গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

শুক্রবার, ২৬ মে, ২০১৭

ইন্দ্রনীল চক্রবর্তী

বাদুড় পূর্ণিমা

এমনিতে সুব্রতর আটটা হয়ে যায় ফিরতে ফিরতে। টালিগঙ্গের অটো লাইন বড় থাকলে আরও দেরি  হয়। পার্ক স্ট্রীট থেকে মেট্রো করে সোজা চলে আসে টালিগঞ্জ (ত্রুটি মার্জনীয়, থুড়ি উত্তমকুমার, যদিও পার্ক স্ট্রীট মেট্রো স্টেশনের নতুন নামটা মনে পড়ছে না)। সুব্রত তারপর অটো নেয়, এবং অটোর সাথে সদ্য বেড়ে ওঠা মধ্যপ্রদেশ কে নিয়ে বাড়ি ফেরে। ফিরেই ব্যাগ, ট্যাগ  খাটে ছড়িয়ে জুতো দুমদাম খুলে সবাইকে উদ্ধার করে। প্রবল প্রতাপে জগৎ উদ্ধার করে পৈত্রিক তিনতলার বাড়িটিতে সে পদার্পণ করে। জলখাবার খেয়েই সোজা চলে যায় তার তিনতলার ঘরে। এখানে পাঠকের মনে অলীক কল্পনা হতে পারে যে সে বোধহয় নিজের স্টাডি রুমে যাচ্ছে। সুব্রতর সে সব অভ্যাস নেই। কেন যায়। কি জন্য যায় সেটা উহ্য থাক। বুদ্ধিমান পাঠকের জন্য  কিছু অংশ রাখতে হয়, সেটা মূল বিষয় নয়। মূল বিষয় হল সেই ঘরটি যেখান থেকে এই গল্পের সূত্রপাত (এতটা ভণিতা করার জন্য দুঃখিত; কিন্তু চরিত্র সম্বন্ধে একটু না বললে, আমাদের সুব্রতর প্রতি অন্যায় করা হত)।

২১/১০/২০১১

(পঞ্জিকা মতে এই দিনে আদৌ পূর্ণিমা ছিল কিনা আমি নিশ্চিত নই, তবে গল্পের খাতিরে গরু গাছে উঠতেই পারে)। যাই হোক ধরে নেওয়া যাক যে এই দিনে পূর্ণিমা ছিল। সুব্রত যথারীতি বাড়ি ফিরে হুঙ্কার টুঙ্কার দিয়ে সোজা তিন তলায় চলে যায়। গিয়েই বিপত্তি।   ঘরের পাশে...
পাশে ছিল ছাদ...
ছাদে ছিল চাঁদ ( তাও পূর্ণ )।
আর ঘরে ছিল বাদুড়। আলো জ্বালতেই সে বাদুড় আনন্দের আতিশয্যে ঘরময় ঘুরতে থাকে। তাতে সুব্রত ভীষণ ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে ওঠে। তার একাকীত্বের গোপন সংসারে কার এই প্রবেশ? তার মনের মধ্যে কেমন একটা ইয়ের সৃষ্টি হয়। কেমন যেন ব্যাপারটা - ছাদে চাঁদ, ঘরে বাদুড় । কেমন কেমন করে উঠল।

ছাদে চাঁদ, ঘরে বাদুড়...
ছাদে চাঁদ, ঘরে বাদুড়...
ছাদে চাঁদ, ঘরে বাদুড়...

সেদিন সুব্রত নেমে আসে। আর উপরে যায়নি সেদিন। পরেরদিন অবশ্য অফিসে গিয়ে একটা খচখচানি  তৈরি হয় । সহকর্মী জিতেন নাকি আগের দিন রাতে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। বেঁচে যায়, কিন্তু সাঙ্ঘাতিক রকম ভাবে আহত হয়।





১২/৫/২০১২

আগের ঘটনাতে এই কাহিনী শেষ হলে, এই কাহিনী হত না। আরেকটি পূর্ণিমার দিন। সুব্রতর মাথা থেকে পুরো ব্যাপারটা মুছে যায়। যাই হোক সেদিনও ছিল পূর্ণিমা। সুব্রত তিন তলায় গিয়ে দেখে একই উপস্থিতি। ইতিহাস বারবার ফিরে আসে।

ছাদে চাঁদ, ঘরে বাদুড়...
ছাদে চাঁদ, ঘরে বাদুড়...
ছাদে চাঁদ, ঘরে বাদুড়...

এই বার সে বেশ ভয় পেয়ে যায়, বাদুড় উড়তে শুরু করলে তাড়াতাড়ি লাইট নিভিয়ে নিচে নেমে আসে। এবং কি আশ্চর্য পরেরদিন অফিসে গেলে বাড়ির  থেকে ফোন আসে, যে পিসিমার যায় যায় অবস্থা। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসে। পিসিমা অবশ্য যাননি, কিন্তু কেমন যেন একটা যোগসূত্র স্থাপন হয়ে গেছিল।

১৯/১২/২০১৩

সেদিনও... এই নিয়ে তিনবার।
রীতিমত আতঙ্ক নিয়ে সুব্রত ছাদ থেকে নেমে আসে।
সেই...।।

ছাদে চাঁদ, ঘরে বাদুড়...
ছাদে চাঁদ, ঘরে বাদুড়...
ছাদে চাঁদ, ঘরে বাদুড়...

আবার সেই অফিসে গিয়ে শোনে পাড়ায় ভীষণ মারামারি হয়েছে, বোম পড়েছে। আর ছোট ভাইঝিটার হাতে ভীষণ লেগেছে।...
আর কি অপেক্ষা করছে? চাঁদ টপকে সুব্রত প্রশ্ন করে।

৭/১০/২০১৫


এই নিয়ে টানা চতুর্থ বার। সারা শরীর হিম হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। অদ্ভুত সেই দৃশ্য।

ছাদে চাঁদ, ঘরে বাদুড়...
ছাদে চাঁদ, ঘরে বাদুড়...
ছাদে চাঁদ, ঘরে বাদুড়...

পরের দিন সে অফিসে যেতে চাইছিলনা। বাড়ির লোকেরা তাকে জোর করে পাঠায়। অফিসে গিয়ে সে  বুঝতে পারে সবাই তার দিকে কেমন ভাবে দেখছে। সুব্রতর সারা শরীর ঘামতে থাকে। একটু পরে বেয়ারা এসে বলে যায় বড় সাহেব তাকে ডাকছে। সুব্রত স্পষ্ট বুঝতে পারছে তার পা কাঁপছে, গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। বড়বাবুর অফিস থেকে বের হবার পর সুব্রতর হাতে একটা চিঠি ভর্তি খাম ধরা ছিল। সুব্রতর পদোন্নতি হয়েছে। সবাই সুব্রতকে ঘিরে ধরে। ওরা বোধহয় আগের থেকে জানত।