গল্পগুচ্ছতে প্রকাশিত লেখার বিষয়ভাবনা বা বক্তব্যের দায় লেখকের । সম্পাদক কোনভাবেই দায়ী থাকবেন না ।

সোমবার, ২৬ জুন, ২০১৭

৬ষ্ঠ বর্ষ ১৬তম সংখ্যা ২৭শে জুন ২০১৭

এই সংখ্যার লেখকসূচি - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়, তাপসকিরণ রায়, অর্ধেন্দুশেখর গোস্বামী, সুবীর কুমার রায়, সুজাতা ঘোষ, সুধাংশু চক্রবর্তী, পার্থ রায়, নীহার চক্রবর্তী, চন্দনকৃষ্ণ পাল, শাশ্বতী চৌধুরী, ত্রিভুবন জিৎ মুখার্জী ।

        সূচিপত্রে লেখকের নামে ক্লিক করে পড়ুন

ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

ধারাবাহিক

এই প্রবাস  (৫ম ও শেষ পর্ব)


পুজোর তিনটে দিন যে কি ভাবে কেটে গেল কেউ জানতেও পারল না। গল্প,আড্ডা হৈচৈ আর পুজো দেখেই কাটিয়ে দিল সবাই। আজ বিজয়া দশমী। একদিকে চেয়ার পেতে চলছে জোর গল্পগুজব। আর একটু পরেই দশমীর অঞ্জলী আর তার পরেই মেয়েদের সিঁদুরখেলা। আসলে এই অনুষ্ঠানটি দেখার জন্যই জমায়েত হওয়া।  ছোট-বড়, বয়স্ক, তরুণ সব পুরুষই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন এই অনুষ্ঠানের সময় মেয়েদের দিকে।  কারো মুখে মৃদু হাসি, কেউ কেউ মজা পান, কেউ বা দীর্ঘদিনের সঙ্গিনী বা ভালবাসার নারীটিকে সিঁদুরে রাঙ্গিয়ে যেতে দেখতে ভালবাসেন। দশমীর সকালে তাই মেয়ে-পুরুষের ভিড় লেগে থাকে পুজোমন্ডপের ভিতর। বয়স্কা মহিলারা অনেক সময় কাউকে বলেনএকটু তুলে ধরত মা, এ বছর তো ঠাকুরের কাছে সিঁদুর নিয়ে নিই, কি জানি, পরের বছর থাকব কিনা।

অল্পবয়সী মেয়ে-বৌদের দিকে তাকিয়ে বলেনদে ঢেলে দে, যত পারিস, আজ কাউকে ছাড়বি না।অল্পবয়সী মেয়েগুলির উৎসাহ আরো বাড়ে। একেবারে কম বয়সী অবিবাহিতা মেয়েদের কপালে কেউ কেউ টিপ পরিয়ে দিয়ে বলেনএই, পরের বছর তোর মাথায় যেন সিঁদুর দেখতে পাই।মেয়েগুলি লজ্জ্বা পায়,একটু দূরে সরে যায় ঠিকই কিন্তু আবীর খেলার মত এ ওর গালে সিঁদুর লাগায়। নতুন বিবাহিতা মেয়েদের দিকে সবার নজর, ঢেলে সিঁদুর লাগানোর হুড়োহুড়ি পড়ে  যায়। মোটের ওপর আজ মেয়েদের অবারিত আনন্দের দিন। সুসজ্জ্বিতা মেয়েদের আজকের দিনে দেখতেও ভালো লাগে। কে বলবে,বাড়িতে এরাই থাকেন আধময়লা শাড়ী আর হাতে হলুদের ছোপ নিয়ে! 

পুজো প্যান্ডেলে মেয়েদের পাশাপাশি আজ বেশ কয়েকটি পুরুষদেরও জটলা। কোথাও বয়স্ক পুরুষেরা, কোথাও অল্পবয়সী ছেলে-ছোকরারা, কোথাও আবার কমবয়সী ছেলে-মেয়েদের হাসাহাসি। সবার নজর কিন্তু আজ মেয়েদের দিকে। এমন একটি অপরূপ উৎসব কেন পুরুষদের থাকে না?

