালায় একখান ঘরে ঠেলগ্যে দিলে! এক্কেবারে ছিনেমার মতন। আমি আমার গতরের সমস্তটা উপুড় করে ঢেলে দিলাম ওই আগুনের মদ্দি। তুমি বারেক মিঞার কোলঘেষা হলে, ইয়ারের বন্ধু হয়ে উঠলে। তারপর ওরই দৌলতে এক হাজার দুহাজার ইট জমল। তারপর জমতে শুরু করল তুমার মনে একশ হাজার কুড়ি পোশ্ন। ---সত্যি করে বল তো তুমি আমাকে ভালো বাসতে?’   
আমি তোমাকে কি করে বুঝাব রুবিনা, একটা মিনিটের জন্যিও আমি তুমাকে ভুলতে পারি নে।
ভুলতি পার না কোনটা? আমার সেই আগুন রূপ, নাকি তুমার অক্ষ্যামতা? সত্যি করে বল তো, আমাকে পুড়ে মরতি হল ক্যান? কই সেদিন তো চিমনির মুখ দিয়ে আগুনের ফুলকি উড়ছিল না ----তবে হঠাত করে ঝুপড়ি গুলো জ্বলে উঠল ক্যান? ফারুক তাল্লাক দিচ্ছিল না তাই?  ফারুক তাল্লাক দেবার কে! সে তো বারেকের কেনা গোলাম। সে না ঝদি অর্ডার দেয়, ফারুকের ঘাড়ে কডা মাথা আছে যে পুড়ামুখী রুবিনাকে তাল্লাক দেয়! পুড়া ইউনিটে দেড়গ্যে তুমি ঝ্যাখন আমার মুখির ঢাকা সরালে,আমি তখনই মন থেকে তুমাকে তাল্লাক দিয়েছিলাম; শুনতে পেয়েছিলে সফি? ভাব মেয়েমানুষের কোনও শরিয়ৎ নেই তাই না?  আর যদি ফারুক তাল্লাক দিতও--- তুমি কি আমার পাশে সত্যি সত্যি শুতে? ফষ্টিনষ্টির ফন্দিই ঝেদি মনে করে থাক, তবে সেই ফসলে অন্যের গোলা ভরানো তো মোটেই উচিৎ না মিঞা! সেদিন আর কোন কুলিদের বৌ মরল না ক্যান? কুলি ব্যারাকের একটি কুকুরও মরল না। কেবল আমি মরলাম! কে দিল আগুন আমার গায়ে?--- বল, কে জ্বালিয়ে দিল আমাকে?’  
সফিউদ্দিন উদভ্রান্তের মত চিৎকার করে উঠল ,‘আমি জানি না। আমি তুমাকে পুড়িয়ে মারতে চাই নি। তুমি আমাকে ভুল বুঝো না! ওরে হারামির বাচ্চা বারেক তুই এজনমেও জম্মের বাঁচা বেঁচে গেলি! জাহান্নামে গিয়ে জ্বলতে জ্বলতে বলবি, এই সফিউদ্দিনই পুড়গ্যে মেরেছে তোকে!

কাকে পুড়গ্যে মেরেছ তুমি?’
সফিউদ্দিনের পুনঃপুন চিৎকারে খালেদা ঘুম জড়ানো চোখে ছুটে এসে দেখতে পেল, কবরটার পাশে ছোট্ট একটা হ্যালা খেজুর গাছের ছায়ার নীচে দাঁড়িয়ে সফি থরথরিয়ে কাঁপছে। গাছে গাছে দুএকটি পাখি, সবে জানান দিতে শুরু করেছে ---রাত আর বুঝি বাকি নেই।

সকালবেলা সফিউদ্দিন বাঁশ ঝাড় থেকে একটা বাঁশ কেটে কবরের পাশে বসে, ধারালো একখানি দা দিয়ে বাঁশটাকে ফালা ফালা করে চটা তৈরি করছিল। পাশে কাশেম। কবরটাকে চটার বেড়া দিয়ে ঘিরে চারপাশে কয়েকটা ফুলের চারা লাগাবে সে। কাশেম সাহায্য করে সফিকে। এমন সময় খালেদা গোয়ালঘর ঝাঁটানো এক ঝুড়ি গোবর চোনা মাখা ছাই-মাটি সফিউদ্দিনের সামনের গর্তের মধ্যে ঢেলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে সফি চেঁচিয়ে উঠল ,--‘এ কী! এ কী করলে তুমি?’  
খালেদার গলার স্বর আজ অত্যন্ত কোমল। আঁচলের খুঁটটা কোমরে জড়াতে জড়াতে শান্ত স্বরে উত্তর দিল ,‘ঘরের দোরে খানাখন্দ, তার ওপর রাত-বিরেতে যত সব বদ-আত্মার আনাগোনা! রাত হলি বালিশে মোটে মাথা রাখা যায় নাকো। তাই ছাইমাটি দিয়ে বুজিয়ে দিলাম।---- রান্নার জায়গাটার যে দশা; ভাবছি শীত গেলি ওকেনে এট্টা আখা উঠোব!
সফি মুহূর্তের মধ্যে বাক্যহারা হয়ে গেল। ধারালো দাখানি সে বার বার দাঁতে দাঁত চেপে মুঠোর মধ্যে রগড়াতে লাগল। মাত্র তিনটি শব্দ আজ আবারও তার সমস্ত শিরা উপশিরা বেয়ে যেন আগুন হয়ে  ঠিকরে বেরুতে লাগল। যে শব্দগুলো তার কাছে তসবিহ জপার চেয়েও অনেক অনেক সহজ অথচ নির্মম! কাশেম খপ করে সফির হাতটা ধরে ফ্যালে, ‘এ কী করছিস তুই! ভালোবাসার মানুষকে এইভাবে বারবার ক্যান মারতে চাইছিস? তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে!

সফিউদ্দিন দু
হাতে মাথাটা চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়ে। থরথরিয়ে কাঁপতে থাকে, ‘আমিও তো ভালবাসতে চাই কাশেম ভাই! কিন্তু কী করব, মেয়েমানুষ গারকোলে আসলিই হঠাত ক্যামন যেন মাথায় খুন চেপে যায়! এটা ক্যান হয়, তুই কিছু জানিস?’

কাশেম করুণার দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে অবাধ্য খালেদার শুকনো মুখখানার দিকে!