গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বুধবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৭

পার্থ কর

ফ্যান


রায়বাবু দু'দিন অফিস ছুটি নিয়েছেন । বি.পি. বড্ডো ফ্ল্যাকচুয়েট করছে । নুনচিনির জল খাচ্ছেন, আর চিৎ হয়ে লাল চোখে ফ্যানের ঘোরা দেখছেন । কেউ কিছু বলতে গেলেই খেঁকিয়ে উঠছেন ।
.
দু'দিন আগে পাশের দত্তবাবুর বাড়ি সান্ধ্য আড্ডায় দু'জনের আলোচনায় উঠে আসছিল নিজেদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার কথা।
রায়বাবু বলেছিলেন - আরে, আজকালকার ছেলেমেয়ে, সব কথা কি আর শোনে ! সব শোনাতে গেলেই কেলো বাধবে হে ।
দত্তবাবু বেশ বিরক্তির সাথে বললেন, তা ব'লে পড়তে যাবার নাম ক'রে এদিক ওদিক বন্ধুদের সাথে ..
.
— আরে ওটুকু একটু-আধটু করতে দিতে হবে, বুঝলে না ? হে হে হে, ওই সুতো ছাড়তে হবে, গোটাতে হবে .. প্রয়োজনে জোরে টেনে আনতে হবে, হা হা হা !
— নিজে তো মেয়েটাকে চোখের বাইরে যেতে দেন না মশায়.. দত্তবাবু ক্ষোভের সাথেই বলেন ।
—আরে ভায়া, মেয়ে সন্তান ব'লে কথা, আপনার তো ছেলে ... তাই বলছিলাম ..
—আরে ছেলে ব'লে মাথা কিনে নিয়েছে ? আটটায় পড়া শেষ, পনেরো কুড়ি মিনিটের পথ সাইকেলে .. ন'টার আগে একদিনও ফেরে না, জানেন ?
— ফোন করেন না ? রায়বাবু জিজ্ঞেস করেন ।
—ফোন করলেই বলবে, এইতো আসছি, এইতো স্যারের এখানেই আছি, এই একটা নোটস বুঝে নিচ্ছি...কত বাহানা !
—হুম, এই একটা সমস্যা বটে। এই ফোন, এই ফোন তো না মিথ্যে বলার যন্তর । আমি গিন্নিকে যা টিপস্ দিয়ে রেখেছি না.. ঠিক ধ'রে ফেলবে মিথ্যে বললে !
 
 আত্মপ্রসাদের হাসি রায়বাবুর মুখে ।
.
দত্তবাবু থমকে গিয়ে বললেন,
বলেন কী ? টিপস্ গুলো বলুন তো মশায়, ব্যাটাডা বড্ডো মিথ্যে বলছে আজকাল, বুঝতে পারি..ধরতে পারিনে !
—শুনুন, ফোন যখন করবেন, তখন ছেলের কথার চেয়ে বেশি খেয়াল করবেন পাশে কীসের শব্দ পাচ্ছেন । ধরুন প্রচুর গাড়িঘোড়া আর হর্নের আওয়াজ,—ছেলে রাস্তায় ! আবার ধরুন, পাশে তেমন শব্দ নেই, এই বইখাতা ওল্টানোর শব্দ, টুকটাক দু-একটা কথা আর একজনের জোরে জোরে কথা.. ছেলে সত্যিই পড়ছে স্যারের কাছে ।
দত্তবাবু বললেন —
হুম এ দু'টো বোঝা যায় বটে ! কিন্তু আর ?
.
রায়বাবু বিজ্ঞের হাসি হেসে বললেন,—
ধরুন দিনের বেলা, বলছে স্কুলে আছে, অথচ চেঁচামেচি নেই, হট্টগোল নেই.. বরং বাতাসের শব্দ বা জলের শব্দ, চাইকি কান খাড়া করলে দু'একটা পাখির ডাকও শুনতে পাবেন । তখন বুঝবেন ছেলে আমাদের নির্জন প্রকৃতি দর্শনে গিয়েছে .. হে হে হে !
.
দত্তবাবু চিন্তিত মুখে বললেন,—
আপনি তো চিন্তায় ফেলে দিচ্ছেন মশায়, এমন তো মাঝেমাঝেই হয় !
.
রায়বাবু বললেন,-
হ'তেই হবে । আরে আমাদের চন্দ্রকান্তের ছেলেটাকে তো এভাবেই পাকড়ে দিলুম আমিই !
ও হ্যাঁ, আবার ধরুন ছেলে বলছে পড়ছে, সন্ধ্যাবেলা, অথচ কোনো শব্দটি নেই..কেবল হয়তো ফ্যান ঘোরার সামান্য আওয়াজ পাচ্ছেন.. হেঃ হেঃ হেঃ.. বুঝবেন ছেলে আমাদের লায়েক হয়ে উঠছে !
.
দত্তবাবু একটু রাগত হয়েই বললেন—
কী বলছেন কী ! এই বয়সে এইসব ! সামনে এইচ এস ! ওফ ! আমি যে কী করি !
.
রায়বাবু আশ্বস্ত ক'রে বললেন, —
আরে না না, ও'রম হবে তার মানে নেই। তবে কিনা চন্দ্রকান্তের ছেলেটার ওইরকম ফোন পাওয়ার পরই ওকে বললাম ঠিক ক'রে খোঁজ নিতে । খোঁজ নিয়ে যা পাওয়া গ্যালো সে আর কহতব্য নয় হে..
.
দত্তবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন,—
রাখুন আপনার চন্দরকান্ত ! শুধু শুধু ভয় ধরিয়ে দিচ্ছেন !
রায়বাবু বললেন—
আরে মেয়েটাকে নজরে রাখতে গিয়েই এসব শিখতে হয়েছে স্যার । যাকে বলে প্রাকটিশ টু থিওরি ..হে হে হে ।
আরে ওও তো আপনার ছেলের মাস্টারের পাশের ফ্ল্যাটের মধুবাবুর কাছে পড়ে ।
.
দত্তবাবু উদাস মুখে বললেন—
বললাম দুজনে একজায়গায় পড়, তা না বলে দু'জন দু'জায়গায় পড়লে দু'রকম নোটস পাওয়া যাবে, শেয়ার ক'রে নেবো !
.
রায়বাবু একটু যেন অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, —
হুম আমিও বলেছিলাম, মেয়ে রাজী হলো না.. ওই একই কথা বললো।
.
— এই দেখুন সাড়ে আটটা হয়ে গেলো, বাবুর ফেরার নাম নেই । ..দত্তবাবু উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন হঠাৎ ।
রায়বাবু উঠে পড়েন, বলেন—
 