তখনও পুজো চলছে, আর একটু পরেই শুরু হবে অঞ্জলি। হাতে পুজোর থালায়  সিঁদুর, আলতা, অপরাজিতার মালা, কিছু ফুল-দুর্বা আর একটি ছোট্ট মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে মন্ডপে এলো মালিনী। পরনে লাল পাড় গরদের শাড়ী। স্নান করে এসেছে, অঞ্জলি দেবে বলে। শাড়ির আঁচল পিঠের ওপর দিয়ে গায়ে জড়ানো।  আজ প্রায় ছয়-সাত বছর ধরে রণেন, মালিনীর দাদা মারা যাবার পর থেকে এই অনুষ্ঠানটিতে সে আসে,আসতে হয়।  রণেন চলে যাবার পর থেকে পারুল আর আসেন না প্রতিমার সামনে। গুণিনবাবু মারা যাবার পর থেকে তো বাইরে বেরোনই বন্ধ করে দিয়েছেন। একরকম বিছানায় বন্দী বলা যেতে পারে তাঁকে। দশমীর সন্ধ্যাবেলা পাড়ার ছেলেমেয়েরা প্রণাম করতে গেলে অল্পক্ষণ উঠে বসেন, দু-চারটি কথাবার্তা বলেন, ওইটুকুই। আর কোন কথা প্রায় সারা বছর হয় না বললেই চলে। নিজেকে সকলের থেকে আড়াল করে নিয়েছেন। বাইরের কাজকর্ম, উৎসব অনুষ্ঠানের ঝক্কি সব সামলাতে হয় মালিনীকেই।
মিলি মন্ডপে আসতেই শুভর মা,অণিমা কাকিমা জিজ্ঞেস করলেন মৃদু স্বরে,দিদিকে কার কাছে রেখে এলি?’

তেমনই নিচু গলায় উত্তর দিল মিলিআলোদি আছে,কাকিমা।গুপ্তকাকিমা হাত ধরে নিজের কাছে টেনে নিলেন মিলিকে। অনিমার সঙ্গে কথা বলার সময় কেমন যেন চাঞ্চল্য অনুভব করল মিলি। কেন জানে না, কিন্তু কি একটা মনে হতেই একটু দূরে ডানদিকে যেখানে ঠিক বয়স্ক নয় আবার একেবারে ছেলেছোকরাদের জটলাও নয়, সেদিকে তাকাতেই শুভর চোখে চোখ পড়ে গেল। একবার তাকিয়েই আবার চোখ তুলে দেখে নিয়ে চোখ নামিয়ে নিল মিলি। দেখল শুভও তাকিয়ে রয়েছে এদিকেই। মুখ লালহয়ে উঠল। আর কোনদিকে না তাকিয়ে প্রতিমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সে। কিন্তু মনের ভিতর তখন আলোড়ন। কই, শুভ আসবে, একথা তো সে জানে না! শুভ তো দুর্গা পুজোতে আসে না, দেওয়ালিতে বোনের কাছে ভাইফোঁটা নিতে যায় বলে আর বাড়তি ছুটি পায়না। সেই কারণেই মহালয়ার সময় দু-একদিন বাড়তি কাটিয়ে যায়। এবারেও তো মহালয়াতে এসেছিল। তবে কি শুভ এবার পাটনা যাবে না! ভাবতে গিয়ে আবার শুভর চোখে চোখ পড়তে একেবারে অন্যদিকে মুখ ঘুড়িয়ে নিল মালিনী। আর মুখ ঘোরাতেই দেখল কণা বৌদি আর বাণী, ওপাড়ার রুদ্রদার বৌ ওরই দিকে তাকিয়ে। লজ্জ্বায় মুখ নিচু করে ফেলল মিলি।

