গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

বৃহস্পতিবার, ১১ মে, ২০১৭

উদয় চক্রবর্তী

এই জন্যে


হেটে চলেছি... হেটেই চলেছি...পথের আর শেষ নেই। চলেছি কি ঠিক পথে? হবেও বা...তবে হেটে যেতে ভালই লাগছে। সবুজ ধানের ক্ষেতে হাওয়ায় ঢেউ খেলে যাচ্ছে। দোলা লাগে মনে। এত ধান... এত ধান... মাটির আশির্বাদ যেন ঝরে পড়ছে। দেশে তবু আকাল আধ-পেটা ভাত জোটে না গরীবের। আমাদের রেলপারের বস্তিতে কজন পেট পুরে খেতে পায়? আমরাই কি খেতে পেতাম! বাবা গাড়ি খালাস করে যা পেত... সাতটা পেট। আমি রিক্সা চালাতে শিখলাম। বাঁচল পরিবার। -এই যে শুনছেন? হ্যাঁ, আপনাকে বলছি -দেখে তো মনে হচ্ছে শহুরে ছোকরা, গাঁয়ে কি মনে করে? দেখ বাপু কিছু মতলব থাকলে বলে ফেল। -না না মতলব কিছু নয় মুকুন্দপুর গ্রামটা কোন দিকে বলতে পারেন? -পারব না কেন? মুকুন্দপুর যাবে কেন? চুরি-ডাকাতির মতলব আছে নাকি। -ছিঃ ছিঃ কি যে বলেন। ওখানে আমার শ্বশুর বাড়ি। -বল কি তোমার শ্বশুর বাড়ি! নিজের শ্বশুরবাড়ি চিনতে পারছ না? এমন গাড়োল লোক তুমি? ...কোথায় থাকা হয়? -বারুইপুর। আমার সদ্য বিয়ে হয়েছে। অষ্টমঙ্গলে বউ বাপের বাড়ি এলো, আর ফেরার নাম নেই! বাবা পাঠালে আনতে। -বিয়ে করতে তুমি এসেছিলে তো? নাকি অন্য কেউ... -গাড়ি করে এসেছিলাম। তারপর হেটে, ঠিক চিনতে পারছি না। -ঠিক পথেই যাচ্ছ। আর আধ মাইল পথ। তবে সাবধানে যেও বাপু। -কেন সাবধান কেন? মুকুন্দপুর গ্রামে পরুশু রাতে ডাকাতি হয়েছে। গুলি, বোমা, মারধর...একটি মেয়েকে তুলে নিয়ে গেছে ডাকাতরা। -ও তাই নাকি? -আর বেশি পথ নেই পা চালাও। সন্ধ্যে হয়ে এল। এখন গাঁয়ের লোক অচেনা দেখলেই ভাবে ডাকাত। -কাকা যাই তবে। -এসো, তবে সাবধান। পথে বেফাস কিছু বলে বসো না যেন। কি জানি গোলমেলে লাগছে সব। শ্বশুরবাড়ি গরীব, সামান্য মুদিখানা দোকান, ও বাড়িতে নিশ্চয় ডাকাতি হয় নি। গরীবের বাড়ি ডাকাত আসবে কেন... এসে গেলাম মনে হচ্ছে... এবার চেনা চেনা লাগছে... ওই টালির বাড়ি... হ্যা, ওইটাই তো। ভিতরে যাই... দুয়ার ফাঁকা, খাঁ খাঁ করছে। ঘরের শিকল টানা। শুনশান...দেখছিনা তো কাউকেই। সন্ধ্যে হল, আলো জ্বলছে না। -শুনছেন? কেউ আছেন? শুনছেন... না- কোন সারা নেই। গেল কোথায় সব... এমন সময় কোলাহল করতে করতে কয়েকজন লোক বাইরে থেকে এসে দাড়াল দুয়ারে। শ্বশুর বাড়ির লোকজন... গাঁয়ের লোকও। আমায় দেখতে পেয়ে চুপ হল ভিড়। -এসে গেছ বাবা। শ্বাশুড়ি ফুপিয়ে কেঁদে উঠে বললেন আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমি বিশ্ময়ে হতবাক। চেয়ে আছি। - সর্বনাশ? -থানা পুলিশ সব ফেল। কোথাও তার কোন খবর পাওয়া গেল না। -কিসের খবর? কার খবর পাওয়া গেল না? -বাড়িতে এত বড় ডাকাতি হয়ে গেল...খবর পাওনি? -কই না তো। -বিয়ের গয়না সমেত বাড়িতে যা কিছু ছিল সব নিয়ে গেল। যাবার সময় কাজলকে ওরা তুলে নিয়ে গেল। কাজল! আমার বৌ কাজল। মনে পড়ে গেল পথের লোকটির কথা। গরীবের বাড়ি ডাকাতি... আশ্চর্য... -একি বলছেন আপনারা! -হ্যাঁ বাবা... পুলিশ, গায়ের সব লোক, সেই থেকে চারিদিকে খোজ করছি। কিন্তু কাজলের কোন খবর পাওয়া গেল না। আমার কাজল.. নেই! ডাকাত ধরে নিয়ে গেছে। 

পরিণতির কথা ভেবে গায়ে আমার কাঁটা দিয়ে উঠলো। ওরা আমার দূর-সম্পর্কে আত্মীয়... বিয়ের আগে দেখাশুনোও হয় নি। একেবারে বিয়ের পিড়িতে প্রথম দেখা। কাজল। গরীব ঘরের হলেও কাজল ম্যাট্রিক পাশ। আর আমি কেলাস ফোর। গায়ের রঙ কালো হলেও দেখতে ভারি ভাল। স্বপ্নেও ভাবিনি এমন ভাল বৌ জুটবে আমার। ফুলশয্যা রাত... অল্প দুএকটি কথা... আমায় সরিয়ে দিয়ে বলেছে- পরে। শ্বশুর বাড়িতে চাপা কান্নার রোল। একটা বিভীষিকার রাত... তাকিয়ে রইলাম আকাশের দিকে চেয়ে...মনের আনাচে কানাচে কাজল...কাজল...শুধুই কাজল। সকালে খবর আনল পুলিশ... মাইল দূরে হাইরোডের ধারে এক যুবতীর লাশ পাওয়া গেছে। পুলিশের সন্দেহ-গণধর্ষণ ও খুন। ডাক পড়ল শনাক্তকরণের। আমার ভিতরের চাপা কান্না দপ করে উঠল জ্বলে। হাসপাতাল-মর্গ। বাড় হল দেহ। সকলে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। আমি দাঁড়িয়ে আছি দূরে। ডাক পড়ল। শনাক্ত। হ্যা। কাজল। দুটো চোখ বোজা। মুখে তীব্র যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে... একটা বলিষ্ঠ নিরবতা যেন সমাজের বুকের মাঝখানে হাতুড়ি মারছে। পৌরুষের কাপুরুষতার দিকে আঙুল তুলে ও যেন বলতে চাইলো-- -আমার জন্ম কি, এই জন্যে?