গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৬ মে, ২০১৭

তাপসকিরণ রায়

মান্ডালার হ্যান্টেড কাহিনী--

ছায়াবৃত্ত


ঘটনাটা ছিল ২০০০ সালের। স্থান কাল ঠিক রেখে পাত্রকে একটু পালটে দিলাম মাত্র--
মধ্যপ্রদেশ জবলপুরের সাতপুলা ব্রীজ। দিবালোকে লোকজনের আনাগোনা চলতেই থাকে। ব্যস্ত রাস্তা। রাত নটার পর থেকে ধীরে ধীরে চহলপহল কমে আসে।
সেদিন রাত এগারটা ছিল। বেলা তিনটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত ডিউটি ছিল ধীর বাবুর। এমনি সময়ের ডিউটির শেষে তার সঙ্গী থাকে হরলাল। ওরা দু জনেই রাঞ্ঝি এলাকার। সাতপুলা ব্রীজ তাদের পেরোতে হয় না, গান ক্যারেজ ফ্যাক্টরির গেট থেকে বেরিয়ে কুয়াটার কিলোমিটার রাস্তা পার করতে হয়। তারপর টার্ন নিয়ে প্রায় পুল ঘেঁষে ওদেরকে ডান দিকের মেন রোড ধরে নিজেদের ঘর, রাঞ্ঝির  দিয়ে চলতে হয়।
ধীর বাবু আর হরলাল গান ক্যারেজ ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। সাইকেলেই দুজনের যাতায়াত। কিন্তু আজকের দিনটা ধীর বাবু একা। হরলাল আজ ছুটিতে। এমনটা আজই প্রথম। এই ধরনের নাইট ডিউটি ধীর বাবু মাস তিন ধরে করছেন। তিন মাস আগেই তিনি সুপারভাইজারের পোস্টে প্রমোশন পান। আর হরলাল অল্প বয়সের ছেলে। সে মাস চার আগে এই ফ্যাক্টরিতে মজদুর শ্রেণীর কাজে জয়েন করেছে।
অসুবিধা তো হচ্ছিলই ধীর বাবুর। একে তো রাত এগারটা বেজে গেছে তার ওপর সঙ্গের হরলাল আজ নেই। সাইকেলে একটু বেশী স্পীড দিয়েছেন তিনি। এখান থেকে কুয়াটার কিলোমিটার গেলে আসবে সাতপুলা ব্রীজ। সেখান থেকে রাস্তা বেশ চওড়া। একেবারে আশপাশে কোন লোকালয় নেই। কিছুটা দূরে আছে ছোট বস্তি এলাকা, সেখানে কয়েক ঘরের বাস।
ধীর বাবু জানেন, এ রাস্তায় জোরালো লাইট থাকে না।  আর দুশ মিটারের মত এগোলেই  পৌঁছবেন সাতপুলা পুলের কাছে। গান ক্যারেজ ফ্যাক্টরি থেকে সাতপুলা ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তাটুকু বেশী নির্জন। আধ আলো, আধ অন্ধকার রাস্তা।  রাস্তায় লাইট আছে তবে তত জোরালো নয়। এ রাস্তার এক পাশে গান ক্যারেজ ফ্যাক্টরির উঁচু লম্বা দেওয়াল অন্য পাশে পাতলা জঙ্গল। হ্যাঁ, জঙ্গলের দিক থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ কানে আসছিলো, আর মাঝে মাঝে জোনাকির আলো জ্বলছিল নিভছিল। ধীর বাবু বড় একাকীত্ব অনুভব করছিলেন সে সঙ্গে সামান্য হলেও ভয় ভয় ভাব লেগে ছিল তাঁর মনে। না, তিনি মনে করতে পারলেন না এই রাস্তার ব্যাপারে কোন দিন কারও কাছ থেকে কোন রকম বদনাম শুনেছেন বলে। কাজেই রাতের নির্জনতা আর একাকীত্বের ভয়টুকুই তাঁর মনে লেগে ছিল।
ধীর বাবুর হঠাৎই চমকে উঠলেন, একি তার পেছন থেকেই একটা কেমন ধরণের সাঁই সাঁই শব্দ আসছে না ! যেন বেশ স্পীডে একটা সাইকেল আসছে তার দিকেই। ধীর ঘাড় ফিরিয়ে তাকাবার চেষ্টা করলেন। চোর ডাকাত নয় তো ? কিংবা তার মতই একাকী পড়ে যাওয়া কোন ঘর ফিরতি যাত্রী ? পেছনের যাত্রী প্রায় এসে পড়ল বলে, তিনি সাইকেলে আরও একটু স্পীড নিলেন। সামনে তাকিয়ে দেখলেন, সাতপুলার রাস্তা দেখা যাচ্ছে কিন্তু সেখানেও এত অস্পষ্ট আলো কেন ? ওখানে তো বেশ জোরালো পাওয়ারের লাইট থাকে !