দশমীর শেষে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল প্রণাম করার। একদিকে প্রণাম, অন্যদিকে মেয়েদের সিঁদুর খেলার রেশ তখনও চলছে। হীরালালের নতুন বৌ কুসুমকে মেয়েরা সিঁদুরে একেবারে ঢেকে দিয়েছে, তাই নিয়ে এখনও অল্পবয়সী বৌ-মেয়েদের মধ্যে হই-চই লেগে রয়েছে। কুসুমও এদের সঙ্গে বেশ মেতে উঠেছে দেখে মুখে কাপড় চাপা দিয়ে হাসছিলেন নয়না দেবী, হীরালালের মা। হীরালালরা  অনেকটা দূরে থাকে, তাই সব সময় সকলের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করা হয়ে ওঠে না। এবার পুজোতে তাই হীরালালের মা পুত্রবধূকে সকলের সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্য মন্ডপে নিয়ে এসেছেন, প্রবাসের দিনগুলি আনন্দমুখর হয়ে উঠুক সকলের। এই দুরদেশে তো এদের সঙ্গেই ওঠা বসা। তাই পরিচয়ও প্রয়োজন। কখন কার কাকে দরকার, কেউ কি  বলতে পারে! তাছাড়া হীরালাল এই বাঙ্গালীপাড়ার ছেলেমেয়েদের সঙ্গেই একসাথে বেড়ে উঠেছে। পড়াশোনা, খেলাধূলা সবেতেই সে আছে, পুজোর মিটিং এও তার ভূমিকা আছে, তবে তাঁদেরই বা পুজোতে সকলের সঙ্গে একত্র হওয়া বাদ যাবে কেন?
 
হঠাত বেশ জোরে দুলুর গলা শোনা গেল। কয়েকজন এই হাঁক শুনে তাকাল দুলুর দিকে। দুলু একহাতে টুটুলকে ধরে টেনে নিয়ে মন্ডপের মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে, টুটুল হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। টুটুল মানে ইব্রাহিম, যে কিনা বাইরে বসেছিল কিছু ছেলে ছোকরার সঙ্গে , সেখান থেকে দুলু তাকে জোর করে প্যান্ডেলের ভিতর নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। টুটুল পুজোর সময়টাতে বাইরে বসে গাল-গল্প করে, ভিতরে আসে না, প্রবাসে হয়ত দেশের মত অত নিয়ম,শুচি-অশুচি বাতিক নেই, টুটুলকে  এই  নিয়ে কেউ কোনদিন কোন কথাও বলেন না, বলেন নি। কিন্তু সে নিজের থেকেই ভিতরে আসে  না। তার জন্যও তাকে কেউ জোর করেন না। কি জানি, ভিতরে পুজোর সময় আসাতে তার নিজেরও কোন বাধা থাকতে পারে! এই নিয়ে কেউ যেমন কিছু বলে না, আবার পুজোর মিটিং এর সময় কাজের দায়িত্ব দিতেও কেউ অস্বীকার করে না। প্রবাস বলেই হয়ত ভালবাসাবাসিটা এখনও পর্য্যন্ত বজায় আছে। একটু আগেই ঘট বিসর্জন হয়েছে, তার মানে প্রথামত পুজো শেষ। তবে এখন আর মন্ডপের ভিতরে আসায় দোষ কিসের? দুলু তাই টুটুলকে ভিতরে নিয়ে আসার চেষ্টা করছিল। যে ছেলেটি পুজোর অনেক কাজে অংশগ্রহণ করেছে,করে, সে পুজোর শেষ আনন্দটুকুও ভাগ করে নিক সকলের সঙ্গে। হাসতে হাসতে টুটুল দুলুর হাত ধরে মন্ডপের ভিতরে ঢুকল।
পুরোহিত মশায়ের তখন শান্তির জল দেওয়াও প্রায় শেষ। টুটুলকে ঢুকতে দেখে আম্রপল্লবটি একবার ঘটের জলে ডুবিয়ে নিয়ে ওঁ শান্তিবলে টুটুলের মাথায় ছিটিয়ে দিলেন। বাটু, দুলু, বাদলের দল হই হই করে উঠলকাকু, আমাদের কম দিলেন, ওকে বেশী দিলেন। আরো একবার আমাদের দিতে হবে। 
-যা ভাগ, তোদের সবাইকে দিয়েছি, আর না, পরের বছর দেববলে শুধু আম্রপল্লবটি আবার সকলের মাথার উপর ছিটিয়ে দিলেন। মেয়েরা তখনও টুকরো টুকরো দলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্প করছেন। বয়স্করা একে অপরের খোঁজ নিচ্ছেন, আবার কবে দেখা হবে একে অপরের সাথে। বউগুলি কিছুক্ষণের জন্য ছাড়া পেয়ে গল্প করছেন নিজেদের মত। আবার পথ চেয়ে থাকা,আগামী বছরের জন্য। মেয়েদের কেউ বিবাহিতা, কেউ বাপের বাড়ি এসেছেন, কেউ হয়ত এখানেই আছেন, যাওয়া হয়নি পিত্রালয়ে, কিন্তু আনন্দে মুখরিত সকলেই। বছরকার দিনে মলিন মুখ কেউ রাখতে চায় না। সেদিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে মা দুর্গার কাছে আরো একবার প্রার্থনা জানালেন পুরোহিত মশাইসকলের ভালো কর মা, আনন্দে রাখো, সুস্থ রাখো, মা গো দয়াময়ী, মা গো দুর্গতিনাশিনী, আজকের দিনে কাউকে নিরানন্দ কোর না মা! 