আরে এসে পড়বে ঠিক। আমি আসি দত্তবাবু, দেখি মেয়েটা ফিরলো কিনা । এতো বলি, আমি গিয়ে নিয়ে আসি.. তা হবে না, নিজেই সাইকেল চালিয়ে ফিরবেন ।
দত্তবাবু এগিয়ে গেলেন দরজা পর্যন্ত—
হুম আর কেউই মোটে কথা শোনা না ।
 
রায়বাবু বিদায় জানিয়ে বলেন,—ছেলে ফিরলে জানাবেন একটা ফোন ক'রে ।
 
.
বাড়ি ফিরতেই রায়গিন্নি মুখ হাড়ি ক'রে বললেন,—
মেয়ে তো ফিরলো না এখনো !
দত্তবাবু উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন । তাদের পরবর্তী আলাপচারিতা নিম্নরূপ—
রায়: কতদিন বলেছি, দত্তদের বকাটে ছেলেটার সাথে মোটে মিশতে দেবে না ..তা তো শুনবে না !
গিন্নি : বলি না আবার ! কত বকি, মেরেওছি একদিন । বলে, 'আমি কি ওর সাথে প্রেম করছি ? পড়ার প্রয়োজনে দু'একটা কথা বলতেই হয়, তাই !'
রায়: পড়ার প্রয়োজন ! দেবো সব বন্ধ ক'রে ! ফোন করেছিলে ?
গিন্নি : (মুখ আরও কালো ক'রে) হুম্! প্রথমে তো ধরছিলই না ! অনেকবার রিং হ'বার পর ধরলো । বলে, 'এতো ফোন করার কী আছে । আসছি একটু পরেই !'
রায়: বটে ! তা কোথায় আছে বলে মনে হল ? মানে কোনো শব্দটব্দ ?
 
গিন্নি : আমি অত গোয়েন্দাগিরি পারিনে বাপু । কোনো শব্দই তো শুনলাম না..শুধু ফ্যানের একটু আওয়াজ পেলাম ।
.
রায়বাবুর তারারন্ধ্র বিস্ফারিত হলো, কথা বন্ধ হয়ে গেল উত্তেজনায়, সোফায় ধপ ক'রে বসে পড়লেন, বললেন, "জল" !
জল খেয়ে গিন্নিকে বললেন, "আর কী বললো ?"
গিন্নি রেগে বললেন, অত টেনশন কোরো না তো, ঠিক চলে আসবে ! বললো, 'বাবা য্যানো আবার খুঁজতে না বেরোয় !'
.
বিশেষ সূত্রে জানা গিয়েছে, একটু পরেই দত্তবাবুর ফোন এসেছিল । ছেলে তখনো ফেরেনি । ফোনে কেবল ফ্যানের শব্দ শোনা গেছে...
.
রায়বাবু চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন । মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে, নজর সেদিকেই ।
ফ্যান চলছে..চলছে .. উনি বুঝতে পারছেন না, ফ্যানটা কোথায় ঘুরছে, মাথার উপরে, না মধ্যে !