হ্যাঁ, আওয়াজে মনে হচ্ছে পেছনের সাইকেল আরোহী তার পাশটাতে এসে পড়েছে। একবার দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখবার চেষ্টা করলেন ধীর। মনের ভেতরে তাঁর একটু ভয় ভয় করছিলো বৈ কি ! ছায়া, একটা ছায়াই তার নজরে এলো। একটা লোক সাইকেল চালাচ্ছে বটে, কিন্তু এতটা ছায়া ছায়া তার শরীর মনে হচ্ছে কেন ? লাইট কম আছে ঠিকই কিন্তু একটা মানুষের পূর্ণ  আকৃতির ছায়া ছবিটুকু তো টের পাওয়া যাবে ! অথবা লোকটার সাদা বা অন্য রঙের পোশাক চোখে ধরা পড়ার কথা। না, ঠিক বুঝতে পারছিলেন না তিনি। ধীর বাবু এবার ধীর স্বরে বলে উঠলেন --কাঁহা জানা হায় ?
না, কোন উত্তর নেইচারদিকের স্তব্ধতা যেন আরও বেড়ে গেল। ধীর বাবু ভাবলেন, হয়ত তার গলার আওয়াজ ভয়ে ধীর হয়ে গিয়ে থাকবে, পাশের লোকটার কান পর্যন্ত তা পৌঁছাতে পারেনি হবে। এসে গেলো সাতপুলা ব্রিজ। ব্যাস, অনেকটা সস্তি পেলেন যেন তিনি, ডানদিকে মোর নিলেন, পুলের একদিকের প্রধান রাস্তা রাঞ্ঝির দিকে চলে গেছে। ধীর বাবুর হঠাৎ খেয়াল এলো যে স্ট্রীট লাইট জ্বলছে না। এমনটা তো হবার কথা নয়, পরক্ষণেই ভাবলেন, হতে পারে, কোন কারণে কারেন্ট চলে গেছে। পাশের লোকটা কথা বলছে না, তার পাশ দিয়েই সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। চলতে চলতে ধীর বাবু আর একবার ওর দিকে তাকাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু এ কি ! এখনও একটা ছায়া ? চমকালেন ধীর বাবু। সাইকেলের ব্যালেন্স হারাতে হারাতে কোন মত তাল সামলালেন। দূরে চার পাঁচটা পোস্ট ছাড়িয়ে রাস্তায় লাইট আছে বলে মনে হল। দুটি সাইকেল সাঁই সাঁই পাশাপাশি এগিয়ে চলেছে। যেন সাইকেল দৌড় প্রতিযোগিতা চলছেধীর বাবু ঠিক বুঝে গেছেন, ব্যাপারটা অস্বাভাবিক কিছু হবে। কোন ভৌতিক ব্যাপার নয় তো ? তাই তো ! আর একটু সামনে গেলেই পথের উজ্বল আলোয় তিনি এসে পড়বেন। আর পারছিলেন না তিনি, বেশ কিছু সময় ধরে যেন সাইকেলটাও জাম চলছে। এবার তিনি টের পেলেন, পাশের সাইকেলটা একটু পেছনে পড়ে গেছে। ব্যাস, হাঁপাতে হাঁপাতে লাইট পোস্টের তলে এসে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। আর তাঁর চলার মত ক্ষমতাই যেন ছিল না। পেছনের সাইকেলের শব্দ আর নেই। ধীর বাবু কৌতূহল বসে আরও একটু সাহস জুগিয়ে আর একবার পেছনের দিকে ফিরলেন। এবারের দৃশ্য দেখার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শরীর কেঁপে উঠলএ কি দেখছেন তিনি ? তাঁর পেছনে হাত দশ পনের দূরে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে কালো ছায়াটা তার মাথা কোথায় ? তিনি স্পষ্ট দেখলেন, মুণ্ডু বিহীন একটা লোকের কালো ছায়া। সাইকেল হাতে তার দিকেই ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে ও পালাবার তাড়নায় ধীর বাবু খানিক সাইকেল হাতে নিয়েই ছুটে চললেন, তারপর পড়ি মরি করে আবার সাইকেলে চেপে বসলেন। আর তিনি পেছন দিকে তাকাবার সাহস করলেন না। তিনি নিজের মনে একবার আওড়ে নিলেনস্কন্ধকাটা !
ধীর বাবু সাইকেলের প্যাডেলে শরীরের সমস্ত জোর লাগিয়ে এগিয়ে চললেন রাঞ্ঝির দিকে।