মা-মাসি-বউদের একটি বড় দঙ্গল বেরিয়ে এলো মন্ডপের ভিতর থেকে। এবার বাড়ি ফেরার পালা। পুরুষেরা গুলতানি মারুন আর যাই করুন, মেয়েদের এবার ফিরতেই হবে। বছরকার দিনে যত চাপই পড়ুক না কেন, সকলেই চায় ঘরের মানুষগুলিকে একটু ভালো-মন্দ খাওয়াতে, যত্ন করতে। এ কদিন মন্ডপেই খাওয়া-দাওয়ার পালা ছিল, কিন্তু আজ আর নয়। আজ তাই তাড়াতাড়ি ফিরতেই হবে ঘরে। আশা কাকিমা, চিনিপিসি, অণিমা কাকিমা আর লতুমাসি সামনের সারিতে, মাঝখানে প্রভাদি,সুলেখা মাসি আর অপু পিসি, যিনি আবার পুরোহিত মশায়ের বড় দিদি আর একেবারে পিছনে আছে অল্পবয়সী বৌ-মেয়েরা।  তাদের মধ্যে আছে সীতেশের বৌ কণা বৌদি, ঋষির বৌ বাণী বৌদি আর ওপাড়ার রুদ্রদার বৌ এবং আরো একজন যাকে মিলি ঠিক ভালো ভাবে চেনে না। বেশ কয়েকটি অল্প বয়সী মেয়ে হই হই করে মন্ডপ থেকে বেরিয়ে এদের সঙ্গে যাবে বলেও আবার ফিরে গেল মন্ডপে,হয়ত পরে আসবে। একেবারে পিছনের সারিতে কণা দের ঠিক সঙ্গে নয় আবার আগের সারিতেও নয়, মালিনী কিছুটা একা একাই হাঁটছে। প্রভাদি, যিনি মালিনীর স্কুলের হেড দিদিমনি, পিছনে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, বাড়িতে যাস মিলি, আমি পা চালাই    
-যাব বড়দি’-উত্তর দিল মিলি। পিছনে শাড়ির আঁচল টেনে ধরল কণাএই বেশী বড়দি বড়দি করবি নাতো, এটা তোর স্কুল নয়। তুই আমাদের সঙ্গে থাকবি। কণা মিলিকে টেনে নিজেদের কাছে নিয়ে এল। মিলি ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখল বাণী ঋষিকে চোখের ইশারায় ডেকে নিল। মন্ডপের বাইরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিল ঋষি, তনু,শুভর দল।  ঋষিকে ইশারায় ডাকতেই ঋষি বলে উঠল-দাঁড়া, কেন ডাকছে  দেখে আসি। আচ্ছা, চল না, এতগুলো মেয়ে যাচ্ছে...গায়ে সব গয়নাগাঁটি আছে, একটু এগিয়ে দিই ওদের!ঋষি, শুভ, তনুরা এগিয়ে এসে কণা, বাণীদের কাছে চলে এল।   
ইচ্ছে করেই আস্তে হাঁটছিল কণা। হঠাৎ ব্যস্ততা দেখিয়ে বলে উঠলচলি রে, আমাকে ভাই আগে যেতে  হবে,মাকে রেখে এসেছি, জানই তো! আমাকে একটু পৌঁছে দাও তো ভাই, তনু। দেরী হলে মা আবার চিন্তা করবেন। সীতেশের মা বিধবা, তাই সিঁদুর খেলার সময় কণাকেই আসতে হয়। রুদ্রদার বৌ তাড়াতড়ি বলে উঠল, এই, আমিও যাব তোমার সঙ্গে, আমাকেও একটু এগিয়ে দিও ভাই, তনু।মুচকি হেকে বাণী বৌদি বলল- এসো, আবার দেখা হবে
 
সামনের সারির ওরা তখন বেশ কিছুটা এগিয়ে। মাঝের সারির প্রভাদিরাও তাড়াতড়ি এগিয়ে গেছেন অনেকটাই। বাড়ি ফেরার তাড়া যেন সকলেরই। বাণী আর ঋষি একটু এগিয়ে গিয়ে পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। মুখ তুলে মালিনী দেখল, শুভ কখন যেন তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কোথাও যেন একটা ষড়যন্ত্রের আভাস পেল মালিনী। প্রথমটা হকচকিয়ে গেল। তারপর বুঝতে পেরে অনেকদিন পর শুভর দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলল । পুজোয় বাড়ি আসা সার্থক হল শুভর।
আকাশে তখন শুধুই পুজোর গন্ধ।


তাপসকিরণ রায়

ধারাবাহিক

জবলপুর, হ্যান্টেড কাহিনী--  

শাস্ত্রীব্রীজ একটি কালো  বিড়াল


সেদিনের কথা মনে পড়েছে রমেন বাবুর। অস্তিত্ব অস্তিত্বহীনতার মধ্যে কতটা পার্থক্য ? যে মরে যায় সে অস্তিত্বহীন হয়ে যায়, তবু, তবু কেন সে অলীক হয়ে আমাদের চোখে ধরা পড়ে ? আর যাকে আমরা অলীক বলি তাকে, তাকে আমরা অস্তিত্বের চোখে কি ভাবে দেখে নিতে পারি ?

হ্যাঁ, আজ থেকে প্রায় বছর দশেক আগের কথা, আজ আবার নতুন ভাবে রমেন বাবুর মনে পড়ে যাচ্ছে। শাস্ত্রীব্রীজ মধ্যপ্রদেশের জবলপুর নগরীর মাঝখানটাতে বলা যেতে পারে। দিন সারা জনারণ্য থাকে--সারাক্ষণ সেখানে হৈহৈ, রৈরৈ চলতেই থাকে। তারপর মাঝরাত থেকে হয়ে পড়ে জনশূন্য, নির্জনতা মগ্ন। রাত একটার পর থেকে ব্রীজ বুঝি অসীম ভরদিনের  ব্যস্ততার ভারশেষে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে !
রমেন বাবু সেদিন মেডিকেল হসপিটাল থেকে একলাটি ফির ছিলেন। তাঁর স্ত্রী তখন দিন তিন যাবত হসপিটালে এডমিট ছিলেন। সারাদিন স্ত্রীর পাশে হসপিটালে থাকতেন তিনি। প্রতিদিনই রাতে তাঁকে বাড়ি ফিরতে হত। ঘরের চৌকি দেওয়া সে সময়টা খুবই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে ছিল। কারণ সে     দিনগুলিতে বেশ চোরের উপদ্রব চলছিল। রাইট টাউনের স্টেডিয়ামের কাছাকাছি রমেন বাবুদের ঘর। মেডিকেল থেকে ঘরের দূরত্ব হবে তা প্রায় বিশ কিলোমিটারের কাছাকাছি। যাতায়াতের বিশেষ একটা অসুবিধা ছিল না। নিজের ইন্ডিকা কার ছিল। স্বল্প দৈর্ঘ্যের দূরত্বগুলি তিনি নিজে ড্রাইভ করে যাতায়াত করতেন।

সেদিনও স্ত্রীর পাশে সারাদিন থেকে রাত প্রায় সারে বারটায় ঘরের দিকে রওনা দিয়েছিলেন রমেন বাবু। মনের দিক থেকে একটু স্বস্তি চলছিল। স্ত্রী তখন অনেকটা সেরে উঠেছেন। আর দু দিন পরেই হসপিটাল থেকে ওঁর ছাড়া পাবার কথা ছিল। শাস্ত্রীব্রীজের কাছাকাছি তিনি পৌঁছে গেলেন। অন্য দিনের তুলনায় আজ বেশ রাত হয়ে গেছে ফিরতে, সেটা তিনি সামনের ঘুমন্ত ব্রিজের দিকে তাকিয়েই টের পেলে গিয়েছিলেন। ব্রিজের ওপরে ইনসাফিসিয়েন্ট লাইট। আলো আছে, অন্ধকার আছে। আলো-অন্ধকারে চারদিক তখন মাখামাখি-- কেমন যেন নিঃশব্দ থমথম নিশীথ।

কয়েক মুহূর্তে রমেন বাবু পৌঁছে গেলেন ব্রীজের মাঝামাঝি। আর মুহূর্তের মাঝে হঠাৎ তাঁর গাড়ি আপনি আপনি ক্যাঁচ শব্দ করে থেমে গেলো। গাড়ির এক্সিলেটার দাবিয়ে স্পিড বাড়াবার বারবার চেষ্টা করতে লাগলেন রমেন বাবু। কিন্তু আশ্চর্য, গাড়ি এক চুলও নড়ছিল না। গাড়ি তো স্টার্টে ছিল তার আওয়াজ অনেক কমে গিয়ে ছিল বটে কিন্তু এমনি গতিশূণ্যতা কেন ? রমেন বাবুর বুদ্ধিতে কিছুতেই তা আসছিলো না। তাঁর মনের মধ্যে তখনও কোন রকম ভয় ঢোকে নি। মিনিট দুই তিন এমনি ভাবেই কেটে গেলো। শীতের কাঁপানো রাতে রমেন বাবু গাড়ির বাইরে বেড়িয়ে এসে ভাবলেন গাড়ি ঠেলবেন কি না ! ধীরে ধীরে গাড়ির পেছনের দিকে গিয়ে তিনি ভাবলেন একবার ঠেলা দিয়ে দেখলে কেমন হয় ?

গাড়ি ঠেলতে যাবার পূর্বমুহূর্তে রমেন বাবুর পাশ থেকে হঠাৎ একটা বিড়াল ডেকে উঠল। ডাক শুনে তিনি চমকে উঠলেন, দেখলেন, তাঁর পাশে একটা কালো বেড়াল দাঁড়িয়ে। একটা হুলো বেড়াল বলে মনে হল। বড় গম্ভীর গভীর ছিল ওর আওয়াজ। বেশ বলিষ্ঠ দেহ তার। আর আবছা অন্ধকারে তার  চোখ জ্বলজ্বল জ্বলছে ! বেড়াল হতেই পারে, কালো বলিষ্ঠ  বেড়াল আর তার অন্ধকারে চোখ জ্বলা এমনটাও কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার না। এদিকে গাড়ি ঠেলতে শুরু করেছেন তিনি। না, বারবার চেষ্টার পরেও এক তিল জাগাও এগোচ্ছে না গাড়ি, সামান্য গোঁ গোঁ আওয়াজ করছে বটে কিন্তু ডাউনে থেকেও নড়ছে চড়ছে না। ব্যাপার কি ?
এবার রমেন বাবু দেখতে পেলেন কালো বেড়ালটা আর একবার ডেকে উঠে সামনের দিকে হেঁটে চলছে। বাড়ি পার করছে বেড়ালটা, আর কি ! গাড়িটা এবার চলা শুরু করেছে, বেড়ালের পেছনে পেছনে গাড়ি এগিয়ে চলেছে ! বেড়ালের গতি বেশী ছিল না, গাড়িও সেই গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। এটা কি হচ্ছে, হচ্ছে টা কি ! এবার রমেন বাবুর মন একটু টলে গেলো, তিনি ভয় পাচ্ছিলেন। অলৌকিক একটা ভয় তাকে ক্ৰমশঃ জড়িয়ে ধরছিল। তিনি ছুটে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটে এসে বসলেন। আচমকা এক্সিলেটরে চাপ দিলেন, স্বাভাবিক ভাবে চাপে গাড়ি লাফ দিয়ে অন্তত পঞ্চাশ কিলোমিটার বেগ নিত--কিন্তু না--গাড়ি বেশী হলে পাঁচ কিলোমিটার বেগে বিড়ালের চলার গতিতেই এগিয়ে যাচ্ছিল। বিড়াল মাঝে মাঝে গুরুগম্ভীর মেউ মেউ ডেকে উঠছিল আর মেউ ডাকের সঙ্গে সঙ্গে বারবার রমেনের দিকে তাকাচ্ছিল। তখন রমেনের বুকের মধ্যে যেন ভয়ের কাঁপন ঢুকে গেছে। ভয়ে তার শরীর ঈষৎ কেঁপে কেঁপে উঠছিল। তবু বাঁচার তাগিতে তিনি বারবার এক্সেলেটার দাবিয়ে চলেছেন। ব্রীজ প্রায় শেষ হতে চলেছে। সামান্য দূরেই বেশ আলোর ঝলক, চোখে এসে লাগছে। ব্যাস, ব্রীজ শেষ হবে হবে অবস্থা। বেড়ালটা ব্রিজের শেষ রেখাতে এসেই যেন থেমে গেলো। এবার, এবার কি হবে ? এমনি আতঙ্কিত প্রশ্ন এসে রমেনের মনে ধাক্কা দিয়ে গেলো। মুহূর্ত, মুহূর্ত, নেই, বেড়াল নেই আর কিছুই নেই। আশপাশে আর তাকিয়ে দেখার অবস্থা রমেনের ছিল না। গাড়িও পুরো দমে স্ট্যার্ট হয়ে গেলো। গাড়ির এক্সিলেটরে পা রাখার আগে রমেন একবার ঘাড় ফিরালেন, কেন যেন তিনি সেই বেড়ালের অস্তিত্ব খুঁজে দেখার ইচ্ছে এত ভয়ের মাঝেও দমন করতে পারছিলেন না। হঠাৎ তিনি দেখলেন, শূন্যতার মাঝখানে চারদিক থেকে কিছু ধোঁয়া ছুটে আসছে আর মুহূর্ত মাঝে তা এক নারীর আকার ধারণ করে নিয়েছে। সে নারী যেন তাঁর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্চল এক ছায়াছবি দেখছিলেন রমেন। পর মুহূর্তে সে ধোঁয়া ছিঁড়ে ছিঁড়ে আবার খালি জাগায় পরিণত হয়ে গেলো। না, আর না, রমেন তাঁর অজান্তেই বুঝি সব কিছু এত সময় ধরে দেখে যাচ্ছিলেন। তাঁর সম্বিৎ যখন ফিরল তখন, আর না, এক্সিলেটারে পা রেখেই তিনি পঞ্চাশের স্পীডে এগিয়ে গেলেন তাঁর ঘরের দিকে।